উচ্চ শিক্ষা

বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ এক ধরণের অভিশাপ

উন্নয়নশীল দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত হয়েছে বাংলাদেশ। দেশে গড় মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬৪ ডলার। সে দিক থেকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থান অনেকটা ভালো। কিন্তু দেশের উচ্চ শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে বিশাল একটি অংশ এখনও বেকার। লন্ডনের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান “ইআইইউ” এর মতে বাংলাদেশের স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারীদের মধ্যে প্রতি ১০০ জনে ৪৭ জন বেকার।

উচ্চ শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থান দেওয়ার মত কর্মসংস্থান খুবই সামান্য। এদিকে জীবনের একটি বড় অংশ পড়ালেখার পেছনে ব্যয় করে সাধারণ কোন কাজে নামতেও পারছে না। সব মিলিয়ে প্রায় অনিশ্চিত জীবন নিয়ে হতাশায় ভুগছে দেশের বৃহ একটি অংশ। দেশে এখন বেকার জনসংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। অর্থনীতিবিদ রিজওয়ানুল ইসলাম এর মতে যারা চেষ্টা করেও কাজ পায় না তাদের বলে বাধ্যতামূলক বেকারত্ব। সেদিক থেকে বলা যায় বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ এক ধরণের অভিশাপ।

স্নাতকোত্তর পাস একজন যুবক কি করে? আত্মীয়স্বজন-পাড়াপ্রতিবেশির অনেক প্রশ্ন থাকে। মা-বাবা চায় বিয়ে দিতে, কিন্তু প্রশ্ন হলো- ছেলে কি করে? উত্তরে “না মানে ছেলে মাস্টার্স শেষ করে চাকরী খুজছে” প্রতিউত্তর ওহ আচ্ছা!! আগে চাকরী-বাকরী কিছু পাক তারপর বিয়ে দেন, নয়তো ভালো মেয়েইতো পাবে না। আগে ক্যারিয়ার, পরে বিয়ে!! এমটা ৪৭ শতাংশ উচ্চ শিক্ষিত বেকারের সাথে হয়েছে এবং হচ্ছে।

চাকরীর বাজারে চাহিদার তুলনায় আসন কম, তার মধ্যে সজনপ্রীতি, তদবির ইত্যাদি তো আছেই। অনেক স্নাতকোত্তর আছে, যারা একাদিক বার লিখিত পরীক্ষা টপকিয়ে পরের ধাপে আটকে গেছে। কিছু দিন আগেও সরকারী চাকরী মানের ঘুষের ছড়াছড়ি ছিলো প্রকাশ্য গোপন। বর্তমানেও তার ব্যতিক্রম তেমন একটা লক্ষ করা যায় না।

বিষয়টি পাসপোর্ট অফিসের চ্যানেল ফি বা পুলিশ প্রতিবেদনের হাত খরচের মত। সবাই জানে এখানে কাজ আদায় করতে হলে চ্যানেল ফি লাগবে নতুবা শক্ত কোন চ্যানেলের হস্তক্ষেপ লাগবে। দেশের আমজনতা শক্ত চ্যানেল কই পাবে। তাদের চ্যানেল ফি বা হাত খরচই দিতে হয়। নতুবা ফাইল সামনে আগায় না।

চাকরীর বাজারে যোগ্যতা বিবেচনায় সরকারী বিভিন্ন অফিসের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করলে দেখা যায় কত অযোগ্যরাই চেয়ার দখল করে বসে আছে। অনেক দপ্তরের সরকারী ওয়েবসাইট ভিজিট করলে দেখা যায় কোন আপাডট নেই। সেই শুরুতে যে তথ্য দেওয়া হয়েছিলো তা বহাল রয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে অনেক কর্মকর্তা আসা যাওয়া করেছেন। অনেক তথ্যের পরিবর্তন হয়েছে। তার কোন তথ্য ওয়েব সাইটে নেই। নেই কোন আর্কাইভ। শুধু আইসিটি নয়, প্রতি খাতেই একই অবস্থা।

অন্য একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশে নিরক্ষরদের এক শতাংশেরও কম বেকার। তারা কোন না কোন কাজ করছে। তাদের কাজের বিনিময়ে দেশের শিক্ষার্থীরা পড়া লেখা করতে পারছে। আর পড়ালেখা শেষ করে শিক্ষিত বেকারদের তালিকা সমৃদ্ধ করছে। উচ্চ শিক্ষিত দের তুলনায় অল্প শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার কম। যেখানে মোট বেকার ৪.২ শতাংশ, সেখানে উচ্চ শিক্ষিত ৪৭ শতাংশ।, আইএলও এর পরিসংখ্যান অনুযায়ি তরুণদের ২৫ শতাংশ বেকার। বিবিএস এর হিসেবে করোনাকালীন সময়ে ১০ শতাংশ বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। তার মানে বেকারদের তালিকা সমৃদ্ধ হচ্ছে।

পরিসংখান গুলো বিচার বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় চাকরীর বাজার কতটা কঠিন। বিশাল আশার বীজ বুনে পড়ালেখা শেষ করে হতাশা লালন করতে হচ্ছে তাদের। এটাই বাংলাদেশের জন্য চরম বাস্তবতা।

তার মধ্য তামাশার আরে প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশের কর্মসংস্থান ব্যাংক। এ-ব্যাংকের সরকারী নিয়ম দেখে ঋণ গ্রহণে উৎসাহী হয়ে নিজে থেকে কিছু করার স্বপ্ন দেখে বেকার সমাজের প্রায় ৩৫ শতাংশ তরুণ। সরকারের ভাষায় যাকে বলে উদ্যোক্তা হওয়ার উদ্যোগ। বিন্তু কর্মসংস্থান ব্যাংকে যাওয়ার পর সব নিয়মাবলী বিপরীত হয়ে যায়। শর্ত মতে বেকার বা অর্ধ বেকারদের ঋণ দওয়ার কথা থাকলেও কোন বেকার কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে ঋণ পায় নি। যারা ঋণ পেয়েছে তারা ব্যবসায়ী কোন ক্ষেত্রে কর্মজীবী। তাই একথা বলাই যায় বেকারদের নিয়ে তামাশা করার রাষ্ট্রিয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের কর্মসংস্থান ব্যাংক।

বঙ্গকন্যা দেশের জন্য অনেক কিছু করছেন, মাথাপিছু আয় প্রায় তিনগুণ বৃ্দ্ধি করেছেন। কিন্তু তার অনেক উদ্যোগ তত্বাবধানের অভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নজর দিয়েছেন সেখানে সোনার হরিণ জন্মনিয়েছে। কিন্তু বেকারত্ব দূরিকরণে আমাদের বঙ্গকন্যার উদ্যোগ সমূহ বাস্তবায়নে তাঁর নিজের তত্বাবধান প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। একমাত্র তাঁর হস্থক্ষেপই পারে শিক্ষাগ্রহণের ফলে যে অভিশপ্ত জীবনের জন্ম হয়, তা থেকে মুক্ত করতে।

আবুল হায়দার তরিক, লেখক ও সাংবাদিক
torikbd5@gmail.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version