২০২৫ সালের যারা মধ্যম পরিমান পুঁজি নিয়ে উৎপাদনমূলক ব্যবসা শুরু করতে চাচ্ছেন, তারা বাচ্চাদের খেলনা তৈরীর ব্যবসা আইডিয়াটি কাজে লাগাতে পারেন।
ব্যবসা করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের মানসিকতা থাকা অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং লাভজনক। বর্তমান সময়ে দীর্ঘমেয়াদী চাহিদা সম্পন্ন একটি ক্ষেত্র হলো বাচ্চাদের খেলনা উৎপাদন। তাই যেসকল উদ্যোক্তা ভাইয়েরা এই উৎপাদনমূলক ব্যবসাটি শুরু করতে চাচ্ছেন, তাদের জন্য এই আর্টিকেলে বাচ্চাদের খেলনা তৈরীর ব্যবসা আইডিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা তুলে ধরা হলো।
বাংলাদেশে বাচ্চাদের খেলনার বর্তমান বাজার চাহিদা
বাংলাদেশে বাচ্চাদের খেলনা উৎপাদন অত্যন্ত চাহিদাসম্পন্ন একটি খাত। খেলনার প্রতি চাহিদা শুধু শহরাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নয়, গ্রামাঞ্চলেও রয়েছে অনেক আগে থেকেই। স্থানীয়ভাবে তৈরিকৃত এবং আন্তর্জাতিকভাবে তৈরিকৃত উভয় ধরনের খেলনার প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ লক্ষণীয়।
বর্তমানে, অভিভাবকরা শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে সহায়ক এমন খেলনার দিকে বেশি ঝুঁকছেন। এক্ষেত্রে শিক্ষামূলক খেলনা, যেমন পাজল, বিল্ডিং ব্লক, এবং আর্ট-ক্রাফট সেটের চাহিদা বেশি বড়ছে। এছাড়া, টেকনোলজি ভিত্তিক খেলনা, যেমন ইলেকট্রনিক গ্যাজেট ও রিমোট কন্ট্রোল গাড়িও ক্রমাগত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে চীন থেকে আমদানিকৃত খেলনা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। কারণ সেগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি সাশ্রয়ী হয়। তবে বর্তমানে অভিভাবকরা দেশীয় বিভিন্ন খেলনা, বিশেষ করে নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব উপকরণ দিয়ে তৈরি খেলনা বেশি খুজে থাকেন।
এছাড়া, শিশুদের বয়স ও আগ্রহের ওপর নির্ভর করে খেলনার ধরণেও বৈচিত্র্য দেখা যায়। যেমন, নবজাতক থেকে পাঁচ বছর বয়সীদের জন্য নরম পুতুল এবং সুরক্ষিত প্লাস্টিকের খেলনার চাহিদা বেশি। আবার ৬-১২ বছর বয়সীদের জন্য ক্রিয়েটিভ বা ইলেকট্রনিক খেলনা বেশি জনপ্রিয়।
আরও পড়ুনঃ লাভজনক কয়েকটি উৎপাদনমুখী ব্যবসায় আইডিয়া।
বাচ্চাদের খেলনা তৈরীর ব্যবসা
ব্যবসার জন্য প্রাথমিক বাজেট/ মূলধন নির্ধারণ
বাচ্চাদের খেলনা তৈরির ব্যবসায় প্রাথমিক বাজেট নির্ধারণ করার সময় পণ্য উৎপাদন, উপকরণ সংগ্রহ, বিপণন, এবং অন্যান্য খরচ বিবেচনায় রাখতে হবে। একটি ছোট পরিসরের উৎপাদনমূলক ব্যবসা শুরু করতে ১,০০,০০০ থেকে ৩,০০,০০০ টাকার মতো মূলধন প্রয়োজন হতে পারে। এখানে যেসকল ক্ষেত্রে খরচগুলো হতে পারে সেগুলো হলো:
- মেশিন ও সরঞ্জাম: খেলনা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় মেশিন কিনতে ৩০,০০০-৫০,০০০ টাকা।
- প্রয়োজনীয় উপকরণ: পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক, কাঠ, রঙ, এবং অন্যান্য কাঁচামাল কেনার জন্য ৫০,০০০-৭০,০০০ টাকা।
- বিপণন খরচ: অনলাইন মার্কেটিং, সোশ্যাল মিডিয়া প্রমোশন, এবং প্যাকেজিংয়ে ২০,০০০-৩০,০০০ টাকা।
- অন্যান্য খরচ: কর্মচারী মজুরি, অফিস বা ওয়ার্কশপ ভাড়া এবং বৈদ্যুতিক খরচের জন্য ১০,০০০-২০,০০০ টাকা।
এছাড়াও বাজেট নির্ধারণের আগে বাজার গবেষণা করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিভিন্ন এলাকায় এসকল খরচ গুলোর পরিমাণ কম বেশি হতে পারে। এর মাধ্যমে আপনি বিনিয়োগকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে দ্রুত লাভবান হতে পারবেন।
আরও পড়ুনঃ সাপ্লাই ব্যবসা কী? বাংলাদেশে সাপ্লাই ব্যবসা করার নিয়ম।
ব্যবসা শুরুর লাইসেন্স সংগ্রহ
বাচ্চাদের খেলনা উৎপাদনের ব্যবসাটি শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি অনুমোদন নিয়ে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে আপনাকে স্থানীয় সিটি কর্পোরেশন বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে। যদি আপনার তৈরি খেলনার নিজস্ব ডিজাইন থাকে, তাহলে পেটেন্ট বা কপিরাইটের মাধ্যমে সেটি সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করতে পারেন।
ব্যবসার আয় অনুযায়ী সরকারের নিয়ম মেনে কর প্রদান করতে হবে। VAT ও আয়কর সম্পর্কিত নীতিমালা মেনে চললে ব্যবসা পরিচালনায় সমস্যা এড়ানো যায়। এক্ষেত্রে আপনি TIN Certificate সংগ্রহ করতে পারেন। এসকল লাইসেন্স বা অনুমোদন ব্যবসার আইনি সুরক্ষা এবং গ্রাহকদের আস্থার জন্য অপরিহার্য।
ম্যানুয়াল ও যান্ত্রিকভাবে বাচ্চাদের খেলনা উৎপাদন পদ্ধতি
বাচ্চাদের খেলনা উৎপাদনে ম্যানুয়াল এবং যান্ত্রিক উভয় পদ্ধতিরই ব্যবহার রয়েছে। ব্যবসার পরিধি, বাজেট, এবং দক্ষতার ওপর নির্ভর করে একজন উদ্যোক্তা যে কোনো একটি পদ্ধতি বা উভয়ের সমন্বয় বেছে নিতে পারেন। নিচে দুটি পদ্ধতির ক্ষেত্রেই উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাধারণ ধারণা দেওয়া হলো:
(১) ম্যানুয়াল পদ্ধতি
ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে উৎপাদন কাজের অধিকাংশই হাতের শ্রম দিয়ে সম্পন্ন করা হয়। এটি মূলত ছোট বা হস্তশিল্পভিত্তিক ব্যবসার জন্য উপযোগী। এই প্রক্রিয়ায় কাঠ, প্লাস্টিক, কাপড় বা নরম উপকরণ হাতে কাটা, নকশা করা এবং রঙ করা হয়। এক্ষেত্রে সৃজনশীল নকশা তৈরি করতে দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন। তারপর সেই নকশা অনুযায়ী খেলনার গঠন এবং রঙের জন্য একাধিক স্তরে কাজ করা হয়।
ম্যানুয়াল পদ্ধতির সুবিধা হলো কম খরচ এবং সহজে কাজ শুরু করা যায়। তবে এতে উৎপাদন ধীরগতির হয় এবং বড় পরিসরে চাহিদা মেটানো কঠিন হবে।
আরও পড়ুনঃ চামড়ার ব্যাগ উৎপাদন ব্যবসা আইডিয়া।
(২) যান্ত্রিক পদ্ধতি
যান্ত্রিক পদ্ধতিতে আধুনিক মেশিন ব্যবহার করে খেলনা তৈরি করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ইঞ্জেকশন মোল্ডিং মেশিন, কাটার, এবং থ্রি-ডি প্রিন্টিং মেশিন ব্যবহার করে কাঙ্ক্ষিত আকারে খেলনা তৈরি করা হয়। এই পদ্ধতিতে একই সময়ে বেশি পরিমাণ খেলনা উৎপাদন করা সম্ভব। মেশিন ব্যবহার করার ফলে প্রতিটি খেলনার আকার, গঠন, এবং মানের স্থিরতা বজায় রাখা সহজ হয়।
মূলত এই যান্ত্রিক পদ্ধতি বড় পরিসরের উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয় এবং এটি সময় ও শ্রম বাঁচায়। তবে এর জন্য উচ্চ মূলধন এবং প্রশিক্ষিত কর্মীরও প্রয়োজন রয়েছে। তাছাড়া উভয় পদ্ধতির সমন্বয়েও একজন উদ্যোক্তা দক্ষতার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে।
শিশুদের পছন্দ অনুযায়ী ডিজাইনিং ও প্রোটোটাইপ তৈরি
শিশুদের পছন্দ অনুযায়ী খেলনার ডিজাইনিং এবং প্রোটোটাইপ তৈরি একটি সৃজনশীল ও গবেষণাধর্মী প্রক্রিয়া। এর জন্য, প্রথমে বাজার গবেষণার মাধ্যমে শিশুদের বয়স, আগ্রহ, এবং শখের উপর ভিত্তি করে খেলনার ধরণ নির্ধারণ করতে হবে। সাধারণত রঙিন, মজার আকৃতির এবং শিক্ষামূলক খেলনার প্রতি শিশুদের বেশি আগ্রহ দেখা যায়।
ডিজাইনিংয়ের সময় বিভিন্ন সৃজনশীল সফটওয়্যার, যেমন- CAD বা Computer-Aided Design ব্যবহার করতে হয়। এরপর প্রোটোটাইপ তৈরি করতে থ্রি-ডি প্রিন্টিং বা ম্যানুয়াল মডেলিংয়ের সাহায্য নিতে হয়। এই প্রোটোটাইপ শিশুদের হাতে পরীক্ষা করে তাদের প্রতিক্রিয়া মূল্যায়ন করতে হয়। এভাবে শিশুদের পছন্দ অনুযায়ী নিরাপদ এবং মানসম্পন্ন খেলনা তৈরি সম্ভব হয়। শিশুদের পছন্দ অনুযায়ী খেলনা তৈরি করাটা ব্যবসার সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আরও পড়ুনঃ ২০২৫ সালে শুরু করার জন্য সেরা কয়েকটি বড় ব্যবসার আইডিয়া।
খেলনায় বাচ্চাদের নিরাপত্তা ও মান নিয়ন্ত্রণ
বাচ্চাদের খেলনায় নিরাপত্তা ও মান নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অভিভাবকদের আস্থা অর্জনে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন খেলনা উৎপাদন প্রতিটি ব্যবসার সফলতার অন্যতম চাবিকাঠি। খেলনা তৈরিতে অ-বিষাক্ত এবং পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। ছোট অংশ বা ধারালো প্রান্ত এড়ানো উচিত, কারণ এগুলো শিশুদের শ্বাসরোধ জনিত সমস্যা এবং আঘাতের ঝুঁকি বাড়ায়।
নিবন্ধিত উৎপাদনমূলক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিটি খেলনার গুণমান নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়। প্রোডাক্ট ল্যাব টেস্টিং এবং প্রোটোটাইপ চেকিং প্রক্রিয়ায় খেলনার সুরক্ষা যাচাই করে নিতে হয়।
তৈরিকৃত খেলনা বাজারজাতকরণ
বাচ্চাদের খেলনা বিক্রিতে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, সোশ্যাল মিডিয়া, এবং রিটেইল স্টোর তিনটি মাধ্যমই অত্যন্ত কার্যকর। নিচে এই তিনটি উপায় সম্পর্কেই সংক্ষিপ্ত তথ্য দেওয়া হলো:
(১) রিটেইল স্টোর
স্থানীয় রিটেইল স্টোর বা সুপার শপে খেলনা বিক্রি করলে সরাসরি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো সম্ভব হয়। এখানে পণ্য স্পর্শ ও পরীক্ষা করার সুযোগ থাকায় ক্রেতাদের বিশ্বাস বাড়ে। তাই আপনি সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে পারেন আপনার নিকটস্থ বিভিন্ন দোকান ও সুপারশপ গুলোতে।
(২) অনলাইনে বিক্রি
বাংলাদেশের বিভিন্ন বড় বড় ই-কমার্স ওয়েবসাইটে কিংবা নিজস্ব একটি ই-কমার্স ওয়েবসাইট তৈরি করে পণ্য বিক্রি করাটা একটি জনপ্রিয় ও কার্যকর পদ্ধতি। এখানে পণ্যের ছবি, বিবরণ, এবং ভিডিও ব্যবহার করে সহজেই গ্রাহকদের আকৃষ্ট করা যায়। অনলাইনে বিক্রি পদ্ধতিতে স্টোর পরিচালনার খরচ কম থাকে এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পণ্য পৌঁছানো যায়।
(৩) সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মে প্রচারণা চালিয়ে লক্ষ্যমাত্রা ভিত্তিক ক্রেতাদের কাছে পণ্যের তথ্য ও ছবি পৌঁছানো সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে কাস্টমার রিভিউ, লাইভ স্ট্রিমিং এবং কনটেস্টের মাধ্যমে ক্রেতাদের আগ্রহ তৈরি করা যায়।
উপরোক্ত তিনটি পদ্ধতি ছাড়াও আপনি বিভিন্ন হোলসেল মার্কেটে কিংবা নিজস্ব একজন সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ নিয়োগ করে আশেপাশের কসমেটিকস ও বাচ্চাদের খেলনা দোকানগুলোতে পাইকারি দরে পণ্য সরবরাহ করতে পারেন। একজন সফল উদ্যোক্তা হতে চাইলে সবগুলো ব্যবস্থাই পাশাপাশি গ্রহণ করা উচিত।
বাংলাদেশে খেলনা উৎপাদন ব্যবসায় সাফল্যের উদাহরণ
বাংলাদেশে খেলনা উৎপাদন খাতে অন্যতম একটি উদাহরণ হল চাঁদপুরের মোঃ আমান উল্লাহ। তিনি মাত্র ৯০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে খেলনা তৈরির ব্যবসা শুরু করেছিলেন। উন্নত মানের খেলনা উৎপাদনের মাধ্যমে তিনি স্থানীয় পাইকারি ব্যবসায়ীদের আস্থা অর্জন করেছিলেন। পরবর্তীতে সেই পাইকারি ব্যবসায়ীরা তাকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল। তারপর ক্রমান্বয়ে তার ব্যবসাটি প্রসারিত হতে থাকে। এবং এক পর্যায়ে বার্ষিক ২৫ কোটি টাকার বিক্রির লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়।
এই সাফল্য প্রমাণ করে যে, সঠিক পরিকল্পনা ও মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশে খেলনা শিল্পে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন সম্ভব। তবে সম্পূর্ণ বিষয়টাই তাকদীরের উপর নির্ভরশীল। তাই দীর্ঘদিন ধৈর্য্যধারণ করে উদ্যোক্তা মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।