শবে বরাতের ফজিলত: খুব শীঘ্রই আমাদের সামনে আসছে শবে বরাত। এই দিনটি ধর্মীয়ভাবে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিও এর সাথে জুড়ে রয়েছে। সারা বিশ্বেই এই দিনটি খুবই গুরুত্ব সহকারে পালন করে মুসলিমগণ।
রমজান মাস মুসলিমদের কাছে খুবই পবিত্র মাস। শাবান মাসের পরেই আসে রমজান মাস। শবে বরাত শাবান মাঝের মাঝামাঝি পালন হয়। অর্থাৎ ১৫ দিন পরেই রমজান শুরু। তাই এই দিনটি রমজানের সুসংবাদ বহন করে বিধায় এর বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। এছাড়া বারো শিয়া মুসলিমগণ এই দিন মুহাম্মদ আল-মাহদির জন্মদিন উদযাপন করে। তবে সালাফি বা সুন্নিগণ এর বিরোধিতা করে থাকেন। আজ মধ্য শাবান বা শবে বরাত সম্পর্কে কিছু আলোচনা করব।
শাবান শব্দের বিশ্লেষণ
শা’বান ( شَعْبَان ) হলো ইসলামিক ক্যালেন্ডারের অষ্টম মাস । এটিকে “বিচ্ছেদের মাস” বলা হয়, কারণ শাবান শব্দের অর্থ “ছত্রভঙ্গ করা” বা “বিচ্ছিন্ন করা” । কেননা পৌত্তলিক আরবরা এই সময় পানির সন্ধানে ছড়িয়ে পড়ত।
এছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় পণ্ডিতগণ এই মাসের প্রতিটা হরফেরকে বিভিন্ন শব্দের দিকে ইঙ্গিত করে একটি বাক্য রচনা করে। যার সাথে আরবি অভিধানের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা একটি মাসের নাম, এটাকে নাম হিসেবে রাখাটাই ভালো।
শবে বরাতের নামসমূহ
শাবান মাসের ১৫তম রাত্রিকে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। নামকরণগুলো দুটি বিষয়ের ভিত্তিতে হয়ে থাকে: ১. মধ্য শাবান বা অর্ধ শাবান: ইসলামী দিনপঞ্জির অষ্টম মাস হলো এই শাবান মাস। এই শাবান মাসের অর্ধ দিনটিকে উল্লেখ করে এর নামকরণ হয় অনেক স্থানে।
- ইরান ও আফগানিস্তানে নিম শা’বান।
- আরবী ভাষাভাষীগণ বলেন নিসফ্ শা’বান।
- মালয় ভাষাভাষীগণ বলেন নিসফু শা’বান।
বরাতের রাত:
ফার্সিতে বরাত শব্দের অর্থ হচ্ছে ভাগ্য, বণ্টন, নির্ধারিত। তাই একে সৌভাগ্যের দিন হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।
- লাইলাতুন নিফসি মিন শা’বান বা লাইলাতুল দোয়া।
- তুর্কি ভাষাভাষীগণ বলেন বিরাত কান্দিলি।
- ভারতীয় উপমহাদেশে বলা হয় শবে বরাত, লাইলাতুল বরাত।
আরো পড়ুন: শবে বরাত ২০২৪ কত তারিখে
তবে আজ থেকে বহু বছর আগে শেরপুরের সহজ সরল মানুষেরা যখন ঢাকায় এসেছিল। তখন তারা শহরে মানুষের শবেবরাত উপলক্ষে হালুয়া-রুটির উৎসব দেখে এই রাতকে “উডির রাইত” (রুটির রাত) বলে সম্বোধন করে। কেননা গ্রামাঞ্চলে হালুয়া রুটির প্রচলন নেই বললেই চলে।
কুরআনে শবে বরাত
পবিত্র কুরআনে একটি রাতের প্রতি নির্দেশ করে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- “নিশ্চয় আমি (কুরআন মজিদকে) নাজিল করেছি বরকতময় রাতে” কিছু কিছু ধর্মগুরু কুরআন নাযিল হওয়ার রাতটি অর্ধ শাবান বলে থাকে। কিন্তু এটা সঠিক নয়।
সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতামত হচ্ছে কুরআন নাযিল হয়েছে শবে কদর বা লাইলাতুল কদর এর রাতে। লাইলাতুল কদর রমজান মাসের শেষ ১০ দিনের মধ্যে একটি রাত।
হাদীসে শবে বরাত (শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস)
মধ্য শাবানের রাত্রির বিশেষ মাগফিরাত। এই বিষয়টি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে:
إِنَّ اللَّهَ لَيَطَّلِعُ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ
‘‘মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃকপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।’’
এ অর্থের হাদীস কাছাকাছি শব্দে ৮ জন সাহাবী: আবূ মূসা আশআরী, আউফ ইবনু মালিক, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর, মুয়ায ইবনু জাবাল, আবু সা’লাবা আল-খুশানী, আবূ হুরাইরা, আয়েশা ও আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে। এই সকল হাদীসের সনদ বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা উপর্যুক্ত গ্রন্থে করেছি। এগুলোর মধ্যে কিছু সনদ দুর্বল ও কিছু সনদ ‘হাসান’ পর্যায়ের। সামগ্রিক বিচারে হাদীসটি সহীহ। শাইখ আলবানী বলেন, ‘‘হাদীসটি সহীহ।”
শবে বরাতের ফজিলত ও তাৎপর্য
শবে বরাতের ফজিলত ও তাৎপর্য সম্পর্কে অনেক হাদীসে রয়েছে। কিন্তু সেগুলো সনদের ক্ষেত্রে দুর্বল । যেহেতু একটি বিষয়ের ওপর অসংখ্য হাদিস রয়েছে তাই আলেমরা এই দিনটিকে কিছুটা গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
এই সম্পর্কে একটি হাদীস “হযরত ওসমান ইবনে আবুল আস (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন- “রাসূলআল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রজনীতে প্রথম আসমানে একজন ফেরেশতা আহ্বান করে ডাকতে থাকেন ‘ কেউ কি কোন ফরিয়াদ বা প্রার্থনা করার আছ? করলে তা কবুল বা গ্রহণ করা হবে। ফলে যা চাওয়া হবে তা প্রদান করা হবে। (সুনানে বায়হাকী) তবে এটার সনদ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে।
যাদের জন্য সুসংবাদ
এই দিনে সুসংবাদ হিসেবে হাদীসে এসেছে- ‘জিব্রাঈল (আ.) রাজনীর এক চতুর্থাংশে আসিয়া রাসূলআল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন- হে রাসূলআল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনার মস্তক মোবারক উন্নত করুন। পয়গম্বর দেখিলেন স্বর্গের আট কপাট খুলিয়া দেওয়া হইয়াছে। প্রথম কপাট হইতে অষ্টম দ্বার পর্যন্ত আট জন ফেরশতা ৮টি সুসংবাদ প্রদান করিলেন। যথাক্রমে-
১. যে রুকু করিবে।
২. যে সিজদা করিবে।
৩. যে দোয়া করিবে।
৪. যাহারা আল্লাহর নাম জপ করিবে।
৫. যাহারা চোখের নীর ছাড়িয়া ক্রন্দন করিবে।
৬. যাহারা আল্লাহর সামনে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করিবে তাহাদের জন্য সুসংবাদ।
৭. কোনো প্রার্থী আছ কি? যাহা চাইবে দেওয়া হইবে।
৮. পাপের তরে ক্ষমা প্রার্থী আছ কি? তাহাকে ক্ষমা করিয়া দেওয়া হইবে।
আর রহমত ও জান্নাতের দ্বার সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত খোলা থাকিবে।
যারা গুনাহ হতে ক্ষমা পাবে না
এই রমহতের রাতেও কিছু মানুষ ক্ষমা লাভ করবে না। তারা হলো শিরককারী, যাদুকর, গনক, ব্যভিচারক, সুদখোর, মদপানকারী, মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান, আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্নকারীর এবং মুসলিম ভাইয়ের সাথে ঝগড়া-বিবাধকারী। হযরত আবু সিদ্দিক (রা:) বলেন- “আল্লাহ এই রাতে মুশরিক এবং হিংসুক ছাড়া অন্য গুনাগারদের ক্ষমা করেন।
বরাআত রাতের আমল | শবে বরাতের আমল সমূহ
এই রাত নফল ইবাদত করার রাত। এটাতে মানুষজন নকল নামাজ, জিকির আজকার, দান-খয়রাত করে পূণ্য অর্জন করে।
নফল নামায
শবে মোটাদের রাতে নফল নামাজ পড়ার পাবন্দি করতে হয়। যে যার মতো যত সংখ্যক ইচ্ছা নফল নামাজ আদায় করতে পারে। আপনি চাইলে দীর্ঘ কিরাত পাঠ করে নফল নামাজ পড়তে পারেন। প্রতিটা রুকনে বেশি বেশি তসবি পাঠ করতে পারেন। নেকি লাভের উদ্দেশ্যে গরীব-দুঃখীদের মাঝে দান সদকা করা যায়। আমাদের দেশে শহরে হালুয়া রুটির প্রচলন আছে। এই হালুয়া রুটির একটি বৃহৎ অংশ গরিব-বিভেদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয়।
শবে বরাতের রোজা কয়টি রাখা উত্তম?
শাবান মাস আসলে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবাদতের মাত্রা বাড়িয়ে দিতেন। তিনি এই মাসে বেশি বেশি নফল রোজা রাখতেন। দান সদকা করতেন ও নফল নামাজ আদায় করতেন। এটা রমজানের প্রস্তুতি। তাই নবীজির সুন্নত হিসেবে শুধু শবে বরাত নয় এই মাস জুড়ে নফল রোজা রাখার নিয়ত করতে হবে।
শবে বরাতে কবর জিয়ারত
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কবর জিয়ারত করার আদেশ দিয়েছেন। কেননা কবর জিয়ারত করলে অন্তরে পরকালের প্রতি ভয় সঞ্চার হয়। তাই শবে বরাত উপলক্ষে অনেক মানুষ কবর জিয়ারত করে থাকে।
শবে বরাতে কুরআন তিলাওয়াত
যেহেতু এটাতে বেশি বেশি ইবাদত করতে হবে তাই রাতের কিছু অংশ কোরআন তেলাওয়াতে ব্যয় করাটা উত্তম। কুরআন তেলাওয়াত করলে অন্তর নরম হয়। কলক পরিষ্কার হয়। আল্লাহর কালামের প্রতি মহব্বত বাড়ে।
শবে বরাতে যে দোয়াটি বেশি পড়বেন
প্রতিটা মানুষেরই নিজস্ব চাহিদা রয়েছে। নিজের অভাব অভিযোগের জন্য আমাদের একমাত্র ভরসার স্থল হচ্ছে আল্লাহ। আমরা আমাদের চাহিদার কথা বলার পাশাপাশি আল্লাহর সন্তুষ্টি চাইবে। কেননা এই জগতে আমাদের একটি মাত্রই উদ্দেশ্য আর তা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি।
শেষ কথা
কুরআনে বর্ণিত হয়েছে একটি বিশেষ রাত্রে কুরআন নাযিল হয়। ওই বিশেষ রাতটি হচ্ছে শবে কদর। কিন্তু আমাদের দেশে শবে কদরের চেয়ে শবে বরাতের গুরুত্ব বেশি দেওয়া হয়। তাই আমাদের উচিত শবে বরাতে ইবাদত করার পাশাপাশি শবে কদরে এর চেয়ে বেশি ইবাদত করা।