রেমিটেন্স যোদ্ধার আত্মকাহিনী

রেমিটেন্স যোদ্ধার আত্মকাহিনী – প্রবাসীদের কান্না

রেমিটেন্স যোদ্ধার আত্মকাহিনী : আজ এই দিনই আমি স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমিয়ে ছিলাম। এই দিনই আমি সর্বপ্রথম আকাশে উড়েছিলাম। প্রথমবার যখন পরদেশে যাওয়ার জন্য এয়ারপোর্টে আসি, তখন সাথে ছিল বাবা-চাচা, ভাই, ভাগিনা, ভাতিজা, বন্ধুরা। তখন হৃদয়টা নরম ছিল। হৃদয়টা গলে গলে চোখ দিয়ে বের হচ্ছিল। ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল চারপাশের সকল দৃশ্য।

কিন্তু আজ…
কিন্তু আজ হৃদয়টা পাথরের মতো শক্ত। চোখ মরুভূমির মতো শুষ্ক। আশেপাশে অচেনা মানুষের ভিড়। এত ভিড়ের মাঝেও আমি একদম একা। চারপাশে একাকিত্বের শূণ্যতা। এতটা শূন্য যে আমার হৃদস্পন্দনের শব্দ আমার কানে ভেসে আসছে। এতটাই একাকী যে, আমার সাথে ছায়াটাও তীব্র আলোকরশ্মিতে সঙ্গ ছেড়ে দিয়েছে।

হ্যাঁ, আপনারা যা ভাবছেন আমি তাই। আমি এক প্রবাসী। আমি এক রেমিটেন্স যোদ্ধা। আমি স্বপ্ন দাস। আমি এই যান্ত্রিক সভ্যতার একটি মানুষ আকৃতির যন্ত্র ব্যতীত কিছু নই। হ্যাঁ, আমি ওই মেশিন, যে শুধু টাকা উপার্জন করতে পারে। কিন্তু কখনো ভোগ করতে পারে না।

রেমিটেন্স যোদ্ধার আত্মকাহিনী

যেদিন এই মরুর দেশে এসে প্রথম কাজে গিয়েছিলাম, সেদিন ভেবেছিলাম আর কয়েকটা বছরই তো। সব ঠিক হয়ে যাবে।

তপ্ত মরুর বুকে তীব্র রৌদ্রের মাঝে কাজ করেছি। পিঠে সিমেন্টের বস্তা রেখে সিঁড়ি বেয়ে কয় তলা উঠেছি মনে নেই। তখন শুধু একটিই নেশাই ছিল। সেই নেশাটা হলো কীভাবে রক্তটাকে পানি করে ঝরাবো। কয়েক মিনিট কাজ করলেই কাপড় ঘামে একদম ভিজে যেত। সেই ভেজা কাপড় আবার প্রচন্ড রৌদ্রে শরীরেই শুকিয়ে যেত।

দিনশেষে যখন বাসার দিকে ফিরে যেতাম, তখন তৃপ্তির একটি হাসি মুখে এমনিতেই এসে যেত। মনে মনে বলতাম, “আজকের দিনটা যেভাবে কেটেছে। আগামী কয়েকটা বছর ঠিক এভাবেই কেটে যাবে নিশ্চিন্তে।”

যখনই বেতন পেতাম সাথে সাথে বাড়িতে টাকাটা পাঠিয়ে দিতাম। জিজ্ঞাসা করতাম, আজ বাজার থেকে কোন মাছটা কিনে এনেছো? আজ গরুর মাংস আনোনি কেন?

আরো পড়ুন: প্রবাসীর বোবা কান্না

একদিন বড় ভাই বলল, বাড়ির পাশে ওই বড় ধানের ক্ষেতটা তালুকদারেরা বিক্রি করে দেবে। আমিও বড় ভাইয়ের মনের কথা বুঝতে পারলাম। সাথে সাথে জমি কেনার জন্য কিছু টাকা পাঠিয়ে দিলাম। বিদেশের ব্যাংকে আমার কিছু টাকা ছিল সেগুলোও পাঠিয়ে দিলাম। ৮-৯ মাস দিনরাত কাজ করে সেই জমির টাকা পরিশোধ করলাম।

একদিন শুনি ভাবীর অবস্থা খুব খারাপ। সিজার করতে হবে। বড় ভাই আমার কাছে টাকা ধার চাইল। আমি বললাম, “ভাবির সিজারের জন্য আমি এক টাকাও ধার দিতে পারব না। ভাবির সিজারের যত টাকা লাগে সব আমার পক্ষ থেকে খরচ হবে।” ভাবির সিজারে ভালো টাকাই খরচ হলো।

একদিন শুনি ভাগিনা মেট্রিক পরীক্ষায় পাশ করেছে। শুনে আমি অনেক খুশি হলাম। শোনার সাথে সাথেই ল্যাপটপ কেনার জন্য টাকা পাঠিয়ে দিলাম। বলেছিলাম সবচেয়ে ভালো ল্যাপটপটা কিনতে। এইতো সেই দিন, আমার ভাতিজিটার বিয়ে হলো। খুব শখ ছিল ভাতিজির বিয়েতে থাকবো। কিন্তু সব শখ কি আর পূরণ হয়?

ভাতিজির বিয়েতে থাকতে পারিনি তো কী হয়েছে?ভাতিজির বিয়েতে খরচ তো করতে পেরেছি। বিয়ের বরযাত্রীদের খাওয়ানোর সব খরচ আমি দিলাম। বড় আদরের আমার ভাতিজিটা। ও যখন ছোট ছিল তখন সারাটা দিন আমার কোলে থাকতো। আমাকে ‘ছোট আব্বু’ বলে ডাকতো।

বিয়ের কিছুদিন পর শুনি জামাই মোটরসাইকেলের জন্য আবদার করেছে। সেই আবদার এক সময় যৌতুক নাম ধারণ করেছে। ধীরে ধীরে ভাতিজির উপর নির্যাতনের ঢল নেমেছে। তখন আমার কাছে মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ার মতো এত টাকা ছিল না। গ্রামের সুদখোর মণ্ডলের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছি। ধীরে ধীরে অবশ্য সেই সুদের টাকাও পরিশোধ করেছি।

এভাবে চার-পাঁচটা বছর কেটে গেল। সারাদিন রোদে পুড়ে কাজ করতাম। রাতের বেলা বিশ্রামের বদলে গোডাউনে কাজ করতাম। শেষ রাতে দু-চার ঘণ্টা ঘুমিয়ে আবারো কাজে নেমে পড়তাম। কারণ আমার টাকা দরকার। বাড়িতে থাকা আপনজনদের সুখে রাখতে হলে আমাকে প্রচুর কাজ করতে হবে।

হঠাৎ আমার চাকরি সংক্রান্ত কী একটি জটিলতা তৈরি হয়। বাড়িতে ফিরতে পারছিলাম না। বাড়িতে ফিরলে আর বিদেশে আসতে পারবো না। অবশ্য দেশের বাড়িতে বড় ভাইয়ের মাধ্যমে অনেক টাকার জমি কিনে রেখেছি। দেশে গেলেও মোটামুটি চলে ফিরে খেতে পারবো। কিন্তু গেলাম না। আমাকে আরো টাকা অর্জন করতে হবে। পরিবারকে আরো সুখে রাখতে হবে।

একদিন এক বন্ধুর কাছে আমার বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনলাম। আমার বন্ধু বলে আমার বাবা নাকি একমাস আগে মারা গেছে। বন্ধু ঠাট্টা করছে ভেবে আমি বন্ধুকে গালাগালি দিয়ে ফোন রেখে দিয়েছি। আমি জানতাম বাবা চিল্লায় গিয়েছে। বড় ভাইকে ফোন দিলাম জিজ্ঞাসা করলাম বাবা কোথায়? বড় ভাই বলল, “বাবা তো চিল্লায়।”

আমি অনেক জেরা করতে শুরু করলাম এবং একসময় বড় ভাই সত্য বলে ফেললো। আমি বললাম কেন তুমি লুকালে বাবার মৃত্যুর সংবাদ? বড় ভাই যে কথা বলল সেটা শুনে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। বড় ভাই বললো, “যদি তোকে জানাতাম এবং তুই যদি দেশে ফিরে আসতি, তাহলে তো আর বিদেশে যেতে পারতি না তখন কী হতো তোর?” আমিও মনে মনে ভাবলাম, আহারে বড় ভাই! আমার জন্য আপনার কত চিন্তা।

একদিন ভাবি ফোন দিয়ে বলে, তার নাকি দূর সম্পর্কের এক বোন আছে। খুব সুন্দরী সেই মেয়েটি। আমি যদি এখন মেয়েটিকে বিয়ে না করি তাহলে জীবনে বড় একটি ভুল করবো। আমিও ভাবীর কথা মেনে নিলাম। ফোনে আমাদের বিয়ে হলো। বিয়ের পর প্রতিদিন রাতের বেলা ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতাম। কত মিষ্টি-মধুর আলাপ। আমার বউটা খুব আদরের ছিল। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আমি টাকা পাঠাতাম। তাকে বলতাম এগুলো জমিয়ে রাখো। ভবিষ্যতে আমাদের কাজে লাগবে।

একদিন হঠাৎ বউ বাপের বাড়ি চলে এসেছিলো। আমি এটা নিয়ে একটু রাগারাগি করেছিলাম। কেন আমাকে না জানিয়ে বাপের বাড়ি এলো। এরপর দেখি তার ফোন অফ। শশুর-শ্বাশুড়িকে ফোন দেই, তারাও ফোন ধরে না। ভাবিকে ফোন দিলাম তারাও কোনো কিছু জানে না।

চাকরি জটিলতা মিটে গেছে ততদিনে। আমিও বউয়ের অভিমান ভাঙাতে দেশে ফিরে আসলাম। সাথে নিয়ে আসলাম দামী দামী উপহার। শুধু বউয়ের জন্য নয়। ভাতিজি, ভাতিজা, ভাগিনা সবার জন্য। বাড়িতে আসলাম সবাই সবার উপহার বুঝে নিলো। কিন্তু আমি একটি জিনিস বুঝতে পারছিলাম যে, সবাই আমার কাছে কিছু একটা লুকাচ্ছে।

এরপর চলে গেলাম শ্বশুরবাড়ি। সেখানে গিয়ে আশেপাশের মানুষের কাছে যা শুনলাম, শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। ব্যাংকের সব টাকা নিয়ে সে তার পূর্ব প্রেমিকের হাত ধরে চলে গিয়েছে। আমি হতভম্ব হয়ে বাড়িতে ফিরে আসলাম। কিছুদিন পর চিন্তা করলাম বাড়ির পাশের ওই ধানের জমিটা বিক্রি করে বড় একটি ব্যবসা শুরু করবো। বড় ভাইয়ের কাছে জমির দলিল চাইলাম। বড় ভাই বিভিন্ন অজুহাতে দলিল দিচ্ছিল না। একসময় খুব জোরাজোরি করলাম। দেখি বড় হয় আর ভাবি আমার সাথে ঝগড়া শুরু করে দিলো। বলল, আমার নাকি কোনো জমি নেই। এমনকি বাপের ভিটাটাও নাকি তাদের নামে।

বড় বোনের কাছে গেলাম কিছুদিন থাকতে। বড় বোন কয়েকদিন থাকতে দিলো। একদিন বলল এভাবে বসে থাকলে তো আর হবে না। আমি যেন কিছু কাজ করি। তিনি আমাকে রিকশা চালাতে বললেন। একদিন আমি কার কাছে যেন শুনতে পাই বড় ভাই আমার কেনা জমিটার কিছু অংশ বড় বোনকে লিখে দিয়েছে। এর কারণ, বড় বোন সব জানতো। বড় বোনের মুখ বন্ধ রাখতে এই ঘুষ। বড় বোনের কাছ থেকে আমি চলে আসলাম। গেলাম সেই ভাতিজির শশুর বাড়ি। কিন্তু ভাতিজি আমাকে চিনতে অস্বীকার করে।

আজ… এখন আমি এয়ারপোর্টে বসে আছি। গন্তব্য আবারও সেই বিদেশ। কিন্তু এখন সেটা অর্থ উপার্জনের দেশ নয়। এখন সেটা বেঁচে থাকার একটি দেশ। কেননা নিজের মাতৃভূমিতে আমি শ্বাস নিতে পারছি না। এই দেশের কারো প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। কারো প্রতি আমার কোনো ঘৃণা নেই। শুধু এতোটুকু জানি, জগতে কেউ কারো না। আমার পরিচয় আমি একজন প্রবাসী। আমি একজন রেমিটেন্স যোদ্ধা।

[প্রিয় পাঠক, প্রোবাংলা অনলাইনে প্রবাস বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাসে আপনার কমিউনিটির নানান খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছবিসহ মেইল করুন info@probangla.com এই ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।]

About Juyel Ahmed Liton

সুপ্রিয় “প্রোবাংলা” কমিউনিটি, ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি আকর্ষণ ছিলো এবং হয়তো সেই আকর্ষণটা অন্য দশ জনের থেকে একটু বেশি। ওয়েবসাইট, টাইপিং, আর্টিকেল লেখাসহ টেকনোলজি সবই আমার প্রিয়। জীবনে টেকনোলজি আমাকে যতটা ইম্প্রেস করেছে ততোটা অন্যকিছু কখনো করতে পারেনি। আর এই প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ থেকেই লেখালেখির শুরু.....

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *