অক্টোবর, ১৯৫৬ সালের ঘটনা। যখন উপনিবেশবাদী দুটি শক্তি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স, এরা ইসরাইলের সাথে মিলে মিশরে আক্রমণ করে বসে। আর দুনিয়াকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরেকটি নতুন যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। ইতিহাসে এটা ‘সুয়েজ ক্রাইসিস’ বা ‘সুয়েজ সংকট’ বলে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।
কেন এই আক্রমণ করা হলো?
কেন এই যুদ্ধে মিত্রশক্তি পরস্পর বিরোধী হয়ে উঠল?
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার কী ভূমিকা ছিল এটাতে?
আমেরিকা কেন ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের ওপর নারাজ?
মিশরের ওপর ইসরাইল-ফ্রান্স-ইংল্যান্ডের যৌথ হামলা।
মিশরে কেন ইসরাইল হামলা করল?আসুন, জানার চেষ্টা করি প্রো-বাংলায়।
এই ঘটনা জানার আগে জানতে হবে সুয়েজ খালের ইতিহাস। তবেই এটা সহজে বোঝা যাবে। লোহিত সাগরকে ভূমধ্য সাগরের সাথে সংযুক্ত করার এই নৌপথের কথা, আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগের ইতিহাসে পাওয়া যায়। আধুনিক সুয়েজ খালের নির্মাণকার্য শুরু হয় ১৮৫৯ সালে। এটার কৃতিত্ব ফরাসি কূটনৈতিক ‘ফার্দিনান্দ দে লেসপল’ অর্জন করেছে।
সুয়েজ খাল নির্মাণ করতে ১০ বছর সময় লেগেছে। ১২০ মাইল দৈর্ঘ্যের এই নৌপথ ইউরোপ থেকে এশিয়া আগমনের পথকে সংক্ষিপ্ত করেছে।

আগে ইউরোপ থেকে জাহাজ আটলান্টিক মহাসাগর বেয়ে আফ্রিকা মহাদেশ প্রদক্ষিণ করে এশিয়ায় আসতো। সময় লাগতো ৮ থেকে ১০ দিন। কিন্তু এখন আরব সাগর থেকে লন্ডন এর নৌপথ ৫৫০০ মাইল কমে এসেছে। এখন ভূমধ্যসাগর হয়ে সুয়েজ খাল পাড়ি দিয়ে অল্প সময়েই লোহিত সাগরে আসা যায়। লৌহিত সাগর থেকে পুরো এশিয়া চষে বেড়াচ্ছে বাণিজ্যিক জাহাজগুলো। এখন সময় ও দূরত্ব দুটোই কমেছে। সেই সাথে কমেছে পরিবহন ব্যয়।
এই খাল একটি বেসরকারি মালিকানায় ছিল। কোম্পানির নাম “সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি”। এটার বেশিরভাগ শেয়ার মিশর ও ফ্রান্সের কাছে ছিল। এটা নির্মাণের সময় মিশরের বাদশাহের সাথে একটি চুক্তি হয়। চুক্তি মোতাবেক এটা ৯৯ বছর পর্যন্ত ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এরপর তা মিশরের মালিকানায় দিয়ে দেওয়া হবে।
১৮৬৯ সালের ১৭ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে নৌযান চলাচলের জন্য এটা খুলে দেওয়া হয়। ১৮৭৫ সালে মিশরের বাদশা ‘ইসমাইল পাশা’ ঋণ মেটানোর জন্য সুয়েজ খালের মিশরীয় শেয়ার ব্রিটিশদের কাছে বিক্রি করে দেয়। যেটা ছিল সুয়েজ খালের মালিকানার ৪৪ শতাংশ। এভাবেই সুয়েজ খালের ওপর থেকে মিশর তার সম্পূর্ণ অধিকার হারিয়ে ফেলে।
এখানে একটি মজার বিষয় হলো, ব্রিটিশরা তাদের স্বার্থের জন্য সুয়েজ খাল নির্মাণের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু এটা নির্মাণের পর তাদের বেশিরভাগ বাণিজ্যিক জাহাজ এই পথ দিয়েই যেতে শুরু করে। তারা এটার মালিকানাও পেতে চাইতো। অতঃপর সেই সুযোগ পেয়ে যায় ১৮৭৫ সালে শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে।
১৮৮২ সালে মিশর তার স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে। ব্রিটিশরা মিশরকে উপনিবেশে পরিণত করে এবং সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ ইংল্যান্ডের কাছে চলে যায়।
ভবিষ্যতের দিনগুলোতে এই খাল নিয়ে সমস্যা এড়াতে ১৮৮৮ সালে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তি অনুসারে এটাকে নিরপেক্ষ অঞ্চল ঘোষণা করা হয় এবং সকল দেশকে এটা ব্যবহারের অধিকার দেওয়া হয়।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেহেতু মিশর ব্রিটিশদের উপনিবেশ, তাই তারা এই খালের মাধ্যমে খুব ফায়দা লুটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সে শুধু মিত্রবাহিনীর জাহাজগুলোকেই এই খাল ব্যবহার করতে দিত। যা চুক্তির বিরুদ্ধাচরণ।
১৯২২ সালে মিশর ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু ব্রিটিশদের প্রভাব মিশরে তখনো সম্পূর্ণ শেষ হয়নি। স্বাধীন হওয়ার পরও মিশরে ব্রিটিশ ফৌজ মোতায়েন থাকে। এই ব্যাপারটি নিয়ে মিশরীয় জনগণ ও সরকার খুব ক্ষিপ্ত ছিল। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৩৬ সালে মিশর ও ইংল্যান্ডের মাঝে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যেটাকে “অ্যাংলো-ইজিপশিয়ান ট্রিটি” বলে। চুক্তিতে বলা হয়, শুধুমাত্র সুয়েজ খালের নিরাপত্তার জন্য ব্রিটিশ ফৌজ থাকতে পারবে। বাকি যত সৈন্য আছে তা বিশ বছরের মধ্যে মিশর থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
১৯৫২ সালে মিশরে এক বিপ্লব শুরু হয়। এই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিচ্ছিল জামাল আব্দুল নাসের। ১৯৫৪ সালে সে মিশরের প্রধানমন্ত্রী হয়। তিনি মিশরে বিদেশী শক্তিদের নাক গলানোর কট্টর বিরোধী ছিলেন। তিনি জনগণের কাছে ওয়াদা করেছিলেন যে, মিশরকে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত করবেন। এরই সাথে তিনি নীল নদে “আসওয়ান ড্যাম” তৈরি করার প্রতীজ্ঞা করেন।
সেই সময় মিশর ও ইসরাইলের সম্পর্ক খারাপ ছিল। মিশর ‘তিরান প্রণালী’ দিয়ে ইজরাইলি জাহাজ যাতায়াত নিষেধ করে দেয়। এই অবস্থায় মিশর আমেরিকার কাছে অস্ত্র সাহায্য চায়। কিন্তু আমেরিকা তো ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাই আমেরিকায় এমন কোনো হাতিয়ার দেবে না যা ইসরাইলের জন্য হুমকি। অবশ্য আমেরিকা নীল নদে ‘আসওয়ান ড্যাম’ তৈরির জন্য ঋণ দিতে রাজি ছিল। এমনকি ইংল্যান্ডও ঋণ দিতে চেয়েছে।
অস্ত্র না দেওয়ায় জামাল আব্দুল নাসের আমেরিকার উপর নারাজ হয়ে যায়। তাই সে যুগোস্লাভিয়া থেকে আধুনিক অস্ত্রের চুক্তি করে ফেলে। যুগোস্লাভিয়া যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র ছিল, তাই আমেরিকা ও বন্ধু রাষ্ট্র ইংল্যান্ড ঋণ দিতে অস্বীকার করে। এই অবস্থায় জামাল আব্দুল নাসেরের কাছে কোনো উপায় ছিল না। ড্যাম তৈরি করাটাও খুব প্রয়োজন। তাই তিনি ১৯৫৬ সালের ২৬ জুলাই সুয়েজ খালকে জাতীয়করণ করার ঘোষণা দেয় এবং এটা থেকে যা মুনাফা হবে তা ড্যাম তৈরিতে ব্যবহার করবে বলে জানায়।
মিশরের জন্য এটা খুবই ভয়ংকর ও শক্তিশালী পদক্ষেপ ছিল। এটার তো কিছু না কিছু প্রতিক্রিয়া হওয়ার ছিলই। মিশরের এই সিদ্ধান্তের ফলে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের ঘুম হারাম হয়ে যায়। কেননা এই দুই দেশের কাছেই সুয়েজ খালের শেয়ার। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল এই নৌপথ দিয়েই ইউরোপে পৌঁছাতো এবং ইউরোপের কলকারখানা চলতো। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের তো এখন চালিকাশক্তি বন্ধ হওয়ার উপায় হয়েছে। এই জীবন মরণের প্রশ্নে কোনো আপোষ নয়। তাই ইংল্যান্ড জামাল আব্দুল নাসিরকে ক্ষমতাচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নিল এবং সেই সিদ্ধান্তে ফ্রান্সের পূর্ণ সমর্থন ছিল।
ইংল্যান্ড দ্রুত এই সমস্যার নিষ্পত্তি চায়। তাই লন্ডনে একটি কনফারেন্স করে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ আন্তর্জাতিক শক্তির হাতেই থাকবে। কিন্তু কনফারেন্সে আমেরিকা যেকোনো প্রকার হামলার তীব্র বিরোধিতা করেছিল। তখন আমেরিকার সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। তাই আমেরিকা চায়নি এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে, যেটা আরবদের আমেরিকা বিমুখী করে দেবে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সেটার সুযোগ নেবে।
ইংল্যান্ড আমেরিকার কোনো তোয়াক্কা না করেই গোপনে প্যারিসে ফ্রান্স ও ইসরাইলের সাথে একটি খসড়া চুক্তি স্বাক্ষর করে। এটাকে চুক্তি বলার চেয়ে ষড়যন্ত্র বলাই ভালো। সেই চুক্তিতে বলা ছিল যে, ইসরাইল আগে মিশর হামলা করবে। এরপর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স এরা মিশর ও ইসরাইলি সৈন্যকে সরে যাবার আল্টিমেটাম দেবে। এই আল্টিমেটাম অবশ্যই মিশর মানবে না। তখনই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স সুযোগ পাবে সুয়েজ খাল রক্ষার অজুহাতে হামলা করার। এটাই ছিল জামাল আব্দুল নাসেরকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র।
১৯৫৬ সালের ২৯ অক্টোবর মিশরের সিনাই উপদ্বীপে ইসরাইল আক্রমণ করে বসে এবং দ্রুত সেখানকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। পরিকল্পনা অনুসারে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স দুই দেশই মিশর ও ইসরাইলকে সৈন্য সরাতে আল্টিমেটাম জারি করে। মিশর তার সৈন্য সারাতে অস্বীকৃতি জানায়। সেই সুযোগে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ইসরাইলের আক্রমণের দুইদিন পর অর্থাৎ ৩১ অক্টোবর দুই দেশই মিশরের ওপর হামলা করে বসে। তারা সাইদ বন্দর ও ফুয়াদ বন্দর দখলে নিয়ে নেয়।
আরো পড়ুন: রাশিয়ার বৃহৎ অংশ কিনেছে আমেরিকা!
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার ভূমিকা
হামলার পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এই অগ্রাসনের বিরুদ্ধে সমর্থন আদায়ের প্রস্তাব পেশ করা হয়। যেটাতে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড ভেটো প্রদান করে।
এই কর্মকাণ্ডগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড যদি আক্রমণ করা বন্ধ না করে, তবে এই দুই দেশের উপর হামলা করবে এমন হুমকিও দিয়ে বসে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
নিষেধাজ্ঞা সত্বেও আক্রমণ করাতে আমেরিকা খুব অসন্তুষ্ট ছিল। তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ‘ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার’ ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও ইসরাইলের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করবে বলে হুমকি দেয়, যদি না তারা মিশরের ওপর হামলা থামায়।
আমেরিকার হুমকি অবশেষে কাজ করল। ৬ নভেম্বর ইংল্যান্ড ‘সিজফায়ার’ বা ‘যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণা করলো। এরপর ডিসেম্বরের মধ্যেই ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের সৈন্য সরিয়ে ফেলা হয়। মার্চ পর্যন্ত ইসরাইলের সৈন্য থাকার পর তারাও সরে আসে। যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণের জন্য শান্তিরক্ষী বাহিনীর একটি দল মিশরে আগমন করে।
যুদ্ধের ফলাফল
বাহ্যিকভাবে দেখলে দেখা যাবে মিশরের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সঠিক তথ্য তো পাওয়া যায়নি, তবে অনুমান করা হয় এক থেকে তিন হাজার মিশরীয় সৈন্য নিহত হয়েছে এবং চার হাজার আহত হয়েছে। প্রায় এক হাজার বেসামরিক মিশরীয় নিহত হয়।
অপরদিকে ইসরাইল, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মোট নিহতের সংখ্যা মিশরের তুলনায় অনেক কম।
এত কিছুর পরেও মিশর এই যুদ্ধে জয়ী। কেননা এই সুয়েজ খালের মালিকানা চুক্তি মোতাবেক ১৯৬৮ সালে পাওয়ার কথা। মিশর সেটা ১৯৫৬ সালেই পেয়ে যায়। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড এই যুদ্ধে কিছুই লাভ করতে পারেনি। কিন্তু ইসরাইল তিরান প্রণালী ব্যবহারের অনুমতি পেয়ে যায়।
আরবরা একজন বীরের দৃষ্টিতে জামাল আব্দুল নাসেরকে দেখতে শুরু করল।
এই ঘটনা এইজন্য স্মরণীয় যে, ব্রিটিশরা বুঝতে পেরেছিল এখন থেকে তারা আর পরাশক্তি নয়। এখন আমেরিকা বিশ্বের পরাশক্তি।
খুব সুন্দরভাবে ইতিহাসকে তুলে ধরা হয়েছে। অল্প কথার গল্পগুলো পড়তে ভাল লাগে। ধন্যবাদ আপনাকে।
ধন্যবাদ