আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দল (Argentina national football team) আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফুটবল খেলায় আর্জেন্টিনার প্রতিনিধিত্বকারী পুরুষগণের জাতীয় দল। এটার সব কার্যক্রম আর্জেন্টাইন ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘আর্জেন্টিনীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর্জেন্টিনা ফিফার সদস্য হয় ১৯১২ সালে। ১৯১৬ সাল থেকে ‘দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবল কনফেডারেন’ সংক্ষেপে ‘কনমেবলের’ সদস্য হয়। ১৯০২ সালের ২০শে জুলাই, আর্জেন্টিনা সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক খেলায় অংশগ্রহণ করে। উরুগুয়ের মোন্তেবিদেও-এ অনুষ্ঠিত একটি ম্যাচে আর্জেন্টিনা উরুগুয়েকে (৬–০) পরাজিত করে।
আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের অতীতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
আর্জেন্টিনায় ফুটবল খেলা আরম্ভ হয় ১৮৬৭ সালে। কিন্তু ১৯০১ সালে আর্জেন্টিনায় সর্বপ্রথম জাতীয় ফুটবল টিম গঠন হয়। এই দল প্রথমে উরুগুয়ের সাথে একটি প্রীতি ম্যাচে অংশগ্রহণ করে। খেলাটি ১৯০১ সালের ১৬ মে অনুষ্ঠিত হয়। আর্জেন্টিনা (৩–২) গোলে সেই ম্যাচে জয়ী হয়। ‘কোপা লিপতন’ (Copa Lipton) আর্জেন্টিনার প্রথম আনুষ্ঠানিক শিরোপা অর্জন ছিল। ১৯০৬ সালে আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ের ম্যাচ হয়। অতঃপর (২–০) গোলে আর্জেন্টিনা জয়ী হয় এবং এই শিরোপা অর্জন করে।
ওই বছরটাতেই আর্জেন্টিনা ‘কোপা নিউটন কাপে’ (Copa Newton) অংশগ্রহণ করে এবং উরুগুয়েকে (২–১) গোলে হারিয়ে শিরোপা জয়ী হয়। ১৯০৭ থেকে ১৯১১ সাল অবধি একাধারে চারবার এই শিরোপা জিতে আর্জেন্টিনা। এই ‘কোপা নিউটন কাপে’ মোট ২৮ টি খেলা হয় এবং এর মধ্যে ১৭ টি খেলায় আর্জেন্টিনা জয়ী হয়। এছাড়া আর্জেন্টিনা ১৯০৬ সাল থেকে ১৯০৯ সাল অবধি চারবার লিপতন কাপ জয়ী হয়।
দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ খেলায় আর্জেন্টিনা প্রথম জয়ী হয় ১৯২১ সালে। এই প্রতিযোগিতায় আর্জেন্টিনা উরুগুয়ে, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ের বিপক্ষে সবকয়টি ম্যাচে জয়ী হয়।
আর্জেন্টিনা ১৯২৭ সালে ৩য় দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা জয়ী হয়। ওই প্রতিযোগিতার তিনটি ম্যাচের সবগুলতেই বিজয়ী হয়। আবারও ১৯২৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা আর্জেন্টিনার ঝুলিতে আসে। এই আসরের সবগুলো ম্যাচে আর্জেন্টিনা জয়ী হয়।
ফিফা ১৯৩০ সালে সর্বপ্রথম বিশ্বকাপ আয়োজন করে। ওই প্রতিযোগিতায় আজেন্টিনাসহ মোট ১৩টি দেশ অংশ নেয়। আর্জেন্টিনা সবগুলো ম্যাচে জয় লাভ করে ফাইনাল অবধি পৌঁছায়। কিন্তু ফাইনালে উরুগুয়ের কাছে ৪–২ গোলে হেরে বিশ্বকাপ জেতা থেকে বঞ্চিত হয়। ওই বিশ্বকাপে আটটি গোল দিয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয় আর্জেন্টাইন প্লেয়ার গুইলেরমো স্তাবিল।
- আর্জেন্টিনার বর্তমান প্রধান কোচ ‘লিওনেল স্কালোনি’
- অধিনায়ক হচ্ছে ‘লিওনেল মেসি’
এই দলের সর্বাধিক ম্যাচ খেলেছে লিওনেল মেসি। তিনি ১৭১ টি ম্যাচ খেলেছে।*
এই দলের শীর্ষ গোলদাতাও তিনি। সে এই পর্যন্ত আর্জেন্টিনার হয়ে ৯৬টি গোল দিয়েছে।*
[*ভবিষ্যতে এটা পরিবর্তন হতে পারে।]
আরো পড়ুন: ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল ২০২২ ও বিশ্বকাপের ইতিহাস
আর্জেন্টিনার জনপ্রিয় খেলোয়াড়ের নাম
এখানে আর্জেন্টিনার ওইসব কয়েকজন খেলোয়াড়ের নাম উল্লেখ করেছি যারা নূন্যতম ৫০টি খেলায় অংশগ্রহণ করেছে কিংবা নূন্যতম ১০টি গোল করেছে।
- অসভাল্দো আর্দিলেস (১৯৭৪ –১৯৮২)
- অস্কার মাস (১৯৬৫– ১৯৭২)
- অস্কার রুগেরি (১৯৮২ –১৯৯৪)
- অ্যাঞ্জেল লাব্রুনা (১৯৪২ –১৯৫৮)
- অ্যালবার্তো তারান্তিনি (১৯৭৪– ১৯৮২)
- আবেল বাল্বো (১৯৮৮ –১৯৯৮)
- আমেরিকো গ্যালিগো (১৯৭৫–১৯৮২)
- উবাল্দো ফিল্লোল (১৯৭২– ১৯৮৫)
- এরমিন্দো অনেগা (১৯৬০ –১৯৬৭)
- এরিয়েল অর্তেগা (১৯৯৩– ২০১০)
- এর্নান ক্রেসপো (১৯৯৫ –২০০৭)
- ওমার অরেস্তে কর্বাতা (১৯৫৬ –১৯৬২)
- কার্লোস পিউচিল্লি (১৯২৮ –১৯৪০)
- গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা (১৯৯১ –২০০৩)
- জর্জ অলগুইন (১৯৭৬ –১৯৮২)
- জর্জ বুরুচাগা (১৯৮৩ –১৯৯০)
- দমিনগো তারাস্কোনি (১৯২২ –১৯২৯)
- দিয়েগো সাইমন (১৯৯১ –২০০৩)
- দেনিয়েল প্যাসারেলা (১৯৭৪ –১৯৮৬)
- দেনিয়েল বার্তোনি (১৯৭৪ –১৯৮২)
- নরবার্তো মেন্দেজ (১৯৪৫ –১৯৫৬)
- পাবলো আইমার (১৯৯৯ –২০০৯)
- ফেরন্যান্দো রেদোন্দো (১৯৯২ –১৯৯৯)
আপনারা হয়তো এই তালিকায় দিয়েগো ম্যারাডোনা ও লিওনেল মেসির নাম খুঁজে না পেয়ে বিস্মিত হচ্ছে। এই দুইজন খেলোয়াড় এতটাই জনপ্রিয় যে, এদেরকে আলাদা করে উল্লেখ্য করার কোনো প্রয়োজন পড়ে না।
আর্জেন্টিনার স্মরনীয় দুটি গোল
১. ১৯২৪ সালের ২রা অক্টোবর আর্জেন্টিনা উরুগুয়ের বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলে। খেলার ১৬তম মিনিটে আর্জেন্টাইন প্লেয়ার ‘উইঙ্গার সিজারিও ওঞ্জারি’ কর্নার কিক থেকে একটি গোল করেন। সে কর্নার কিক নেয় এবং কোনো খেলোয়াড় দ্বারা বল স্পর্শ না করা সত্ত্বেও সেটা উরুগুয়ের গোলপোস্টে ঢুকে যায়। এই বিস্ময়কর গোলটির নাম দেওয়া হয় ‘গোল অলিম্পিকো’ বা ‘অলিম্পিক গোল’।
২. ১৯৮৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে একজনের নাম সবচেয়ে বেশি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো। তিনি হলেন আর্জেন্টিনার অধিনায়ক দিয়েগো ম্যারাডোনা। অবশেষে সেই বিশ্বকাপ পুরস্কারটা ম্যারাডোনারই হাতে এসে ওঠে।
১৯৮৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ খেলায় আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে ফুটবল খেলার উত্তেজনা ছাড়াও অন্য আরেকটি উত্তেজনা কাজ করছিল। ১৯৮২ সালে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা নিয়ে ইংল্যান্ডের সাথে আর্জেন্টিনার তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে আর্জেন্টিনা পরাজিত হয়। সেই স্মৃতিটা তখনো আর্জেন্টাইনদের অন্তরে তাজা ছিল। তাই কোয়ার্টার ফাইনালে মাঠে ইংল্যান্ড ও আর্জেন্টিনার চরম লড়াইয়ের পাশাপাশি দুই দেশের দর্শকদের মাঝেও স্নায়ুযুদ্ধ চলেছিল। তবে শেষ অবধি আর্জেন্টিনার ঝুলিতেই বিশ্বকাপ এসে পড়ে।
ওই দিন কী ঘটেছিল?
কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচে দুই পক্ষের তীব্র লড়াইয়ের পরও প্রথমার্ধ কোনো গোল ব্যতিত শেষ হয়। চরম উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে ফুটবল খেলার ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত ও চমৎকার ঘটনার জন্ম হয়। আর্জেন্টাইন অধিনায়ক ম্যারাডোনা ম্যাচের ৫১তম মিনিটে একটি গোল করে দলকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
কিন্তু পরে টেলিভিশনে রিপ্লেতে মানুষজন লক্ষ্য করে যে, ম্যারাডোনা এই গোলটি হাত দিয়ে করে। হাত দিয়ে ফুটবলে আঘাত করে সেটাকে গোলপোস্টের দিকে ঠেলে দেয়। ম্যারাডোনা অবশ্য পরে এটা স্বীকারও করেছিলো। তিনি সেই গোলের ব্যাখ্যায় বলেছিলো, ‘ঈশ্বর তার হাত দিয়ে গোলটা করিয়েছেন!’
তারপর থেকেই গোলটি ‘ঈশ্বরের হাতের গোল’ নামে পরিচিত হয়।
বাংলাদেশে কোন ফুটবল দল সবচেয়ে জনপ্রিয়?
বাংলাদেশে দুইটি প্রধান দল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। এখানে কোন দলের কত সমর্থক সেটা অবশ্য গণনা করে দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু কয়েকটি দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় আর্জেন্টিনার জনপ্রিয়তা অনেক বেশি।
আর্জেন্টিনা ফুটবল দল এখন অবধি দুইটি বিশ্বকাপ জিতেছে। একটি ১৯৭৮ সালে অপরটি ১৯৮৬ সালে। অপরদিকে ব্রাজিল পাঁচটি বিশ্বকাপ জয়ী হয়েছে। সেই দিক দিয়ে বিবেচনা করলে ব্রাজিল অনেক শক্তিশালী দল।
আর্জেন্টিনা সর্বশেষ বিশ্বকাপ জয় করে ১৯৮৬ সালে। অর্থাৎ এখনকার যে সকল তরুণ আর্জেন্টিনার সমর্থক তারা কখনোই আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জয়ী হতে দেখেনি। তবুও আর্জেন্টিনার এত এত সমর্থক। কিন্তু কেন?
যারা তাদের জীবদ্দশায় একবারও আর্জেন্টিনার হাতে বিশ্বকাপ দেখেনি, তবুও আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে দিয়ে তাদের প্রতি সমর্থন দেখায়। এটা কিসের শক্তিতে সম্ভব হয়েছে? নিশ্চয়ই আর্জেন্টিনার মাঝে এমন কিছু আছে যা এই দেশের মানুষের মনপ্রাণ ছুঁয়ে গেছে। তাইতো এত বছর ধরে বিশ্বকাপ না জিতলেও এ দেশের মানুষের হৃদয়ে আর্জেন্টিনা গেঁথে আছে।
বলা হয়ে থাকে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ খেলার সময় থেকে বাংলাদেশ এত আর্জেন্টিনার ভক্ত। সে সময় ম্যারাডোনার চমৎকার খেলা দেখে এদেশের মানুষজন খুবই আনন্দিত হয়েছিল। তখন থেকেই বাংলাদেশের জনগণ আর্জেন্টিনার প্রতি দুর্বল। এছাড়া সেই সময়টার পর থেকে ধীরে ধীরে মানুষের ঘরে টিভি আসতে শুরু করে এবং খেলা দেখার প্রচলন বাড়তে থাকে।
শেষ কথা
খেলাধুলা একটি বিনোদন। এটাকে বিনোদনের জায়গায় রাখলেই খুব ভালো হয়। কিন্তু আমার দেশে এটাকে বিনোদনের জায়গাতে না রেখে যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে গেছে কিছু বোকা মানুষজন। প্রায় সময় বিভিন্ন স্থানে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। এগুলো হচ্ছে শুধুমাত্র দলের সমর্থনকে কেন্দ্র করে। তাই আমাদের উচিত খেলাটাকে উপভোগ করা এবং সেখান থেকে আনন্দ লাভ করা।