সিলেটি প্রবাদ বাক্য

সিলেটের প্রবাদ বাক্য (সিলেট আঞ্চলিক ভাষার কিছু প্রবাদ প্রবচন)

লোকসাহিত্যের প্রাণই হচ্ছে প্রবাদ-প্রবচন। বিশেষ উক্তি বা সুন্দর সুন্দর কথাকেই প্রবাদ বাক্য বলা হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি ভাষার মত সিলেটি ভাষায়ও অনেক প্রবাদ বাক্য রয়েছে। সেগুলো একত্রে সিলেট অঞ্চলে সিল্লক, ডাকের কথা, উচিত কথা নামে পরিচিত। নিম্নে প্রায় সময় ব্যবহৃত কয়েকটি সিলেটি প্রবাদ-প্রবচন তুলে ধরা হলো।

সিলেটের প্রবাদ বাক্য

  • ১। । বোঢ়ায়-ধুঢ়ায় রাজ্য পাইলা, কালসর্প বিওড়ে গেলা। ভাবার্থঃ- অযোগ্য লোকের শাসন।
  • ২। । ছালিয়ে লেট-পেট দুইকান কাটা, ত্রিভুবন দেখাইলেরে তুই চিলাবেটা। ভাবার্থঃ- কষ্টসাধ্য কাজ।
  • ৩। জলদি কাম(কাজ) শয়তানী, আস্তে কাম(কাজ) রহমানী। ভাবার্থঃ- ধীরে-সুস্থে কাজ করা বাঞ্ছনীয়।
  • ৪। চুরে চুরে আলি, এক চুরে বিয়া করলা আরেক চুরর হালি। ভাবার্থঃ- চোরে-চোরে মাসতুতো ভাই।
  • ৫। । বাপে নায় গুতে, চুঙ্গা ভরি মুতে। ভাবার্থঃ- আতিসাজ্য।
  • ৬। । খাওরা আছইন কররা নাই, বুড়ি মরলে কানরা নাই। ভাবার্থঃ- সুসময়ের বন্ধু (দুধের মাছি)।
  • ৭। জোয়ানোর জোয়ানকি, আর বুড়ার এক ধামকি। ভাবার্থঃ- অভিজ্ঞতা সব জায়গায়ই কাজে লাগে।
  • ৮। চেমা ইমানদার থাকি, খাড়া বেইমান বালা। ” ভাবার্থঃ- স্পষ্টভাষী শত্রু, নির্বাক মিত্র অপেক্ষা শ্রেয়।
  • ৯। দুই নাওয়ে চড়ে যে, উপোইত হইয়া মরে সে। ভাবার্থঃ- এক সাথে দুই কাজ কখনো ঠিক ভাবে হয় না।
  • ১০। ঘাট পার হইলেও, খেওয়ানি হালা। ভাবার্থঃ- Selfish।
  • ১১। । হুটকির ভাড়ারও, বিলাই চকিদার। ভাবার্থঃ- যে রক্ষক সেই ভক্ষক।
  • ১২। যে যারে নিন্দে, হে তার পিন্দে। ভাবার্থঃ- অকৃতজ্ঞ।
  • ১৩। আধ মন তেলো হইতো নায়, আর রাধার নাছও হইতো নায়। ভাবার্থঃ- অনিচ্ছা।
  • ১৪। চুন চুন চুনের ঘটি, রাইত পোহাইলে উজান-ভাটি। ভাবার্থঃ- অস্থায়ী।
  • ১৫। যার হাতো হয় না, তার হাতাইশোও হয় না। ভাবার্থঃ- সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়।
  • ১৬ । আইছেরে ভাই কলি কাল, ছাগিয়ে চাটে বাঘর গাল। ভাবার্থঃ- অসামঞ্জস্য ।
  • ১৭। ক) বাপে বেটা -গাছে গোটা, মায় ঝি-গাইয়ে ঘি। । খ) আগর হাল যেবায় যায়, পরর হালও অবায় যায়। ভাবার্থঃ- ছেলে-মেয়েরা সাধারনত পিতা-মাতা কে অনুসরণ করে।
  • ১৮। আদেখায় দেখলা, পুটিমাছে লেখলা। ভাবার্থঃ- সাধারন কাজ করে অনেক বেশি গর্ববোধ করা।
  • ১৯। ক) হারা রাইত কানভরি হুনলো বেটায় পুঁথি, বিয়ানে উঠি জিগায়, সোনাভান বেটা না বেটি
  • খ) সাত খণ্ড রামায়ণ পড়ি কয়, সীতা কার বাপ। ভাবার্থঃ- আদ্যোপান্ত সবকিছু জানার পরও না জানার ভান করা।
  • ২০। ক) যম, জামাই, ভাইগ্না তিন নয় আপনা। খ) ভাইগ্না কুটুম নিমকহারাম। গ) মামার বাড়িত ভাইগ্না বইতল। ভাবার্থঃ- বিশ্বাসের অভাব।
  • ২১। পাইয়া পরার ধন, বাপে পুতে করে কীর্তন। । ভাবার্থঃ- পরের ধনে পোদ্দারি।
  • ২২। চোররে কয় চুরি করিস, গিরস্তরে কয় হজাগ থাকিস। ভাবার্থঃ- দুমুখো সাপ।
  • ২৩। ক) হক মাতো আহম্মক বেজার, গরম ভাতও বিলাই বেজার। । খ) উচিত মাতো ভাত নাই, রাস্তাবায় পথ নাই। ।
  • ভাবার্থঃ- রুঢ় সত্য সব সময় তিক্তই হয়।
  • ২৪। বালা মাইনশে চড় খায়, গাল হাতইয়া বাড়িত যায়। ভাবার্থঃ- এই ভবে ভালো মানুষের গুরুত্ব একটু কমই।
  • ২৫। চুরোর মাউগর বড় গলা, আরও মাংগইন দুধ আর কলা। ভাবার্থঃ- চোরের মার বড় গলা।

আরও কিছু সিলেটি প্রবাদ

  1. ভালা মাইন্সর (ভদ্রলোকের) জুতা বইও (বহন করিও), কমিন্দর (দুর্জনের) পাগড়ীও না। – দুর্জনের সংস্রব পরিত্যাজ্য
  2. আল্ (হাল) নাই বেটায় ভুঁই জুড়ে, দাঁত নাই বেটিয়ে হুকইন। (শুটকি) পুড়ে। – যে যেটার জন্য উপযুক্ত নয়, সে সেটার জন্য অনাবশ্যক চেষ্টা করে থাকে
  3. ধরা বান্ধার হাই (জোর-জবরদস্তি করে বরের অমতে বিয়ে), রাইত পোয়াইতে নাই – জোর-জবরদস্তি করে কাউকে কোন কাজ করাতে গেলে বিপত্তি ঘটে
  4. নিজর কাপ্ড়ে (শাড়ীতে) হেঙ্গা বওয়া (বিয়ে করা) – অতি আগ্রহী হয়ে যেচে গিয়ে অযাচিতভাবে কোন কিছুতে নিজেকে জড়ানো
  5. ফেন্ (ভাতের মাড়) দিয়া ভাত খাইয়া , গপ্ মারে দই – আত্মতুষ্টি সাধনে অতিরঞ্জিতভাবে নিজেকে উপস্থাপনের প্রয়াস
  6. চোরে চোরে আলি (বন্ধুত্ব), এক চোরে বিয়া করইন্ আরক্ চোরর্ হালি (শালিকা) – চোরে চোরে মাসতুতো ভাই
  7. ভাত খাও হাইঅর (স্বামীর), আর ক্কাউয়া (কাক) ডাকাও লাঙ্গরর – আপন-জনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে আপনজনকে
  8. অবজ্ঞা করে অপরজনের তুষ্টি সাধনে সদা তৎপর চেঙ্গও (টাকি মাছ) উজাইন, বেঙ্গও (ব্যাঙ) উজাইন, খইয়া (খলসা) পুঁটি তাইনও উজাইন – যোগ্যজনের সঙ্গে অযোগ্যজন তাল দিয়ে আষ্ফালন করা
  9. ছাগিয়ে চেনাইতে (মুত্র ত্যাগের সময়) ধরইন্ না, পরে তিন বন্দ (মাঠ) দৌড়াইন – উপযুক্ত সময়ে কর্ম তৎপর না হলে অসময়ে কর্মতৎপর হলে বেশ বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়
  10. দা’র বালি, কুড়ালর হিল (শিল), বান্দীর লাত, গোলামর কিল – অধ:স্তনদের যুৎসই শাসনে রাখার দরকার আছে
  11. চোরের মা’র বড় গলা, আর মাগে দুধ আর কলা – অপরাধীর পক্ষ নিয়ে গলাবাজি করে অপরাধ ধামাচাপা দেয়ার প্রয়াস
  12. চরে (দ্বারে দ্বারে ঘোরে) ফকির মরে না – অলসভাবে বসে না থেকে পরিশ্রম করলে সুফল পাওয়া যায়
  13. মাউগোর (স্ত্রীর) কথা চলবায়, আগন (অগ্রহায়ন) মাসে হকি (ফকির) অইবায় – স্ত্রীর কু পরামর্শে চললে কপালে দু:খ আছে
  14. কার গরু, কে ধুমা (ধোয়া) দেয় – নির্ধারিত দায়িত্ব ছাড়া কেউ কাজ করতে চায় না)
  15. বাড়ি কান্দার (নিকটের) কুত্তায়ও বেউকায় (ঘেউ ঘেউ করে) – নিজ বাসস্থানে থেকে নিজেকে শক্তিশালী ভেবে হম্বি দম্বি করা
  16. তোরও বালি, মোরও বালি -উভয়ের জন্য সম অবস্থা বিরাজমান অর্থাৎ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ।
  17. খালি দোয়ায় পোয়া (পুত্র সন্তান) অয়না, তনাইর (শরীরের) জোরও লাগে -দোয়ার সাথে চেষ্টা তদবির ও পরিশ্রম প্রয়োজন ।
  18. হুরু (ছোট) পোয়া, বড় পোয়ার বাপ -ইচঁড়ে পাকা।
  19. আগিয়া হছইননা (মল ত্যাগ করে পানি দিয়ে পরিষ্কার না করে), পাদিয়া (বায়ূ ত্যাগ করে) যাইনগি গলা পানিত্ -অত্যাবশ্যক কাজে তৎপর না হয়ে অপ্রয়োজনীয় কাজে অতিতৎপর হওয়া।
  20. মাতিলে মাত্রা (বাঁচাল) না মাতিলে আবরা (বোবা) -কথা বললে বাঁচাল, আবার না বললে বোবা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
  21. নয়া যোগী তাতো (আসনে) উঠ্ছইন -ক্ষুদ্র অবস্থান থেকে হঠাৎ করে বৃহ্ত্তর অবস্থানে এসে অহংকারভরে আষ্ফালন করা।
  22. দশ্র মুখো হাখরাইদ্ (সংক্রান্তি) -দশ চক্রে ভগবানভূত ।
  23. ঘাইল (ধান ভানার কাঠের তৈরী জিনিস) আন্মান্ (উপযুক্ত) ছিয়া (ধান ভানার জন্য কাঠের তৈরী শক্ত দন্ড যার অগ্রভাগে লোহার রিং থাকে ), জাতে জাতে বিয়া -সমগোত্রের মধ্যে সম্মিলন।
  24. ঘরো নাই ঘটি লোটা, কোম্রো বান্ধা চাবির ঝুটা -অপ্রয়োজনীয় জিনিস প্রদর্শন করে অহমিকা প্রকাশ।
  25. কুত্তায় বাচ্চা করে, হিয়ালর (শিয়ালের) পেট ভরে -একজনের পরিশ্রমের ফসল অন্যজন ভোগ করে।
  26. হম্কে (সামনাসামনি) পড়লে ভাইভাই, আফরকে (অগোচরে) হালা (গালি অর্থে) -সামনা-সামনি দেখা হলে যেন বন্ধু, পরোক্ষে কিন্তু শত্রু।
  27. কার গরু, কে ধুমা (ধোঁয়া) দেয় -নির্ধারিত দায়িত্ব ছাড়া কেউ কাজ করতে চায় না
  28. আউওয়া (বোকা) চাড়াল (চন্ডাল) ভুকাডুম, হারা রাইতে (সারা রাতে) এক ঘুম -দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যক্তি
  29. আতো (হাতে) বৈটা, ঘাটো নাও -শেষ বিদায়ের জন্য প্রস্তুত।
  30. হইয়ে (শেষ পর্যন্ত) আইলায়, বুনাইরে (ভগ্নিপতি) আরাইয়া (হারায়ে) -অসময়ে শেষ পর্যন্ত প্রত্যাবর্তন।
  31. মাইনষ্র কুটুম আওয়া-যাওয়ার মাধ্যমে সম্পর্ক গভীর ও দৃঢ়তর হয় । -পারস্পরিক আসা-যাওয়ার মাধ্যমে সম্পর্ক গভীর ও দৃঢ়তর হয়।
  32. কম আক্লে (বুদ্ধিতে) তরে (পার পেয়ে যায়), বেশী আক্লে মরে -অতি চালাকের গলায় দড়ি ।
  33. যার লগে (সঙে) যার মজে মন, বিট্ (বিষ্টা) অইলেও চন্দন -প্রেম অন্ধ ।
  34. যার বিয়া তার খবর নাই, আরি পরির (পাড়া প্রতিবেশীর) ঘুম নাই -যার কাজ সে কিন্তু নির্বিকার, অন্যদের তাগিদ বেশী।
  35. ইজ্জত যায় না ধুইলে, খাইসলত্ (অভ্যাস) যায় না মইলে (মরলে) -কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না ।
  36. ঈদর চান (চাঁদ) না মক্কার তেতই (তেতুল), অতদিন আছলায় কই -বহুদিন পরে দেখা হলে মনের অভিব্যক্তির প্রকাশ ভঙ্গি ।
  37. অমৃতর মা’র মুখখানি মিটা, হারা দিন (সারাদিন) কাম করাইয়া দেয় আধখানি (অর্ধেক) পিঠা -মিষ্টি কথায় কাজ করায়ে ন্যায্য পারিশ্রমিক না দেয়া।
  38. উচার উচ্, নীচর নিচ্, মা দেখি ঝি (কনে) আনিছ -ভাল বংশের মেয়ে বিয়ে করা উত্তম।
  39. আতুর বিবি চতুর অইলা, ব লার (বোলতার) কামড় খাইয়া -বিপদে পড়লে অলসও পরিশ্রমী হতে বাধ্য।
  40. লউ (রক্ত) কাটলে দু’ফাঁক (ছিন্ন) অয়্ না -রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না ।
  41. উদান (সকাল) মাদান (মধ্যাহ্ন) বাছিয়া, কাম কর নাছিয়া -সময় বুঝে সঠিক কাজ করা।
  42. উরাত (উরু) দেখাইয়া বরমপুত্র (ব্রহ্মপুত্র নদ ) পার -প্রলোভন দেখায়ে কাজ উদ্ধার।
  43. মাইর (মায়ের) ঘরে থাকা, আর হাইরর (স্বামীর) ঘর করা এক না -স্বামীর সংসারে একজন রমণীকে বিভিন্ন ধরণের পরিস্থিতির মোকাবেল করে নিজেকে খাপ-খাইয়ে নিতে হয়।
  44. হাজ্মা পুয়ার (সদ্যজান সন্তানের) মাথায় ভরন (গাছ গাছড়ার পাতা দিয়ে তৈরী ঔষধের প্রলেপ) দেওয়া বালা নায় -তাড়াহুড়া করে সব কিছু বিবেচনা না করে দ্রুত প্রাপ্তির নিমিত্তে কাজ করলে প্রাপ্তির তুলনায় বিপর্যয়ই ঘটে।

সিলোটি মাত (সিলেটি কথা) / সিলেটী ভাষা

আশা করি, সিলেটের প্রবাদ বাক্য লেখাটি পড়ে অনেক শিখতে এবং মজাও পেয়েছেন, ধন্যবাদ।

তথ্য সূত্র: সামহোয়ারইনব্লগউইকিপিডিয়া

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top