বীমা কী? এটা এমন একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে গ্রাহক তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিংবা সম্পদের ঝুঁকি অন্যের কাছে হস্তান্তর করে। সহজ ভাষায় বললে, বীমা প্রতিষ্ঠান কিছু অর্থের বিনিময়ে গ্রাহকের নির্দিষ্ট সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি গ্রহণ করে অর্থাৎ সম্পদের ক্ষতি হলে সেটার ক্ষতিপূরণ দেয়।
গ্রাহক এককালীন অথবা কিস্তিতে প্রিমিয়াম দিতে পারে। বীমা আবার দুই প্রকারের। এক ধরনের বীমা আছে যেটাতে আপনি শুধু প্রিমিয়াম দিতে থাকবেন কিন্তু মেয়াদ শেষে কোনো টাকা পাবেন না। তবে নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে আপনার সম্পদের কোনো প্রকার ক্ষতি হলে সেটার নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ পাবেন।
আরেক ধরনের বীমা রয়েছে যেটা কিস্তি অথবা এককালীন প্রিমিয়াম প্রদান করতে হয়। যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হয় তাহলে মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর সুদ সমেত মূলধন ফেরত পাবেন। আর যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো ক্ষতি হয় তাহলে নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ পাবেন।
এই দুটি পদ্ধতিতে বীমা ব্যবস্থা সারা বিশ্বময় চলছে। বহির্বিশ্বে বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে বীমা খুবই জনপ্রিয়। ওই সকল দেশে তো দামি ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বিমান প্রচলিত। যেমন বড় এলইডি টিভি, ফ্রিজ।
কিন্তু আমাদের দেশে এটা সে তুলনায় খুব কম প্রতিষ্ঠিত।
বীমা করার প্রতি অনীহা থাকার দুইটি মূল কারণ রয়েছে। প্রথমত হচ্ছে ধর্মীয় কারণ। দ্বিতীয়ত হচ্ছে এর নিয়মাবলী সম্পর্কে ধোঁয়াশা; যার ফলে গ্রাহকেরা বীমা করতে নিরুৎসাহিত হয়।
- ধর্মীয়ভাবে এটা অবৈধ। তাই অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষেরা বীমা করা থেকে বিরত থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এটা জুয়া খেলার শামিল এবং সুদের ব্যবহার থাকে বিধায় মানুষজন এটা থেকে দূরে থাকে। তবুও অনেক মানুষ ধর্মীয় চেতনাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বীমা করে।
- দ্বিতীয় এবং সবচাইতে বড় ও প্রধান কারণ হচ্ছে মানুষজন বীমার প্রতি আস্থা রাখতে পারে না। এর অবশ্য অনেকগুলো কারণ আছে। কারণগুলো হচ্ছে বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো সময়মতো ক্ষতিপূরণ দেয় না। মানুষজন যেই আশা নিয়ে বীমা প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় সে আশা পূরণ হয় না। দেখা যায় বছরের পর বছর টাকা দেওয়া নিয়ে ঘোরাতে থাকে।
এছাড়া ব্যাঙের ছাতার মতো অহরহ বীমা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যেগুলোতে মানুষজন সারা জীবনের সঞ্চয় আমানত রেখে প্রতারিত হয়। এর ফলে মানুষজন অনেক বেশি বীমা থেকে বিমুখ হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে মোটরসাইকেল বা গাড়ির বীমা করা বাধ্যতামূলক। প্রতিবছর এর জন্য গ্রাহক একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা বীমা প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করে। কিন্তু গাড়ির যখন ক্ষয়ক্ষতি হয় তখন বীমা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিপূরণ দেয় না। এক কথায় তারা শুধু টাকা গ্রহণ করে কিন্তু প্রতিদান কিছুই দেয় না।
আরো পড়ুন: বাংলাদেশের বীমা কোম্পানিগুলোর তালিকা
অনেক মানুষ আছে যারা বীমা প্রতিষ্ঠান ফাঁদে পা দেয়। বিশেষ করে মহিলাগণ। বীমা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন এজেন্টদেরকে কমিশনের মাধ্যমে নিযুক্ত করে। এই এজেন্ট গুলো সাধারণ মানুষদেরকে অলীক স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে। ভবিষ্যতের সুন্দর সুন্দর কথা বলে। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলে। এমন আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখায় যেগুলো শুনে গরিব মানুষেরা প্রলুব্ধ হয় এবং বীমা করে।
মাসে মাসে প্রিমিয়াম দিতে থাকে। সাধারণত পাঁচ বা দশ বছর মেয়াদী এই সকল বীমা হয়ে থাকে। নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পরও বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ছলচাতুরির মাধ্যমে গ্রাহককে মূলধন দেওয়া থেকে বিরত থাকে। এছাড়া গ্রাহকের বীমার মেয়াদ থাকা অবস্থায় গ্রাহকের যদি কোনো ক্ষতি হয় তাহলে সেগুলোর ক্ষতিপূরণও দেয় না।
গ্রাহক মারা গেলে তার উত্তরাধিকারীদেরকেও টাকা দেয় না। কেননা এ সকল দরিদ্র গ্রাহকেরা বীমার আইন সম্পর্কে বেশি একটা জানে না এবং পুলিশি ঝামেলায় জড়াতে চায় না।
তবে কলকারখানার মালিকেরা ক্ষমতাবান। তারা প্রতিটা শ্রমিকের জন্য জীবন বীমা করে থাকে। কারখানার উপর তো বীমা আছেই। তাই যখন কোনো কারখানায় আগুন লাগে তখন কারখানা মালিকের কোনো চিন্তা হয় না। কেননা কারখানার ক্ষতিপূরণ সে বীমা কোম্পানি থেকে পেয়ে যাবে।
যত জন শ্রমিক মারা যাবে সেগুলোর টাকাও তার হস্তগত হবে। অর্থাৎ শ্রমিক বেঁচে থাকলেও লাভ; মারা গেলেও লাভ। এভাবেই শ্রমিকের রক্ত-মাংস বিক্রি করে পুঁজিবাদীরা আজ সমাজের শীর্ষে অবস্থান করছে।
বীমার একটি সাধারণ আইন হচ্ছে কমপক্ষে দুই বছর প্রিমিয়াম দিতে হবে। দুই বছর প্রিমিয়াম দিলে মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর যতগুলো প্রিমিয়াম দেওয়া হচ্ছে সেগুলো সুদ সমেত ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু অনেক লোকেরা আছে যারা এই আইন সম্পর্কে জানে না। তাদেরকে ইচ্ছে করেই জানানো হয় না। যে সকল এজেন্টগণ বীমা প্রতিষ্ঠান গুণকীর্তণ করে থাকে, তারাও দরিদ্র এবং কমিশনের লোভে মানুষকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখায়।
প্রতিনিয়ত খবর আসে অমুক বীমা প্রতিষ্ঠান জনগণের টাকা নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। তখন বীমা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বেচারা গরীব কর্মীগণ জনরোষের শিকার হয়।
মূল কথা, বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে না। এইজন্যই গ্রাহকেরা তাদের উপর আস্থা রাখতে পারে না। বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো বেশি দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। নচেৎ এই দেশে তারা তাদের প্রতিষ্ঠান সুনামের সাথে পরিচালিত করতে পারবে না।