প্রবাস বনবাসী

প্রবাসী না কি বনবাসী?

একটা সময় ছিল যখন শাস্তি হিসেবে মানুষকে বনবাস বা দেশান্তরি করতো। তখন পরদেশে মানুষ বনবাসী জীবন যাপন করত। কী নিদারুণ কষ্ট ছিল সেই জীবন। আজ প্রবাসী জীবনের সাথে বনবাসী জীবনের তুলনা করা চলে। কেননা প্রবাসী জীবনটাও একপ্রকার বনবাস। প্রবাসে না থাকে কোনো আপনজন। না থাকে কোন সহমর্মী। প্রবাসে যারা থাকে তারা সকলেই স্বার্থের জন্য পাশে থাকে। মালিকেরা আপনাকে শুধু শুধু টাকা দেয় না। আপনি আপনার রক্তকে ঘামে রূপান্তর করার ফলেই তারা যতসামান্য কিছু টাকা দেয়।

এদিকে দেশের মানুষেরা মনে করে আপনি বিদেশে খুব শান্তিতেই আছেন। কেননা তাদের ধারণা বিদেশের পথঘাট সবই চকচকে ঝকঝকে। রাস্তায় কোনো কাদা নেই, কোনো গর্ত নেই। পরিবহন ব্যবস্থা কত উন্নত। তারা মনে করে আপনি বিদেশে গিয়ে গাছ থেকে টাকা পারেন এবং তাদেরকে পাঠিয়ে দেন। তারা কল্পনাও করতে পারে না, কী কষ্টের মধ্যে আপনার জীবন কাটছে পরদেশে। খেয়ে না খেয়ে কাজ করতে হয় আপনাকে। শরীরের অসুস্থতাকে ভুলে, সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে আপনি কাজ করে যান।

আপনার লক্ষ্য থাকে কীভাবে আপনার পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে পারবেন। এইজন্য আপনি আপনার সবকিছুই বিলিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন আপনারও একটি জীবন আছে। আপনার জীবনেরও মূল্য আছে। যদিও আপনি আপনার জীবনকে তুচ্ছ মনে করে পরিবারের জীবনকে রাঙাতে চান। নিজের ঘুম-বিশ্রাম বাদ দিয়ে পরিবারকে একটু আরামে রাখতে চান।

কিন্তু একটি বার ভেবে দেখুন, আপনি যদি হঠাৎ কোনো কারণে দেশে এসে পড়েন এবং বিদেশে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখন কি আপনার পরিবার আপনাকে সঙ্গ দেবে?

এমন অনেক ঘটনার উদাহরণ আমাদের সমাজে রয়েছে; যখন কোনো প্রবাসী কোনো কারনে বিদেশ থেকে একেবারে দেশে এসে পড়ে, তখন তার সাথে কী দুর্ব্যবহারই না করা হয়। তখন তাকে বোঝা মনে করে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন। যতক্ষণ আপনি মানুষকে টাকা দিতে পারবেন ততক্ষণ আপনার মূল্য আছে। টাকা ছাড়া আপনার বিন্দু পরিমাণ মূল্য নেই কারো কাছে। আসলে এই জগতে মানুষের কোনো মূল্য নেই। মূল্য নেই কোনো আবেগ, অনুভূতির, কোনো ভালোবাসার। এই সমাজ, সংসার বোঝে শুধু টাকা। এই টাকার জন্যই আপনি আপনার জীবনটাকে তিলে তিলে ধ্বংস করছেন বিদেশে গিয়ে।

আরো পড়ুন: প্রবাসীর বোবা কান্না

মানছি টাকার প্রয়োজন আমাদের আছে। কিন্তু সেই প্রয়োজন কি আবেগ, অনুভূতি, ভালবাসার উর্ধ্বে?
যেখানে ভালোবাসা নেই এমন সম্পর্ক থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। টাকা দিয়ে সম্পর্ক গড়া যায় না। টাকা দিয়ে যে সম্পর্ক করা হয় সেটাকে সম্পর্ক বলে না। সেটাকে বলে চুক্তি বা বানিজ্য।

প্রবাসী ভাইদের পদে পদে লাঞ্ছিত হতে হয়। জমি-জমা বিক্রি করে, বন্ধক দিয়ে, সুদের ওপর টাকা নিয়ে বিদেশে যেতে হয়। বিদেশে গিয়ে রক্ত মাংসের শরীরকে যন্ত্রে পরিণত করতে হয়। অক্লান্ত পরিশ্রম করে সুদের টাকা শোধ করতে হয়। এরপর তো আছে আত্মীয় স্বজনদের দাবি দাওয়া। তারা এমনভাবে আবদার করে বসে যে, না দিয়ে পারা যায় না। তখন তাদের মুখে কত মধু। আপনি যতক্ষণ টাকা ঢালবেন ততক্ষণ দুধের মাছিরা আপনার আশেপাশে ঘুরবে। কথায় আছে, ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয় না।

কিন্তু আপনি টাকা উপার্জন বন্ধ করে দিন। দেখবেন কেউ আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে না। এমনকি ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসাও করবে না।

এজন্যই বলছি সম্পর্কগুলো নিঃস্বার্থ কি না তা আগে ভালোভাবে যাচাই করুন। নাচেৎ এর ভয়াবহ পরিণতি ভোগের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। আপনার আশেপাশেই এমন অসংখ্য প্রবাসী আছে যারা এর ভুক্তভোগী।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top