তালমাখনা উপকারিতা 

তালমাখনা উপকারিতা ও অপকারিতা 

রাস্তাঘাটে প্রায় সময় চলতে গেলে কিছু হকার ভেষজ ঔষধের পসরা নিয়ে বসে। লোকজন ভিড় জমায় সেগুলো দেখার জন্য। এছাড়া শরবতের দোকানগুলোতে যেখানে ভেষজ উপাদান দিয়ে সর্বোচ্চ তৈরি করা হয় সেখানে এই তালমাখনা খুব দেখতে পাওয়া যায়। তালমাখনা বহু কাল আগে থেকে কবিরাজি চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটা আমাদের দেশীয় একটি গাছ থেকে উৎপন্ন হয়। কিন্তু আজকাল এটার প্রচার-প্রচারণা বেশি একটা না থাকায় সাধারণ মানুষের দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে। এখন শুধু এগুলো কিছু কবিরাজি ঔষধের দোকানে শরবতের সাথেই বিক্রি হচ্ছে। জনসচেতনতা না থাকার কারণে আমাদের দেশ থেকে এই সকল ভেষজ উপাদানের ব্যবহার দিন দিন কমে যাচ্ছে।

এটা তাল বা মাখনাফুল কোনো কিছুরই সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়, তবুও এর নাম তালমাখনা। শুনতে বড় অদ্ভুত লাগে। তবে কিছু কিছু জায়গায় এটাকে কুলেখাড়া নামেও ডাকা হয়ে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ এই ভেষজ উদ্ভিদ এবং এর বীজ সম্পর্কে মানুষজন খুব কম জানে। তবে বোটানিক্যাল গার্ডেন গুলোতে খোঁজ নিলে এটা পাওয়া যেতে পারে।

তালমাখনা পরিচিতি 

অতি মূল্যবান এই ভেষজ উদ্ভিদ তালমাখনা এবং তালমূলী— এদের খুবই কাছাকাছি দুটো নাম। কিন্তু বাস্তবে দুটি উদ্ভিদই পৃথক প্রজাতির। এগুলো দেখতেও আলাদা। অনেকেই আছেন এই দুই উদ্ভিদকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে যান।

এই উদ্ভিদটির ইউনানি বা গ্রিক নাম তালমাখনা। তবে আয়ুর্বেদিক নাম বা প্রাচীন ভারতীয় নাম কোকিলাক্ষা। উদ্ভিদটির মাটির উপরের অংশে যেসকল রাসায়নিক উপাদান আছে তা হলো— অ্যালকালয়েড, ফাইটোস্টেরল, স্টিগমাস্টেরল, লুপিয়ল, উদ্বায়ী তেল ও হাইড্রোকার্বন।

আরও পড়ুন: সাবুদানা খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা

ফুলের মধ্যে আছে এপিজেনিন। এর বীজের মধ্যে তেল ও এনজাইম থাকে। এই গাছের মূল ব্যবহার্য অংশ হচ্ছে এর বীজ। যেটা পানিতে ভিজিয়ে শরবত বানিয়ে খাওয়া হয়। এই বীজ অনেক পুষ্টিকর, শুক্রবর্ধক এবং দেহে প্রফুল্লতা আনে। লিউকোরিয়া, শুক্রমেহ, যৌন দুর্বলতা ও স্নায়বিক দুর্বলতা দূরীকরণ ক্ষেত্রে এই বীজ অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। বিশেষত এই বীজ খাদ্য হজম, বায়ুনিঃসারক ও পাকস্থলীর ব্যথা নিবারণে সাহায্য করে।

তালমাখনার বৈজ্ঞানিক নাম Hygrophyla auriculata. এটা সাধারণত ৫০ সেমি থেকে ১ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। এর কাণ্ড থেকেই বহু শাখা-প্রশাখা বের হয়। ফুলের রঙ গাঢ় বেগুনি বা লাল কিংবা বেগুনি সাদা। বীজ ছোট এবং গোলাকৃতির‌। এটা দেখতে অনেকটা তিলের মতো দেখায়। বীজের রঙ গাঢ় খয়েরি। এর বীজ পানিতে ভিজিয়ে রাখলে তোকমার মতো আঠালো এবং চটচটে হয়। যা শরবত তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

এটার ইংরেজি নাম স্টার থর্ন। 

এই কাজটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল— অথবা যেখানে বছরের কিছু সময় পানি জমে থাকে এমন জায়গায় ভালো জন্মায়। হেমন্ত থেকে শীতকালের মধ্যে এর ফুল ফোটা শুরু হয়। ফুল থেকেই এর বীজ হয় এবং সেটা দ্রুত সংরক্ষণ করতে হয়। চাইতে খুব সহজে আপনি এটার চাষ আবাদ করে অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ করতে পারেন।

তালমাখনা উপকারিতা 

তালমাখনা উপকারিতা 

তালমাখনা একটি চমৎকার ভেষজ উদ্ভিদ এবং এটার শিকড় থেকে পাতা অবধি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। এটা লতাগুল্ম জাতীয় একটি উদ্ভিদ। এর আয়ুষ্কাল এক বছর। সাধারণত এটা ৫০ সেন্টিমিটার বা তারও একটু বেশি বড় হয়। কিন্তু অধিকাংশ সময় এটা ৩০ সেন্টিমিটারের বেশি বড় হতে দেখা যায় না।

‘তালমাখনা উপকারিতা ও অপকারিতা’ আর্টিকেলে এখন আমরা জানবো তালমাখনা খাওয়া এবং ব্যবহার করার কী কী উপকারিতা রয়েছে।

  • লিউকোমিয়া ও শুক্রমেহ রোগ: এমতাবস্থায় ৩ চামচ তালমাখনা বীজের গুঁড়ার সাথে ১ চামচ তেঁতুলের বীজের গুঁড়া দুধের সাথে মিশিয়ে প্রত্যহ এক কাপ করে ২ বেলা সেবন করলে রোগ মুক্তিতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে।
  • স্নায়ুবিক দুর্বলতায় ব্যবহার: তালমাখনা বীজের গুঁড়া ৩ চামচ, ১ চামচ পরিমাণ অশ্বগন্ধা, ৩ চা চামচ মধু এক সাথে মিশিয়ে প্রতিদিন ২ করে সেবন করলে স্নায়ুবিক দুর্বলতা কমে যাবে।
  • দেহের পুষ্টি সাধন ও দুর্বলতায়: ৩ চামচ তালমাখনা বীজের গুঁড়া ও ১ চামচ শতমূলী গুঁড়া একত্রে মিশিয়ে কুসুম গরম দুধের সাথে গুলিয়ে প্রতিদিন সকাল বেলা খালি পেটে এবং রাতে ঘুমানোর আগে সেবন করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
  • বাত ও অস্থিসন্ধির ব্যথায় তালমাখনা: বাত ও অস্থিসন্ধির ব্যথায় তালমাখনা পাতা বেটে সেটার প্রলেপ দিলে ব্যথা কমাতে কার্যকরী ভুমিকা পালন করে থাকে। এছাড়া প্রতিদিন এক চামচ তালমাখনা পানিতে ভিজিয়ে প্রতিদিন সকালবেলা পান করলে ভালো উপকার পাওয়া যাবে।
  • ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য: ডায়াবেটিস রোগীদের নানান দিকে সমস্যা রয়েছে। তারা দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ে। এর প্রভাব পড়ে তাদের যৌন জীবনে। তালমাখনা যৌনশক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভালো কবিরাজি চিকিৎসকগণ যুগ যুগ ধরে তালমাখনার ব্যবহার করে আসছে এই রোগে।
  • জেনে নিন: গরম পানি খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা 
  • লিভার ও কিডনির প্রতিবন্ধকতা দূর করে: অনেক সময় কিডনি পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্ত শোধন করতে পারে না। ফলে রক্তে দূষণ দেখা দেয় এবং বিভিন্ন চর্ম রোগের উত্থান ঘটে। এই যেমন ব্রণ উঠা, ফুসকুড়ি হওয়া। আবার লিভার ঠিকমতো পিত্ত রস তৈরি করতে না পারলে খাদ্য হজম করতে সমস্যা তৈরি হয়। তালমাখনার শিকড় ও পাতার রস কিডনি ও লিভারের এই সকল সমস্যা থেকে পরিত্রান পেতে সাহায্য করে। 
  • যৌবন শক্তি বৃদ্ধি: যৌবন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে তালমাখনার ব্যবহার করা অত্যন্ত উপকারী। কেননা এটার কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। এক থেকে দেড় চামচ তালমাখনা বীজ এক গ্লাস শীতল দুধের সাথে মিশিয়ে রেখে দিতে হবে কিছুক্ষণ। হলে তালমাখনা বীজ পানি শোষণ করে কিছুটা ফুলে উঠবে এবং এটা হজম তাড়াতাড়ি হবে। প্রতিদিন প্রতিদিন যদি এভাবে পান করেন— তাহলে আপনার বল বৃদ্ধি, যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং যৌন উদ্দীপনা বৃদ্ধিতে খুবই সাহায্য করবে।
  • যৌন সমস্যা দূর করে: অনেকের গুরুতর যৌন সমস্যা থাকে। তাদের জন্য তালমাখনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঔষধ হিসেবে কাজ করতে পারে। দুই চামচ তালমাখনা বীজের গুঁড়া, অশ্বমূল চূর্ণ এক চামচ, এক চিমটি শিলাজিৎ একত্রে করে কুসুম গরম দুধের সাথে মিশিয়ে রোজ পান করলে সমস্যা দূর হবে।
  • কোষ্ঠ পরিষ্কারক ও হজমকারক: আজকাল বাজারের ফাস্টফুড খাবার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য খুবই সাধারণ একটি বিষয় হয়ে গেছে। কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি পেতে তালমাখনার বীজ খুব কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এছাড়া এটা খাদ্য হজম করতেও দারুন কার্যকরী। এজন্য প্রতিদিন সকালবেলা অথবা রাতের বেলা তালমাখনার শরবত পান করতে হবে।
  • গ্যাস্টিক সমস্যা দূর করে: অনেকেই হয়তো জানে না তালমাখনা গ্যাস্ট্রিক হলে এটার উপশম করতে সক্ষম। বর্তমান নগর জীবনে বাহিরের বিভিন্ন ধরনের আজেবাজে খাবার খাওয়ার ফলে পেটে গ্যাস্টিক হয়ে যায়। ফলে বুক জ্বালাপোড়া শুরু হয়। এমতাবস্থায় তালমাখনা ও দই একসাথে মিশিয়ে সেবন করলে ভালো উপকার পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা দ্রুত গ্যাস্ট্রিক থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিভিন্ন গ্যাসের ট্যাবলেট ব্যবহার করি। যেগুলো সাময়িকভাবে গ্যাস্ট্রিক থেকে মুক্তি দিতে পারে কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে এটা মানবদেহের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
  • প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া দূর করে: অনেকের প্রস্রাব করতে জ্বালাপোড়া হয়। এটার একটি মূল কারণ হচ্ছে পানি কম পান করা। তাই বেশি বেশি পানি পান করতে হবে। কিন্তু সেই পানিটা যদি শরবত হয় তাহলে আরো ভালো। এতে করে পানি চাহিদা পূরণ হবে এবং দেহের অন্যান্য উপকারেও আসবে।

একটি উৎকৃষ্ট ভেষজ শরবত

আমরা চাইলেই ঘরে খুব সহজে একটি উৎকৃষ্ট ভেষজ শরবত তৈরি করতে পারি। বাজারের কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিংকস, কেমিক্যাল যুক্ত শরবত পান না করে ভেষজ শরবত পান করার অভ্যাস গড়ি। এতে করে শরীর থাকবে সুস্থ। মানসিকভাবেও থাকবেন প্রশান্তিতে। 

২৫০ মিলি শরবত তৈরির জন্য 

এক চামচ ইসুবগুলের ভুষি 

এক চামচ তালমাখনা 

আধা চামচ ত্রিফলা গুঁড়া 

আধা চামচ তোকমা

চিয়াসিড ও কাতিলা এক চামচ

এগুলো সব আধা ঘন্টার জন্য পানিতে গুলিয়ে রেখে দিতে হবে। এরপর পান করলে ভালো ফলাফল পাবেন।

তালমাখনা অপকারিতা 

সাধারণত তালমাখনা তেমন কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। এছাড়া এটা সাধারণত মানুষ দিনে এক থেকে দুই চামচের বেশি কেউ খায় না। তবে কারো হতো বেশি খাওয়ার ফলে কোনো ধরনের সমস্যা হতে পারে। তাই এটা পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।

উপসংহার

গরমের সময় আমরা সকলেই শরবত পান করি। রাস্তাতেও অনেক ভেষজ শরবত বিক্রি করা হয়। সেখানে ব্যবহৃত উপাদানগুলো নিঃসন্দেহে অনেক উপকারী। কিন্তু সেখানকার ব্যবহৃত পানি বিশুদ্ধ নয়। এমনিতেই ঢাকা শহরের পানিতে প্রচুর পরিমাণে জীবাণু রয়েছে। তাই দেখা যায় যে— শরবতের ভেষজ উপাদান যতটুকু না দেহের উপকার করে তার চাইতে বেশি অপকার করে সেখানকার ব্যবহৃত পানি। 

রমজান মাস আসলে প্রত্যেক ঘরে ঘরে ইফতারে শরবত তৈরি করার রেওয়াজ আছে। এ সময় রুহ আফজা কিংবা ট্যাং চিনির সাথে গুলিয়ে পান করা হয়। কিন্তু আপনারা জেনে আশ্চর্যিত হবেন যে রুহ আফজা হচ্ছে একটি ঘন চিনির শিরা এবং রঙের মিশ্রণ। বিজ্ঞাপনে বলা হয় এতে রয়েছে নানান ধরনের ফুল, ফল ও ভেষজ উপাদানের নির্যাস। কিন্তু বাস্তবে এটাতে ওই পরিমাণ পুষ্টি উপাদান নেই। বরঞ্চ সেটাতে থাকা চিনি আরো মানুষের ক্ষতি করে। এছাড়া ট্যাং জাতীয় পাউডারগুলো সম্পূর্ণ কেমিক্যাল দ্বারা তৈরি। কৃত্রিম রঙ ও স্বাদ বর্ধক উপাদানগুলো মানব দেহের প্রচণ্ড ক্ষতি করে।

তাই আপনি ঘরে বিভিন্ন ভেষজ উপাদান দিয়ে নিজেরাই শরবত তৈরি করতে পারেন। এতে করে আপনার শরীর থাকবে সুস্থ। 

About Juyel Ahmed Liton

সুপ্রিয় “প্রোবাংলা” কমিউনিটি, ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি আকর্ষণ ছিলো এবং হয়তো সেই আকর্ষণটা অন্য দশ জনের থেকে একটু বেশি। ওয়েবসাইট, টাইপিং, আর্টিকেল লেখাসহ টেকনোলজি সবই আমার প্রিয়। জীবনে টেকনোলজি আমাকে যতটা ইম্প্রেস করেছে ততোটা অন্যকিছু কখনো করতে পারেনি। আর এই প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ থেকেই লেখালেখির শুরু.....

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pro Bangla-প্রো বাংলা