সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ পা দিয়েছে মেট্রোরেলের জামানায়। উন্নত বিশ্বে এমনকি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রেও মেট্রোরেল অনেক আগে থেকে থাকলেও বাংলাদেশ এটা নির্মিত হয় কিছুদিন আগে। বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকা নগরীতে এর প্রয়োজন অত্যাধিক ছিল। কেননা ট্রাফিক জ্যামের জন্য ঢাকা নগরী বিশ্বজুড়ে বদনাম।
ঢাকার কর্মজীবী মানুষের হাজার হাজার কর্ম ঘন্টা শুধুমাত্র জ্যামে আটকে অপচয় হয়। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে মেট্রোরেল যেন যাদুকরী এক ভূমিকা পালন করছে। এর সুফল ইতিমধ্যে বাংলাদেশের জনগণ দেখতে পেয়েছে। এটা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
মেট্রোরেলের পূর্ব কথা:
মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা ২০০৫ সালে করা হয়। এরপর রাজনৈতিক ছন্দপতনের ফলে সেটা দীর্ঘদিন আড়ালে থেকে ছিল। অতঃপর চূড়ান্তভাবে এর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় এবং ২৬ জুন ২০১৬ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। যা ২০২২ সালে সম্পন্ন হয়।
মেট্রোরেলের বিস্তৃতি
পুরো ঢাকা নগরীর মানুষকে মেট্রোরেলের সেবার আওতায় আনতে ছয়টি রুটে মেট্রোরেল চালু করার পরিকল্পনা করা হয়। এর মধ্যে একটি রুট নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এটার সুবিধা ইতিমধ্যে জনগণ ভোগ করছে। যা খুবই ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে। মানুষজন আশাবাদী—দ্রুত সকল পরিকল্পিত মেট্রোরেল লাইন নির্মিত হবে।
মেট্রোরেলের প্রয়োজনীয়তা
ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এবং ব্যস্ত নগরীতে মেট্রোরেল যেন আশীর্বাদ। কেননা এখানে কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য ঘন্টাব্যাপী জ্যামে আটকে থাকতে হয়। এটার থেকে উদ্ধার হতে মেট্রোরেলের বিকল্প নেই। ট্রাফিক জ্যামের ফলে মানুষের কর্মক্ষেত্রে পৌঁছাতে দেরি হয়। তার চাইতেও বড় কথা— প্রতিটা মানুষ কর্ম ক্ষেত্রে পৌঁছানোর কয়েক ঘন্টা আগে বাড়ি থেকে রওনা করে। আবার কাজ শেষে বাড়ি পৌঁছাতেও কয়েক ঘন্টা সময় লাগে। ফলে তার বিশ্রামের সময়ের ঘাটতি দেখা যায়। দীর্ঘক্ষণ জ্যামে আটকে থাকার ফলে মানুষের মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব পড়ে।
অধিকক্ষণ রাস্তায় থাকার ফলে ধুলাবালি ফুসফুসে প্রবেশ করে রোগাক্রান্ত করে ফেলে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের অবস্থা হয় করুণ। রোগীদের অ্যাম্বুলেন্স জ্যামে আটকে থাকার ফলে অনেক রোগীকে বাঁচানো আর সম্ভব হয় না। এমতাবস্থায় যানজট এড়িয়ে স্বল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে মেট্রোরেল অতীব প্রয়োজন।
নির্মিত মেট্রোরেল
মেট্রোরেল সেবা পুরো ঢাকা নগরীতে প্রদান করার জন্য একটি দীর্ঘ পরিকল্পনা করা হয়েছে। ছয়টি ভিন্ন রুট পরিকল্পিত হয়েছে। এরমধ্যে MRT-6 রুট বাস্তবায়ন হয়েছে। এটা নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছে এক হাজার পাঁচশত চুয়াত্তর কোটি টাকা। এটা চালু হয় ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ সালে। যা প্রাথমিক অবস্থায় উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলাচল করতো। এরপর মধ্যবর্তী স্টেশন গুলো মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ৫ নভেম্বর ২০২৩ সালে মতিঝিল পর্যন্ত সকল স্টেশন উন্মুক্ত হয়।
পরিকল্পিত ও নির্মিত মেট্রোরেল রুট স্টেশন
MRT-6 রুট ইতিমধ্যে নির্মিত হয়ে গেছে। নিম্নে বর্ণিত স্টেশন গুলো বর্তমানে সচল। তবে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রো রেল লাইন নির্মাণ কাজ চলছে। আশা করছি খুব দ্রুত নির্মাণ সম্পন্ন হবে।
- উত্তরা উত্তর
- উত্তরা মধ্য
- উত্তরা দক্ষিণ
- পল্লবী
- মিরপুর ১১
- মিরপুর ১০
- কাজিপাড়া
- শেওড়াপাড়া
- আগারগাঁও
- বিজয় সরণি
- ফার্মগেট
- কারওয়ান বাজার
- শাহবাগ
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- সচিবালয়
- মতিঝিল।
MRT-5 (উত্তর) মেট্রোরেল রুটের মধ্যে নিম্ন বর্ণিত স্টেশন গুলো থাকবে।
- হেমায়েতপুর
- বলিয়ারপুর
- বিলামালিয়া
- আমিনবাজার
- গাবতলী
- দারুস সালাম
- মিরপুর ১
- মিরপুর ১০
- মিরপুর ১৪
- কচুক্ষেত
- বনানী
- গুলশান ২
- নতুন বাজার
- ভাটারা।
MRT-5 (দক্ষিণ) রুটে গাবতলী
- টেকনিক্যাল
- কল্যাণপুর
- শ্যামলী
- কলেজগেট
- আসাদগেট
- রাসেল স্কয়ার
- পান্থপথ
- সোনারগাও
- হাতিরঝিল পশ্চিম
- নিকেতন
- রামপুরা
- আফতাবনগর পশ্চিম
- আফতাবনগর মধ্য
- আফতাবনগর পূর্ব
- দাশেরকান্দি
- এ সকল স্টেশনগুলো থাকবে।
MRT-4 রুটে মদনপুর, কাঁচপুর, চট্টগ্রাম রোড, সাইনবোর্ড, যাত্রাবাড়ী, কমলাপুর স্টেশনগুলো থাকবে।
MRT-2 রুটে গাবতলী
- এমব্যাংকমেন্ট রোড
- কল্যাণপুর
- বসিলা
- মোহাম্মাদপুর
- সাত মসজিদ রোড
- ঝিগাতলা
- ধানমন্ডি ২
- সায়েন্স ল্যাবরেটরি
- নিউ মার্কেট
- নীলক্ষেত
- আজিমপুর
- পলাশী
- শহীদ মিনার
- ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ
- পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স
- গোলাপ শাহ মাজার
- বঙ্গভবন
- মতিঝিল
- আরামবাগ
- কমলাপুর
- মুগদা
- মান্ডা
- ডেমরা
- চট্টগ্রাম রোড স্টেশনগুলো থাকবে।
MRT-1 (পূর্বাচল) রুটে নতুন বাজার
- নদ্দা
- বসুন্ধরা
- পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটি
- মাস্তুল
- পূর্বাচল পশ্চিম
- পূর্বাচল মধ্য
- পূর্বাচল পূর্ব
- পিতলগঞ্জ স্টেশন গুলো থাকবে।
MRT-1 (বিমানবন্দর) রুটে নতুন বাজার
- নদ্দা
- বসুন্ধরা
- পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটি
- মাস্তুল
- পূর্বাচল পশ্চিম
- পূর্বাচল মধ্য
- পূর্বাচল পূর্ব
- পিতলগঞ্জ স্টেশন থাকবে।
মেট্রোরেল সেবা
মেট্রোরেল খুবই আধুনিক একটি প্রযুক্তি। সর্বত্র এর আধুনিকতার ছোঁয়া। এখানে কোনো কাগজের টিকেট ব্যবহার হয় না। একটি স্মার্ট চিপ সংযুক্ত প্লাস্টিকের শক্ত কার্ডের মাধ্যমে যাত্রী যাতায়াত করে থাকে। এর সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ভাড়া ১০০ টাকা।
টিকেট কাউন্টার থেকে যাত্রী নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে কার্ড পেয়ে থাকে। অতঃপর একটি স্বয়ংক্রিয় মেশিনে কার্ড পাঞ্চ করে প্রবেশ করতে হয় প্ল্যাটফর্মে। যাত্রা শেষে আবার সে কার্ড স্বয়ংক্রিয় মেশিনে প্রবেশ করিয়ে বের হতে হয়। এখানে কেউ টিকেট ছাড়া প্লাটফর্মে প্রবেশ করতে পারবে না। সুতরাং বিনা ভাড়ায় ভ্রমণ করার সুযোগ থাকছে না।
এখানে আরেকটি সুবিধা রয়েছে। যারা নিয়মিত যাতায়াত করে তারা রেপিড পাস ক্রয় করে নিতে পারে। যেখানে টাকা রিচার্জ করা যায়। এর ফলে প্রতিদিন টিকিট কাউন্টারে লাইন ধরে টিকিট কাটার প্রয়োজন পড়ে না। ওই টিকেট পাঞ্চ করেই সে প্লাটফর্মে প্রবেশ ভ্রমণ এবং বের হতে পারবে। এবং প্রতিবার ভ্রমণে দশ শতাংশ করে ছাড় রয়েছে।
মেট্রোরেল ভ্রমণে কিছু নিয়ম: বাঙালিরা স্বভাবতই কৌতুহলী জাতি। মাঝে মাঝে এই কৌতুহল বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। মেট্রোরেল খুবই পরিকল্পিতভাবে যাত্রীসেবা প্রদান করে থাকে। নিয়মগুলো সঠিকভাবে পালন করলে কোন যাত্রীর কোন প্রকার অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। প্রথমত লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কাউন্টার থেকে টিকেট সংগ্রহ করতে হবে।
এছাড়া অটোমেটিক মেশিনে টাকা প্রবেশ করিয়ে টাচস্ক্রিনে গন্তব্য সেট করে টিকিট ক্রয় করা যায়। প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের জন্য একটি স্বয়ংক্রিয় দরজা পাড়ি দিতে হয়। সঠিক নিয়মে টিকেট পাঞ্চ করলে দরজা খুলে যাবে। অতঃপর সিঁড়ি, লিফট অথবা এক্সেলেটরে করে উপরতলার প্ল্যাটফর্মে পৌঁছাতে হয়। লিফট সাধারণত প্রতিবন্ধী, অসুস্থ, বৃদ্ধ এবং গর্ভবতী নারীদের ব্যবহারের জন্য রাখা হয়েছে। সুস্থ মানুষদের লিফট ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হয়। সাধারণ মানুষেরা সিঁড়ি অথবা স্বয়ংক্রিয় সিঁড়ি অর্থাৎ এক্সিলেটরে প্ল্যাটফর্মে উঠতে পারবে।
প্ল্যাটফর্মে বিশেষ নিরাপত্তার জন্য স্বয়ংক্রিয় দরজা দেওয়া হয়েছে। সেটা থেকে এক ফুট দূরত্বে অবস্থান করতে হবে সকলকে। কিন্তু মাঝেমধ্যেই যাত্রীরা সেটা অমান্য করে। যা বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। আগে যাত্রীদেরকে নামতে দিতে হবে তারপর উঠতে হবে। কিন্তু এটা অনেকেই মানে না তাই যাত্রীরা বিড়ম্বনার শিকার হয়।
মেট্রো রেলের একটি বড় সুবিধা হচ্ছে এটা সম্পূর্ণ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। যা খুবই আরামদায়ক। মানুষজন এটাতে উঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। অনেকে তো বলে —মেট্রোরেল জ্যামে পড়লেও কোনো সমস্যা নেই। অন্তত শান্তিতে এসির বাতাস তো গায়ে লাগাতে পারবে। বলে রাখা ভালো, মেট্রোরেলে কোনো প্রকার যানজট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কর্মজীবী মানুষজন দুই থেকে তিন ঘন্টার পথ মাত্র ২০-২৫ মিনিটে পাড়ি দিচ্ছে। এর চাইতে আনন্দদায়ক আর কী হতে পারে ঢাকা নগরবাসীর জন্য?
মেট্রোরেলের প্রভাব
নগরবাসীর জীবনে মেট্রোরেলের একটি গভীর প্রভাব পড়েছে। কর্মজীবী মানুষেরা কর্মস্থলে সময়মতো পৌঁছাতে পারছে। ক্লান্তিমুক্ত ভ্রমণ করতে পারছে। আগে যেখানে ঘন্টাব্যাপী জ্যামে বসে নিজের বিশ্রামের সময়টুকু ব্যয় করতে হতো। এখন সেই সময়টা পরিবারের সাথে কাটাতে পারছে।
তবে যেই রুটে মেট্রোরেল চলছে সেই রুটের বাস শ্রমিকেরা কিছুটা অসন্তুষ্ট। তারা যাত্রী সংকটে ভুগছে। এটা নিয়ে মান-অভিমান চলছে।
মেট্রোরেলের একটি বড় প্রভাব অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে। সেটা হচ্ছে নাগরিক জীবনের জীবন প্রণালীর পরিবর্তন। নগরবাসীর দীর্ঘদিনের অভিযোগ —প্রতিবছর বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সেই তুলনায় সেবা হ্রাস পাচ্ছে। এমতাবস্থায় মেট্রোরেল আনতে পারে যুগান্তকারী পরিবর্তন।
চীনের রাজধানী অথবা প্রধান নগরগুলোতে কোনো বস্তি বা অব্যবস্থাপূর্ণ আবাসন নেই। কারণ সেখানে কোনো বস্তি গড়ে উঠতে পারেনি। কর্মজীবী মানুষেরা শহরের বাহিরে থাকে। প্রতিদিন সকালে ট্রেনে করে নগরে প্রবেশ করে এবং কাজ শেষে আবার ট্রেনে করে নগরের বাহিরে নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছে যায়। ফলে নগরে অবস্থান করার তেমন দরকার হয় না।
ঢাকার পরিকল্পিত মেট্রোরেলে দেখা গেছে প্রত্যেকটা মেট্রোরেলের শুরুর স্টেশন প্রধান নগরের বাহিরে। যেখানে ব্যস্ততা এবং জনবসতি কম। যদি মেট্রোরেল সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হয়, তাহলে নগরের মধ্যে অবস্থান করা কর্মজীবী মানুষেরা শহরতলী অথবা নগরের বাহির থেকে প্রতিদিন কাজে আসতে পারবে এবং যেতে পারবে। কেননা শহরতলীতে বাড়ি ভাড়া কম।
এছাড়া তখন সময় কম লাগবে নগরে মেট্রোরেলে আসা-যাওয়া করতে। ফলে বাড়ি ভাড়ার দুশ্চিন্তা থেকে কিছুটা মুক্ত হতে মানুষজন শহরতলীতে বসবাস শুরু করবে। এতে করে নগরের মধ্যবর্তী মানুষজনের চাপ কমবে। মানুষজনের চাপ কমলে বাড়িওয়ালারা বাধ্য হবে ভাড়া কমাতে। যেমন কোণঠাসা হয়েছিল করোনাকালীন সময়ে। ভাড়াটিয়া সংকটে বাড়িওয়ালারা অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল তখন।
উপসংহার
পরিশেষে এ কথাই বলতে চাই —মেট্রোরেল একটি আশীর্বাদ। আশা করব পরিকল্পিত মেট্রোরেল অতি দ্রুত নির্মিত হবে। যানজট থেকে মানুষজন মুক্ত হবে। নগরে মানুষজনের চাপ কমবে। শারীরিক ও মানসিকভাবে কর্মজীবী মানুষেরা শান্তি লাভ করবে। হাজার হাজার কর্ম ঘন্টা বাঁচবে।
তবে আমাদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। মেট্রোরেলের কোনো প্রকার ক্ষতি সাধন হয় এমন কাজ করবো না। মেট্রোরেলের শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে এমনভাবে চলবো না।