গ্রামের পরিবেশে অনেক ধরণের ব্যবসা গড়ে তোলা সম্ভব। গ্রামে নতুন ব্যবসা গড়ে তোলার মাধ্যমে একদিকে স্থানীয় মানুষের জীবনমান উন্নত হয়। অন্যদিকে, উদ্যোক্তাদের জন্য মুনাফা অর্জনের পথ সুগম করে।
তাই যেসকল উদ্যোক্তারা গ্রামীন এলাকায় নতুন কোন ব্যবসা স্থাপন করতে চাচ্ছেন, তাদের উদ্দ্যেশে এই আর্টিকেলে সেরা কয়েকটি লাভজনক গ্রামের ব্যবসা আইডিয়া নিয়ে আলোচনা করা হলো।
৬টি গ্রামের ব্যবসা আইডিয়া
(১) গ্রামীণ কৃষি খামারের ব্যবসা
গ্রামীণ কৃষি খামার বলতে গরু ছাগল এবং হাঁস-মুরগির খামারকে একত্রে বুঝানো হয়। সাধারণত ডিম, মাংস, এবং দুধ উৎপাদনের জন্য হাঁস-মুরগি পালন এবং গরু-ছাগল লালনপালন অত্যন্ত লাভজনক। কারণ ডিম, দুধ এবং মাংসের চাহিদা দেশে এবং বিদেশে সবসময়ই রয়েছে। তাছাড়া শহরে এগুলোর চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে।
পশুপালন গ্রামীণ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই বলেই হাঁস-মুরগি এবং গরু-ছাগলের খামার গড়ে তোলা গ্রামে বসবাসকারী মানুষের জন্য একটি লাভজনক উদ্যোগ। কম খরচে এই খামার শুরু করে বড় আকারে লাভবান হওয়া সম্ভব। গ্রামে নিজস্ব বাড়িতে স্বল্প খরচে এই ব্যবসা শুরু করতে পারেন কিন্তু শহরের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত।
গ্রামে এই ব্যবসা করার একটি খারাপ দিক হলো সহজেডাক্তার পাওয়া যায় না। তবে আপনাকে এই ব্যবসা শুরু করার পূর্বে গরু ছাগল ও হাঁস মুরগি পালন সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। এবং নিকটস্থ কোন পশু ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে।
গ্রামীণ কৃষি খামারের ব্যবসাটি শুরু করার জন্য:
- স্থানীয় পরিবেশ অনুযায়ী লাভজনক পশু বা পোল্ট্রি জাত নির্বাচন করতে হবে।
- স্বাস্থ্যসম্মত খামারের ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
- উন্নতমানের পশুখাদ্য এবং চিকিৎসার জন্য ভেটেরিনারি সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
- উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় এবং শহুরে বাজারে বিক্রি করার চেষ্টা করতে হবে।
- সরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে পশুপালন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে নেওয়া ভালো।
প্রাথমিকভাবে এই ধরনের ব্যবসা শুরু করার জন্য, গরু বা ছাগলের ক্ষেত্রে ১-৩ লক্ষ টাকা এবং হাঁস-মুরগির ক্ষেত্রে ২০,০০০-৫০,০০০ টাকা।
আরও পড়ুনঃ লাভজনক কয়েকটি উৎপাদনমুখী ব্যবসায় আইডিয়া।
(২) কাঁচামাল ও সবজি উৎপাদন এবং বিক্রি
উর্বর জমি এবং সহজলভ্য প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে গ্রামে সবজি চাষ একটি লাভজনক ব্যবসার মাধ্যম হতে পারে। নিজের উৎপাদিত সবজি স্থানীয় বাজারে অথবা শহরের বাজারে বিক্রি করে নিজের আয় বাড়ানো সম্ভব।
যারা নিজেরা চাষ করতে পারবেন না, তারা স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে পাইকারি দামে সবজি কিনেও খুচরা বিক্রি করতে পারবেন। আবার সরাসরি গ্রামের বাজারে বিক্রির পাশাপাশি শহরের বাজারে খুচরা বিক্রি করতে পারেন।
সবজি উৎপাদন এবং বিক্রির ব্যবসা শুরুর জন্য:
- সঠিক মৌসুমি ফসল নির্বাচন করে উৎপাদন শুরু করতে হবে।
- ফসলে রাসায়নিক এর পরিবর্তে জৈব সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে পারেন।
- স্থানীয় বাজার এবং পাইকারি বাজারে সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
- ফসল কাটার পর সংরক্ষণের জন্য হিমাগারের ব্যবস্থা থাকলে বেশি লাভবান হতে পারবেন।
এধরনের ব্যবসায় আপনার জমির আকার এবং ফসলের ধরন অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে ২৫,০০০-৫০,০০০ টাকা প্রয়োজন। তবে বড় পরিসরে ব্যবসা করতে চাইলে কয়েক লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারেন।
আরও পড়ুনঃ ২০২৫ সালে শুরু করার জন্য সেরা কয়েকটি বড় ব্যবসার আইডিয়া।
(৩) ঠিকাদারি ব্যবসা
ঠিকাদারি ব্যবসা বলতে বোঝায় শ্রমিক সরবরাহ বা বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করার জন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে নির্ধারিত টাকা গ্রহণ করা। গ্রামে একটি শ্রমিক দল তৈরি করে শহরের নির্মাণকাজ বা বড় প্রকল্পের জন্য শ্রমিক সরবরাহ করা একটি লাভজনক উদ্যোগ। এই ব্যবসায় বিনিয়োগ কম, তবে সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং পরিকল্পনা প্রয়োজন।
উদাহরণস্বরূপ বলতে গেলে, ধরুন আপনার গ্রামের পাশের শহরে একটি পুকুর খনন করা হবে, কিন্তু ওই পুকুরের মালিক পুকুর খননের জন্য কোন আইডিয়া রাখেনা। তাই তিনি চাচ্ছে ঠিকাদার দিয়ে পুকুরটি খনন করাতে। এখন আপনি চাইলে আপনার টিম নিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকা অফার করে যথাসময়ের মধ্যে তার কাজটি সম্পন্ন করে দিবেন।
সেক্ষেত্রে ধরা যাক, এই পুকুরটি খননের জন্য মোট বাজেট হয়েছে ২০,০০০ টাকা। এবং পুকুরটি খনন করতে সময় লাগবে ৩ দিন। এখানে সরঞ্জাম খরচ এবং অন্যান্য শ্রমিকের পারিশ্রমিক মিলিয়ে মোট আপনার খরচ হয়েছে ১৫,০০০ টাকা। বাকি ৫,০০০ টাকা আপনার ব্যবসা। এভাবে করে কোন ধরনের ইনভেস্ট ছাড়াই ঠিকাদারি ব্যবসা করে প্রতিমাসে মোটা অংকের টাকা উপার্জন করতে পারবেন।
আরও পড়ুনঃ লাভজনক ৭টি ৫০ হাজার টাকায় ব্যবসা আইডিয়া।
(৪) হস্তশিল্পের ব্যবসা
গ্রামীণ এলাকাগুলোতে হস্তশিল্পের পণ্যের জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা অনেক বেশি। হস্তশিল্পের ব্যবসা গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণত হস্তশিল্প বলতে আমরা মাটির জিনিসপত্র, পাটের ব্যাগ, বাঁশের আসবাবপত্র, নকশী কাঁথা, এবং কাঠের খোদাইয়ের জিনিসপত্রকেই বুঝে থাকি। এ ধরনের ঘর সজ্জার উপকরণ তৈরির মাধ্যমে একটি লাভজনক ব্যবসা শুরু করা সম্ভব।
গ্রামীণ জনগণের সৃজনশীলতা এবং কম খরচে সহজলভ্য কাঁচামাল এই ব্যবসাকে আরও সহজ ও লাভজনক করে তোলে। এসকল পণ্য স্থানীয় বাজারে যেমন বিক্রি হয়, তেমনি শহুরে বাজারেও প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
হস্তশিল্পের ব্যবসা শুরু করার জন্য:
- প্রশিক্ষণ নিতে হস্তশিল্প বিষয়ক কর্মশালায় অংশগ্রহণ করতে হবে।
- উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি ক্ষুদ্র কারখানা বা ঘর প্রয়োজন হবে।
- স্থানীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করতে হবে। যেমন: পাট, মাটি, বাঁশ।
- অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বা স্থানীয় বাজারে পণ্য বিক্রির পরিকল্পনা করে নিতে হবে।
এই ধরনের ব্যবহারের সাথে খুব বেশি পুঁজির প্রয়োজন হবে না। প্রাথমিকভাবে ১০-২০ হাজার টাকার মধ্যেই ব্যবসা শুরু করতে পারবে।
আরও পড়ুনঃ সেরা ৬টি ২ লাখ টাকায় লাভজনক ব্যবসা আইডিয়া।
(৫) সার ও কীটনাশকের ব্যবসা
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কৃষিকাজ হলো মানুষের প্রধান পেশা। কৃষি ক্ষেত্রে সারের কীটনাশকের ব্যবহার কৃষকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই গ্রামের বাজারে একটি সার ও কীটনাশক বিক্রির দোকান খুলে সহজেই লাভজনক ব্যবসা করা যায়।
এই ধরনের ব্যবসা শুরু করতে অল্প পুঁজির প্রয়োজন হয়। তবে ব্যবসা সম্পর্কিত সঠিক তথ্য এবং স্থানীয় চাহিদা সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। পাশাপাশি কোন সময় কোন ফসলে কি ধরনের সার বা কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে, সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন করতে হবে।
সার ও কীটনাশকের ব্যবসা শুরু করার জন্য:
- একটি ভালো অবস্থানে দোকান ভাড়া নিতে হবে।
- বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সার, কীটনাশক, এবং বীজের যোগানদাতার সাথে চুক্তি করতে হবে।
- অন্য বিক্রির পাশাপাশি কৃষকদের জন্য পরামর্শমূলক সেবা প্রদান করলে বেশি গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে পারবেন।
- সার ও কীটনাশকের প্যাকেজিং ও সংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কেও জেনে নিতে হবে।
এসব কিছু মিলিয়ে প্রাথমিকভাবে ৫০,০০০-১,০০,০০০ টাকা বিনিয়োগ করলেই ব্যবসাটি শুরু করতে পারবেন। পরবর্তীতে স্থানীয় চাহিদা এবং আপনার লাভের পরিমাণ অনুযায়ী ব্যবসা-সম্প্রসারণ করতে পারবেন।
(৬) সুপারি চাষ ও ব্যবসা
বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে সুপারি চাষ অত্যন্ত জনপ্রিয়। নিজের জমিতে সুপারি চাষ করে বা বাৎসরিক চুক্তিতে সুপারি গাছ কিনে ব্যবসা শুরু করা সম্ভব। সুপারি সংগ্রহ করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা ছাড়াও বিদেশে রপ্তানি করে ভালো মুনাফা অর্জন করা যায়।
বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই সুপারি উৎপন্ন হয়৷ তবে বিশেষ করে বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট, লক্ষ্মীপুর, ইন্দুরকানী, পিরোজপুর, পঞ্চগড় ইত্যাদি জেলাগুলোতে অধিক হারে সুপারি উৎপাদন হয়ে থাকে। সাধারনত নিজে গাছ লাগিয়ে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে অনেক সময় লাগতে পারে। তাই কারো কাছ থেকে বাৎসরিক চুক্তিতে সুপারি গাছ কিনে ব্যবসা করাই বেশি লাভজনক হবে।
সুপারির ব্যবসা করার জন্য আপনার প্রয়োজন হবেঃ
- প্রাথমিকভাবে ২০-৩০ হাজার টাকা বিনিয়োগ।
- ফল সংগ্রহের পর সঠিক পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াকরণ ও প্যাকেজিং সম্পর্কে ধারনা।
- স্থানীয় বাজার, পাইকারি ক্রেতা এবং রপ্তানিকারকদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে এবং বাজারচাহিদা সম্পর্কে ধারনা থাকতে হবে।
এই ধরনের ব্যবসার পরিধির উপর আয় ও মুনাফার পরিমান নির্ভর করে।
শেষকথা
গ্রামাঞ্চলে ব্যবসার সুযোগ সীমাহীন। সঠিক পরিকল্পনা, পরিশ্রম এবং স্থানীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহার গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পারে। যারা চাকরির বিকল্প খুঁজছেন, তারা গ্রামের এই ব্যবসাগুলো শুরু করে স্বাবলম্বী হতে পারেন।