আজকে আমরা জানবো – বীমা কী? বীমা কাকে বলে? ইন্সুরেন্স কাকে বলে? বীমা (Insurance) হচ্ছে, টাকার বিনিময়ে সম্পদ বা জীবন কিংবা ব্যবসায়িক মালামালের দৈবিক বা ন্যায়সঙ্গত অথবা নির্দিষ্ট কিছু ঝুঁকির ক্ষয়ক্ষতির মাশুল দেওয়া। যদিও এটাকে মাশুল বলাটা ঠিক নয়। এটাকে অনিশ্চিতার লেনদেন বললে ভাল হয়। কেননা বীমা করার ফলে বীমা প্রতিষ্ঠান অর্থের (প্রিমিয়াম বা কিস্তি) গ্রহণের মাধ্যমে মক্কেলের আংশিক বা সমস্ত ন্যায়সঙ্গত ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকে। এটা অনিশ্চিত ক্ষয়ক্ষতি এড়াবার জন্য মক্কেল প্রতিষ্ঠানের সাথে টাকার বিনিময়ে একটি চুক্তি করে থাকে।
মূলনীতি
বীমা কোম্পানিকে কিস্তি বা প্রিমিয়াম দেওয়ার মাধ্যমে বীমাকৃত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সকল ধরণের দৈনিক বা অনিশ্চিত ক্ষতির হাত থেকে নিশ্চিত থাকে। কেননা যদি কোনো দুর্ঘটনা থাকে এবং বীমা প্রতিষ্ঠানের শর্ত অনুযায়ী সেই দুর্ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে বীমা প্রতিষ্ঠান মক্কেলকে এটার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে।
অনেক বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা বীমাকৃত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কিস্তি বা প্রিমিয়াম গ্রহণ করে এবং সেই আমানত বা মূলধন নির্দিষ্ট মেয়াদের পর বৃদ্ধি করে মক্কেল বা বীমাকৃত প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করে।
তবে বর্তমানে এমন কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা কোন বীমা প্রতিষ্ঠান সাহায্য ছাড়াই শ্রমিকদের জীবন বীমা করে থাকে। তারা শ্রমিকদের বেতন থেকে নির্দিষ্ট হারে কিস্তি গ্রহণ করে থাকে এবং চাকরির মেয়াদ শেষে সেই আমানত বৃদ্ধি করে প্রদান করে।
বীমার ইতিহাস: বীমার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
এই বিশ্বে বীমার সাদৃশ্য পদ্ধতিগুলি সর্বপ্রথম প্রায় চার সহস্র বছর পূর্বে ব্যাবিলনে লক্ষ্য করা গিয়েছে। ব্যাবিলন তখন সেই সময়কার বাণিজ্য কেন্দ্র ছিলো। ব্যবসায়িক কাফেলা যারা পরিচালনা করতো তারা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিত। এর ফলে কাফেলা যদি কোনো দুর্ঘটনা সম্মুখীন হয় তাহলে কাফেলা পরিচালনাকারী ব্যক্তিরা সেটার ক্ষতিপূরণ দিত।
এই প্রথাকে তৎকালীন শাসক বৈধতা প্রদান করে। ওই শাসক এই কথাতে আরো কিছু জিনিস যোগ করে। এমন কোনো কাফেলা যদি লুণ্ঠন হয়, তাহলে সেই কাফেলার ক্ষতিপূরণ বাকি সব কাফেলার ব্যবসায়ীরা দিত। ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে প্রাচীন যৌথ ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা হিসেবে পরিগণিত হয়।
পরবর্তী সময়ে, বীমার নিকটবর্তী একটি প্রথা চালু হয়। যেটা সমুদ্রের বণিকদের জন্য। প্রথম সমুদ্র বাণিজ্যপ্রিয় জাতির মধ্যে রোমান এবং গ্রীকদের মধ্যে এমন কিছু লোক ছিলো, যারা জাহাজ দ্বারা পণ্য বহন করতো। টাকার বিনিময়ে পণ্যের নিরাপত্তা ও ঝুঁকি নিয়েছিল। এখানে কিছু সুদের লেনদেনও চলত। অতি উচ্চমাত্রার সুদের ব্যবহার হতো বিধায় তৎকালীন ধর্ম যাজকেরা এটা নিষিদ্ধ করে দেয়।
১৩ শতাব্দীর দিকে ফ্লোরেন্স, ভেনিস এবং জেনোয়া নগরে কিস্তি ভিত্তিক বীমার প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। তবে আজকের আধুনিক বীমা কাঠামোতে আসতে ১৪ তম শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ওই শতাব্দীতেই ইতালিতে এক ধরনের সমুদ্র বীমা শুরু হয়। যেটা ছিল কিস্তি ভিত্তিক।
১৭ শতকের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ছিল। যেটা বীমার বিকাশকে আরো ত্বরান্বিত করেছিল। ১৬৬৬ সালে লন্ডন শহরে সংঘটিত বিশাল অগ্নিকাণ্ড। তৎকালে সাধারণত বাড়ি ঘর কাঠের ছিল এবং যথেষ্ট অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না। এর ফলে অগ্নিকাণ্ড চার দিন স্থায়ী হয়েছিল। এতে করে ১৩০০০ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যার মধ্যে গির্জা, অফিস ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানও ছিল।
বহু মানুষের হতাহতের ঘটনাও ঘটে। তখন মানুষজন উপলব্ধি করতে পারে যে তাদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার জন্য কিছু একটা করার দরকার। এগুলোর ঝুঁকি অন্য একজনকে নিতে হবে তাই এই আধুনিক বীমার প্রয়োজন বোধ হয়।
তখন থেকেই ধীরে ধীরে সামুদ্রিক বীমা, অগ্নি বীমা, ভূমি বীমা, দুর্ঘটনা বীমা (ট্রেন, বাস দুর্ঘটনা) এছাড়া কলকারখানার দুর্ঘটনার ঝুঁকি নেওয়ার জন্যও বীমা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়। বীমা এখন এতটাই সহজলভ্য হয়েছে যে দামি টিভি, ফ্রিজেরও বীমা করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে বীমা ইতিহাস: বাংলাদেশে কত সালে বীমা আইন কার্যকর হয়?
বাংলাদেশে বীমা ব্যবস্থা একেবারে নতুন কিছু নয়। এটা প্রায় শত বছর আগের ব্রিটিশ শাসন আমলে গুটি কয়েক বীমা কোম্পানি জীবন বীমা ও সাধারণ বীমা উভয় ধরনের সেবা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল।
দেশভাগ থেকে শুরু করে স্বাধীনতা পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশে বীমা ব্যবসা ভাল অবস্থানে ছিল। ওই সময় প্রায় অর্ধশত জীবন বীমা ও সাধারণ বীমা কোম্পানি দ্বারা এই সেবা পরিচালিত হতো। এই কোম্পানিগুলোর শাখা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়ানো ছিল।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে বীমা শিল্পকে জাতীয়করণ করে। এই আদেশটি “বাংলাদেশ বীমা জাতীয়করণ আদেশ ১৯৭২” হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
আরো পড়ুন: পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিজের হাতে
বীমা করার সুবিধাবলী:
- এটা জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
- এটা একটি মূলধন। দুর্ঘটনা না ঘটলেও মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে মুনাফা সহকারে এটা পাওয়া যায়।
- এটা মানুষকে মানসিক প্রশান্তি দেয়।
- ব্যবসায়ীদের জন্য এটা অনেক বড় সুযোগ।
- জমি, বাড়ির মতো এটা একটি সম্পত্তি।
- এটা বৃদ্ধ বয়সে সম্বল। শেষ বয়সে এই মূলধনের মুনাফা থেকে জীবন পরিচালনা করা যায়।
বীমা (Insurance) করার ধাপ সমূহ কী কী?
বীমা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি কিংবা ওয়েব সাইট থেকে গ্রাহক বিভিন্ন পরিকল্প সম্পর্কে জানতে পারবেন এবং বিভিন্ন পরিকল্প যাচাই বাছাই করে, পছন্দ মতো পরিকল্প নিবার্চন করবেন।
বীমা করার ক্ষেত্রে প্রথমে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কিসের বীমা করবেন। যদি জীবন বীমা করে থাকেন তাহলে আপনার বাজেট অনুযায়ী প্রিমিয়াম বা কিস্তি মোতাবেক কোন কোন মেয়াদের জীবন বীমা পরিকল্প আছে তা দেখুন। এটা ভালোভাবে জানুন দুর্ঘটনার কত দিনের মধ্যে টাকা দেবে। সর্বনিম্ন কতগুলো প্রিমিয়াম দিলে আসল মূলধন পাওয়া যাবে। মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে কতদিন পর মূলধন সুদ সমেত ফেরত দেবে। এই সকল বিষয়বস্তু আপনাকে ভালোভাবে যাচাই করতে হবে।
- আপনার পছন্দের পরিকল্প গ্রহণের জন্য বীমা প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করুন।
- বীমা প্রতিষ্ঠানের কাছে আপনার আবেদন করার ফরম এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তারা পর্যালোচনা করবে। এরপর আপনি বীমাকারী প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করুন। তাদের শর্তগুলো ভালোভাবে পড়ে দেখুন এবং পছন্দ হলে গ্রহণ করুন।
- বীমা প্রতিষ্ঠান আপনার আবেদন মঞ্জুর করলে আপনার প্রথম প্রিমিয়ার বা কিস্তি প্রদান করুন। (অনেক ক্ষেত্রে প্রথম কিস্তির সাথে কিছু স্টাম্প খরচ দিতে হয়)
- আপনার প্রিমিয়াম পরিশোধের পর বীমা প্রতিষ্ঠান এফ.পি.আর এর মাধ্যমে বীমা চুক্তি চূড়ান্তভাবে সম্পাদন করবে।
- বীমা প্রতিষ্ঠান যখন এফ.পি.আর চুক্তি সম্পাদনের করবে তখন আপনি বীমা দলিল সংগ্রহ করুন।
জীবন বীমা কী? জীবন বীমা কত সালে চালু হয়?
জীবন বীমা তৎকালীন রাষ্ট্রপতির আদেশ অনুসারে ১৯৭৩ সালে চালু হয়।
জীবন বীমা হচ্ছে এমন একটি চুক্তি, যা একজন বীমাকারী ও একটি বীমা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পাদিত হয়। এখানে বীমা প্রতিষ্ঠান এই চুক্তি করে যে, বীমাকারীর মৃত্যু হলে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বীমাকারীর উত্তরাধিকারীকে প্রদান করবে।
চুক্তির শর্ত অনুসারে বীমকারী মারাত্মক অসুস্থ হলেও সে অর্থ পাবে। বীমাকারী সাধারণত এককালীন বা নির্দিষ্ট সময় পর পর বীমা প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট পরিমান টাকা প্রদান করে থাকে।
বীমাকারী এই ব্যাপারে নিশ্চিত থাকে যে, তার মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারী অর্থ কষ্টে পড়বে না। এভাবে সে মানসিকভাবে চিন্তামুক্ত থাকে।
এছাড়া বীমা পলিসিতে যদি এমন কোনো শর্ত থাকে যে, বীমার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর মূলধন লাভ সমেত ফেরত পাবে, তাহলে এটা বীমাকারীর জন্য একটি সম্পদে পরিণত হয়।
তবে সাধারণত এখানে কিছু শর্ত থাকে। বীমাকারী যদি আত্মহত্যা করে কিংবা যুদ্ধে মারা যায় তাহলে বীমা কোম্পানি কোনো টাকা প্রদান করে না।
প্রিমিয়াম কী
বীমা প্রতিষ্ঠান আপনার জীবনের অনিশ্চিত ঝুঁকি নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার জন্য আপনার কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নেয়। সেটা এককালীন কিংবা কিস্তিতে হতে পারে। সেই এককালীন বা প্রতি কিস্তিকে প্রিমিয়াম বলা হয়।
সরকারি বীমা কয়টি এবং কি কি?
বাংলাদেশ সরকারের আওতায় দুইটি বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই দুইটি বীমা প্রতিষ্ঠান সরকারি বীমা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশ সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে এই দুইটি বীমা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশের সরকারি দুইটি বীমা প্রতিষ্ঠান:
- জীবন বীমা কর্পোরেশন বা জেবিসি।
- সাধারণ বীমা কর্পোরেশন।
এই দুইটি বীমা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত দেশে বেসরকারি এবং মালিকানা আরও অনেক বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে সবচেয়ে নিরাপদ হিসেবে এই দুইটি প্রতিষ্ঠানকেই ধরা হয়।
যৌথ বীমা কী?
যৌথভাবে অর্থাৎ কয়েকজন মিলে যে বীমা করা হয় সেটাকে যৌথ বীমা বলে। এটা সাধারণত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে করা হয়।
বীমা কত প্রকার?
বীমা অনেক প্রকারের হয়ে থাকে। নিম্নে কয়েকটা উল্লেখ করা হলো।
- জীবন বীমা
- সম্পত্তি বীমা (কলকারখানা, বাড়ি, গাড়ি, অনেক ক্ষেত্রে দামি ইলেকট্রনিক্স পণ্য)
- সমুদ্র বীমা
- দুর্ঘটনা বীমা
- অগ্নি বীমা
এছাড়া ডাক বিভাগেও কিছু বীমা (Insurance) রয়েছে। এরমধ্যে একটি বীমা আছে যা অনেকের অজানা। এটা হচ্ছে আপনি যদি কোনো দামি দলিল ডাক মাধ্যমে পাঠাতে চান, তাহলে এটার জন্য একপ্রকার বীমা রয়েছে। যেই বীমা অনুসারে, যদি সেই দলিল হারিয়ে যায় তবে আপনি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পাবেন।