প্রবাসীর বোবা কান্না

প্রবাসীর বোবা কান্না

প্রবাসীর বোবা কান্না- প্রবাসী; যে স্বদেশ ত্যাগ করে বিদেশে বাস করে, তাকে বলা হয় প্রবাসী। আমি এটাকে প্রবাসী বলতে নারাজ। আমি বলবো এটাকে বনবাসী। কেননা জেলখানার জীবন আর প্রবাস জীবনের মাঝে তেমন একটা পার্থক্য আমি দেখতে পাই না।

জেলখানাতে যেমন মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানকে ছেড়ে বন্দী জীবন যাপন করতে হয়- প্রবাসেও তো এর ব্যতিক্রম নয়।

এখানেও বন্দি থেকে রোবটের মতো সারাদিন কাজ করতে হয়। তপ্ত মরুর বুকে গড়ে ওঠা সুউচ্চ দালান গুলো তো এই প্রবাসীদের হাড্ডি দিয়েই বানানো। রঙিন রঙিন অট্টালিকাগুলো তো প্রবাসীর রক্তে রাঙানো। প্রবাসীদের রক্তকে ঘামে রূপান্তর করেই তো আকাশচুম্বী ভবনের ঝলমলে কাঁচগুলো নির্মিত। কিন্তু প্রবাসীর কি আর সেই অধিকার আছে- সেই সুউচ্চ দালানে বাস করার?

প্রবাসী; যার খাওয়া-ঘুমের কোনো ঠিক নেই। যার জীবনের কোনো দাম নেই। যার আরাম-আয়েশের কথা কেউ ভাবে না। কেননা সে তো রোবট। সে তো কাজ করার একটি মেশিন। যত পারা যায় তাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই হলো। যখন মাটির ওই রোবটটি অকেজো হয়ে যায়, তাকে রিক্ত হস্তে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

আচ্ছা, দেশেও কি সে শান্তিতে থাকতে পারে?

সারাটা যৌবন ব্যয় করেছে পয়সা উপার্জন করতে। নিজের শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে পরিবারের চাহিদা মিটিয়েছে। পরিবারের সকলের শখ-আবদার পূরণ করেছেন। নিজের এই আত্মত্যাগের বিনিময়ে চেয়েছে শুধু পরিবারের মুখের হাসি। এই একটুকরো হাসির জন্য না জানি কত রাত জেগে জেগে ডিউটি করতে হয়েছে। না জানি কত দুপুর কড়া রৌদ্দুরে কাটিয়েছে। নিজের শরীরকে কয়লা করেছে।

নিজের মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে না জানি কতদিন বেলা অভুক্ত রয়েছে এই প্রবাসী। চাকরির অনিশ্চয়তা, মালিকের অত্যাচার, সময়মতো বেতন না পাওয়া- এতসব চিন্তায় রাতে না ঘুমানো প্রবাসী। অপরদিকে খেয়ে পড়ে নরম বিছানায় তৃপ্তির বেঘোর ঘুমে আচ্ছন্নতার তার পরিবার।

প্রবাসীরা খুবই মিথ্যুক- এরা না খেয়ে থাকলেও ফোনে মাকে বলে “আজ দুপুরে খুব ভালো খাবার খেয়েছি মা।” এরা আসলেই খুব মিথ্যুক- এদের হাসিগুলোও মিথ্যা। এরা নিজের কান্না লুকাতে হাসিখুশি থাকার ভান ধরে। এরা নিজের জন্য নয়, পরিবারের জন্য খেটে মরে।

প্রবাসীরা আসলেই মিথ্যাবাদী। এরা কথা দেয়- এই ঈদে বাড়ি ফিরবে, না হয় ওই ঈদে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু এরা বাড়ি ফিরে না। দেশের বাড়িতে থাকা ঋণের বোঝাকে হালকা করতে বছরের পর বছর বিদেশে পড়ে থাকে। দেশে আসতে না পারার বিভিন্ন মিথ্যা অজুহাত দিতে থাকে।

আরো পড়ুন: জামানত ছাড়া ব্যাংক লোন – বিদেশিদের জন্য

শুনেছি প্রবাসীদের কখনো অসুখ হয় না। কেননা এরা প্রতিটা দিন কাজে যায়। প্রচন্ড জ্বর উঠলেও একটু শুয়ে বিশ্রাম করার উপায় যে এদের নেই। একটি দিন বসে থাকলে, একটি দিনের বেতন কাটা যাবে। সেই একটা দিনের টাকাও যে তার দেশে পাঠাতে হবে। কেননা ছেলে আবদার করেছে নতুন জুতো কিনে দেওয়ার। তাই সেই প্রবাসী দুইটা প্যারাসিটামল খেয়ে কাজে নেমে পড়ে। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে প্রবাসীর যেন কিছুই হয় না। যদি কখনো প্রবাসী দেশে ফিরে আসার কথা বলে, তাহলে লোকেরা তাকে ‘অলস’ বলে ঠাট্টা করে।

প্রবাসীরা অন্ধ:- এরা নিজের দুঃখ দেখতে পায় না। নিজের শরীরের ক্ষত এদের নজরে পড়ে না। এরা দেখতে পায় নিজের পরিবারের অভাব-অনটন। এরা শুধু দেখতে চায় পরিবারের হাস্যজ্জল মুখ।

প্রবাসীরা বধির:- এরা নিজের কান্না শুনতে পায় না। এদের বুকের মাঝে একাকীত্ব চিৎকার করে, তবুও সেই চিৎকার এদের কানে যায় না। এরা পরিবারের সুখের কথা শোনার জন্য ব্যাকুল থাকে।

প্রবাসীদের দুঃখ-কষ্ট কেউ দেখতে চায় না। কেউ জানতে চায় না তার মনের কথা। কেউ বুঝতে চায় না তার বেদনা। সবাই ভাবে প্রবাসীরা তো টাকা কামানোর মেশিন।

এই প্রবাসীর টাকাতেই তো দেশের উন্নয়ন হয়। পরিবার সুখে-শান্তিতে বাস করে। কিন্তু প্রবাসীর জীবনের কোনো উন্নয়ন সাধিত হয় না। সব কিছুর পরে প্রবাসীকেই হতে হয় লাঞ্ছিত-বঞ্চিত।

এদের চোখের অশ্রু, এদের কান্না এরা নিজেরাই তো দেখে না। দেখবে কীভাবে?

[প্রিয় পাঠক, প্রোবাংলা অনলাইনে প্রবাস বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাসে আপনার কমিউনিটির নানান খবর, ভ্রমণ, আড্ডা, গল্প, স্মৃতিচারণসহ যে কোনো বিষয়ে লিখে পাঠাতে পারেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছবিসহ মেইল করুন info@probangla.com এই ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।]

About Juyel Ahmed Liton

সুপ্রিয় “প্রোবাংলা” কমিউনিটি, ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি আকর্ষণ ছিলো এবং হয়তো সেই আকর্ষণটা অন্য দশ জনের থেকে একটু বেশি। ওয়েবসাইট, টাইপিং, আর্টিকেল লেখাসহ টেকনোলজি সবই আমার প্রিয়। জীবনে টেকনোলজি আমাকে যতটা ইম্প্রেস করেছে ততোটা অন্যকিছু কখনো করতে পারেনি। আর এই প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ থেকেই লেখালেখির শুরু.....

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pro Bangla-প্রো বাংলা