কবুতর পালন একটি সৌখিন ব্যবসা। আমাদের মধ্যে অনেকেউ শখের বশে কবুতর পালন করে। আবার অনেকেই এটাকে ব্যবসা হিসেবে নিয়ে, স্বল্প পুজিতে লালনপালন শুরু করে লাভজনক ভাবে বিক্রি করে থাকে।
প্রকৃতপক্ষেই, কম টাকায় ব্যবসা করার মাধ্যম হিসেবে কবুতর পালন দিন দিন এক সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত হচ্ছে। অনেকেই কবুতর পালনের নিয়ম কানুন জানতে চায়। কারন সঠিক লালনপালন পদ্ধতি না জানা থাকলে এই ব্যবসাতে খুব সহজেই লসের সম্মুখীন হতে হয়। তাই আপনাদের জন্য এই আর্টিকেলে কবুতর পালন পদ্ধতি, খাবার, বাসস্থান, চিকিৎসা, প্রজনন ও বিক্রয় সম্পর্কে ধারনা দেওয়া হলো:
কবুতর পালন পদ্ধতি | কবুতরের খামার
কবুতর পালন করার জন্য প্রথমেই আপনাকে জানতে হবে যে, আপনি কোন কোন জাতের কবুতর পালন করতে চান। বর্তমানে বাংলাদেশে বহু কবুতরের জাত রয়েছে। এছাড়াও আরও কিছু বিদেশি জাতের কবুতর রয়েছে, যা আপনি ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোন থেকে লালনপালন করতে পারবেন।
আপনার কবুতরের জাত নির্বাচন নির্ভর করবে আপনার স্থানীয় পরিবেশ, স্থানীয় বাজারচাহিদা, কবুতরের বাসস্থানের অবস্থা ও আপনার পুজির উপর। ব্যবসা শুরু করার জন্য আপনার কাছে যেই পরিমান পুজি থাকবে, সেটা বিবেচনায় রেখে কমদামী বা বেশিদামী জাত বাছাই করবেন। তারপর ব্যবসা শুরু করার আগে একটি ব্যবসায়িক গাইডলাইন আগে থেকেই লিখে রেখে, সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে চেষ্টা করবেন।
কবুতর সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় বাসা বাঁধে। প্রতি জোড়ায় একটি পুরুষ কবুতর এবং একটি স্ত্রী কবুতর থাকে। এরা গড়ে ১২-১৫ বছর পর্যন্ত বাঁচে। যত দিন বাঁচে, ততো দিন কবুতর ডিমের মাধ্যমে বাচ্চা দেয়। ডিম পাড়ার পর স্ত্রী ও পরুষ উভয় কবুতরই পালা করে ডিমে তা দেয়। কবুতরের জোড় যদি কখনো ভেঙ্গে যায়, আবার জোড়া মিলাতে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। নতুন জোড়া মিলানোর জন্য স্ত্রী ও পরুষ কবুতরকে কিছুদিন একঘরে রাখতে হয়। তারপর সেগুলো পুনরায় বংশবিস্তারের জন্য লালন পালন করতে পারবেন।
আরও পড়ুনঃ দেশি মুরগী পালন পদ্ধতি | মুরগীর জাত নির্বাচন, বাসস্থান, খাবার ও চিকিৎসা।
কবুতর কোথায় পাওয়া যাবে?

সাধারণত বাংলাদেশের প্রায় সকল এলাকাতেই সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে কবুতরের হাট বসে। আপনার স্থানীয় বাজার থেকেই যাচাই-বাছাই করে ভালো জাতের কবুতর কিনে নিতে পারবেন। তবে আপনি যদি বিভিন্ন দেশীয় ও বিদেশী জাতের কবুতর লালন পালনের জন্য কিনতে চান, তাহলে গুলিস্তানের কাপ্তান বাজার থেকে কিনে নিতে পারবেন।
প্রতি শুক্রবার গুলিস্তানের কাপ্তান বাজারে নানান জাতের কবুতর, কবুতরের খাঁচা বা কবুতরের খোপ এবং কবুতরের খাবারের বিশাল হাট বসে। এখানে দেশি বিদেশি প্রায় সব ধরনের কবুতর পাওয়া যায়। এছাড়াও ঢাকার জিনজিরা প্রতি শুক্রবার, ঢাকার বাংলায় প্রতি শনিবার কবুতরের হাট বসে।
আবার কাপ্তান বাজারে এবং কাঁটাবনে কিছু স্থায়ী দোকান আছে, যেখানে সারা সপ্তাহ কবুতর ও খাবার পাওয়া যায়। তবে সেখানে দামের তারতম্য হতে পারে। তাই নির্দিষ্ট হাটের দিনে আপনার পছন্দসই কিছু কবুতর কিনে নিলেই লাভজনক হবে।
কবুতর পালনের জন্য বাসস্থান তৈরি
পর্যাপ্ত সূর্যের আলো এবং বাতাস চলাচল আছে এরকম উঁচু জায়গায় কবুতরের খোপ করতে হবে। মাটি থেকে ঘরের উচ্চতা ২০-২৪ ফুট এবং কবুতরের খোপের উচ্চতা ৮-১০ ফুট হওয়া ভালো। একটি খামারে কবুতর পালন করার জন্য ৩০ থেকে ৪০ জোড়া কবুতর আদর্শ।
কবুতরের খোপ দুই বা তিন তলাবিশিষ্ট করা যায়। কাঠ, টিন, বাঁশ, খড় ইত্যাদি দিয়ে সহজেই ঘর তৈরি করা যাবে। কবুতরের খোপের বাইরে বা খামারের ভিতর নরম, শুষ্ক খড়কুটা রেখে দিলে তারা ঠোঁটে করে নিয়ে নিজেরাই বাসা তৈরি করে নেয়। ডিম পাড়ার সময় খোপে খড়, শুকনো ঘাস, কচি ঘাসের ডগা জাতীয় উপাদান দরকার হয়। তাই এ সময় আপনার খাবারের মধ্যে এগুলো দিয়ে রাখতে পারেন।
আরও পড়ুনঃ লাভজনক পদ্ধতিতে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন করবেন যেভাবে।
কবুতর কি কি খাবার খায় | কবুতরের খাবার
কবুতরের প্রধান খাবার হলো গম, মটর, খেসারি ভুট্টা, সরিষা, যব, চাল, ধান, কলাই ইত্যাদি শস্যদানা। প্রতিটি কবুতর দৈনিক প্রায় ৩০-৫০ গ্রাম খাবার খায়। কবুতরের জাত ভেদে কবুতরের খাবারও ভিন্ন ভিন্ন। গোলা প্রজাতির কবুতর সাধারণত সব ধরনের শস্যদানা খায়। আর গিরিবাজ কবুতর খায় ধান, গম, সরিষা, তিসি, ভুট্টা, কুসুম, ফুলের বিচি ইত্যাদি।
অন্যদিকে, ফেন্সি কবুতরের খাবার ডাবলি বুট, গম, সূর্যমূখীর বিচি, কুসুম ফুলের বিচি ইত্যাদি। এছাড়াও হোমার জাতের কবুতরগুলো বাদাম, ডাবলি বুট, ছোলা বুট, ফুলের বিচি, তিসি, বাজরা, চিনা, মুগডাল, মাষকলাই, মসুর, হেলেন ডাল ইত্যাদি।
কবুতরের প্রজননের সময় করণীয়

কবুতর পালন করে লাভজনকভাবে বিক্রি করার জন্য আপনাকে প্রধান গুরুত্ব দিতে হবে কবুতরের প্রজননের দিকে। কারণ বাচ্চা উৎপাদন করার মাধ্যমে আপনার ব্যবসার লাভ এবং প্রসার হবে।
কবুতর সাধারণত ছয় মাস বয়সে ডিম দেয়। সেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে সময় লাগে ১৭-১৮ দিন। বাচ্চার ১ মাস বয়সেই মা কবুতর আবার ডিম দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার পর থেকে বাচ্চাকে খাবার খাওয়ানো থেকে শুরু করে সব ধরনের যত্ন মা কবুতর করে।
বিক্রির ক্ষেত্রে ১৫ দিন থেকে এক মাস বয়সী বাচ্চা বাজারে বিক্রি করা যায়। রেসের কবুতরকে বাচ্চা বয়স থেকেই আলাদাভাবে যত্ন নিতে হয়। কবুতরটির বয়স ২-৩ মাস হলেই পরিবার থেকে আলাদা করে ভিন্ন খাঁচায় রাখতে হয়। তারপর ৪ মাস বয়স হলে আবারো কবুতরের খাচা পরিবর্তন করতে হয়। এবার কবুতরের খাঁচা থাকবে ঘরের বাইরে।
৬ মাস বয়সে রেসার বাসস্থানের আশে পাশে সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ওড়ার প্রশিক্ষন দেওয়া হয়। এভাবে রেসার কবুতর উড়তে শিখে। ধীরে ধীরে ওড়ার বেগ ও দূরত্ব বাড়তে।
আরও পড়ুনঃ সেরা ৬টি ২ লাখ টাকায় লাভজনক ব্যবসা আইডিয়া।
কবুতরের চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা
লাভজনকভাবে কবুতরের খামার ব্যবসা করার জন্য কবুতরের চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায়, বিভিন্ন রোগে আপনার খামারের কবুতর ব্যাপক হারে মারা যেতে পারে।
কবুতরের রোগ হওয়ার আগেই প্রতিরোধের চেষ্টা করতে হবে। কবুতরের একটি অতিপরিচিত রোগ হলো রানিক্ষেত। এ রোগ প্রতিরোধে কবুতরকে ৩ দিন বয়সে, ২১ দিন বয়সে এবং এরপর প্রতি ২ মাস পর পর প্রতিষেধক টিকা দিতে হয়। বসন্ত রোগের জন্য ডিম পারার আগে মা কবুতরকে এবং বাচ্চাকে ২১ দিন বয়সে টিকা দিতে হয়।
কলেরার জন্য কবুতরের বাচ্চা জন্মের ২ মাস বয়সে টিকা দিতে হয়। কবুতরের ঠান্ডা এবং জ্বরও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রেনামাইসিনের সঙ্গে মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট খাওয়াতে পারবেন। এছাড়াও কবুতরের রোগ হলে নিকটস্থ পশু হাসপাতালে যোগাযোগ করতে পারেন।
খামার থেকে কবুতর বাজারজাতকরণ
আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রজাতির কবুতর পালনের প্রচলন রয়েছে। যেমন- গোলা, গিরিবাজ, হোমার এবং ফেন্সি প্রজাতির কবুতর বেশি পালন করা হয়। এর মধ্যে গোলা প্রজাতির কবুতর পালন করা হয় সবচেয়ে বেশি। এই প্রজাতির কবুতর বাচ্চা উৎপাদন ও বিক্রির জন্য পালন করা হয়।
গিরিবাজ প্রজাতির মধ্যে সবুজ গোলা, গরবা, মুসলদম, কালদম, বাগা, চুইনা, লাল চিলা, খয়েরি চিলা ইত্যাদি উল্যেখযোগ্য। গিরিবাজ ও হোমার প্রতিযোগিতার জন্য বিখ্যাত। ফেন্সি বা শৈখিন প্রজাতির কবুতরের মধ্যে রয়েছে লক্ষ্যা, প্রিন্স, বল, সুয়া চন্দন, সুইট, কিং সিরাজি, নোটন পায়রা ইত্যাদি।
আরও পড়ুনঃ লাভজনক ৭টি ৫০ হাজার টাকায় ব্যবসা আইডিয়া।
কবুতরের বাজারদর
- প্রতি জোড়া দেশি গোলা কবুতর প্রায় ২০০-৬০০ টাকা।
- বোম্বাই গোলা কবুতর প্রায় ৫০০-১,০০০ টাকা।
- মুসলদম কবুতর প্রায় ৮০০-১,০০০ টাকা।
- কালদম কবুতর প্রায় ১,০০০-১,৬০০ টাকা।
- বাগা কবুতর প্রায় ৮০০-১,০০০ টাকা।
- লক্ষ্যা কবুতর প্রায় ২,০০০-২,৫০০ টাকা।
- প্রিন্স কবুতর প্রায় ১,৫০০-৩,০০০ টাকা।
- হোমার প্রজাতির কবুতর প্রায় ৫,০০০ থেকে ৩০,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
শেষকথা
উপরোক্ত আলোচনা থেকে লাভজনকভাবে কবুতর পালন পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারলাম। তবে পালন পদ্ধতি সম্পর্কে জানা এবং বাস্তবিকভাবে পালন করার মাঝে ব্যাপক ব্যবধান রয়েছে। তাই কবুতরের খামার হিসেবে ব্যবসা শুরু করার জন্য এই সম্পর্কে আপনাকে আরো বিস্তারিত ও গভীরভাবে জানতে হবে এবং ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে।
FAQ’s
একটা কবুতর দিনে কত গ্রাম খাবার খায়?
একটি ছোট আকারের কবুতর দিনে প্রায় ২০-৩০ গ্রাম খাবার খায়। মাঝারি আকারের কবুতর প্রায় ৩৫-৫০ গ্রাম এবং বড় আকারের কবুতর প্রায় ৫০-৬০ গ্রাম খেতে পারে।
কবুতর কত বছর বয়সে ডিম পাড়ে?
সাধারনভাবে কবুতর ৫ থেকে ৬ মাস বয়সে প্রথমবার ডিম পাড়ে। কিছু কিছু প্রজাতির কবুতর কিছুটা বেশি সময় নিতে পারে ডিম দেওয়ার জন্য।
কোন জাতের কবুতর বেশি বাচ্চা দেয়?
সাধারনত রেসিং পায়রার প্রজনন ক্ষমতার জন্য এই জাতের কবুতরের মাধ্যমে প্রজনন করা হয়। অন্যান্য কবুতরের জাতের তূলনায় এই জাতের কবুতরের উর্বরতার হার অনেকটা বেশি থাকে।