ছোটবেলায় তিলের-খাজা কে না খেয়েছে? আপনার জেনে অবাক হবেন তিলের খাজার উপর যে ছোট ছোট সাদা সাদা তিল লেগে থাকে, ওটা পিষে তৈরি হয় তিলের তেল। যা খুবই দামী এবং খুবই পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। তিলের তেলের অনেক ব্যবহার রয়েছে। তা আমাদের এই ‘তিলের তেলের উপকারিতা ও অপকারিতা’ আর্টিকেলে তুলে ধরা হলো।
তিলের তেল উপকারিতা
তিলের তেলের নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে এবং এটার উপকারিতাও রয়েছে অনেক। আজ আপনাদের জন্য তিলের তেলের উপকারিতা সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে এই আর্টিকেলে বলা হবে।
- তিলের তেলের আছে অনেক গুণাগুণ। যদি কেউ সকালবেলা দুই চামচ তিলের তিল সেবন করে, তাহলে বল ও পুষ্টি উভয় পাবে। সেই সাথে দাঁত হবে মজবুত। তিলের তেল দাঁত পরিষ্কার করতেও সাহায্য করে।
- তিলের তেল নিয়মিত খেলে অর্শ রোগের সমস্যা খুব দ্রুত সমাধান হয়।
- তিলের তেল বাচ্চাদের জন্য খুবই উপকারী। এটার তেমন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই বলে বাচ্চাদেরকে প্রতিদিন আধা চামচ তিলের তেল খাওয়ালে ভালো উপকার পাওয়া যায়। তবে কখনোই বেশি পরিমাণে খাওয়ানো যাবে না।
- এটা মালিশের জন্য উৎকৃষ্ট একটি তেল। শিশুদেরকে সকালবেলার মিষ্টি রোদে শুইয়ে এই তেল দিয়ে মালিশ করলে শিশুর শরীরের ভিটামিন ডি উৎপন্ন হবে। এতে করে হাড় হবে মজবুত। মাংসপেশীতে মালিশের ফলে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পাবে। ফলে মাংসপেশিতে জোর পাবে।
- শরীরের কোথাও পুড়ে গেলে সেই জায়গায় তিলের তেল ঢেলে দিলে সহজে ফোসকা পড়ে না। সেই সাথে পানিতে তিলের তেল, সামান্য ঘি ও কর্পূর মিশিয়ে প্রলেপ লাগিয়ে দিলে খুব দ্রুত আরাম পাওয়া যাবে। যদি ঘা শুকাতে দেরি হয় তাহলে তিলের তেল হালকা গরম করে অর্থাৎ সহনীয় পর্যায়ে গরম করে ক্ষতস্থানে ঢেলে দিলে তা দ্রুত শুকায়। কেননা তিলের তেলের মধ্যে আছে আন্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান— যা ক্ষত স্থানে থাকা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সমূহকে মেরে ফেলে। সেই সাথে ক্ষত শুকাতে সাহায্য করে।
- আরও পড়ুন: তালমাখনা উপকারিতা ও অপকারিতা
- অনেক সময় দেখা যায় শরীরের বিভিন্ন অংশে অযথাই জ্বলতে থাকে। এমত অবস্থায় ২ চামচ টক দই এবং এক চামচ তিলের তেল ভালোভাবে মিশিয়ে সেই স্থানে প্রলেপ দিলে আরাম পাওয়া যায়।
- যে সকল কাটা ঘা সেরে উঠতে খুব দেরি করছে। সামান্য পুঁজ দেখা যাচ্ছে। এখানে তিলের তেল ও খাঁটি মধু একসাথে মিশিয়ে প্রলেপ দিলে খুব দ্রুত ক্ষত সেরে ওঠে।
- বাতের ব্যথায় তিলের তেল মালিশ করলে খুব আরাম পাওয়া যায়। এজন্য প্রথমে কয়েক গোয়া রসুন কুচি তিলের তেলে দিয়ে হালকা ভেজে নিতে হবে। এরপর রসুনগুলো ছেঁকে ফেলে দিয়ে তিলের তেল দিয়ে মালিশ করলে খুব আরাম পাওয়া যায়।
- শীতকালে ফাটা হাত-পা এমনকি গাল বা ঠোঁটেও তিলের তেল লাগালে উপকার হয়।
- দীর্ঘক্ষণ সাঁতার কাটার ফলে কানে পানি পানি ঢুকে যায় এবং কান ব্যথা করে। এমতাবস্থায় কুসুম গরম তিলের তেল কয়েক ফোঁটা কানে দিলে কান ব্যথা ভালো হয়।
- অন্যান্য তেল হজম হতে বেশ সময় নেয়। কিন্তু তিলের তেল খুব সহজে হজম হয়ে যায় এবং এর পুষ্টি সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। তাই এই তেল নিয়মিত পরিমিত পরিমাণে পান করলে দেহ থাকে সুস্থ।
- নিঃসন্দেহে অলিভ অয়েল খুবই পুষ্টিকর এবং নানান ধরনের গুণাগুণে ভরপুর। অলিভ অয়েল এর সাথে তুলনা করলে তিলের তেল কোনো অংশে কম নয়। আমাদের দেশে উৎপন্ন এই তেল অলিভ অয়েল এর বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। কেননা এটা স্বাদ অলিভ অয়েলের চাইতেও ভালো। আমাদের উচিত উচ্চ দাম দিয়ে বিদেশি অলিভ অয়েল না ক্রয় করে দেশীয় তিলের তেল ক্রয় করে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে চাঙ্গা করা।
- যে সকল মেয়েদের ঋতুস্রাব ঠিকমতো হয় না। ঋতুস্রাবকালীন সময়ে তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা করে, এমত অবস্থায় তিলের তেল কুসুম গরম করে দুই তিন চামচ খেলে ব্যথা কমে যায় এবং ঋতুস্রাব ঠিক মতো হয়।
- গর্ভবতী নারীর জন্য পুষ্টিটিকর খাদ্য আবশ্যক। কেননা এই সময় তার পেটের সন্তান বড় হতে থাকে এবং সেই সন্তানের জন্য আলাদা খাদ্যের প্রয়োজন হয়। এমতাবস্থায় তিলের তেল পুষ্টিকর খাদ্যের তালিকায় যুক্ত হতে পারে।
- কবিরাজি চিকিৎসায় রক্ত আমাশা দূর করণে তিলের তেল ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহুকাল ধরে। এখানে তিলে তেলের সাথে মধু, অ্যালোভেরা, শতমূলী গুঁড়া মিশিয়ে খেলে মলের সাথে রক্ত আসা বন্ধ হয়।
- অর্শ রোগের চিকিৎসায় তিলের তেল ব্যবহৃত হয়। তিলের তেলের সাথে নাগেশ্বর গুঁড়া (কবিরাজি দোকানে পাওয়া যায়) মধু মিশিয়ে সেবন করলে অর্শ রোগ সারে। এছাড়া মাখনের সাথে তিলের তেল মিশিয়ে খেলে অর্শ রোগীর আরাম হয়।
- বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষ আছে যাদের মুখে পাইরিয়া রোগ হয়। এটা দাঁতের মাড়ি দুর্বল করে ফেলে এবং সেখানে ক্ষতের সৃষ্টি করে। এমত অবস্থায় গরম পানিতে তিলের তেল মিশিয়ে ভালোভাবে কুলি করতে হবে। এভাবে নিয়মিত কুলি করলে খুব দ্রুত পাইরিয়া রোগ ভালো হবে।
- দাঁত যদি খুব ব্যথা করে তাহলে তিলের তেল সরাসরি ব্যথাযুক্ত স্থানে প্রয়োগ করতে হবে। তুলোতে তিলের তেল ভিজিয়ে সেখানে রেখে দিতে হবে। অতি দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। কেননা দাঁতের রোগ নিয়ে অবহেলা করলে এটা ভবিষ্যতে মারাত্মক আকার ধারণ করবে।
- জেনে নিন: সাবুদানা খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
- পানিতে তিলের তেল, তেজপাতা, সামান্য গোলমরিচ নিয়ে সিদ্ধ করতে হবে। এরপর এটার বাষ্প নাক দিয়ে টানলে দ্রুত বন্ধ নাক খুলে যাবে।
- তিলের তেলের সাথে ঘি মিশিয়ে গরম করে সেটা ফাটা গোড়ালিতে লাগাতে হবে। এরপর বেশ কিছুক্ষণ রেখে দিলে ফাটা গোড়ালি যখন নরম হয়ে যাবে— তখন সেটা খসখসে ঝামায় ঘষে মৃত চামড়া গুলো উঠিয়ে ফেলতে হবে। এরপর ভালোভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছে আবার তিলের তেল দিয়ে মেখে দিতে হবে। এভাবে প্রতি সপ্তাহে দুইবার করে করলে কয়েক সপ্তাহ পর পা হয়ে উঠবে বাচ্চাদের মতো কোমল।
- সেই প্রাচীনকাল থেকেই পুড়ে যাওয়া স্থানে তিলের তেলের ব্যবহার হয়ে আসছে। শরীরের কোনো অংশে যদি আগুন লেগে পুড়ে যায় তাহলে সেখানে তিলের তেল ঢেলে দিলে সহজে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ হতে পারে না। ফলে দ্রুত ক্ষত সেরে যায়।
- আমাদের দেশের চিকেন-পক্স বা জলবসন্ত খুবই কমন একটি রোগ। এটা হলে সারা দেহ ছোট ছোট ফোঁড়া দিয়ে ভরে ওঠে। এ সময় তিলের তেল হালকা করে প্রলেপ দিলে দ্রুত চিকেন-পক্স বা জলবসন্ত রোগ ভালো হয়। কিন্তু এই রোগ সেরে যাবার পর শরীরে অনেক ক্ষতচিহ্ন এবং দাগ রয়ে যায়। তখন তিলের তেল দিয়ে মালিশ করলে দাগ কিছুটা কমে যাবে।
ত্বকের যত্নে তিলের তেলের ব্যবহার
ত্বকের যত্নে তিলের তেলের ব্যবহার হয়ে থাকে। আসুন জেনে নেই ত্বকের যত্নে তিলের তেলের ব্যবহারগুলো।
- শীতকালে ছেলে বুড়ো সকলের ত্বক ফেটে যায়। কারণ ওই সময় বাতাসে আর্দ্রতা খুব কম থাকে। তাই তখন দেখা যায় মানুষজন বিভিন্ন কেমিক্যাল যুক্ত লোশন ব্যবহার করে ত্বক ফাটা রোধ করতে। কিন্তু এ সকল কেমিক্যাল যুক্ত প্রসাধনী ব্যবহারে ত্বকের দীর্ঘ স্থায়ী ক্ষতি করা হয়। তাই উচিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হীন ভেষজ এই তেল ব্যবহার করা। যা শতভাগ নিরাপদ ত্বকের জন্য।
- এই তেলে আছে অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান যা ত্বক থেকে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া দূরে রাখে।
- আরও পড়ুন: আতা ফলের উপকারিতা
- এটা দিয়ে প্রতিদিন চেহারা মালিশ করলে মৃত কোষ গুলো বের হয়ে আসে এবং নতুন কোষ তৈরিতে সাহায্য করে।
- মানুষজন শরীরের মাংসপেশিতে রক্ত চলাচল বৃদ্ধির জন্য বডি মালিশ করে থাকে। তিলের তেল দিয়ে বডি মালিশ করলে দেহের জন্য খুব ভালো হয়।
- গোসলের পর কয়েক ফোঁটা তিলের তেল মুখে মালিশ করলে ত্বক খুবই কোমল থাকে। তবে খেয়াল রাখতে হবে জানো ধূলি-ময়লার জমে ত্বকের লোমকূপ বন্ধ করে না ফেলে।
চুলের যত্নে তিলের তেল
- তিলের তেলে আছে ফ্যাটি এসিড যা চুলের রুক্ষতা দূর করে।
- তিলের তেল চুলকে প্রাকৃতিকভাবে কালো রক্তে সাহায্য করে।
- তিলের তেলে থাকা ভিটামিন ও মিনারেল সমূহ মাথার চুল বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং গোড়া মজবুত করে।
- তিলের তেল দিয়ে মাথায় মেসেজ করলে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায় এবং মাথা থাকে শান্ত।
- তিলের তেল চুলের উজ্জ্বলতা বাড়ায়।
তিলের তেলের অপকারিতা
তিলের তেল খুবই দামি এবং উচ্চমাত্রার পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। বিভিন্ন চিকিৎসা এবং রূপচর্চায় এটার ব্যবহার হয়ে থাকে। আজকাল বাজারে বিভিন্ন কোম্পানি তিলের তেল বিক্রি করেছে। কিন্তু সকল তিলের তেল কি আসল? নকল তেল ব্যবহার করে মানুষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই আসল এবং বিশুদ্ধ তিলের তেল ক্রয় করতে হবে।
ক্লিয়ার তেল সাধারণত মানুষের জন্য তেমন একটা ক্ষতিকর নয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আরও পড়ুন: গরম পানি খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
যাদের অ্যালার্জি থাকে তাদের অনেক সময় তিলের তেল ব্যবহারে এলার্জির পরিমাণ বৃদ্ধি হতে পারে। এছাড়া তিলের তেলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ক্যালরি। এই কালার যদি সঠিকভাবে খরচ না করা যায় তাহলে দেহে চর্বি জমে শরীর মোটা হয়ে যেতে পারে। তাই পরিশ্রম করে ক্যালরি ক্ষয় করতে হবে।
তিলের তেল ব্যবহারে সতর্কতা
তিলের তেল বায়ু ও আলোনিরোধক কাচের পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। কেননা এটায় বাতাস লাগলে বাতাসে থাকা অক্সিজেন দ্বারা রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়— যাকে বলে অক্সিডেশন। ফলে এই তিলের তেল মানুষের জন্য ক্ষতিকর হয়ে যায়। এবং এটায় সূর্যালোকের মধ্যে রাখলে তেলের পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়।