বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মৎস্য আমিষের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যেই মাছ খাওয়া হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো পাঙ্গাস।
মূলত অতীতকালে বিশেষ করে বাংলাদেশে দক্ষিণাঞ্চলের নদীমাতৃক উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে এই মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু পরবর্তীতে এই মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এর উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে।
তবে এখন পাঙ্গাস মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদন কম হলেও চাষাবাদের মাধ্যমে এর ব্যাপক উৎপাদন করে মানুষের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। তবে এই মাছের প্রতি মানুষের চাহিদা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই আপনার যদি মাছের খাবার করার ইচ্ছা থাকে, তাহলে পাঙ্গাস মাছ চাষ পদ্ধতি জেনে এই লাভজনক উদ্যোগটি শুরু করতে পারেন।
পাঙ্গাস মাছের বিভিন্ন জাত
সাধারণত পাঙ্গাস মাছের যে সকল জাত রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি চাষ করা হয় দেশী পাঙ্গাস ও থাই পাঙ্গাস। তাই চাষাবাদের জন্য পাঙ্গাস মানুষের জাত নির্বাচন করতে এই দুটি সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক:
(১) দেশী পাঙ্গাস
দেশী পাঙ্গাস এর রূপালী রঙের পিঠের দিকে কালচে এবং পার্শ্ব রেখার ওপরে সামান্য ধূসর। এ মাছের দেহে কোন আঁশ নেই। এখনও আমাদের দেশীয় প্রজাতির পাঙ্গাস সুস্বাদু এবং বেশি মূল্যে বিক্রি হয়ে থাকে। বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, বহ্মপুত্র ও যমুনা নদীতে এ মাছটি বেশি পাওয়া যায়। এরা প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের বিভিন্ন নদীসহ প্রধান নদীগুলোতে এর পোনা পাওয়া যায়।
(২) থাই পাঙ্গাস
এদের আদিবাস থাইল্যান্ডে, কম্পুচিয়া, ভিয়েতনাম এবং পাশ্ববর্তী অঞ্চলের দেশে। আমাদের দেশে সর্বপ্রথম ১৯৯৩ সনে বিদেশী এ প্রজাতির মাছের সফল প্রজনন করানো সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে বাণিজ্যিক চাষাবাদের ক্ষেত্রে থাই পাঙ্গাস একটি জনপ্রিয় নাম। দেশী পাঙ্গাসের চেয়ে এ জাত দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এ মাছটি সর্বোচ্চ ১০-১২ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
আরও পড়ুনঃ
- লাভ বার্ড পাখি পালন পদ্ধতি | Love Bird.
- লাভজনকভাবে কবুতর পালন পদ্ধতি।
- লাভজনকভাবে কোয়েল পাখি পালন পদ্ধতি।
পাঙ্গাস মাছ চাষ পদ্ধতি
মাছ চাষের পদ্ধতিটি নির্ভর করে পুকুর বা জলাশয়ের বৈশিষ্ট্য, পরিবেশেগত অবস্থা, পানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা, পুঁজি, মানসম্মত পোনা প্রাপ্তি, বাজার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ের ওপরে। এসব বিষয়গুলোকে মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় চাষ পদ্ধতিটি কেমন হবে। এক্ষেত্রে আমরা পাঙ্গাস মাছের একক বা নিবিড় চাষ সম্পর্কে জেনে চাষাবাদ শুরু করতে পারি।
মূলত এই পদ্ধতিতে কম সময়ে বেশি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে বেশি ঘনত্বে পোনা মজুদ করা হয়। এক্ষেত্রে আমিষ সমৃদ্ধ কৃত্রিম খাবার প্রয়োগের মাধ্যমে বেশি মুনাফা করা যায়। উন্নত চাষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হেক্টর প্রতি ১৫ থেকে ২০ টন পাঙ্গাস উৎপাদন করা সম্ভব।
একক চাষে প্রতি হেক্টরে ৮ থেকে ১০ সেমি. আকারের ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে বিগত বছরের পোনা মজুদ করে অধিক উৎপাদন ও বেশি মুনাফা বাড়ানো সম্ভব।
পাঙ্গাস চাষের পুকুর নির্বাচন
মূলত পাঙ্গাস মাছ চাষের জন্য পুকুর নির্বাচনের ক্ষেত্রে আয়তাকার পুকুর হলে বেশি ভালো হয়। যাইহোক, পুকুরের আকৃতি যেমনই হোক না কেন পুকুরের তলার মাটি ভালোভাবে সমতল করে নিতে হবে। আর চাষাবাদের জন্য পুকুরের পানির গভীরতা ১.৫ থেকে ২ মিটার রাখতে হয়।
পাঙ্গাস চাষের জন্য দোআঁশ মাটির পুকুর সবেচেয়ে ভাল। জরুরি প্রয়োজনে যাতে দ্রুত পানি দেয়া যায় সেজন্য পুকুরের কাছেই গভীর বা অগভীর নলকূপের ব্যবস্থা রাখা দরকার। বর্ষায় বা অতিরিক্ত বৃষ্টিতে যাতে করে পুকুর ভেঙ্গে না যায় সেজন্য আগে থেকেই প্রয়োজনীয় মেরামত সেরে ফেলতে হয়।
সর্বোপরি এমন জায়গায় পুকুরটি বেছে নিতে হবে যেখানে যোগাযোগের সুবিধা ভাল এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে।
আরও পড়ুনঃ মাশরুম চাষ করে লাভবান হওয়ার ব্যবসা আইডিয়া।
মাছ চাষের জন্য পুকুর প্রস্তুতি
পুকর নির্বাচন করার পরের কাজটি হলো পুকুরকে ভালোভাবে প্রস্তুত করে নেয়া। এক্ষেত্রে পুকুর প্রস্তুতি জন্য পুকুরে নানা ধরনের জলজ আগাছা থাকলে প্রথমেই সেগুলোকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
পাঙ্গাস চাষের পুকুরে অপ্রয়োজনীয় ও রাক্ষুসে মাছ যেমন: গজার, টাকি, মলা, বাইম, শোল, বোয়াল, ঢেলা ইত্যাদি মাছকে পাঙ্গাস চাষের আগেই অপসারণ করতে হবে। বিভিন্নভাবেই এদেরকে অপসারণ করতে পারবেন। যেমন ঘন ফাঁসের জাল বারবার টেনে সব ধরণের অনাকাঙ্খিত মাছ সরিয়ে ফেলতে হবে।
পুকুরের পানি পরিষ্কার করে এবং সম্ভব হলে তলার মাটি লাঙ্গল দিয়ে চাষ করে দিতে হবে। অনেক সময় বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করলেও অপ্রয়োজনীয় ও রাক্ষুসে মাছদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে স্থানীয় মৎস্য অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করে এদের দমন করা যেতে পারে।
আবার পুকুরকে মাছ চাষের উপযুক্ত ও টেকসই করতে চুন প্রয়োগ খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে সব পুকুরের পানিতে অম্লত্বের সমস্য নেই সেখানে প্রতি হেক্টরের জন্য ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হয়। চুন প্রয়োগের আগে গুড়ো করে মিহি করে নিলে এর কার্যকারিতা অনেকগুণ বেড়ে যায়। পুকুরের প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জৈব এবং রাসায়নিক সার দুটোই ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
সাধারণত চুন প্রয়োগের ৪/৫ দিন পর সার প্রয়োগ করতে হয়। নতুন পুকুর এবং বেলে মাটির পুকুরে জৈব সার বেশি প্রয়োগ করতে হয়। তবে পুরাতন কাদাযুক্ত পুকুরে রাসায়নিক সার প্রয়োগের হার বেশি হবে। পুকুর প্রস্তুতকালীন সময়ে জৈব সার হিসেবে প্রতি শতকে ৮ থেকে ১০ কেজি গোবর অথবা ৪ থেকে ৫ কেজি মুরগীর বিষ্ঠা ব্যবহার করতে হবে।
সারের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য প্রতি শতকে ১০০ গ্রাম টিএসপি জৈব সারের সাথে ৮ থেকে ১০ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে ব্যবহার করতে হয়। ব্যবহারের আগে প্রতি শতকে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া মিশিয়ে মিশ্রনটি সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের ৪ থেকে ৫ দিন পর পুকুরের পানির রঙ সবুজ বা বাদামী হলে সাধারণত পোনা মজুদের উপযোগী হয়।
আরও পড়ুনঃ বাণিজ্যিকভাবে টার্কি পালন পদ্ধতি ২০২৫।
পোনা সংগ্রহ ও পরিবহন
পুকুরের প্রস্তুতি শেষ হলে উন্নত গুনাগুন সম্পন্ন পাঙ্গাস মাছের পোনা সংগ্রহ করতে হয়। এ জন্য বিশ্বস্ত কোন হ্যাচারী থেকে পোনা সংগ্রহ করা উচিত। পোনা পরিবহনের সময় বিশেষ সতর্কতা নিতে হবে যাতে করে পরিবহনের সময় পোনার কোন ক্ষতি না হয়।
পরিবহনের আগেই চৌবাচ্চায় ৪ থেকে ৫ ঘন্টা পোনাকে উপোস রেখে টেকসই করে নিতে হবে। পরিবহনের সময় পোনাকে বেশি উত্তেজিত করা উচিৎ নয়।
পুকুরে পাঙ্গাস মাছের খাদ্য প্রয়োগ
পাঙ্গাস চাষে পুকুরে যে প্রাকৃতিক খাবার তৈরি হয়, তা মাছের আশানুরূপ ফলনের জন্য যথেষ্ঠ নয়। তাই সুষম খাদ্য প্রয়োগ অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে চাষ পর্যায়ে দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমান খাদ্য সরবরাহ না করতে পারলে পাঙ্গাসের উৎপাদন বাধাগ্রস্থ হবে।
মাছের খাদ্যের পরিমান মাছের বয়স এবং দেহের ওজনের ওপর নির্ভর করে। ১৫ দিন পর পর নমুনা হিসেবে কয়েকটি মাছের ওজন পরীক্ষা করে দেখতে হবে মাছ ঠিক মতো বাড়ছে কিনা। নির্দিষ্ট পরিমান খাদ্য পুকুরের আয়তন অনুযায়ী নির্ধারিত ৬ থেকে ৮ টি স্থানে প্রদান করা ভাল।
দানাদার জাতীয় খাবার ছিটিং এবং সম্পূরক খাবার বল আকারে নির্দিষ্ট জায়গায় সরবরাহ করতে হয়। খাবার একবারে না দিয়ে ২ থেকে ৩ বারে সমানভাবে ভাগ করে প্রয়োগ করলে খাদ্যের কার্যকারীতা অনেক বেড়ে যায়। এ ছাড়া প্রয়োজনমতো চুন এবং সার প্রয়োগ করাটাও জরুরি।
আরও পড়ুনঃ মৌমাছি পালন বা মৌমাছি চাষের ব্যবসা করার নিয়ম।
পুকুর থেকে মাছ সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণ
সাধারণত মাছ মজুদের ৫-৬ মাস পর যখন পাঙ্গাসের গড় ওজন ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম হয়। তখনই বাজারের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে মজুদকৃত মাছের ৫০% বাজারে বিক্রি করে দিতে হয়। এতে করে অবশিষ্ট মাছ দ্রুত বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়।
শেষকথা
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পারিপারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণে মাছের চাষ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই আপনিও চাইলে পুকুরে আধুনিক পদ্ধতিতে পাঙ্গাস মাছ চাষ শুরু করতে পারেন।