বিজয় দিবস মুক্তিযুদ্ধ কবিতা

বিজয় দিবস: মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি কবিদের কবিতা

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কবিতা-উপন্যাস রচনা হয়েছে। অনেক ছায়াছবি নির্মাণ হয়েছে। কত সুন্দর সুন্দর গান গেয়েছে শিল্পীরা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ইংরেজিতেও গান গাওয়া হয়েছে। সেই গানটি গেয়েছে জর্জ হ্যারিসন।

আচ্ছা, আমরা কি জানি পাকিস্তানি কবিগণও মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কবিতা লিখেছে!

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দেশেও এমন কিছু মুক্তিকামী, শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিল যারা এই যুদ্ধের তীব্র প্রতিবাদ করেছে। তারা স্বৈরশাসকদের পরোয়া করেনি। আর্মির বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে এই কবিতা উচ্চারণ করেছে। তারা আমার দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কথা বলেছে। আসুন আজ তাদের কয়েকটা কবিতা পাঠ করি। আপনারা হয়তো এর আগে কখনোই এই বিষয়ে জানতেন না। কিন্তু আজ probangla -এর কল্যাণে আজ তা জানবেন। এই কবিতাগুলো উর্দু থেকে ভাবান্তর করেছে হৃদয় মৃধা। এর সকল দায়ভার হৃদয় মৃধার।

পাকিস্তানের প্রগতিশীল কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ। তিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় প্রবাসে কাটাতে বাধ্য হয়েছে। কেননা দেশে আসলেই তাকে জেলখানায় আটকে রাখা হয়। তবুও তিনি দমে যাননি সত্য বলতে। তিনি একটি কবিতায় বলেছিলেন, “যদি কলম ছিনিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে কলিজায় আঙুল ডুবিয়ে রক্ত দিয়ে লিখব।”

উনার একটি কবিতা,

“সাজাবো তো কীভাবে সাজাবো গণহত্যার মেলা?
কাকে প্রলুদ্ধ করবে আমার রক্তের মাতম?
আমার জীর্ণ বদনে কতটুকুই বা রক্ত আছে?
না প্রদীপ জ্বলবে, না পেয়ালা ভরবে
না আগুন জ্বলবে, না কারো তৃষ্ণা মিটবে।
আমার জখমি বদনে কতটুকুই বা রক্ত আছে?
কিন্তু আমার শিরা-উপশিরা হলাহলে ভরা।
যেটাই কাটো, প্রতিটা বিন্দু বিষাক্ত গোখরের ক্রোধ।
শত বছরের কষ্ট ও শোক ঘাম হয়ে নির্গত হয়
সেলাই করা প্রতিটা মুখে বেদনা ও ক্রোধের লাভা।

সাবধান করো আমার দেহ থেকে, এটা বিষের দরিয়া।
সাবধান করো, এই দেহ মরুর ওই কাষ্ঠ
যেটা জ্বালাবে তো বাগানের উঠানে জ্বলবে
তখন জুই-মল্লিকার বদলে পড়ে থাকবে আমার হাড্ডির ফণীমসা কাঁটা।
এটা যদি ছড়িয়ে দাও তো মরুভূমিতে ছড়াবে
খুশবুর বদলে আমার জীবনের বেদনার ধূলি।
সাবধান করো, আমার হৃদয় রক্ত পিপাসু।”

ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ পাক হানাদার বাহিনীকে এই কবিতার মাধ্যমে বলছে, এই মুক্তিযোদ্ধারা তোমাদের অত্যাচারে-নিপীড়নে আজ অতিষ্ঠ। আজ এরা ক্রোধে পরিপূর্ণ। এদেরকে উত্তেজিত করো না। এদেরকে দমিয়ে রেখো না। এরা বিষের উত্তাল দরিয়া। স্বাধীনতার জন্য এরা আত্মঘাতী। এদের থেকে সাবধান হও।

তিনি যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কঠোরভাবে প্রতিবাদ না করার দরুন অনেকটা লজ্জিত হন। বাংলাদেশের উনার অনেক বাঙালি বন্ধু ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি যখন বাংলাদেশে আসেন, তখন ওই বন্ধুগুলো উনার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। কেননা তিনি ওই সময়টায় ভুট্টোর সাথে খুব ভালো সম্পর্ক রেখেছিলেন।
বন্ধুদের এই অবহেলার জন্য তিনি একটি কবিতা লেখেন।

“আমরা এত অচেনা, এত সৌজন্যের পর।
আমরা আবারও পরিচিত হব, না জানি কত সাক্ষাতের পর।

কবে নজরে আসবে দাগহীন সবুজের বসন্তকাল?
রক্তের দাগ মিটে যাবে, না জানি কত বৃষ্টির পর।

ছিলো অনেক নির্মম মুহূর্ত, প্রেমের বেদনা শেষ হলে
ছিলো অনেক নির্দয় সকাল, মেহেরবান রাতের পর।

হৃদয় চেয়েছিলো, কিন্তু ভগ্নহৃদয় সুযোগ দেয়নি
কিছু মান-অভিমান করে নিতাম, নিভৃত আলাপের পর।

তাকে যা বলতে গিয়ে ‘ফয়েজ’ প্রান থেকে
অব্যক্ত রয়ে গেছে ওই কথা, সব কথা বলার পর।”

আহমেদ ফারাজ নামে আরো একজন কবি আছেন। যিনি রোমান্টিক ধারার কবিতা লেখার জন্য জনপ্রিয়। কিন্তু তিনিও অনেক তীব্র প্রতিবাদী কবিতা লিখেছেন। উনি বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর জন্য পাকিস্তানি আর্মিকে অনেক কটাক্ষ করেছেন। এখানে ওই কবিতাটির অনুবাদ দেওয়া হলো।

আরো পড়ুন: বিজয় দিবস: হাজার বছরের বাঙালির স্বপ্নের প্রতিফলন

“আমি আজ অবধি তোমাদের কবিতা লিখিয়াছি,
আর আজিকে আপন সংগীতের জন্য লজ্জিত।
আপন কবিতার অমর্যাদায় লজ্জিত।
আপন বিদ্যার আকাঙ্ক্ষায় লজ্জিত।
আপন হৃদয়গ্রাহী বন্ধুদের সম্মুখে লজ্জিত।

যখনই আমার হৃদয়-ভূমির উপর
অপরের ছায়া অথবা শত্রুহস্ত পড়িয়াছে,
যখনই সম্মুখে ঘাতকেরা সারিবদ্ধ হইয়াছে,
আমার রক্তাক্ত হৃদয় ছিলো, না কি শব্দের নৈপুণ্য
নৈবদ্য করিয়াছি আমার দ্বারা যা সৃজন হইয়াছে।

অশ্রু দিয়া তোমায় বিদায়-সম্ভাষণ জানাইয়াছি
রণাঙ্গন যখনই ডাকিয়াছে তোমায়
তুমি তো বিজয়ী; তুমি আর কী ফিরিয়া আসিবে
পরাজিত হইয়া আসিলেও অন্তর হইতে সরাই নাই তোমাকে।
তুমি জীবনের বিনিময়ে সম্ভ্রম বিক্রয় করিয়াছো
তবুও আমরা মানিয়া লইয়াছি তোমাকে।

বক্ষ-ছিন্ন বাংলাও তো আপনই ছিলো
যাহার শোণিতধারায় মুখ রঞ্জিত করিতে আসিয়াছিলে।
মমতার পবিত্রতা লুণ্ঠন করিতে; নাকি বিদ্রোহ দমন করেতে আসিয়াছিলে?
তাহাদের ভাগ্য কী পরিবর্তন করিতে?
তুমিতো তাহাদের জাত পরিবর্তন করিতে আসিয়াছিলে।

ইহার পরিণাম যাহা হইলো তো হইলো,
রাত্রি গত হইলো; তোমার কল্পনাগুলোও পেরেশান হইলো।
কোন ক্রোধ ও ঔদ্ধত্য নিয়া উপস্থিত হইলে?
কোন লজ্জায় কারাগার অভিমুখী হইলে?
অসি-হস্তে থাবা দিতে সেথায় আসিয়াছিলে
পদবেড়ী ও কণ্ঠে শিকল পড়িয়া ফিরিয়াছিলে।

যেদিন হইতে ব্রিটিশ রাজত্বে গোরখে*
বিদ্রোহীদের ওপর অত্যাচারের প্রথা ছিলো তাহাদেরও।
যেদিন হইতে ভিয়েতনামে নির্দয় গোরে*
সত্য-পূজারীদের উপর অভিযোগ ছিলো তাহাদেরও।
তুমিও আজ তাহাদের চেয়ে ভিন্ন নও
রাইফেল, ওয়ারদি, নাম-ডাক ছিলো তাহাদেরও।

তবুও আমি তোমাদের নির্দোষ বলিয়াছি,
নির্জন শহরকে আরও শান্ত করিবার জন্য।
যদিও আমার কবিতা জখমের পথ্য নহে,
তবুও এক প্রয়াস চিকিৎসার জন্য
আপন প্রত্যাশাহীন মানুষের জন্য।

স্মরণ আছে তোমাদের ওই দিনগুলি
যখন তুমি বন্দিদশা হইতে ফিরিয়া আসিয়াছিলে।
আমরা ভগ্নহৃদয় নিয়া পথে দাঁড়াইয়া
আপন হৃদয় আপন আঁখিতে সাজাইয়া
আপন লাঞ্ছনার তিক্ততা ভুলিয়া
তোমার উপর শ্রদ্ধাপুষ্প বর্ষন করিয়াছিলাম।

যাহাদের চোয়ালে আপনজনের রক্ত লাগিয়েছে
তাহারা জুলুমের সব সীমা পূর্ণ করিতে আসিবে।
বাংলা পতনের পর ‘বোলান’*-এর
নাগরিকদের কণ্ঠ কাটিতে আসিবে।

আজিকে সারহাদ* হইতে পাঞ্জাব ও মেহরান* অবধি
তুমি বদ্ধভূমি সাজাইয়াছো কেন গাজীগণ?
এত লুটপাট কাহার ইঙ্গিতে?
কাহার সম্মুখে নতশিরে গাজীগণ?
ইহা কোন শাহেনশাহের ফরমান?
কাহার জন্য এই সংহার-শোণিতধারা গাজীগণ?

কী সংবাদ ছিলো চামচিকাগণ?
তুমি ভর্ৎসনা রাত্রির আঁধারের
কাল অবধি তুমি রক্ষী ছিলে লুণ্ঠনকারীর সিংহাসনের,
আজও পক্ষপাতিত্ব করিতেছ দরবারীদের।
এক আমিরের পাগড়ির তরে
সবার শাহরগে তরবারির তীক্ষ্ণ ফলা।
তুমি দেখিয়াছো জনগণের কাফেলা
তাহাদের হস্তে বিদ্রোহের পতাকা ছিলো
স্তরের পর স্তর রুধির
বলিতেছে এই দৃশ্য কেয়ামতের।
কাল তোমার জন্য ভালোবাসা যেই বক্ষ মাঝে ছিলো,
এখন সেইখানে যে স্ফুলিঙ্গ জ্বলিতেছে, তাহা ঘৃণার।

এখন তো কবির উপর ঋণ এই মাটির
এখন কলমে কালি নহে রক্ত রহিয়াছে।
উত্তেজিত হইয়াছো তো প্রমাণিত হইয়াছে
পেশাদার খুনি তুমি, সিপাহী নও।
এখন সব বিবেকহীনদের মস্তক চাই
এখন শুধু শাহী তাজের প্রশ্ন নয়।
পেশাদার খুনি তুমি সিপাহী নও।”

*গোরখে= নেপালের অধিবাসী। ভারতবর্ষ শাসন করার জন্য ব্রিটিশরা এদের নিজ সেনাবাহিনীতে যুক্ত করে।
*গোরে= ব্রিটিশ। তবে কবিতায় আমেরিকানদের কথা বলা হয়েছে।
*বোলান= পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের একটি জায়গার নাম। বেলুচিস্তানিরাও বাঙ্গালীদের মতো স্বাধীন দেশ চায়।
*সারহাদ= সুবা-সারহাদ, যার বর্তমান নাম পেশোয়ার।
*মেহরান= পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের একটি স্থানের নাম।

আহমেদ ফারাজ এই কবিতায় তীব্রভাবে পাকিস্তানি আর্মিদের নিন্দা করেছে। কতটা সাহস হলে নিজ দেশে বসে নিজ দেশের আর্মিদের এভাবে তাচ্ছিল্য করা যায়?
তিনি এই কবিতায় আর্মিদেরকে স্মরণ করাচ্ছে কীভাবে তারা বাংলার মানুষদেরকে হত্যা করেছে। কীভাবে রেসকোর্স ময়দানে যুদ্ধবন্দী হয়েছে। কত লজ্জার ব্যাপার এটা! কবি এই আর্মিকে স্মরণ করাচ্ছে, তারা কতটা নীচ ও ঘৃণ্য কাজ করেছে।

আরেকজন কবি আছেন, যিনি আজ এই ১৬ই ডিসেম্বরে ঢাকায় বসে একটি বেদনাময় কবিতা লিখেছিলেন। উনার নাম নাসির তুরাবি।

“সে ভ্রমণসঙ্গী ছিলো, কিন্তু তার সাথে বন্ধুত্ব ছিলো না,
রৌদ্র ছায়ার মতো সম্পর্ক ছিলো, কিন্তু তার সাথে বিচ্ছেদ ছিলো না।

না নিজের কষ্টে, না অন্যের দুঃখে, না তোর বেদনায়,
বিচ্ছেদের রাতও কভু এভাবে কাটাইনি।

মোহাব্বতের সফর কিছুটা এভাবেও কেটেছে,
ক্লান্ত হৃদয় ছিল, কিন্তু মুসাফির ক্লান্ত ছিলো না।

শত্রুতা ছিলো, অবহেলা ছিলো, বুক ভরা কষ্ট ও ছিলো,
যে ছেড়ে চলে গেছে তার মাঝে সবকিছু ছিলো,
কিন্তু বেইমানি ছিল না।

ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় উনার চোখে ছিলো আমার গজল,
গজল যেটা এখনো কাউকে শোনায়নি।

কাকে ডাকতে ছিলো ডুবন্ত ওই সুরুজ,
আওয়াজ তো আসছিলো কিন্তু কোনো প্রার্থনা ছিলো না।

কখনও এমন হালত এসেছে যে, দুই হৃদয় এক ছিলো
কখনো এমন পর্যায় পৌঁছেছে যে, মনে হয় কেউ কাউকে চেনেই না।

অদ্ভুত হয় কবিতার পথ, দেখ ‘নাসির’,
সেখানেও এসে পড়ে যেখানে আসার কোনো পথই নেই।”

নাসির তুরাবি এই দেশকে ভালোবেসে ছিলো। যদিও ছিল উনি পশ্চিম পাকিস্তানের। আসলে মানুষ মানুষকে ভালোবাসে কিন্তু স্বার্থ এসে সেখানে বাধা প্রদান করে।

লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা এই বিজয় অর্জন করেছি। লক্ষ লক্ষ বেদনা গাঁথা এই বিজয়ের পিছনে লুকানো। কত অশ্রু নদী হয়ে বয়ে গেছে। রক্তের দরিয়ায় চেপে এই বিজয় এসেছে। আমরা এই বিজয়কে সদা সর্বদা অক্ষুন্ন রাখবো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top