হাঁস পালন বা হাঁসের খামার একটি লাভজনক ব্যবসায়ী উদ্যোগ। কিন্তু অনেকেই সঠিকভাবে পরিচালনা করতে না পেরে এই ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
তবে উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা থাকলে এবং সফল হওয়ার পেছনে সচেষ্ট হলে সঠিক পদ্ধতি মেনে লাভজনকভাবে হাঁসের খামার করতে পারবেন। এমন উদ্যোক্তাদের সুবিধার জন্যই এই আর্টিকেলে লাভজনকভাবে হাঁস পালন পদ্ধতি, কি কি করণীয় ও কি কি পরিহার করতে হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
খামারের জন্য হাঁসের জাত বাছাইকরন
হাঁসের খামার করার জন্য আপনাকে প্রথমেই ভেবে নিতে হবে আপনার উদ্দেশ্য কি মাংস উৎপাদন করা নাকি ডিম উৎপাদন করা। এই উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন জাতের হাঁস নির্বাচন করতে হয়। মাংস উৎপাদনের জন্য ও ডিম উৎপাদনের জন্য হাঁস নির্বাচন করতে যে সকল বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে সে সম্পর্কে নিচে জেনে নিন:
(১) মাংস উৎপাদনের জন্য হাঁসের জাত নির্বাচন
- দ্রুত বর্ধনশীল জাতের হাঁস নিতে হবে। যেমন: পেকিন হাঁস।
- যে সকল হাঁসের জাত তুলনামূলক বড় সেগুলো নিতে হবে।
- যে সকল হাঁসের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি সেগুলো নিতে হবে।
- কম খাদ্য খরচে অধিক মাংস উৎপাদনকারী জাত নির্বাচন করতে হবে।
(২) ডিম উৎপাদনের জন্য হাঁসের জাত নির্বাচন
- এমন জাত নির্বাচন করতে হবে, যেগুলো বেশি ডিম দেয়। যেমন- খাকি ক্যাম্পবেল।
- রোগমুক্ত এবং সুস্থ হাঁস নির্বাচন করবেন।
- এমন জাত নির্বাচন করা উচিত যা স্থানীয় আবহাওয়ায় ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে।
আরও পড়ুনঃ লাভজনক পদ্ধতিতে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন করবেন যেভাবে।
বাংলাদেশ পালনযোগ্য সেরা কয়েকটি হাঁসের জাত
বর্তমানে বাংলাদেশে যে সকল জাতের হাঁস সবচেয়ে বেশি পালন করা হয় এবং যে সকল হাঁস পালন করা লাভজনক হবে, সেগুলোর তালিকা নিচে দেওয়া হলো:
- দেশি জাতের হাঁস,
- খাকি ক্যাম্পবেল হাঁস,
- জিংডিং,
- ইন্ডিয়ান রানার,
- পিকিং,
- মাসকোভি জাতের হাঁস,
- এবং রাজহাঁস ইত্যাদি।
বর্তমানে এই সকল হাঁস সবচেয়ে বেশি লালন পালন করতে দেখা যায়। তবে এর বাইরেও অনেকে কিছু বিদেশী জাতের হাঁস পালন করে থাকে। ভালো মানের ডিম ও মাংস উৎপাদনের জন্য বিশেষজ্ঞরা দেশি হাঁসের পালন করতেই বেশি উৎসাহ দেয়। আর দেশি হাঁসের এবং ডিমের বাজার চাহিদা বাংলাদেশে অনেক বেশি।
আরও পড়ুনঃ দেশি মুরগী পালন পদ্ধতি | মুরগীর জাত নির্বাচন, বাসস্থান, খাবার ও চিকিৎসা।
৩০০টি হাঁস পালনের জন্য খামার ঘর তৈরি
একটি পূর্ণাঙ্গ ধারনা দেওয়ার জন্য আমরা ধরে নিলাম যে, ৩০০ টি হাঁস পালনের জন্য খামার ঘর তৈরি করতে চাচ্ছি। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জায়গার পরিমাণ এবার যে সকল বিষয়ের মাথায় রেখে ঘরটি নির্মাণ করতে হবে, সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা জেনে নেওয়া যাক:
(১) খামারটি এমন জায়গায় তৈরি করবেন যেখানে ভালো পরিমাণ বায়ু চলাচল করবে এবং সুরক্ষা পাওয়া যাবে। গরম আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত ছাউনির ব্যবস্থা রাখবেন। আর শীতকালীন আবহাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা করাও উচিত।
(২) প্রতিটি হাঁসের জন্য ২ থেকে ৩ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ৩০০টি হাঁসের জন্য ৬০০ থেকে ৯০০ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন হবে।
(৩) খামারে সঠিক বায়ু চলাচল নিশ্চিত করতে খামারের দেয়ালে ভাল ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা রাখা উচিত, যেন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি না হয়।
(৪) হাঁসের থাকার মেঝেতে তুষ, খড়, বিচুলি, কাঠের গুড়া লিটারের মতো করে বিছিয়ে দিতে হবে। এতে করে ডিম গড়িয়ে যাবেনা ও ডিম ভাংবেনা এবং হাঁস গুলো আরামে থাকবে। হাঁসের ঘরের লিটার যেন কোন অবস্থাতেই ভিজে না যায়। প্রতিদিন একবার করে লিটার ওলট পালট করে দিতে হবে। পানি পড়ে লিটার ভিজে গেলে তা সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন করে দিতে হবে। এতে করে হাঁসের জন্যও আরামদায়ক হয়।
(৫) খামারের চারপাশে সুরক্ষার জন্য জাল দিয়ে দিবেন। যেন শিকারি পশুর থেকে হাঁস গুলোকে রক্ষা করা যায়।
উপরোক্ত তথ্যের আলোকে মূলত বদ্ধ পদ্ধতিতে হাঁস পালন করার জন্য খামার নির্মাণ করতে পারবেন। তবে গ্রামাঞ্চলে মূলত খোলা পরিবেশে আধা বদ্ধ অবস্থায় হাঁস পালন করা হয়। এক্ষেত্রে কিছুটা খোলা জায়গা থাকে এবং কিছুটা আবদ্ধ জায়গা থাকে।
আরও পড়ুনঃ লাভজনকভাবে কবুতর পালন পদ্ধতি।
আধা বদ্ধ পদ্ধতিতে হাঁস পালন
আধা বদ্ধ পদ্ধতিতে পালনের জন্য আপনাকে নিচের প্রয়োজনীয়তা গুলো পূরণ করতে হবে:
- প্রতি হাঁসের জন্য ১০ থেকে ১২ বর্গফুট খোলা জায়গা প্রয়োজন। ৩০০টি হাঁসের জন্য প্রায় ৩০০০ থেকে ৩৬০০ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন হবে।
- আধা বদ্ধ পদ্ধতির জন্য একটি ছোট্ট অববদ্ধ জায়গা রাখতে হবে। সেখানে হাঁসগুলো রাতের বেলা বা প্রয়োজনে আশ্রয় নিবে। এর জন্য ৩০০টি হাঁসের জন্য ৩০০ থেকে ৪০০ বর্গফুট জায়গা লাগবে।
অর্থাৎ, আধা বদ্ধ পদ্ধতিতে হাঁস পালনের জন্য আপনার মোট জায়গার প্রয়োজন হবে- ৩০০ টি হাঁস পালনের জন্য ৩৩০০ থেকে ৪০০০ বর্গফুট জায়গা।
আরও পড়ুনঃ বর্তমান সময়ের সেরা ৭টি স্টক মালের ব্যবসা আইডিয়া।
৩০০টি হাঁস পালনের জন্য খাবারের সরবরাহ
হাঁসের খাবারের পরিমাণ বিভিন্ন উপাদান এবং পালনের পদ্ধতির উপর নির্ভর করে। তবে সাধারণভাবে, প্রতিটি হাঁসের জন্য দৈনিক প্রায় ১০০-১৫০ গ্রাম খাবারের প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে খাদ্য শস্য, প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল মিশ্রিত খাবার হতে হবে। ৩০০টি হাঁস পালনের জন্য যে পরিমাণ খাবার প্রয়োজন হবে, তা নিচে দেওয়া হলো:
- প্রতিটি হাঁসের দৈনিক খাবার প্রয়োজন ১০০-১৫০ গ্রাম।
- ৩০০টি হাঁসের জন্য দৈনিক খাবার প্রয়োজন ৩০ কেজি (গড়ে ১১০ গ্রাম/ হাঁস ধরে)।
- ৩০০টি হাঁসের জন্য মাসিক খাবার প্রয়োজন ৩০ কেজি × ৩০ দিন = ৯০০ কেজি খাবার।
অর্থাৎ, ৩০০টি হাঁস পালনের জন্য মাসে প্রায় ৯০০ কেজি খাবার প্রয়োজন হবে। এবার চলুন জেনে নেওয়া যাক হাঁসের পর্যাপ্ত খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য যে সকল খাবার দেওয়া যেতে পারে, সেগুলোর তালিকা:
- ভুট্টা, গম, চালখই ইত্যাদি।
- প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার, যেমন- মাছের খাবার, সয়াবিন, তৈলবীজ, ডিমের খোসা বা মুরগির খাদ্য ইত্যাদি।
- ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার, যেমন- মাছের তেল, ভিটামিন, খনিজ লবণ, ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবার ইত্যাদি।
- হাঁসের পুষ্টির জন্য সবুজ ঘাস, পালং শাক, করলা, বাঁধাকপি ইত্যাদি শাকসবজিও দিতে পারেন।
এছাড়াও হাঁসের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে স্বচ্ছ পানি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি চাইলে আপনার হাঁসগুলোকে ফিড মিক্সও খাওয়াতে পারেন।
তবে মনে রাখতে হবে হাঁস প্রচুর খাদ্য গ্রহন করে, তাই তাকে পর্যাপ্ত খাবারের যোগান দিতে হবে। সুষ্ঠ ভাবে হাঁস পালন করতে হলে হাঁসের খাবারের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাহলেই ডিম ও মাংশের প্রকৃত যোগান পাওয়া সম্ভব হবে।
হাঁসকে কোন ভাবেই শুকনো খাবার দেওয়া যাবেনা। হাঁস যেটুকু খাবার গ্রহন করে তার থেকে দ্বিগুন পানি পান করে। শূণ্য থেকে আট সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত বাচ্চাকে তার স্বাধীন মতো খাবার খেতে দিতে হবে। প্রাপ্ত বয়ষ্ক হাঁসকে দিনে দুবার খাদ্য দিতে হবে।
আরও পড়ুনঃ লাভজনক ৭টি ৫০ হাজার টাকায় ব্যবসা আইডিয়া।
হাঁসের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও চিকিৎসা
লাভজনকভাবে হাঁস পালন করার জন্য আপনার খামারকে অবশ্যই রোগ মুক্ত রাখতে হবে। হাঁসের খামার করে লাভজনক ফলাফল পেতে রোগব্যাধির চিকিৎসা করার চেয়ে রোগ মুক্ত রাখা বেশি সুবিধাজনক ও জরুরী। কারণ একজন আদর্শ খামারীর লক্ষ্য থাকবে কিভাবে অল্প খরচে বেশি লাভবান হওয়া যায়।
একজন খামারিকে অবশ্যই হাঁসের মারাত্নক দুটি রোগের টিকা দিতে হবে। রোগ দুটি হলো: ‘ডাক-প্লেগ’ ও ‘ডাক কলেরা’ রোগ। এ দুটি টিকা নিতে ও প্রয়েজনীয় পরামর্শের জন্য নিকটতম পশু টিকিৎসা কেন্দ্রে যেতে হবে। এছাড়া সুষ্ঠ এবং স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থপনায় হাঁসের রোগমুক্ত রাখা খুবই সহজ বেপার। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গুলো হলো:
- খামারে অবাধ প্রবেশ বন্ধ করা।
- চাহিদা অনুসারে স্বাস্থ্যসম্মত সুষম খাবার সরবরাহ করা।
- নিরাপদ পানি প্রদান করা।
- খাবার পাত্র পরিস্কার রাখা।
- কোন হাঁস অসুস্থ হলে আলাদা জায়গায় রাখা ও তার চিকিৎসা করা।
- হাঁসের ঘর পরিস্কার রাখা এবং জীবানুনাশক ঔষধ পানিতে মিশিয়ে খামার জীবানুমুক্ত করা।
এসকল কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারলে হাঁস-মুরগীর রানীক্ষেত বা কলেরা ও এজাতীয় রোগ থেকে মুক্ত রাখা খুবই সহজ হবে। আবার হাঁসের রোগ প্রতিরোধক টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে, প্রথম টিকা দিতে হবে ২১ দিন বয়সে। তার পরের টিকা দিতে হবে ৩৬ দিন বয়সে এবং ৭০ দিন বয়সে কলেরা টিকা দিতে হবে। এছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ি টিকা প্রদান করতে হবে।
আরও পড়ুনঃ সেরা ৬টি ২ লাখ টাকায় লাভজনক ব্যবসা আইডিয়া।
শেষকথা
এই আর্টিকেলে শুধুমাত্র একটি ব্যবসা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হয়েছে। তবে আপনি হাঁস পালন শুরু করতে চাইলে অবশ্যই হাঁসের লালন পালন পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিবেন।
FAQ’s
হাঁস পালনের সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি কোনটি?
উন্মুক্ত পদ্ধতিতে হাঁস পালন হলো হাঁস পালনের সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দিনের বেলা হাঁসগুলোকে ছেড়ে দেয়া হয়, তারা নিজেদের খাদ্য জোগাড় করে। আর সন্ধ্যায় হাঁসগুলো ঘরে ফিরে আসে। পাশাপাশি দিনে নির্দিষ্ট কয়েকবার সুষম খাদ্য সরবরাহ করা হয়। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ খামারিরা এই পদ্ধতিতে হাঁস পালন করে থাকে।
হাঁসের ডিম কত দিনে ফুটে?
সাধারনত হাঁস ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর জন্য ২১ দিন সময় নেয়।
হাঁসের কোন কোন রোগ বেশি হয়?
হাঁসের যে সকল রোগ বেশি হয়, সেগুলো হলোঃ ডাক ভাইরাল হেপাটাইটিস, ডাক প্লেগ, ডাক কলেরা, মাইকোটক্সিকোসিস ও বটুলিজম, আমাশয়।