ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা। ৫০টি অঙ্গরাজ্য নিয়ে গঠিত একটি ফেডারেশন বা সঙ্ঘ। এর প্রতিটি রাজ্য স্বাধীনভাবে আইন প্রণয়ন করতে পারে। তাদের সংবিধান একে অন্যের থেকে ভিন্ন। প্রতিটা রাজ্যের রয়েছে আলাদা আলাদা পতাকা। আমেরিকার পতাকায় যে পঞ্চাশটি নক্ষত্র খচিত আছে। তা এই পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করে। আমেরিকান পতাকায় সাতটি লাল ও ছয়টি সাদা রেখা আছে। এগুলো ওই ১৩-টি রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করে, যেগুলো ১৭৭৬ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করেছিল। English Version
আমরা যদি আমেরিকার নকশা দেখি তবে দেখতে পাবো, কানাডার দক্ষিণে আমেরিকার বৃহৎ অংশ অর্থাৎ ৪৮ টি রাজ্য অবস্থিত। এগুলো ছাড়াও আরো কিছু অঞ্চল আছে যেগুলোকে রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়নি। কিন্তু দুইটি রাজ্য এমন আছে যেটা আমেরিকার মূল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন। এর মধ্যে একটি হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ। যেটা আমেরিকার মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে আর্কটিক মহাসাগরে অবস্থিত। এটাকে ১৯৫৯ সালে রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়।
আরেকটি রাজ্য আছে যা কানাডার পশ্চিমে অবস্থিত এবং এটা আমেরিকার সবচেয়ে বড় রাজ্য। এটা ১৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল অঞ্চল। ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত এটা রাশিয়ার অংশ ছিল। কিন্তু ১৮৬৭ সালে রাশিয়া এই জমিন ৭.২ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দেয়। সেই হিসাবে তৎকালে এটার প্রতি বর্গ কিলোমিটার মাত্র দুই সেন্টে বিক্রি হয়েছিল। যা আজকের হিসাবে মাত্র ৩৫ সেন্ট হবে প্রায়। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রায় ৩৫ টাকায় ১ বর্গ কিলোমিটার।
রাশিয়া কি এতই বোকা ছিল যে, এত সস্তায় এটা বিক্রি করল?
রাশিয়া কেন এমনটা করেছিল তার তিনটি কারণ
প্রথমত, আলাস্কা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর হওয়া সত্ত্বেও এটি ছিল দুর্গম ও বরফে ঢাকা অঞ্চল। এর বেশিরভাগ স্থান সর্বদা বরফে ঢাকা থাকে বিধায় ফসল আবাদ করা যেত না। রাশিয়ার সৈন্য সংখ্যা কম হওয়ার ফলে এটার দখল জারি রাখা কঠিন ছিল। এই বৃহৎ অঞ্চলে সর্বসাকুল্যে মাত্র আড়াই হাজার রুশ ফৌজ মোতায়েন ছিল। স্থানীয় জনসংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ হাজার। যাদেরকে রাশিয়া শক্তির জোরে অনুগত করে রেখেছিল। রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড সাইবেরিয়াও এমন বরফে ঢাকা। সেখানেও ফসল আবাদ ও আবাসন খুবই কঠিন ছিল এবং এখনো আছে।
আরো পড়ুন: ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল ২০২২ ও বিশ্বকাপের ইতিহাস
দ্বিতীয়ত, ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত চলে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ। রাশিয়া এই যুদ্ধে ওসমানী খেলাফত ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছিল। এই যুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হয়। পরাজয়ের ফলে রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ পর্যায়ে পৌঁছায় এবং রাশিয়া ঋণের জালে ফেসে যায়। তৎকালীন রাশিয়ান জার আলেকজান্ডার দ্বিতীয় এর আশঙ্কা ছিল ব্রিটিশরা আবার আলাস্কাতে হামলা করে বসে কি না! যদি এমনটা করে, তবে রাশিয়া সেটা প্রতিরোধ করার অবস্থায় নেই।
তৃতীয়ত, আলাস্কার নিয়ন্ত্রণ করা রাশিয়ার জন্য খুবই ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য ছিল। রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে সাইবেরিয়ার হাজার মাইল বরফাচ্ছন্ন বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে আলাস্কায় অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ অনেক সময় সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। এছাড়া আলাস্কাতেও তেমন কোনো শস্য উৎপাদন হতো না। সেখানকার বন্যপ্রাণী ও সামুদ্রিক জীব শিকার করা ছাড়া আর কোনো খাদ্যের ব্যবস্থা ছিল না। সকল কিছু বিবেচনা করে রাশিয়া এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালো যে, এটা ব্রিটিশদের হাতে চলে যাওয়ার চেয়ে আমেরিকার কাছে বিক্রি করাটাই লাভজনক। এতে করে আমেরিকার সাথেও সম্পর্ক ভালো হবে। কেননা ওই সময় আমেরিকা ও ব্রিটিশদের মধ্যে সম্পর্ক এখনকার মতো এতো মধুর ছিল না। কারণ আমেরিকা ব্রিটিশদের কাছ থেকে লড়াই করে স্বাধীন হয়েছে।
এখন মনের মাঝে একটি প্রশ্ন উদয় হতে পারে। আলাস্কা তো কানাডার সীমান্তঘেঁষা এবং এটা আমেরিকা থেকে বিচ্ছিন্ন। তবে কেন রাশিয়া এটা কানাডার কাছে বিক্রি করল না? কিংবা কানাডা কেন এটা কিনলো না?
এর কারণ ওই সময় কানাডা কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল না। এটা ব্রিটিশদের উপনিবেশ ছিল। আর রাশিয়া তো কখনোই চাইত না আলাস্কা ব্রিটিশদের হাতে পড়ুক। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কর্তৃক আলাস্কা ছিনিয়ে নেওয়ার আগেই রাশিয়া সেটা বিক্রি করে দেওয়া ভালো মনে করলো।
যখন এটা আমেরিকা কিনেছিল তখন আমেরিকার নাগরিকগণ এতটা খুশি ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে এই ক্রয় খুবই লাভজনক প্রমাণিত হয়। এত সস্তায় বিক্রি করাতে রাশিয়ান জনগণও বেজার ছিল। কিন্তু তারা আর কী করবে জারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে?
কেনার পর আমেরিকা এটাকে সামরিক অঞ্চলে পরিণত করে। এর ফলে সেখানে থাকা যে অল্প সংখ্যক রাশিয়ানরা ছিল, তারা রাশিয়ায় চলে যায়।
আমেরিকা এই জমিন বাৎসরিক পঞ্চাশ হাজার ডলারে লিজ দিয়ে দেয় এবং সেখানকার প্রতিটি সীল মাছের চামড়া রপ্তানির জন্য ২.৬২ ডলার রাজস্ব ধার্য করে। পরবর্তী সময়ে এই জমিনে বিভিন্ন খনিজ ধাতু যেমন: সোনা, তামা, জিংক, প্লাটিনাম এবং তেলের খনি আবিষ্কার হয়। যেগুলো বিক্রি করে কোটি কোটি ডলার কামিয়েছে আমেরিকা। বলা হয়ে থাকে এটা কেনার ৫০ বছরের মধ্যে আমেরিকা ক্রয় মূল্যের শতগুণ মুনাফা লাভ করে।
রাশিয়ানরা হয়তো এখন আফসোস করছে এটা কেন বিক্রি করল। কিন্তু এখন তো ধৈর্য ধরা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
আর্কটিক মহাসাগর দিয়ে খুব সহজেই এশিয়ার সাথে আলাস্কা বাণিজ্যিক জাহাজ পরিচালনা করতে পারে। যদিও এই মহাসমুদ্র বরফাচ্ছন্ন। কিন্তু বৈষ্ণিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য খুব দ্রুত সে বরফ গলে যাচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে আর্কটিক মহাসাগরের আধিপত্য নিয়ে রুশ, চীন ও আমেরিকার মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধ শুরু হবে।
আলাস্কার আদিবাসী
আজও আলাস্কার আদিবাসীরা ক্ষুব্ধ। তাদের দাবি হচ্ছে, এই জমিন তো তাদের ছিল। আমেরিকা কীভাবে এটা রাশিয়া থেকে কিনলো? রাশিয়া তো জবরদস্তি এটা করায়ত্ত করেছিল। রুশ তো এটার মালিক না।
আমেরিকানরা আলাস্কা ক্রয় করার পর এখানকার আদিবাসীদের উপর চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করতে শুরু করে। নিতান্ত কম মজুরিতে তাদের শ্রম কিনে নেয়। তাদেরকে শিক্ষা হতে বঞ্চিত রাখে। আদিবাসী কোনো সন্তান আমেরিকানদের স্কুলে পড়তে পারতো না। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে কটাক্ষ করা হতো।
আমেরিকা তো আলাস্কার আদিবাসীদের নাগরিকই মানতো না। অতঃপর ১৯১২ সালে গঠিত হয় ‘আলাস্কা নেটিভ ব্রাদারহুড’। এটার তীব্র আন্দোলনের চাপে আমেরিকার সরকার বাধ্য হয় এবং ১৯২৪ সালে তাদেরকে আমেরিকার নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।
১৯৫৯ সালের ৩ জানুয়ারি আলাস্কাকে রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়। মানব বসতি স্থাপনের জন্য আলাস্কা অতটা সুবিধাজনক স্থান নয়। তাইতো এত বড় অঞ্চলে মোট জনসংখ্যা মাত্র ৭ লক্ষ ৪০ হাজার। এর মধ্যে আদিবাসী সংখ্যা মাত্র এক লক্ষ বিশ হাজার।
আমেরিকা এখন পর্যন্ত এটা থেকে মুনাফা অর্জন করছে। ভবিষ্যতে আরও অধিক অর্জনের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু যাদের জমি ছিল এটা, তাদের আর্তনাদ দুই সাম্রাজ্যের বাণিজ্যের শোরগোলে চাপা পড়ে গেছে।