কদরের নামাজ পড়ার নিয়ম, গুরুত্ব ও ফজিলত

শবে কদর যাকে আরবিতে লাইলাতুল কদর বলে ডাকা হয়। শবে কদরের অর্থ “অতিশয় সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত” বা “পবিত্র রজনী”। এই রাতেই পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল। তাই এই রাতে রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। পবিত্র কুরআনের আল্লাহ্ এই রাতকে অনন্য মর্যাদা দান করেছেন এবং এই একটি মাত্র রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও অধিক সওয়াব প্রদান করার ওয়াদা করা হয়েছে। প্রতি রমজানে এই রাত মুসলিমদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে।

আজকে আমরা আলোচনা করবো শবে কদরের নামাজ পড়ার নিয়ম ও লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব এবং ফজিলত সম্পর্কে। তাই কদরের নামাজের নিয়ম সম্পর্কে জানতে সম্পূর্ণ লেখাটি পড়ুন।

কদরের নামাজ পড়ার নিয়ম

শবে কদরের ইতিহাস

এই শবে কদরের রাতেই ধ্যানমগ্ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে কুরআন অবতীর্ণ হয়। সর্বপ্রথম রাসূলআল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাছে সূরা আলাক্বের প্রথম পাঁচটি আয়াত অবতীর্ণ হয়। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন সময়ে আল্লাহতালা নবীজির কাছে কুরআন অবতীর্ণ করেন।

মুমিনদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাত সর্ম্পকে হাদিসে অসংখ্য বর্ণনা আছে। এমনকি আল কুরআনে সূরা কদর নামে একটি পূর্ণ সূরা অবতীর্ণ হয়েছে। ওই সূরায় শবে কদরের রাত্রিকে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলা হয়েছে।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর আগের পূর্ববর্তী নবী ও উম্মতগণ বহু বছর জীবন আয়ু লাভ করত। সেই তুলনায় আখেরি উম্মতেরা খুবই কম আয়ু পেয়েছে। তাই সাহাবীদের মনে একটি আক্ষেপ ছিল যে, পূর্ববর্তী উম্মতেরা অনেক বেশি এবাদত করতে পেরেছে। সেই আক্ষেপ দূরীকরণে আল্লাহ তা’আলা এই শবে কদরের রাত্র দান করেন। এই একটি রাত্র ইবাদত করলে আল্লাহ তায়ালা এক হাজার রাত্র এবাদত করার সমান নেকি প্রদান করেন।

শবে কদরের গুরুত্ব

মুমিনদের কাছে শবে কদর এত মহিমান্বিত ও বরকতময় এবং বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এই জন্য কারণ এই রাতে আল-কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন,

“নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে। আর কদরের রাত সম্বন্ধে তুমি কি জানো? কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেশতারা ও রুহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি, বিরাজ করে উষার আবির্ভাব পর্যন্ত।” (সূরা আল-কদর, আয়াত ১-৫)

এছাড়া কোরআনের আরো একটি স্থানে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন,

“হা-মীম! শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) এক মুবারকময় রজনীতে অবতীর্ণ করেছি, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।” (সূরা আদ-দুখান, আয়াত: ১-৪)

শবে কদরের রাতে ফেরেশতাগণ ও তাদের আমীর জিবরাঈল (আঃ) পৃথিবীতে আগমন করে এবং ইবাদতরত সকল মানুষের জন্য খাস দোয়া করতে থাকেন। হাদিসে বর্ণিত আছে, শবে কদরে হজরত জিবরাঈল (আঃ) ফেরেশতাদের বৃহৎ দল নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেন এবং নামাজরত অথবা জিকিরে মশগুলরত সকল নারী-পুরুষদের জন্য রহমতের দোয়া করেন।

লাইলাতুল কদরে মানুষের ভাগ্য সংস্কার হয়। পরবর্তী বছরের অবধারিত নসিব নির্ধারিত ফেরেশতাদের কাছে স্থানান্তর করা হয়। এতে প্রতিটি মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিজিক, সবকিছুর পরিমাণ নির্দিষ্ট ফেরেশতাদেরকে বলে দেওয়া হয়, এমনকি হজ্জ কে করবে, তা-ও লিপিবদ্ধ করে দেওয়া হয়।

মুমিনদের নিকট শবে কদরের রাতের গুরুত্ব অপরিসীম। কোরআনে সূরা কদরে উল্লেখ আছে, ‘হাজার মাসের এবাদতে যে নেকি হয়, শবে কদরের এক রাতের এবাদত তার চেয়ে উত্তম।’
লাইলাতুল কদরের রজনীতে সৎ মুসলমানদের ওপর আল্লাহর বিশেষ রহমত ও নিয়ামত বর্ষণ হয়। লাইলাতুল কদরে মুমিনরা আল্লাহর নিকট মাগফিরাত, নাজাত ও ক্ষমা পাওয়ার পরম সুযোগ অর্জন করে। শবে কদর সম্পর্কে রাসূলআল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি এই রাত ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করবে, আল্লাহ তাঁর পূর্বেকৃত সব গুনাহখাতা মাফ করে দেবেন। (বুখারি)

হাদীসে বর্ণিত আছে, শবে কদরের রাতে যারা আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকবে, আল্লাহ তার ওপর থেকে জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেবেন।

হাদীসে আরো বর্ণিত আছে,

” সমস্ত রজনী আল্লাহ তাআলা লাইলাতুল কদর দ্বারাই সৌন্দর্য ও মোহনীয় করে দিয়েছেন, অতএব তোমরা এই বরকতময় রাতে বেশি বেশি তাসবিহ-তাহলিল ও ইবাদত-বন্দেগিতে রত থাকো।”

অন্য হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, “তোমরা তোমাদের কবরকে আলোকিত পেতে চাইলে মহিমান্বিত লাইলাতুল কদর রাতে জেগে রাতব্যাপী ইবাদত-বন্দেগিতে কাটিয়ে দাও।”

কবে শবে কদর

হাদীস মতে ২১ রমজান থেকে ২৯ রমজান অবধি যেকোনো বিজোড় রাতে কদর হতে পারে। তবে ২৬ রমজান দিবাগত রাত অর্থাৎ ২৭ রমজান লাইলাতুল কদর হয় বলে বিজ্ঞ আলেমদের মতামত। আম্মাজান আয়েশা রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, “রাসূলআল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন এবং বলতেন, তোমরা রমজানের শেষ ১০ রাতে শবে কদর সন্ধান করো।” (বুখারি ও মুসলিম)

অন্য একটি হাদিসে আছে, “মাহে রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে তোমরা শবে কদর সন্ধান করো।” (সহীহ বুখারী)

রমজানের সেহরি ইফতারের সময়সূচি দেখুন- রমজানের সময়সূচী – রোজার ক্যালেন্ডার ডাউনলোড ২০২৪

শবে কদরের ইবাদত

রমজান মাসের শেষ দশ দিনের বিজোর রজনীতে আমাদেরকে শবে কদর তালাশ করতে হবে। রাসূলআল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাকে আম্মাজান আয়েশা রাঃ শবে কদর সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “হে রাসুলুল্লাহ! আমি যদি লাইলাতুল কদর পাই তখন কী করব? তখন নবীজি সাঃ বলেন, তুমি বলবে, ‘হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমা করে দিতে ভালোবাসেন—অতএব, আমাকে ক্ষমা করুন।” (তিরমিযি)

এর থেকে প্রমাণিত হয় যে শবে কদরের রাতে আমাদেরকে বেশি বেশি তওবা করতে হবে। আপন গুনাহের জন্য অনুতপ্ত ও অনুশোচনা করতে হবে।

শবে কদরের নামাজের নিয়ত

শবে কদরের নামাজ: শবে কদরের রাতে বেশি বেশি নফল নামাজ পড়তে হবে। দুই রাকাত দুই রাকাত করে নফল নামাজ আদায় করতে হয়। এই নামাজগুলোতে কিরাত, রুকু-সেজদায় দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হবে। যাতে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করা যায়।

নাওয়াইতু আন উছাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা রাকাতাই ছালাতিল লাইলাতিল কাদরি নফলে মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শরিফতি– আল্লাহু আকবার।

শবে কদরের নামাজের নিয়ত
শবে কদরের নামাজের নিয়ত

অর্থ: আমি কাবামুখী হয়ে আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্য শবে কদরের দুই রাকআত নফল নামাজ পড়ার নিয়ত করলাম– আল্লাহু আকবর।

শবে কদরের নামাজ পড়ার নিয়ম

  • শবে–কদরের নামাজ দুই রাকাত ও চার রাকাত করে আদায় করতে হয়। তারপর যত খুশি নফল নামাজ পড়তে পারবেন। এই নামাজের প্রতিটি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা কদর একবার এবং সূরা ইখলাস তিনবার পড়তে হবে।
  • নামাজের পর নিম্নোক্ত দোয়াটি কমপক্ষে ১০০ বার পাঠ করা উত্তম
  • ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদু লিল্লাহি ওয়া লা–ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়ালাহু আকবার, লা হাওলা কুয়াতা ইল্লাবিল্লাহিল্লাহ আলিয়িল আজিম।’

শবে কদরে কুরআন তেলাওয়াত: এই রাতে বেশি বেশি কুরআন পাঠ করতে হবে। কেননা এই রাত্রে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল। এছাড়া নবীজির সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি দুরুদ পড়তে হবে।

শবে কদরের দোয়া

আম্মাজান আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলআল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, শবে কদরের রাতে আমার কোন দোয়াটি পড়া উচিত?’ নবীজি সাঃ তাকে এই দোয়া পড়ার নির্দেশ দিলেন ”আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফাফু আন্নি।”

অর্থঃ “হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল এবং ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। তাই আমাকে ক্ষমা করুন।” (সুনানে ইবনে মাজা)

পরিশেষে: রমজান মাসে সারাদিন রোজা রাখার পর মানুষ ক্লান্ত থাকে। শবে কদরের রাতের ইবাদত হাজার মাস ইবাদত করা সমতুল্য। তাই আমরা যেন কেউ এই রাত্রিকে অবহেলা না করি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top