পোল্ট্রি জাতগুলোর মধ্যে অন্যতম নামজনক একটি জাত হলো টার্কি। বাংলাদেশের অনেকেই টার্কি নিয়েই খামার ব্যবসায় লাভজনকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে নতুন করে আরো অনেকেই এই খামার ব্যবসাটিতে আগ্রহী হয়ে শুরু করতে চাচ্ছে।
তাই আপনাদের জন্য এই আর্টিকেলে বাণিজ্যিকভাবে টার্কি পালন পদ্ধতি, টার্কির পরিচিতি, বিভিন্ন জাত ও সেগুলোর বৈশিষ্ট্য, খামারঘর তৈরি, খাদ্য ব্যবস্থাপনা, রোগ প্রতিরোধ, প্রজনন ও ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানো এবং বাজারজাতকরণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হয়েছে।
টার্কি কি | টার্কির পরিচিতি
টার্কি একটি মাঝারি আকারের গৃহপালিত পাখি যা প্রধানত মাংস উৎপাদনের জন্য পালন করা হয়। এদের মূল উৎপত্তি উত্তর আমেরিকায় হলেও বর্তমানে সারা বিশ্বেই টার্কি পালন করা হয়। পূর্ণবয়স্ক একটি পুরুষ টার্কির ওজন ১০-১৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে, আর মাদি টার্কি ৭-১০ কেজির মতো হয়।
এরা দেখতে বড় ও শক্তিশালী হয়। টার্কি দ্রুত বর্ধনশীল। এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো এবং কম খরচেই পালন করা যায়।
আরও পড়ুনঃ লাভ বার্ড পাখি পালন পদ্ধতি | Love Bird.
বিভিন্ন জাতের টার্কি এবং তাদের বৈশিষ্ট্য
টার্কি পালনের পূর্বে আপনার বিভিন্ন জাতের টার্কির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জেনে নেওয়া উচিত। তারপর এগুলোর মধ্যে থেকে সঠিক ও আপনার জন্য উপযুক্ত জাতের টার্কি পালন শুরু করতে পারেন। নিচে চার ধরনের টার্কির বৈশিষ্ট্য দেওয়া হলো:
(১) ব্রড ব্রেস্টেড হোয়াইট:
- এটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পালনকৃত জাত।
- এদের মাংস উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি।
- দ্রুত বর্ধনশীল এবং বড় আকারের হয়ে থাকে।
(২) ব্রড ব্রেস্টেড ব্রোঞ্জ:
- দেখতে কালো-ধূসর রঙের হয়।
- এদের মাংসের স্বাদ খুব ভালো এবং বাজারে চাহিদা বেশি।
- বাণিজ্যিক খামারের পাশাপাশি পারিবারিক পর্যায়েও পালনযোগ্য।
(৩) বেল্টসভিল স্মল হোয়াইট:
- আকারে ছোট এবং হালকা ওজনের জাত।
- এদের মাংস সুস্বাদু ও কোমল।
- ছোট পরিসরে টার্কি পালনকারীদের জন্য আদর্শ।
(৪) নরফোক ব্ল্যাক:
- এগুলোকে কালো পালকের কারণে সহজেই চেনা যায়।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো এবং প্রাকৃতিকভাবে বেঁচে থাকার দক্ষতা বেশি।
টার্কির উপযুক্ত জাত নির্বাচনের গুরুত্ব
টার্কি পালন শুরুর আগে নিজের লক্ষ্য অনুযায়ী সঠিক জাত নির্বাচন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্যিক মাংস উৎপাদনের জন্য দ্রুত বর্ধনশীল জাত যেমন ব্রড ব্রেস্টেড হোয়াইট ভালো হবে। আর ছোট খামারের জন্য বেল্টসভিল স্মল হোয়াইট বা নরফোক ব্ল্যাক উপযোগী।
এভাবে সঠিক জাত নির্বাচন করলে খামারের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে এবং লাভজনকভাবে টার্কি পালন সম্ভব হবে।
আরও পড়ুনঃ লাভজনকভাবে কবুতর পালন পদ্ধতি।
টার্কি পালনের পদ্ধতি
টার্কি পালনের পদ্ধতি মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত। যথা:
- মুক্ত চারণ পদ্ধতি,
- নিবিড় পালন পদ্ধতি।
(১) মুক্ত চারণ পদ্ধতি
মুক্ত চারণ পদ্ধতিতে টার্কিগুলোকে খোলা পরিবেশে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে টার্কিরা প্রাকৃতিকভাবে খাবার সংগ্রহ করে এবং সহজেই শারীরিক বৃদ্ধি ঘটে। এভাবে টার্কিরা মাঠে ঘাস, কীটপতঙ্গ এবং প্রাকৃতিক খাদ্য খেতে পারে। এ পদ্ধতিতে খাবারের খরচ কম হয়। টার্কির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হয় কারণ তারা খোলা পরিবেশে সজীব থাকে।
তবে এই পদ্ধতিতে টার্কি গুলোকে খোলা মাঠে শিকারি প্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত পানি ও ছায়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
(২) নিবিড় পালন পদ্ধতি
নিবিড় পদ্ধতিতে টার্কিদের সুনির্দিষ্ট ঘরে বা শেডের মধ্যে সীমিত জায়গায় পালন করা হয়। এ পদ্ধতিটি বাণিজ্যিক খামারের জন্য বেশি উপযোগী। এক্ষেত্রে:
- নির্দিষ্ট খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে দ্রুত বর্ধনশীলতা অর্জন করা সম্ভব।
- রোগবালাই পর্যবেক্ষণ করা সহজ এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা দ্রুত নেওয়া যায়।
- বড় পরিসরে বেশি টার্কি পালন করা সম্ভব।
তবে খাঁচা বা শেডে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা রাখতে হবে। নিয়মিত ঘর পরিষ্কার করতে হবে এবং সঠিক খাদ্য ও পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
উপযুক্ত টার্কি পালন পদ্ধতি নির্বাচন
মুক্ত চারণ পদ্ধতি ছোট ও মাঝারি খামারের জন্য বেশি কার্যকর। অন্যদিকে, বড় পরিসরে বাণিজ্যিক খামার পরিচালনার জন্য নিবিড় পদ্ধতিই ভালো হবে। এভাবে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে টার্কি পালন লাভজনক হয়।
আরও পড়ুনঃ লাভজনকভাবে কোয়েল পাখি পালন পদ্ধতি।
টার্কি পালনের জন্য আবাসন ও ঘর ব্যবস্থাপনা
টার্কি পালনে সঠিক আবাসন ও ঘর ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি সুস্থ পরিবেশে টার্কির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং রোগবালাই কম হয়। তাই ঘর নির্মাণের সময় তাপমাত্রা, বায়ুচলাচল এবং পর্যাপ্ত জায়গার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
টার্কির জন্য ঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে পারেন:
- প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক টার্কির জন্য অন্তত ৩-৪ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন।
- মেঝে সিমেন্টের বা কাঠ দিয়ে তৈরি করতে পারেন। তবে খড়, কাঠের গুঁড়া বা বালু বিছিয়ে রাখতে হবে। যাতে টার্কির জন্য নরম ও আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি হয়।
- ঘরের ছাদ কমপক্ষে ৮-১০ ফুট উঁচু হতে হবে। এটি বাতাস চলাচল নিশ্চিত করবে এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে।
- খাবার এবং পানির পাত্র এমনভাবে বসাতে হবে যেন সব টার্কি সহজে খেতে পারে।
- ঘরের উপরের দিকে জানালা বা ভেন্টিলেশন তৈরি করতে হবে যাতে বায়ু চলাচল সহজ হয়।
- রোগ প্রতিরোধের জন্য ঘর নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
আবাসনের সঠিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
বাচ্চা টার্কির জন্য প্রথম সপ্তাহে তাপমাত্রা ৯৫°F (৩৫°C) রাখতে হবে এবং প্রতি সপ্তাহে ৫°F করে কমাতে হবে। বড় টার্কি বা পূর্ণবয়স্ক টার্কির জন্য ঘরের তাপমাত্রা ৬৫-৭৫°F (১৮-২৪°C) বজায় রাখাই আদর্শ। তবে শীতকালে হিটারের ব্যবহার এবং গরমকালে ঘর ঠাণ্ডা রাখার ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়।
টার্কির খাদ্য ও পুষ্টি ব্যবস্থাপনা
টার্কি পালনের সাফল্যের জন্য সঠিক খাদ্য ও পুষ্টি ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টার্কির বিভিন্ন বয়সে খাদ্য চাহিদা ভিন্ন হয়ে থাকে, তাই বয়স অনুযায়ী পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
টার্কির বিভিন্ন বয়সে খাদ্য প্রয়োজনীয়তা:
(১) বাচ্চা টার্কি (০-৮ সপ্তাহ):
- বাচ্চা টার্কিদের দ্রুত বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে ২৮% প্রোটিন সমৃদ্ধ স্টার্টার ফিড দিতে পারেন।
- ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে।
- প্রতিটি বাচ্চার জন্য দিনে ২.৫-৩.৫ গ্রাম খাদ্যের প্রয়োজন হয়।
(২) কিশোর টার্কি (৯-১৬ সপ্তাহ):
- ২০-২২% প্রোটিন সমৃদ্ধ গ্রোয়ার ফিড দিতে হবে।
- খাদ্যে ভিটামিন বি, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস থাকা জরুরি।
(৩) পূর্ণবয়স্ক টার্কি (১৭ সপ্তাহ ও এর বেশি):
- প্রাপ্তবয়স্ক টার্কির জন্য ১৬-১৮% প্রোটিন সমৃদ্ধ ফিনিশার ফিডই যথেষ্ট।
- এ সময় খাদ্যের পাশাপাশি শস্যজাতীয় খাবার যেমন ভুট্টা, গম, ওটস সরবরাহ করা যায়।
- বড় টার্কির প্রতিদিন ২০০-৩০০ গ্রাম খাবারের প্রয়োজন হয়।
উপরে উল্লেখিত বয়স ভেদে টার্কির বিভিন্ন খাবারের পাশাপাশি মাছের গুঁড়ো, সয়াবিন মিল ও সূর্যমুখী খৈল, সবুজ ঘাস, কচি পাতা এবং শাকসবজিও দিতে হবে। এগুলো প্রাকৃতিকভাবে পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে থাকে।
আরও পড়ুনঃ মৌমাছি পালন বা মৌমাছি চাষের ব্যবসা করার নিয়ম।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও রোগ প্রতিরোধ
টার্কি পালনে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক যত্ন এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করলে বিভিন্ন রোগের কারণে টার্কির উৎপাদনশীলতা কমে যায়। তাই রোগ প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
সাধারণত টার্কির যেসকল রোগগুলো হয়ে থাকে, সেগুলো হলো- ব্ল্যাকহেড ডিজিজ, কক্সিডিওসিস, এভিয়ান পক্স, রেসপিরেটরি সমস্যা ইত্যাদি। এ সকল রোগ প্রতিরোধের জন্য আপনাকে শুরু থেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন:
- বাচ্চা টার্কিকে প্রথম দিকে নিয়মিত মারেক ডিজিজ, নিউক্যাসল ডিজিজ ও পক্স টিকা দিতে হবে।
- টার্কির আবাসস্থল সবসময় পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে।
- খাবার ও পানির পাত্র নিয়মিত ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করা জরুরি।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
- রোগের লক্ষণ দেখা গেলে দ্রুত পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
টার্কির ডিম উৎপাদন ও প্রজনন
টার্কি পালন করার সময় ডিম উৎপাদন ও প্রজনন পদ্ধতির দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হয়। সঠিক প্রজনন পদ্ধতি অনুসরণ করে ডিম উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। সাধারণত ৭ মাস বয়সী টার্কি প্রজননের জন্য উপযুক্ত।
প্রজননের জন্য, ৭-৮ টি মাদি টার্কির জন্য ১টি পুরুষ টার্কি পর্যাপ্ত। প্রাপ্তবয়স্ক মাদি টার্কি বছরে ১০০-১৫০টি ডিম দেয়, তবে ভাল যত্ন ও সঠিক খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে এটি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। টার্কির ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর জন্য তাপমাত্রা ১০৭-১০৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৪২-৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) রাখতে হবে। সম্ভব হলে আপনি অটোমেটিক ইনকিউবেটর ব্যবহারের মাধ্যমে তাপমাত্রা ও আদ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে টার্কির বাচ্চা ফোটাতে পারেন।
টার্কি বাজারজাতকরণ
সাধারণত খাদ্য গ্রহণের পর ৫-৭ মাস বয়সে টার্কি বাজারজাত করতে হয়। এই সময়ে টার্কির সঠিক ওজন ও স্বাস্থ্য উন্নত থাকে। ফলে বাজারে ভালো দাম পাওয়া যায়। তবুও বিক্রির আগে স্থানীয় বাজারের চাহিদা যাচাই করে নেওয়া উচিত।