তাহাজ্জুদ নামাজ মহান আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দা হওয়ার অন্যতম উপায়। মুসলিম নর-নারী ও ঈমানদারদের জন্য তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম মেনে আদায় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি নফল ইবাদত। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদের নামাজ নিয়মিত আদায় করতেন।
সঠিকভাবে নিয়ম মেনে এই নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি হাশরের দিন বিনা হিসেবে জান্নাতে যেতে পারবে। তাই জেনে নিন- তাই তাহাজ্জুদ নামাজ কি, নামাজের নিয়ম, দোয়া ও ফজিলত সম্পর্কে।
তাহাজ্জুদ নামাজ কি ও কেন পড়বো
তাহাজ্জুদের অপর নাম হল সালাতুল লাইল। তাহাজ্জুদ অর্থ ঘুম থেকে জাগা । মহান আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করার উদ্দেশ্যে গভীর রাতে এ নামাজ আদায় করা হয় বলে একে তাহাজ্জুদ নামাজ বলা হয়। ফরজ নামাজের পর অন্যান্য সুন্নত ও নফল নামাজের মধ্যে তাহাজ্জুদ নামাজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ।
তাহাজ্জুদ নামাজ হলো নফল ইবাদত। এ নামাজ মুসলিম জাতির জন্য সুন্নতে গায়রে মুয়াক্কাদা। অর্থাৎ নিয়ম অনুযায়ী তাহাজ্জুদ নামাজ পড়লে অনেক ফজিলত পাওয়া যায় আর না পড়লে কোন গুনাহ হবে না।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম অন্যান্য নামাজের মতই। পবিত্র হয়ে নামাজের আরকান- আহকাম গুলো অনুসরণ করে এই নামাজ আদায় করা যায়। তাহাজ্জুদ নামাজের সাধারণ নিয়ম গুলো হলো-
- তাকবীরে তাহরীমা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নামাজের নিয়ত করে হাত বাঁধুন।
- ছানা পড়ুন ও তারপর সূরা ফাতেহা পড়ুন।
- এরপর সূরা বা কেরাত পড়ুন। সম্ভাব্য হলে বড় কোন সূরা তেলাওয়াত করুন।
- অন্যান্য নামাজের মত রুকু ও সিজদা আদায় করুন। আর রুকু সিজদা দীর্ঘ হলে উত্তম।
- দ্বিতীয় রাকাত একই ভাবে আদায় করুন।
- বৈঠকে বসে তাশাহহুদ, দরুদ শরীফ ও দোয়া মাছুরা পড়ুন।
- সালাম ফিরানোর মাধ্যমে নামাজ সম্পন্ন করুন।
- তাহাজ্জুদ নামাজ একইভাবে দুই রাকাত করে আদায় করুন। সর্বোচ্চ এই নামাজ ২ থেকে ১২ রাকাত আদায় করা যায়। তবে ৮ রাকাত পড়াই উত্তম।
উল্লেখিতভাবে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম মেনে সহজে আদায় করতে পারবেন।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত
যেকোনো নামাজের নিয়তের সম্পর্ক হচ্ছে মনের সাথে। মনে মনে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে নামাজের ভাবনা স্থাপন করলেই নিয়ত হয়ে যায়। তবে আরবিতে নিয়ত করতে চাইলে, তা এরকম হবে-
নাওয়াইতুয়ান উছওয়াল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা , রাকাতাই ছালাতুল তাহাজ্জুদি সুন্নাতু রাসুলিল্লাহি তায়ালা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার।
বাংলা অর্থ : আমি আল্লাহর ওয়াস্তে কিবলামুখী হয়ে তাহাজ্জুদের দুই রাকাত সুন্নত নামাজের নিয়ত করিলাম ।
অথবা, ‘ মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য দুই রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত করছি।
তারপর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে হাত বাধতে হবে। এবং তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম অনুযায়ী আদায় করতে হবে।
তাহাজ্জুদ নামাজে সূরা ফাতেহার সাথে অন্য যে কোন সূরা মিলিয়েই আদায় করা যায়। তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম লম্বা কেরাত পড়া উত্তম। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যথাসম্ভব লম্বা কেরাত, লম্বা রুকু ও লম্বা সিজদা করতেন এবং এজন্য ওনার পা ফুলে যেত।
উনি কখনো এক রাকাতে সূরা বাকারা সম্পূর্ণ তেলাওয়াত করতেন। তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম অনুযায়ী উঁচু বা নিচু আওয়াজে কেরাত পড়া জায়েজ আছে।
তাহাজ্জুদ নামাজের দোয়া
তাহাজ্জুদ নামাজের সময় মহানবী (সাঃ) বেশ কিছু দোয়া পড়তেন। সেগুলো হলো-
তাহাজ্জুদ নামাজের আগের দোয়া
গভীর রাতে মহানবী (সাঃ) ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে কুরআনের এ আয়াতসহ সুরা আল-ইমরানের শেষ পর্যন্ত পড়তেন। – (বুখারি, মুসলিম ও মিশকাত)
আয়াতটি হলো:
رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذا بَاطِلاً سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ – رَبَّنَا إِنَّكَ
مَن تُدْخِلِ النَّارَ فَقَدْ أَخْزَيْتَهُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ – رَّبَّنَا
إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلإِيمَانِ أَنْ آمِنُواْ بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الأبْرَارِ
উচ্চারণ: রাব্বানা মা খালাক্বতা হাজা বাত্বিলান, সুবহানাকা ফাক্বিনা ‘আজাবান্নার। রাব্বানা ইন্নাকা মাং তুদখিলিন্নারা ফাক্বাদ্ আখঝাইতাহু, ওয়া মা লিজজ্বালিমিনা মিন্ আংছার। রাব্বানা ইন্নানা সামি’না মুনাদিআই ইউনাদি লিল ইমানি আন আমিনু বিরাব্বিকুম ফাআমান্না; রাব্বানা ফাগফিরলানা জুনুবানা ওয়া কাফ্ফির আন্না সাইয়্যেআতিনা ওয়া তাওয়াফ্ফানা মাআ’ল আবরার।’
অর্থ: ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। পবিত্রতা তোমারই জন্য। আমাদেরকে তুমি জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচাও। হে প্রতিপালক! নিশ্চয়ই তুমি যাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর তাকে অপমানিত কর। আর যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। হে আমাদের প্রভু! আমরা ঈমান আনার জন্য একজন আহবানকারীকে আহবান করতে শুনে ঈমান এনেছি। হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি আমাদের সকল গোনাহ মাফ করে দাও। আমাদের সকল দোষ-ত্রুটি দূর করে দাও। আর নেক লোকদের সঙ্গে আমাদের মৃত্যু দাও।’
এই দোয়াটি তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম নয়, তবে পড়া উত্তম।
তাহাজ্জুদ নামাজে দাঁড়িয়ে দোয়া
মহানবী (সাঃ) তাহাজ্জুদ নামাজে দাঁড়িয়ে যে দোয়াটি পাঠ করতেন তা নিম্নে দেয়া হলো :
اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ قَيِّمُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ وَلَكَ الْحَمْدُ، لَكَ مُلْكُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ،
وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ نُورُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ، وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ الْحَقُّ، وَوَعْدُكَ الْحَقُّ، وَلِقَاؤُكَ حَقٌّ، وَقَوْلُكَ حَقٌّ، وَالْجَنَّةُ حَقٌّ، وَالنَّارُ حَقٌّ،
وَالنَّبِيُّونَ حَقٌّ، وَمُحَمَّدٌ صلى الله عليه وسلم حَقٌّ، وَالسَّاعَةُ حَقٌّ، اللَّهُمَّ لَكَ أَسْلَمْتُ، وَبِكَ آمَنْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ، وَإِلَيْكَ أَنَبْتُ، وَبِكَ خَاصَمْتُ، وَإِلَيْكَ حَاكَمْتُ، فَاغْفِرْ لِي مَا قَدَّمْتُ وَمَا أَخَّرْتُ، وَمَا أَسْرَرْتُ وَمَا أَعْلَنْتُ، أَنْتَ الْمُقَدِّمُ وَأَنْتَ الْمُؤَخِّرُ، لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ ـ أَوْ لاَ إِلَهَ غَيْرُكَ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা লাকাল হামদু আংতা কায়্যিমুস সামাওয়অতি ওয়াল আরদি ওয়া মান ফিহিন্না ওয়া লাকালহামদু। লাকা মুলকুস সামাওয়অতি ওয়াল আরদি ওয়া মান ফিহিন্না। ওয়া লাকাল হামদু আংতা নুরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ। ওয়া লাকাল হামদু আংতাল হাক্কু। ওয়া ওয়া’দুকাল হাক্কু। ওয়া লিক্বাউকা হাক্কু। ওয়াল ঝান্নাতু হাক্কু। ওয়ান নারু হাক্কু। ওয়ান নাবিয়্যুনা হাক্কু। ওয়া মুহাম্মাদুন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা হাক্কু। ওয়াস সাআতু হাক্কু। আল্লাহুম্মা লাকা আসলামতু। ওয়াবিকা আমাংতু ওয়া আলাইকা তাওয়াক্কালতু। ওয়া ইলাইকা আনাবতু। ওয়া বিকা খাসামতু। ওয়া ইলাইকা হাকামতু। ফাগগফিরলি মা কাদ্দামতু ওয়া মা আখ্খারতু। ওয়া মা আসরারতু ওয়া মা আ’লাংতু। আংতাল মুকাদ্দিমু ওয়া আংতাল মুআখ্খিরু। লা ইলাহা ইল্লা আংতা। লা ইলাহা গাইরুকা।’ (বুখারি)
অর্থ: ‘হে আল্লাহ! সব প্রশংসা আপনারই, আপনিই আসমান-জমিন ও উভয়ের মাঝে বিদ্যমান সব কিছুর নিয়ামক এবং আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আসমান-জমিন এবং এর মাঝে বিদ্যমান সব কিছুর কর্তৃত্ব আপনারই। আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আপনি আসমান-জমিনের নুর। আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আপনি আসমান-জমিনের মালিক, আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আপনিই চির সত্য। আপনার ওয়াদা চির সত্য। (পরকালে) আপনার সাক্ষাৎ সত্য। আপনার বাণী সত্য। আপনার জান্নাত সত্য। আপনার জাহান্নাম সত্য। আপনার (প্রেরিত) নবিগণ সত্য। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্য, কেয়ামত সত্য।
হে আল্লাহ! আপনার কাছেই আমি আত্মসমর্পণ করলাম, আপনার ওপর ঈমান আনলাম, আপনার ওপরই ভরসা করলাম, আপনার দিকেই রুজু করলাম, আপনার (সন্তুষ্টির জন্যই) শত্রুতায় লিপ্ত হলাম, আপনাকেই বিচারক মেনে নিলাম। তাই আপনি আমার আগের-পরের প্রকাশ্য ও গোপন সব পাপ/অপরাধ ক্ষমা করুন। আপনিই শুরু এবং আপনিই শেষ মালিক। আপনি ব্যতিত সত্য কোনো প্রকৃত ইলাহ নেই অথবা আপনি ব্যতিত (ইবাদতের উপযুক্ত) অন্য কেউ নেই।’
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম অনুযায়ী এটি বাধ্যতামূলক নয়, তবে পড়তে পারা উত্তম।
তাহাজ্জুদ নামাজের উত্তম সময়
এশার নামাজের পর থেকে ফজর পর্যন্ত তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম মেনে এ নামাজ আদায় করা যায়। তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার সবচেয়ে উত্তম সময় হচ্ছে রাতের এক তৃতীয়াংশের শেষ সময়।প্রত্যেক মানুষেরই উচিত এশার নামাজ পড়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাওয়া এবং মাঝরাতে ২-৩ টার সময় উঠে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা।
তাহাজ্জুদ নামাজ সম্পর্কে কোরআনের বর্ণনা
তাহাজ্জুদ নামাজ সম্পর্কে কোরআনের বেশ কয়েকটি স্থানের বর্ণনা করা হয়েছে তা হলো:-
- অবশ্য রাতে ঘুম থেকে উঠা মনকে দমিত করার জন্য খুব বেশি কার্যকর এবং সে সময়ের কুরআন পাঠ বা জিকর একেবারে যথার্থ।(সূরা আল মুজাম্মিল)
- তারা রাতের সামান্য অংশই নিদ্রায় অতিবাহিত করে এবং রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে।(সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত ১৭-১৮)।
- আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা, যারা তাদের রবের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়।(সূরা আল ফুরকান, আয়াত-৬৪)।
তাই বলা যায়, তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম মেনে আদায় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ।
তাহাজ্জুদ নিয়ে রাসূলুল্লাহ (স:) এর হাদিস
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাহাজ্জুদ নামাজ সম্পর্কে কিছু হাদিস বর্ণনা করে গিয়েছেন নিম্নে তা দেয়া হলো :-
রাসুল (সাঃ) বলেন-
মহান আল্লাহ তায়াল প্রতি রাতে দুনিয়ার আসমানে (যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়) নেমে আসেন যখন রাত্রের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকে। অতঃপর তিনি বলেন, তোমাদের কে আমাকে ডাকবে! আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আমার কাছে কিছু চাইবে আমি তাকে তা দেব, কে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। (মুসলিম, মেশকাত ১০৯ পৃঃ)।
সর্বশেষ
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম মেনে আদায় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ও এর ফজিলত অপরিসীম। এই নামাজের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতে দুই জায়গাতেই লাভবান হওয়া যায়। তাহাজ্জুদ নামাজের মাধ্যমে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা সে ব্যক্তিকে কতই না পছন্দ করেন যাকে একাকী রাতে সেজদারত অবস্থায় পান। তাই আমাদের সকলেরই নিয়মিত তাহাজ্জুদের অভ্যাস গড়তে হবে।