বিজয় দিবস

বিজয় দিবস: হাজার বছরের বাঙালির স্বপ্নের প্রতিফলন

বিজয় দিবস- আমরা সকলেই জানি, ১৯৭১ সালে তুমুল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমরা অনেকে সরলতার বশবর্তী হয়ে এটাকে শুধু ‘পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছি’ বলে থাকি। আমরা কি শুধু পাকিস্তান থেকেই স্বাধীনতা অর্জন করেছি?

২৪টি বছর পাকিস্তান আমাদেরকে শোষণের কারাগারে বন্দি করে রেখেছিল। আমরা কি সেটা থেকে স্বাধীন হয়েছি? না, এই বাঙালি শুধু পাকিস্তান থেকেই স্বাধীন হয়নি। এই বাঙালি স্বাধীন হয়েছে যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা অত্যাচার থেকে। নির্যাতন থেকে। শোষণ থেকে। নিপীড়ন থেকে।

কয়েক হাজার বছর আগে আর্যরা যখন ভারতবর্ষে আগমন করে, তখন এই ভারতবর্ষের আদিবাসীদেরকে কোণঠাস করে ফেলে। এই বঙ্গভূমিও এর ব্যতিক্রম নয়। এখানকার আদিবাসীগণকে বর্ণাশ্রমের বেড়ী পরিয়ে শোষণ করতে থাকে। ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে এই বাংলার জনগণ অতিষ্ঠ। নিচু জাতি বলে এই বাংলার আদিবাসীদেরকে ব্রাহ্মণেরা কখনো মানুষই মনে করত না।

যেহেতু এই অঞ্চলের রাজ ক্ষমতায় ব্রাহ্মণেরা। তাই তাদের কিছু কিছু কৃষ্টি-আচার বাংলার মানুষেরা রপ্ত করতে শুরু করে। তবুও কি ব্রাহ্মণদের মন পাওয়া যায়?

এক সময় পাল সাম্রাজ্যের পত্তন হয়। বৌদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা শুরু হয়। দলে দলে জনগণ মুক্তির আশায় বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে। জাত-পাতের ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে আসতে শুরু করে। কিন্তু এই সাম্রাজ্য বেশিদিন স্থায়ী হলো না। আবারো ব্রাহ্মণদের যুগ ফিরে আসলো। সেন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হলো। সে সাথে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল অত্যাচারের সংস্কৃতি।

কিন্তু যখন মুসলিম শাসকগণ বঙ্গভুমিতে আগমন করলো। এই অঞ্চলে মুসলিম শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন শান্তির আশায় বাংলার বৌদ্ধরা মুসলিম শাসকদের ধর্ম গ্রহণ করল। তাদের আশা ছিল শাসকের ধর্ম যদি পালন করি তাহলে নিশ্চয়ই মুক্তি পাবো। স্বাধীনতা পাবো। শান্তি পাবো।

কিন্তু কোথায় সেই মুক্তি? কোথায় সেই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা? বাদশাহী দরবারে চাকরি করে সেই ব্রাহ্মণেরাই। জমিদারী তাদের হাতেই। তাদের হাতেই সকল ক্ষমতা। বেচারা নব্য মুসলিমরা শুধু আশাই করে গেল। স্বাধীনতা তাদের কপালে জুটলো না।

আরো পড়ুন: আর্জেন্টিনা ফুটবল দল

ক্ষমতা বিভিন্ন শাসকের হাত ঘুরে এলো নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাছে। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চেয়েছিলেন বাংলার স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখতে। কিন্তু নিজ ঘরে যখন বিশ্বাসঘাতকেরা থাকে তখন বাহিরের লোকের প্রয়োজন পড়ে না ক্ষতি করার। এই দেশের স্বাধীনতার সূর্য আবারো ডুবে গেল। তবুও আকাশে একটু রক্তিম আলো হয়ে ছিল নবাব মীর কাসেম। অনেকে ভেবেছিল মীর কাসেমের হাতে হয়তো আবারও স্বাধীনতার পতাকা উদিত হবে। কিন্তু তা আর হলো না।

এই দেশ চলে গেল ব্রিটিশদের পদতলে। উপনিবেশকতার জেলখানায় দুই শত বছর বন্দি রইলো বাঙালি। তবে এই জাতি মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা কখনোই থামায়নি। যুগে যুগে বিদ্রোহ করতো এরা। শাসকের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে এদের প্রতিবাদ চলতেই থাকে। অতঃপর ১৯৪৭ সালে এই বাংলা পাকিস্তানে পরিণত হয়।

বাংলার মানুষেরা তখনো ভেবেছিল, হয়তো এই পাকিস্তান তাদেরকে স্বাধীনতা দেবে। কিন্তু না, এটাও এক নতুন কারাগার। এখন শুধু কারাগারের নাম বদলে হয়েছে পাকিস্তান। এটাও এক শেকলের নাম। মুক্তির মুখোশধারী রক্তচোষা পাকিস্তান বাংলার মানুষের রক্ত চুষতে শুরু করল। এদেশের মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ পশ্চিম পাকিস্থানিদের পাকস্থলীতে যেতে শুরু করল। এরা কি শুধু ক্ষমতা ও অর্থনৈতিকভাবেই আমাদেরকে পঙ্গু করেছে? এটা আমাদের মায়ের ভাষাও কেড়ে নিতে চেয়েছে।

কিন্তু এই বীর বাঙালি তা হতে দেয়নি। ১৯৫২ তে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করেছে। তবুও মায়ের ভাষা ছাড়েনি। এই বাঙালিই ১৯৭১ সালে নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। লক্ষ লক্ষ বাংলা মাতার সন্তান বাংলা মাতৃকার কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। এদেশের নদ-নদীতে হাজার হাজার লাশ ভেসে বেরিয়েছে। হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছে পাক হানাদারেরা।

এত সহজেই কি এই দেশ স্বাধীন হয়েছে? ১৬ ডিসেম্বর কি এত সহজেই এসেছে? বাঙালির কঠিন আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা এই বিজয় অর্জন করেছি। এই বিজয় শুধু একদিনের নয়। আমরা তো হাজার বছর ধরে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়া পরাধীনতার কারাগার থেকে আমরা বের হয়েছি। অত্যাচারের বেড়ী ভেঙে ফেলেছি। এই বাংলা ভূমির নামে আমরা এই দেশের নাম রেখেছি “বাংলাদেশ”। আমরা এখন বুক ফুলিয়ে বলতে পারি “আমি বাঙালি”।

আমরা এখন প্রাণ খুলে বলতে পারি আমরা স্বাধীন। আমরা গর্ব করতে পারি, “আমাদের বিজয় কোনো চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে আসেনি। এই বিজয় এসেছে তাজা রক্তের বিনিময়ে।”

আমাদের এই স্বাধীনতা, আমাদের এই বিজয় অর্জন আমাদেরকেই অক্ষুন্ন রাখতে হবে। এই বঙ্গভূমিকে সোনার বাংলায় আমাদেরকেই পরিণত করতে হবে। আসুন এই বিজয় দিবসে আমরা প্রতিজ্ঞা করি, এই দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে আমরা নিজেদের সর্বস্ব ত্যাগ করতে রাজি। আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদের রক্তকে বৃথা যেতে দেবো না। আসুন বিজয় দিবসে আমরা আমাদের দেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top