এক ঘন্টা কেন ৬০ মিনিটে হয়? কেন ১০০ মিনিটে নয়

এক ঘন্টা কেন ৬০ মিনিটে হয়? কেন ১০০ মিনিটে নয়?

দিনে কতবার আমরা আমাদের ঘড়ি দেখি? আপন সময়সূচি মোতাবেক দিনভর কাজ করি? এভাবেই কেটে যায় দিন, মাস, বছর। পার হয়ে গেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। মানুষ সময়কে ধরে রাখতে চায়, কিন্তু পারে কি? শাহজাদ আহমেদ সেই চেষ্টা করেছিল। তিনি তার কবিতায় বলেন,

“গুযার হি নাহি দি ওহ্ রাত ম্যায় নে
ঘাড়ি পার রাখ দিয়া হাত ম্যায় নে”

যার বাংলা অর্থ

‘পার হতে দেইনি ওই রাত আমি
ঘড়িতে হাত রেখে দিয়েছিলাম আমি’

ঘড়িতে হাত রাখলেও তো সময়কে আটকে রাখা যাবে না। আচ্ছা আমাদের কি কখনো মনে প্রশ্ন জেগেছে, এক ঘন্টায় কেন ৬০ মিনিট হয়? কিংবা এক মিনিটে কেন ৬০ সেকেন্ড? একটি দিন কেন ২৪ ঘন্টায়? সময়ের এই সূক্ষ্ম নিয়মাবলী কে নির্ধারণ করেছে?

আসুন, আজ আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি প্রো-বাংলায়।

এটাতো আমরা সবাই জানি, আমাদের নীল ভুবন সূর্যের চারদিকে ঘোরে। পৃথিবী ৩৬৫ দিনে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে। এটাকে বলে বার্ষিক গতি। পৃথিবী নিজ অক্ষকে কেন্দ্র করে প্রতি ২৪ ঘন্টায় একবার প্রদক্ষিত হয়। এটাকে বলে আহ্নিক গতি। এটার জন্যই দিনরাত হয়। এগুলো তো স্কুল জীবনেই জেনে এসেছি। কিন্তু কতজনই বা প্রশ্ন করতে পেরেছি, ২৪ ঘন্টায় কেন একদিন হয়? ২৫ ঘন্টায় কেন নয়?

একদিনকে ২৪ ঘন্টায় ভাগ করার কৃতিত্ব প্রাচীন মিশরীয়দের। উনারাই ছায়াঘড়ির মাধ্যমে দিনকে দশ ঘণ্টায় ভাগ করে এবং এই দশ ঘন্টার পূর্বে এক ঘন্টা ও শেষে এক ঘন্টা যোগ করে। কারণ ভোর ও সন্ধ্যায় আলো কম থাকে। সেটা নির্ণয়ের জন্যই এই দুটি ঘন্টা যোগ করা হয়। এভাবেই দিন ১২ ঘন্টায় নির্ধারিত হয়েছে।

আচ্ছা এই ছায়াঘড়ি কী? এটা কি আসলেই কার্যকর?

ছায়াঘড়ির পরিচয় জানতে আমাদের যেতে হবে প্রায় তিন হাজার বছর আগে। যখন কোনো ঘড়ি ছিল না। আমাদের জ্যামিতি বক্সে যে চাঁদা থাকে, সেই আকৃতির একটি পাথরকে সমান ১২ টি ভাগে ভাগ করা হতো এবং প্রতিটি ভাগ এক ঘন্টা ধরা হতো। আমরা সবাই জানি দিনের বেলা ছায়া কখনো একদিক বরাবর থাকে না। এমনকি এর দৈর্ঘ্যও কমবেশি হয়ে থাকে। আর এই সরল জ্ঞানটুকু কাজে লাগিয়ে মিশরীয়রা দিনের বেলা সময় নির্ণয় করতো। চাইলে যে কেউ এই পরীক্ষাটি করে দেখতে পারে।

ছায়াঘড়ি কী?

কিন্তু রাতের বেলা যখন সূর্য থাকে না, তখন কীভাবে সময় নির্ধারণ করত?

প্রাচীন মিশরীয়দের বুদ্ধিমত্তা দেখে অবাক হতে হয়। তারা জানত নক্ষত্র সূর্যের মতো উদয় ও অস্ত যায়। তাদের ৩৬ টি নক্ষত্রের একটি সিস্টেম জানা ছিল। যাকে ‘Decans’ বলা হতো। নক্ষত্রগুলো পর্যবেক্ষণ করার জন্য মিশরীদের কাছে একটি নকশা ছিল। যেটা সাধারণত কফিনের কভারের ওপর খচিত করে রাখা হতো। সেই নকশার সাথে নক্ষত্রের অবস্থান মিলিয়ে হিসেব কষে রাতের বেলা সময় নির্ণয় করতো। তারা রাতকেও ১২ ঘণ্টায় ভাগ করেছিল। এভাবেই দিনের ১২ ঘণ্টা ও রাতের ১২ ঘন্টা মিলিয়ে ২৪ ঘন্টা পূর্ণ হয়।

AM-PM কীভাবে এলো?

প্রথম প্রথম যে সকল ঘড়ি আবিষ্কার হয় সেগুলো ২৪ ঘন্টার হিসেবেই তৈরি হতো। অর্থাৎ সেখানে ২৪-টি ঘন্টার চিহ্ন থাকতো। সময়ের সাথে সাথে ঘড়ি নির্মাতারা এটা উপলব্ধি করলো, তারা যদি ১২ ঘন্টার ঘড়ি তৈরি করে তবে সেটা অনেক বেশি সহজ ও সস্তা হবে। সেই থেকেই AM-PM এর যাত্রা শুরু।

AM-PM একটি ল্যাটিন শব্দ। যা সময়কে উল্লেখ্য করার জন্য ব্যবহৃত হয়। ইংরেজি ভাষায় এই শব্দের ব্যবহার সতেরো শতাব্দীতে শুরু হয়।

  • AM বা “Ante meridiem” যা মধ্যাহ্নের আগের সময়কে নির্দেশ করে। অর্থাৎ দুপুর বারোটার আগের সময়।
  • PM বা “Post meridiem” যা মধ্যাহ্নের পরে সময়কে নির্দেশ করে। অর্থাৎ দুপুর বারোটার টার পরের সময়।
  • সংক্ষেপে, AM হলো রাত বারোটা থেকে দুপুর বারোটা। PM হল দুপুর বারোটা থেকে রাত বারোটা।

জনপ্রিয় ঘড়ি কোনটি? ১২ ঘণ্টার না ২৪ ঘন্টার?

১২ ঘন্টার ঘড়ি এতটাও জনপ্রিয় নয় যতটা আমরা মনে করি। আজও দুনিয়াভর ২৪ ঘন্টার ঘড়িই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা সাধারণত আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, ভারত, নিউজিল্যান্ড সম্পর্কে বেশি খবরাখবর রাখি। এই দেশগুলোতে ১২ ঘণ্টার ঘড়ি ব্যবহৃত হয়। এজন্য মনে করি ১২ ঘন্টার ঘড়ির সর্বত্র। কিন্তু বাস্তবতা এর ভিন্ন। জার্মান, ফ্রান্স, রোমানিয়া, ভিয়েতনাম এইসকল দেশগুলোতে ২৪ ঘন্টার ঘড়ি ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের রেলের সময়সূচিও কিন্তু ২৪ ঘন্টার হিসেবেই প্লাটফর্মে দেওয়া থাকে।

এক ঘন্টা কেন ৬০ মিনিটে হয়? কেন ১০০ মিনিটে নয়?

এই আধুনিক যুগে ডেসিমাল বা দশমিক সংখ্যায় সকল হিসাব-নিকাশ করি। এই যুগে দশমিক সংখ্যাকে সবচেয়ে সহজ মনে করা হয়। আমাদের দুই হাতের আঙুল দশ। তাই আঙুলে হিসেব কষতে সহজ হয়। তবে প্রাচীনকালে আরো অনেক পদ্ধতিতে সংখ্যা গণনা করা হতো। যার মধ্যে Duodecimal, Sexagesimal অন্যতম।

Duodecimal-এর ভিত্তি ১২ এবং Sexagesimal-এর ভিত্তি ৬০

ঘন্টা এই Sexagesimal-এর ওপর ভিত্তি করেই কায়েম হয়েছে। এই কাজ ব্যাবেলিয়নরা করেছিল। ব্যাবলিয়ন হচ্ছে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার একটি শহর। ব্যাবিলন শহর বর্তমান ইরাকে অবস্থিত ছিল। তারা এক ঘন্টাকে ৬০ মিনিটে ভাগ করে। এর ফলে কিছু সুবিধা হয়েছে। ৬০ এমন একটি সংখ্যা যেটা ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ১০, ১২, ১৫, ২০, ৩০ এই সংখ্যাগুলো দিয়ে খুব সহজে ভাগ করা যায়। যদি এক ঘণ্টা ১০০ ভাগে ভাগ করা হতো তবে সেটা ভাগ করা কিছুটা মুশকিল হতো। কেননা সেটা শুধু ২, ৫, ১০, ২৫, ৫০ দিয়েই ভাগ করা যেত। এই কারণেই মিনিটকেও ৬০ সেকেন্ডে ভাগ করেছে ব্যাবিলিয়নরা। যাতে খুব সহজে সময়কে ভাগ করা যায়।

প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে। এখন এক সেকেন্ডের ১০০০ ভাগের এক ভাগ হিসেবও খুব সূক্ষ্ম ভাবে রাখা সম্ভব। আমরা যে আজকাল স্যাটেলাইটের মাধ্যমে জিপিএস-এর সুবিধা ভোগ করছি। সেই স্যাটেলাইটও কিন্তু সময়ের সূক্ষ্ম হিসেবের মাধ্যমেই আমাদের স্থান নির্ণয় করে।

এই যুগে সময়ের খুব দাম। আমরা এখন খুব সচেতন। প্রযুক্তিতে খুব উন্নত। খুব হিসেব করে সময় ব্যয় করি। তাইতো আপনজনকে সময় দেওয়ার মতো সময় আমাদের ঘড়িতে নেই।

2 thoughts on “এক ঘন্টা কেন ৬০ মিনিটে হয়? কেন ১০০ মিনিটে নয়?”

  1. Munkashir hossen

    আপন জনকে সময় দেয়ার মত সময় আসলেই আমাদের হাতে থাকে না। পুরো লিখাটা পড়লাম। অনেক মূল্যবান তথ্য পেলাম যা সত্যিই অবাক করেছে। ৬০ বা ১০০ এই বিষয়টা আমি আগে ভাবতাম কিন্তু এখন দেখলাম আমার চিন্তা আর সত্যি বিষয়টা একই। এইটা আরো ভাল লেগেছে যে আমার চিন্তা তবে ঠিক ছিল। ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর লিখার জন্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top