মরক্কো: অনন্য সুন্দর এক দেশ:

মরক্কো: অনন্য সুন্দর এক দেশ

মরক্কো: অনন্য সুন্দর এক দেশ- সূর্য উদয়ের দেশ যদি জাপান হয়ে থাকে। তাহলে সূর্যাস্তের দেশ মরক্কো। আরবরা একে তাদের ভাষায় ‘আল মামলাকাতুল মাগরিবিয়া’ বলে থাকে। এর অর্থ ‘পশ্চিমের রাজ্য’।

মরক্কোর ভৌগলিক অবস্থান

এই দেশ উত্তর আফ্রিকার সর্ব পশ্চিমে অবস্থিত। এর উত্তরে ভূমধ্যসাগর এবং সাগরের ঐ পাড়ে স্পেন। পূর্ব দিকে আলজেরিয়া। পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর। দক্ষিণে ভয়ংকর সাহারা মরুভূমি। বিশ্ব মানচিত্রে আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পশ্চিম কোণে তাকালে খুব সহজেই এর অবস্থান নির্ণয় করা যায়।

মরক্কোর প্রাচীন ইতিহাস

মরক্কো অঞ্চলে প্রস্তর যুগ থেকেই মানব বসতি ছিল এমনটাই ধারণা করছে গবেষকেরা। সাম্প্রতিক সময়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীগণ মরক্কোতে প্রস্তর যুগের আগেরকার মানুষ্য বসতির অস্তিত্ব পেয়েছে। তাদের ধারণা প্রস্তর যুগে এই অঞ্চল এখনকার চেয়ে অনেক বেশি উর্বর ছিল।

মরক্কো একসময় রোমানদের অধীনে ছিল। ইতিহাস বলছে সম্রাট ক্লডিয়াস ৪৪ খ্রিস্টাব্দে মৌরিতানিয়া দখল করার মাধ্যমে মরক্কোকে গভর্নর শাসিত রোমান উপনিবেশে পরিণত করেন।

৩য় শতাব্দীতে মরক্কো অঞ্চলের বার্বাররা মৌরিতানিয়ার কিছু অংশ রোমানদের থেকে উদ্ধার করে। এরফলে ৩য় শতাব্দীর শেষের দিকে রোমান সাম্রাজ্য কয়েকটি উপকূলাঞ্চলীয় শহরেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। যেমন: সেউতা ও চেরচেল। এরপর ৪২৯ খ্রিস্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্য মৌরিতানিয়ায় তার বাকি প্রভাব ও ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেলে। তখন স্থানীয় মৌরো-রোমান রাজাগণ এই অঞ্চলটিকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।

বি.দ্র. বর্তমান মৌরতানিয়া ও মরক্কো পূর্বে একই অঞ্চল বিবেচিত হতো।

আরো পড়ুন: আর্জেন্টিনা ফুটবল দল

মরক্কোয় ইসলামী শাসনের পত্তন

উমাইয়া খিলাফত ৭ম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মরক্কো বিজয় করে। এই বিজয় অর্জনের ফলে মরক্কোতে ইসলাম ও আরবি ভাষার আগমন ঘটে। ইসলামে আগমন ঘটলে সেখানকার আদিবাসী বার্বারগণ ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে এবং দলে দলে মুসলিম হয়। বার্বারেরা ইসলামী খেলাফতকে জাকাত প্রদান করত।

এরপর এখানে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন খেলাফতের শাসন চলতে থাকে। কখনো ফাতেমি খিলাফত। কখনো ইদ্রিসি রাজবংশের রাজত্ব। বহু মুসলিম শাসকের শাসন চলেছে মরক্কোতে।

আধুনিক মরোক্কোর ইতিহাস

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বঃ মরক্কো ছিল সর্বপ্রথম দেশ, যে দেশ ১৭৭৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীন হওয়া নতুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। আমেরিকান স্বাধীনতা বিপ্লবের প্রাক্কালে আটলান্টিক মহাসাগরে মার্কিন বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে বার্বার জলদস্যুদের কর্তৃক হামলার শিকার হতো। মরক্কোর সুলতান তৃতীয় মোহাম্মদ ১৭৭৭ সালের ২০ ডিসেম্বর ঘোষণা করে যে, মার্কিন বাণিজ্যিক জাহাজগুলো মরক্কো সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার অধীনে থাকবে। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজগুলো নিরাপদে এই অঞ্চল দিয়ে জাহাজ পরিচালনা করতে পারতো। মরোক্কা-মার্কিন বন্ধুত্বের চুক্তি ১৭৮৬ সালে স্বাক্ষরিত হয়। এটাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচীনতম বন্ধুত্ব চুক্তি হিসাবে এখনও টিকে আছে।

মরক্কোয় ইউরোপীয় উপনিবেশঃ শিল্প বিপ্লবের পরপরই উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকায় ইউরোপীয়রা উপনিবেশ স্থাপনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ফ্রান্স ১৮৩০ সালের প্রথমার্ধে মরক্কো দখলের পাঁয়তারা করে। এটা যে শুধুমাত্র ফ্রান্সের আলজেরীয়ার ঔপনিবেশিক অঞ্চলের সীমানা রক্ষা করার জন্য, তা কিন্তু নয়। ভূমধ্যসাগর ও বিশাল আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে প্রভাব বিস্তার করার জন্য মরক্কো একটি আদর্শ স্থান। মরক্কোর কৌশলগত অবস্থানের কারণে ফ্রান্স মরক্কো দখলের জন্য মরিয়া ছিল।

স্পেনের উপনিবেশঃ ১৮৬০ সালে সেউতার একটি অঞ্চলের দখলদারিত্ব নিয়ে স্পেনের সাথে মরক্কোর যুদ্ধ লাগে। এতে করে স্পেন সেউতাসহ আরো একটি অঞ্চল দখল করে বসতি স্থাপন করে। অতঃপর স্পেন ১৮৮৪ সালে মরক্কোর উপকূলীয় অঞ্চলে তাদের উপনিবেশ কায়েম করে।

ফ্রান্স ও স্পেন ১৯০৪ সালে মরক্কোয় প্রভাব বিস্তার করা আরম্ভ করে। এক সময় মরক্কোর অর্ধেক ফ্রান্সের উপনিবেশে পরিণত হয়।

মরক্কোর পুরাতন মিত্ররাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ১৯৪৩ সালে মরক্কোর স্বাধীনতার জন্য ইস্তিকলাল পার্টি (স্বাধীনতা পার্টি) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দলটি পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করে।

ফ্রান্স সুলতান মোহাম্মদ পঞ্চমকে ১৯৫৩ সালে মাদাগাস্কারে নির্বাসনে পাঠায়। তখন তার স্থলাভিষিক্ত মোহাম্মদ বিন আরাফা ফ্রান্স ও স্পেনের উপনিবেশের বিরোধিতা করতে শুরু করে। সেই সময় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সহিংসতা ঘটে ওজদাতে। মরক্কোর জনগণ রাস্তা-ঘাটে ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপীয়দের ওপর আক্রমণ করতে থাকে। এর ফলে ফ্রান্স ১৯৫৫ সালে মোহাম্মদ পঞ্চমকে ফিরে আসার জন্য অনুমতি দেয় এবং এর পরের বছরই মরক্কোর স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।

১৯৫৬ সালের মার্চে ফরাসি উপনিবেশবাদের পতন ঘটে। মরক্কো তখন ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীন হয়। এর এক মাস পরেই স্পেন উত্তর মরক্কো থেকে উপনিবেশ গুটিয়ে নিয়ে চলে যায়। তবে ভূমধ্যসাগরের উপকূলের দুইটি ছিটমহল সেউতা ও মেলিলা দখল করে রাখে। এই শহর দুইটি মরক্কোর উপকূল ঘেঁষে এবং অতীতে মরক্কোর অংশ থাকার কারণে মরক্কো আজ পর্যন্ত এর সার্বভৌমত্ব দাবি করে আসছে। মরক্কো স্বাধীন হলে পরে ১৯৫৭ সালে সুলতান মোহাম্মদ রাজা হয়।

আরো পড়ুন: বিজয় দিবস: মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি কবিদের কবিতা

মরক্কোর বর্তমান অবস্থা

মরক্কোর রাজধানী রাবাত। এই দেশ পর্যটনের জন্য বিখ্যাত। এর রয়েছে সুদীর্ঘ সমুদ্রতট। যেটা উপভোগের জন্য প্রতিবছর ইউরোপের লক্ষ লক্ষ পর্যটক ভিড় করে। এছাড়া অন্যান্য দেশ থেকেও পর্যটক আসে। ইউরোপে ভ্রমণ করাটা অনেক ব্যয়বহুল। তাই ইউরোপীয়গণ এখানে ভ্রমণ করতে আসে এবং এটা ইউরোপের থেকে কাছে।

এখানে রয়েছে ইসলামিক প্রাচীন স্থাপত্য। রয়েছে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যের সমাহার। মরক্কো বিভিন্ন দিক দিয়ে উন্নতির পথে ধাবিত হচ্ছে। এই দেশে সাংবিধানিকভাবে রাজতন্ত্র চলে।

এটা আফ্রিকার দেশ হয়েও আফ্রিকান ইউনিয়নের সদস্য নয়। এই দেশের বেশিরভাগ মানুষ আরবিতে কথা বলে। তাই এরা আরব লীগের সদস্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top