পোলট্রি খাতের বিভিন্ন জাতে মধ্যে ছোট পরিসরে শুরু করে লাভবান হওয়া যায় কোয়েল পাখি পালনের মাধ্যমে। বর্তমানে কোয়েল পাখির মাংস ও ডিমের চাহিদা বিগত বছরগুলোর তূলনায় অনেকাংশেই বেড়েছে।
তাই খামার ব্যবসা শুরু করতে চাইলে লাভজনকভাবে কোয়েল পাখি পালন পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন এই আর্টিকেল থেকে।
কোয়েল পাখি পালনের সুবিধা
অন্যান্য পোলট্রী জাতের তূলনায়, কোয়েল পালনের কিছু বাড়তি সুবিধা রয়েছে। যেমনঃ
- কোয়েল দ্রুত বাড়ে এবং ৬-৭ সপ্তাহ বয়সেই ডিমপাড়া শুরু করে।
- এগুলো বছরে ২৫০-২৬০ টি ডিম পাড়ে।
- ১টি মুরগির জায়গায় ৮-১০টা কোয়েল পালন করা যায়।
- রোগবালাই খুব কম এবং খাবার খুবই কম লাগে।
- কোয়েলের ডিমে কোলেস্টেরল কম এবং প্রোটিনের পরিমান বেশি থাকে।
- কোয়েলের দৈহিক ওজনের তুলনায় ডিমের শতকরা ওজন বেশি থাকে।
- মাত্র ১৭-১৮ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।
- বাংলাদেশের আবহাওয়া কোয়েল পালনের উপযোগী।
- অল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে অল্প দিনে তূলনামূলক বেশি লাভ করা যায়।
তাই লাভজনকভাবে কোয়েল পাখি পালন সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আগ্রহীরা এই খামার ব্যবসাটি শুরু করতে পারবে।
আরও পড়ুনঃ দেশি মুরগী পালন পদ্ধতি | মুরগীর জাত নির্বাচন, বাসস্থান, খাবার ও চিকিৎসা।
কোয়েলের বিভিন্ন জাত
বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ১৭-১৮ জাতের কোয়েল আছে। অন্যান্য পোলট্রির মতোই কোয়েলের মাংস এবং ডিম উৎপাদনের জন্যও পৃথক পৃথক জাত আছে। পৃথিবীতে কোয়েলের বিভিন্ন জাতের মধ্যে ‘জাপানিজ কোয়েল’ অন্যতম। এছাড়াও বিভিন্ন জাতের কোয়েলের মূল উৎস জাপানিজ কোয়েল।
আপনি বাণিজ্যিকভাবে লালন পালনের জন্য এই জাপানিজ কোয়েলের জাতটি বাছাই করতে পারেন। এছাড়াও আপনার আশেপাশের অন্যান্য খামারীদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে লাভজনক ও উপযুক্ত জাতটি বেছে নিতে পারবেন।
কোয়েল পাখি পালনের জন্য বাসস্থান তৈরি
যেকোনো খামার ব্যবসায় লাভবান হওয়ার জন্য সঠিকভাবে বাসস্থান তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাণিজ্যিকভাবে কোয়েল পালনের জন্য লিটার পদ্ধতির চেয়ে খাঁচায় পালন অধিক লাভজনক। সাধারণত বাংলাদেশে উভয়ের পদ্ধতিতেই কোয়েল পালন করা হয়। তবে অধিকাংশ খামারেই খাঁচায় পালন করা হয়।
বাচ্চা অবস্থায় প্রতিটি কোয়েলের জন্য খাঁচায় ৭৫ বর্গ সেন্টিমিটার এবং মেঝেতে ১০০ বর্গ সেন্টিমিটার জায়গায় দরকার। অন্যদিকে, বয়স্ক কোয়েলের ক্ষেত্রে প্রতিটি কোয়েলের জন্য খাঁচায় ১৫০ বর্গ সেন্টিমিটার এবং মেঝেতে ২৫০ বর্গ সেন্টিমিটার জায়গা প্রয়োজন হয়।
তাছাড়া কোয়েলের ঘরে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা রাখতে হবে। খামারের তাপমাত্রা ৫০-৭০ ডিগ্রি ফারেনহাইট হওয়া ভালো। স্ত্রী কোয়েল এবং পুরুষ কোয়েল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৃথক পথৃকভাবে রাখতে হবে।
আরও পড়ুনঃ লাভজনকভাবে হাঁস পালন পদ্ধতি।
৫০টি কোয়েল পালনের জন্য খাঁচা তৈরি
খাঁচায় পালনের জন্য ৫০টি প্রাপ্তবয়স্ক কোয়েলের জন্য:
- ১২০ সেমি. দৈর্ঘ্য, ৬০ সেমি. প্রস্থ এবং ৩০ সেমি. উচ্চতা বিশিষ্ট একটি খাঁচার প্রয়োজন।
- খাঁচার মেঝের জালিটি হবে ১৬-১৮ গেজি।
- ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত বাচ্চার খাচার মেঝের জালের ফাঁক হবে ৩/৩ মিলিমিটার এবং বয়স্ক কোয়েলের খাঁচায় মেঝের জালের ফাঁক হবে ৫/৫ মিলিমিটার।
- খাঁচার দুইপার্শ্বে একদিকে খাবার পাত্র এবং অন্যদিকে পানিরপাত্র সংযুক্ত করে দিতে হবে।
- খাঁচায় ৫০টি কোয়েলের জন্য তিন সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত ২৫ সেন্টিমিটার বা ১০ ইঞ্চি উচ্চতা বিশিষ্ট ২৮ বর্গ সেন্টিমিটার বা ৩ বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন।
কোয়েলের খামারে আলো ব্যবস্থাপনা
একটি কোয়েলের খামারে কাঙ্খিত উৎপাদনের জন্য এবং পাখির দেওয়া ডিমের উর্বরতা বাড়ানোর জন্য প্রতিদিন ১৪-১৮ ঘণ্টা আলোর প্রয়োজন হবে। শরৎকালে এবং শীতকালে দিনের আলোর দৈর্ঘ্য কম থাকে তাই কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে, যে সকল পুরুষ কোয়েল প্রজনন কাজে ব্যবহার করা হয় না এবং শুধু মাংস উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর জন্য দৈনিক ৮ ঘণ্টা আলোই যথেষ্ট।
আরও পড়ুনঃ লাভজনকভাবে কবুতর পালন পদ্ধতি।
কোয়েলের খামারে লিটার ব্যবস্থাপনা
খামারের লিটার হিসেবে মেঝেতে বা খাঁচার তলানিতে তুষ, বালি, ছাই, কাঠের গুড়া ইত্যাদি উপাদান ব্যবহার করতে হবে। যেন খামারে কোনরকম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি না হয়, সেদিকে খেয়াল রেখে অবস্থাভেদে লিটার পরিবর্তন করতে হবে। এক্ষেত্রে মেঝেতে ডিপ লিটার পদ্ধতি অবলম্বন করা ভালো।
লিটার তৈরির জন্য প্রথমেই ৫-৬ ইঞ্চি পুরু তুষ বিছিয়ে দিতে হবে এবং লক্ষ্য রাখতে হবে যেন লিটার ভিজা না হয়। স্বাভাবিকভাবে শীতকালে লিটার পরিবর্তন এবং স্থাপন করতে হবে। অন্য ঋতুতে লিটার পরিবর্তন এবং স্থাপন করলে লিটারের শতকরা ১-২ ভাগ কলি চুন মিশিয়ে দিতে হবে। এতে করে লিটার শুষ্ক ও জীবাণুমুক্ত হবে।
কোয়েল পাখি পালনের জন্য খাদ্য সরবরাহ
সাধারনত কোয়েল পাখির খাবারকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ স্টার্টার, বাড়ন্ত, এবং লেয়ার বা ব্রিডার। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারগুলোতে কোয়েল পাখির, পাখির বাচ্চার এবং বাড়ন্ত বা প্রজনন অবস্থার কোয়েল পাখির জন্য উপযুক্ত ভালো মানের খাবার পাওয়া যায় না।
তবে খামারিদের খেয়াল রাখতে হবে যে, পাখির বৃদ্ধি ভালো করার জন্য উপযুক্ত খাবার দেওয়াও জরুরী। আপনার স্থানীয় বাজারে ফাউমী মুরগীর খাবার কিনে কোয়েলকে খাওয়াতে পারবেন। অথবা, নারিশ কোম্পানির যেই ফিড পাওয়া যায়, সেটিও খাওয়াতে পারবেন। সাধারন খাবারে পাশাপাশি ডিম পাড়া কোয়েলের প্রতি কেজি খাবারে ২.৫-৩.০% ক্যালসিয়াম থাকতে হবে। ডিমের উৎপাদন ধরে রাখার জন্য গরমের সময় ৩.৫% ক্যালসিয়াম প্রয়োজন।
খেয়াল রাখবেন কোয়েল পাখিকে খাবার খাওয়ানোর জন্য বাচ্চা অবস্থায় ফ্লাট ট্রে বা ছোট খাবার পাত্র দিতে হবে যেন খাবার খেতে কোনো রকম অসুবিধা না হয়। সকালে এবং বিকালে খাবার পাত্র ভালো করে পরিষ্কার করে মাথাপিছু দৈনিক ২০-২৫ গ্রাম খাবার দিতে হবে। পাখির বয়স অনুসারে, প্রথম সপ্তাহ থেকে ৫ গ্রাম দিয়ে শুরু করে প্রতি সপ্তাহে ৫ গ্রাম করে বাড়িয়ে ২০-২৫ গ্রাম পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
খাবারের সাথে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পানি সরবরাহ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতি ৫০টা কোয়েলের জন্য একটি পানির পাত্র দেয়া উচিত।
আরও পড়ুনঃ সেরা ৬টি ২ লাখ টাকায় লাভজনক ব্যবসা আইডিয়া।
কোয়েল পাখির প্রজনন
কোয়েল পাখি পালনের ক্ষেত্রে খামারে ডিম ফুটাতে চাইলে স্ত্রী এবং পুরুষ কোয়েল একত্রে রাখার প্রয়োজন। ডিমের ভালো ফলন পেতে ৩টি স্ত্রী কোয়েলের সাথে ১টি পুরুষ কোয়েল দেয়ার ৪ দিন পর থেকে বাচ্চা ফুটানোর জন্য ডিম সংগ্রহ করা উচিৎ। স্ত্রী কোয়েল থেকে পুরুষ কোয়েল আলাদা করার পর তৃতীয় দিন পর্যন্ত ফুটানোর ডিম সংগ্রহ করা যায়।
বাংলাদেশের আবহাওয়ায় কোয়েল ৬-৭ সপ্তাহ বয়সে ডিম পাড়া শুরু করে এবং ৮-১২ মাস পর্যন্ত ডিম পাড়ে। উপযুক্ত পরিবেশে প্রথম বছর গড়ে ২৫০-৩০০টি ডিম পাড়ে। দ্বিতীয় বছরের ডিমের উৎপাদন প্রথম বছরের উৎপাদনের শতকরা ৪৮ ভাগ। খেয়াল রাখবেন ডিমপাড়া শুরুর প্রথম দুই সপ্তাহের ডিম ফুটাতে বসানো উচিত নয়।
কোয়েলের বাচ্চার ব্রুডিং এবং যত্ন
সদ্য ফুটন্ত কোয়েলের বাচ্চা খুবই ছোট থাকে এবং এগুলোর ওজন হয় মাত্র ৫-৭ গ্রাম। এ সময় যে কোনো রকম ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার কারনে বাচ্চার দৈহিক বৃদ্ধির উপর প্রভাব পড়ে। তাছাড়া অনেক সময় অনেক বাচ্চা মারা যায়। তাই বাচ্চাকে ব্রুডিং করে রাখতে হয় কিছুদিন।
বাচ্চার বয়সের ভিত্তিতে ব্রুডিং এর তাপমাত্রাঃ
- বাচ্চার জন্মের প্রথম সপ্তাহ ৩৫ সেন্টিগ্রেড
- দ্বিতীয় সপ্তাহ ৩২.২০ সেন্টিগ্রেড
- তৃতীয় সপ্তাহ ২৯.৫০ সেন্টিগ্রেড
- চতুর্থ সপ্তাহ ২৭.৬০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রাখা ভালো।
ইনকুবেটরে বাচ্চা ফুটার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্রুডিং ঘরে এনে প্রথমে গ্লুকোজের পানি এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ খাইয়ে তারপর খাবার ছিটিয়ে দিতে হবে। পাশাপাশি পরিষ্কার পানি সরবরাহ করতে হবে।
আরও পড়ুনঃ লাভজনকভাবে ভেড়া পালন পদ্ধতি | ভেড়ার খামার করার নিয়ম।
কোয়েল পাখির রোগ প্রতিরোধ
কোয়েলের রোগবালাই প্রায় নেই বললেই চলে। সাধারণত কোয়েল পাখিকে কোনো ভ্যাকসিন অথবা কৃমিনাশক ওষুধ দেয়া হয় না। তবে বাচ্চা ফুটার প্রথম ২ সপ্তাহ বেশ সংকটপূর্ণ থাকে। তাই এ সময় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কোয়েলের বাচ্চার যত্ন নিতে হয়। অনেক সময় অব্যবস্থাপনার কারণে কোয়েলের বাচ্চা মারা যায়, তবে বয়স্ক কোয়েলের মৃত্যুহার খুবই কম।
কোয়েল পাখি পালনে আর্থিক লাভ
উৎপাদনের দিক থেকে কোয়েল অধিক উৎপাদনশীল। একটি মুরগির পরিবর্তে ৮টি কোয়েল পালন করা যায়। অল্প জায়গায়, বাংলাদেশের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায়, অল্প খরচে, পারিবারিক পর্যায়ে অথবা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোয়েল পালন করা যায়। বর্তমানে অনলাইনে এবং অফলাইনে কোয়েল পাখির চাহিদা অনেক বেশি। আপনি চাইলে উভয় ভাবেই বিক্রি করে আপনার ব্যবসার আয় বাড়াতে পারবেন।
আরও পড়ুনঃ লাভজনক ৭টি ৫০ হাজার টাকায় ব্যবসা আইডিয়া।
শেষকথা
কোয়েল পাখি পালন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি অত্যন্ত লাভজনক উদ্যোগ। তাই এই ব্যবসাতে আপনার আগ্রহ থাকলে লাভজনকভাবে কোয়েল পালন পদ্ধতি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জেনে ব্যবসাটি শুরু করতে পারেন।