মানব জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই ক্ষুদ্র জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সাফল্য অর্জনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হচ্ছে অধ্যবসায়। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অধ্যবসায় রচনা প্রায় সকল শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র শিক্ষাব্যবস্থায়ই নয় জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অধ্যবসায়ের যে গুরুত্ব রয়েছে, তা আমাদের সকলেরই জানা উচিত। তাই প্রিয় শিক্ষার্থীবৃন্দ এবং বিভিন্ন শ্রেণীর ও শ্রম-পেশার মানুষের জন্য অধ্যবসায় রচনা ১০০০+ শব্দের অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় তুলে ধরা হলো।
অধ্যবসায়
ভূমিকা
“পারিব না এ কথাটি বলিও না আর
কেন পারিবে না তাহা ভাবো একবার,
পাঁচ জনে পারে যাহা,
তুমিও পারিবে তাহা
পারো কি-না পারো করো যতন আবার,
একবার না পারিলে দেখো শতবার।”
কবিতার এই লাইন গুলোর মতোই কোন কাজকে একাগ্রতার সাথে বারবার প্রচেষ্টা ও সাধনার মাধ্যমে অর্জন করাই অধ্যবসায়। পৃথিবীতে মানুষ বর্তমান সময় পর্যন্ত যতগুলো অভ্যাস আয়ত্তা করেছে তার মধ্যে অধ্যবসায়ই সর্বোত্তম। জীবনে সফলতা অর্জনের জন্য অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই। সুখ-দুঃখ, উথান-পতন, ব্যর্থতা- সফলতা। বারবার চেষ্টা করার পরেও ব্যর্থতা ঘিরে ধরতে পারে। কিন্তু সেই ব্যর্থতার মায়াজালে আটকে থাকলে চলবে না। জীবন মানেই সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে টিকে থেকে সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে উঠতে অনবরত চেষ্টা করে যেতে হবে। এবং অধ্যাবসায়ের মাধ্যমেই অর্জন করতে হবে সাফল্য।
অধ্যবসায় কি?
কোন কাজে সফলতা অর্জন করার জন্য বারবার চেষ্টা করার নামই হলো অধ্যবসায়। অধ্যবসায় শব্দের অর্থ হলো চেষ্টা বা সাধনা করা। উদ্যোগ, পরিশ্রম, আন্তরিকতা, মনোবল প্রভৃতি গুণ একত্রিত হয়েই অধ্যবসায়ের পরিপূর্ণরূপ সৃষ্টি করে। অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রেই সফলতা অর্জন করা যায়। অধ্যবসায়ের মূল হলো দৃঢ় মনোবল। প্রথম চেষ্টাতেই সহজ কাজ শেষ করে ফেলা যায়। কঠিন কাজের সফলতার মধ্যে মানুষের জীবনের সফলতা নির্ভর করে। আর এই কঠিন কাজের সফলতার জন্য অধ্যবসায় প্রয়োজন। অধ্যবসায় মানে দৃঢ় পরিশ্রম ও ধৈর্য। মানুষের চরিত্রের অন্যান্য গুণাবলী ও দৃঢ় মনোবল ধারণ করে আত্মনিয়োগ করে যখন কাজে লাগানো হয় তখন অধ্যবসায়ের পরিচয় পাওয়া যায়।
অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা
মানব জীবনে অধ্যবসায় হল সাফল্যের চাবিকাঠি। মানুষের জীবনে চলার পথে বাধা-বিপত্তি আসবেই। এই বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে অধ্যবসায় এর মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। আর সব সময় মনে করতে হবে জীবনের প্রথম ব্যর্থতা কে কারণ এটাই সফলতার প্রথম সিঁড়ি। মানুষ অসাধ্যকে সাধন করতে পারে ও ব্যর্থতাকে জয় করতে পারে শুধুমাত্র অধ্যবসায়ের গুণে। সব কাজে অধ্যবসায়ের প্রয়োজন আছে। অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাই জীবনের লক্ষ্য। জীবনে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কঠিন পথকে সহজ করার জন্য অধ্যবসায়ের প্রয়োজন।
সভ্যতার বিকাশে অধ্যবসায়
আমাদের পূর্বপুরুষদের অধ্যবসায়ের ফলে আজকের এই সভ্য জগৎ আমরা পেয়েছি। এক সময় পৃথিবী ছিল মানুষের বসবাসের অনুপযোগী। বনচর জন্তুুর মত মানুষ ছিল। তখন তাদের ভাষা, পরিবার, রাষ্ট্র, সমাজ ইত্যাদি কোন কিছুই ছিল না। গুহাবাসী মানবদের অধ্যবসায়ের গুনে আজ সভ্যতা চরম পর্যায়ে আহরণ করছে। যুগ যুগ ধরে মনীষীদের জ্ঞানের সমন্বয়ে ও অধ্যবসায়ের গুনে আজ প্রকৃতি এসেছে মানুষের হাতের মুঠোয় । এর ধারাবাহিকতায় চলতে থেকে পৃথিবী আজ সভ্যজগতে পৌঁছেছে । এখন মানুষ উন্নত বিলাসবহুল জীবন যাপন করছে। এইসবের সবই সম্ভব হয়েছে অধ্যবসের মাধ্যমে।
মানবজীবনে অধ্যবসায়
মানুষ সুখে-শান্তিতে থাকতে চায়। কিন্তু এই ভালো থাকার উপকরণ কারোর জন্য তৈরি করা থাকে না। মানুষকে তার যোগ্যতা দিয়ে অর্জন করে নিতে হয়। আর এর জন্য চাই অধ্যবসায়। অধ্যবসায় ছাড়া কোন জাতি ও দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারেনা। অধ্যবসায়ী ও পরিশ্রমী হলে জীবনের সুখ, সফলতা ও পরিপূর্ণতা আনতে পারবে। তাই মানব জীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। অধ্যবসায়হীন ব্যক্তি জীবনে কখনো সফল হতে পারেনা। ইংরেজিতে একটি কথা আছে –
” Failure is the pillar of ‘success “
অর্থাৎ, ব্যর্থতা সফলতার চাবিকাঠি
আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রবাদ হলোঃ
“সবচেয়ে কঠিন কাজ শক্তি দিয়ে নয়
বরং অধ্যবসায়ের দ্বারা সম্পাদিত হয়”
তাই বলাই বাহুল্য যে অধ্যবসায় আমাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যক্তিজীবনে অধ্যবসায়
যেকোনো ব্যক্তির জীবনে অধ্যবসায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। পৃথিবীর সকল মানুষের সক্ষমতা একই রকম নয়। কিন্তু প্রতিটি মানুষই উন্নত জীবনের সন্ধান করে। আর উন্নত জীবন অর্জনের জন্য অধ্যবসায়ের যথার্থ প্রয়োগ করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। একজন ব্যক্তি অধ্যবসায়ী হলে শক্তির স্বল্পতা তার সাফল্যের পথে কোন বাধা হয়ে থাকতে পারে না। একটি কাজের প্রতি আগ্রহ, বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, সুদৃঢ় সংকল্প সকল বিষয়বস্তু যদি ঠিক থাকে তবে সেই কাজে ব্যর্থতার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিজীবনে নিরলস অধ্যবসায় প্রয়োজন।
ছাত্র জীবনে অধ্যবসায়
আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ছাত্রজীবন। এসময় অধ্যবসায়ের একান্ত প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অর্ঘ্য মেধাশক্তি সম্পন্ন ছাত্রও অধ্যবসায়ী হলে তার শিক্ষাজীবনে সাফল্য অর্জন করতে পারে। কিন্তু আলস্যপরায়ণ ও শ্রমবিমুখ ব্যক্তি কখনো উপযুক্ত বিদ্যালাভ করতে পারে না। তাই শিক্ষালাভ করার ক্ষেত্রে সফলকাম না হলে পুনরায় নতুন উদ্যমে তীব্র প্রচেষ্টার সাথে চেষ্টা করতে হবে।
মনীষীদের জীবনে অধ্যবসায়
পৃথিবীতে যারা মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা লাভ করেছেন এবং আদর্শ ব্যক্তিেত্বর ছিলেন তারা প্রত্যেকেই ছিলেন অধ্যবসায়ী। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস ২০ বছরের সাধনায় রচনা করেন ‘বাংলা ভাষার অভিধান’। মহাকবি ফেরদৌসীর অমর মহাকাব্য ‘শাহনামা’ দীর্ঘ ৩০ বছরের কাব্য প্রয়াস। কোন প্রতিষ্ঠানের সহায়তা ছাড়াই একক প্রচেষ্টায় প্রায় ২০০০ প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ করেন খ্যাতনামা সংগ্রাহক আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ। স্কটল্যান্ড এর রাজা রবার্ট ব্রুস পরপর ছয়বার ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়েও হাল ছাড়েননি এবং শেষ পর্যন্ত তিনি জয়ী হয়েছিলেন। বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী নিউটনের অকুন্ঠ স্বীকৃতি; বিজ্ঞানে তার অবদানের মূলে আছে বহু বছরের একনিষ্ঠ সাধনা ও নিরবিচ্ছিন্ন পরিশ্রম। অধ্যবসায় ছাড়া কখনো কোনো মানুষ সফল হতে পারে না।
অধ্যবসায় ও প্রতিভা
অনেকে মনে করেন যে, অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী না হলে বড় কোনো কাজ সাধন করা যায় না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অধ্যবসায় ও পরিশ্রম ছাড়া শুধু প্রতিবায় কোন কিছু অর্জন সম্ভব হয় না। এ বিষয়ে দার্শনিক ভলতেয়ার বলেছেন, “প্রতিভা বলে কিছুই নেই। পরিশ্রম ও সাধনা করে যাও, তাহলেই প্রতিভাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে।” ডালটন বলেছেন, “লোকে আমাকে প্রতিভাবান বলে, কিন্তু আমি পরিশ্রম ছাড়া আর কিছুই জানিনা।” অর্থাৎ প্রতিভাবান ব্যক্তি সফল হতে চাইলেও অধ্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম।
অধ্যবসায় জীবনের চিরায়ত সংগ্রামী শক্তি
ধৈর্য সহকারে বারবার চেষ্টা করাই হচ্ছে অধ্যবসায়। কোন কাজে অধ্যবসায়ী হওয়া মানে জীবন দিয়ে সংগ্রাম করা। জীবনের প্রতিটি ধাপে অধ্যবসায় ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জনের পথরেখা আমাদের সামনে হাজির হবে।
অধ্যবসায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্ত
ইতিহাস ঘাটলে অধ্যবসায়ীদের বহু উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়। স্কটল্যান্ড এর রাজা রবার্ট ব্রুস ইংল্যান্ডের রাজা এডওয়ার্ডের সঙ্গে ৬বার যুদ্ধে পরাজিত হয়েও অধ্যবসায় ত্যাগ করেননি। অতঃপর সে একটি নির্জন দুর্গে অবস্থান করে। সেখানে একটি মাকড়শাকে সাতবার চেষ্টার পর দুটি করি কাটে সুতা জড়িয়ে জাল তৈরি করতে সমর্থ্য হতে দেখে। অতঃপর সে নতুন উদ্যমে সপ্তম বারের মতো যুদ্ধে যায় এবং জয় লাভ করে। বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন ৯৯৯ বার ব্যর্থ হয়েও, ১,০০০ তম প্রচেষ্টায় বাল্ব তৈরি করতে সমর্থন হয়েছিল। এরকম আরো বহু নিদর্শন ইতিহাসে রয়ে গেছে।
আরও পড়ুন: বাংলা বর্ণমালা (স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ)
অধ্যবসায়হীন ব্যক্তির পরিণাম
অধ্যবসায়হীন ব্যক্তির পরিণাম ব্যর্থতা ও আফসোসে পরিপূর্ণ। যাদের জীবনে অধ্যবসায় নেই, তাদের জীবন ব্যর্থতায় পরিপূর্ণ। অধ্যবসায়হীন মানুষ জীবনে সাফল্য লাভ করতে পারে না। একসময় তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। মানুষ পৃথিবীতে অমরত্ব লাভ করতে পারে একমাত্র অধ্যবসায়ের গুণে।
উপসংহার
মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অধ্যবসায়ের একান্ত প্রয়োজন। যে ব্যক্তি অধ্যবসায়ী নয় সে কখনো কোন কাজে সফল হতে পারেনা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পৃথিবীর অধিকাংশ জ্ঞানী -গুণী, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, পন্ডিতরাই ছিলেন চাষাভূসা, শ্রমিক, দর্জি, মুচি ইত্যাদি গরিব লোকের সন্তান। পৃথিবীতে তারা প্রত্যেকেই বড় হয়েছেন শুধু অধ্যবসায়ের শক্তিতে। অধ্যবসায়ের জন্য প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস ও সুদৃঢ় মনোবল।
উপরোক্ত অধ্যবসায় রচনা ১০০০+ শব্দের, রচনাটি Class 7, 8, 9, SSC, HSC ইত্যাদি শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য আকর্ষণীয়ভাবে পাঠযোগ্য এবং উপস্থাপন যোগ্য।