অর্জুন গাছের উপকারিতা ও অপকারিতা

অর্জুন গাছ আমাদের অতি পরিচিত একটি গাছ। গ্রামাঞ্চলে প্রায়শই এই গাছের দেখা মেলে। যদিও এখন কিছুটা কমে গেছে। তবে এর নাম সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। কেননা কবিরাজি চিকিৎসায় অর্থাৎ ভেষজ ঔষধ হিসেবে এর কদর অনেক বেশি। একটা সময় যখন এল্যোপ্যাথি ঔষধ ছিল না তখন মানুষজন ভেষজ উদ্ভিদ দিয়ে চিকিৎসা করত। এমন নয় যে এগুলো দিয়ে কোনো উপকার সাধিত হয় না। বরঞ্চ এ সকল ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া খুবই কম। দামেও সস্তা। 

অর্জুন গাছ ২০ থেকে ২৫ মিটার উচ্চতার হয়ে থাকে। এর ফল কামরাঙ্গা ফলের মতো বড় বড় খাঁজ কাটা। তবে খুবই শক্ত। এটার ফল দিয়েও ওষুধ তৈরি করা হয়। এছাড়া অর্জুন গাছের কাঠ খুবই শক্ত। এটা দিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি করা হয়— খাট, চেয়ার, টেবিল। মাঝেমধ্যে এটা দিয়ে নৌকাও তৈরি হয়। 

বলা হয়ে থাকে, অর্জুন গাছ বাড়িতে থাকলে চিকিৎসক লাগে না। কেননা এর ছাল খুবই উপকারী। এর ছাল দিয়ে অসুখের ওষুধ তৈরি করা হয়। তাই আজ আমরা জানবো অর্জুন গাছের উপকারিতা। 

অর্জুন গাছের বৈশিষ্ট্য 

অর্জুন গাছ অনেক উঁচু হয়ে থাকে। ২০ থেকে ২৫ মিটার উচু। এর বাকল খুবই মসৃণ। ধূসরাভ শাদা রঙের বাকল। পাতাগুলো সবুজ এবং লম্বাটে। এর ফুল হলদে সাদা এবং থোকায় থোকায় হয়ে থাকে। ফলগুলো খুবই আঁশযুক্ত এবং কামরাঙ্গার মতো এরও পাঁচটি কোণা রয়েছে। তবে আকারে কিছুটা ছোট।

অর্জুন গাছের আদি নিবাস এই ভারতবর্ষে। বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তান শ্রীলঙ্কা মায়ানমার এ সকল দেশ সমূহে অর্জুন গাছ খুব ভালো জন্মায়। তবে অন্যান্য দেশেও অর্জুনের চারা নিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেন সমূহে রোপন করা হয়েছে।

অর্জুন গাছের উপকারিতা

অর্জুন গাছের উপকারিতা

অর্জুন গাছের অসংখ্য গুণ রয়েছে। তবে আমরা অনেকেই এই সকল গুন সম্পর্কে অবগত নই। সঠিকভাবে অর্জুন গাছের ব্যবহার করতে জানলে বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্ত হওয়া যাবে। নিচে অর্জুন গাছের উপকারিতা উল্লেখ্য করা হলো।

হৃদরোগের চিকিৎসা: অর্জুন গাছের বাকল হৃদরোগের চিকিৎসায় বিশেষভাবে কার্যকর। এটি হৃদযন্ত্রের পেশী শক্তিশালী করে এবং হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। দুধের সাথে অর্জুন গাছের বাকোলের গুঁড়া মিশিয়ে খেলে ভালো উপকার পাওয়া যাবে।

আরও পড়ুন: জাফরানের উপকারিতা ও অপকারিতা

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: অর্জুন গাছের ছালের নির্যাস রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে, যা উচ্চ রক্তচাপ (হাইপারটেনশন) নিয়ন্ত্রণে উপকারী। কাঁচা অর্জুন গাছের ছালের দুই চামচ রস অথবা এক চামচ অর্জুন গাছের ছালের গুড়া এক কাপ গরম দুধের সাথে মিশিয়ে পান করতে হবে। তাহলে এর ভালো উপকার পাওয়া যাবে।

কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ: অর্জুন গাছের নির্যাস কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সহায়ক। এটি বিশেষভাবে এলডিএল (LDL) বা খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।

অ্যান্টি-অ্যাজমা প্রভাব: অর্জুন গাছ হাঁপানি এবং শ্বাসকষ্টের উপসর্গ লাঘবে সহায়ক। এটি শ্বাসনালীকে প্রশস্ত করে এবং শ্বাস নেওয়া সহজ করে।

অর্জুন গাছের ছালের রস দুই চামচ, এক চামচ তুলসী পাতার রস, এক চামচ খাঁটি মধু এক হচ্ছে মিশিয়ে প্রতিদিন সকালবেলা সেবন করতে হবে।

কিডনি সুরক্ষা: অর্জুন গাছের নির্যাস কিডনির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতে এবং কিডনি সমস্যা প্রতিরোধে সহায়ক। অর্জুন গাছের বাকলের রস দৈনিক দুই চামচ করে পান করলে কিডনির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

মূত্রনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধ: অর্জুন গাছের নির্যাস মূত্রনালীর সংক্রমণ (UTI) প্রতিরোধে কার্যকর, কারণ এতে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যা সংক্রামককারী জীবাণু থেকে মূত্রনালীকে রক্ষা করে। 

ত্বকের সমস্যা নিরাময়: অর্জুন গাছের বাকল ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা, যেমন একজিমা, ফোস্কা, এবং ত্বকের প্রদাহের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এমন কি এটা ব্রণ হওয়া থেকেও চেহারাকে রক্ষা করে।

এক চামচ অর্জুন গাছের বাকল চূর্ণ এবং এক চামচ মধু একত্রে মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে চেহারায় মেখে ১০ থেকে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। এরপর ভালোভাবে চেহারা ধুয়ে ফেলতে হবে।

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য: অর্জুন গাছের বাকলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা শরীরকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করে এবং দীর্ঘমেয়াদী রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। 

হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি: অর্জুন গাছ হাড়ের শক্তি বাড়াতে সহায়ক এবং হাড়ের দুর্বলতা কমাতে সাহায্য করতে পারে। দুই চামচ অর্জুন গাছের বাকোলের চূর্ণ খাঁটি ঘি এর সাথে মিশিয়ে সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন সেবন করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

ক্ষয় কাশি রোধ:  ক্ষয় কাশি হলে ফুসফুসের দারুণ ক্ষতি হয়। এটা প্রতিরোধ করতে হলে অর্জুন গাছের বাকল চূর্ণ ও বাসক পাতার রস একত্রে মিশিয়ে প্রতিদিন সেবন করতে হবে। আশা করি খুব দ্রুত ভালো ফলাফল পেয়ে যাবেন। 

ফোঁড়া রোধ:  শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফোঁড়া হয়েও থাকে। এটা স্বাভাবিক একটা বিষয়। তবে এটার যন্ত্রণা কম করতে এবং দ্রুত সারিয়ে তুলতে অর্জুন গাছের পাতা খুবই উপকার করে। অর্জুন গাছের পাতা বেটে এটার প্রলেপ দিতে হবে ফোঁড়ার উপর। তাহলে ব্যথা কমে যাবে এবং ফোঁড়া পেকে শেষ হয়ে যাবে।

জেনে নিন: ডাবের পানির উপকারিতা ও অপকারিতা 

হাড় মচকে গেলে:  খেলতে গিয়ে অথবা সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে অনেক সময় পা মচকে যায়। মূলত এটা হাড্ডি ভেঙ্গে যায় না কিন্তু মাংসপেশীতে খুবই গুরুত্ব আঘাত লাগে। এই সময় প্রচুর ব্যথা করে। অর্জুন গাছের ছাল ও রসুন বাটা একত্রে মিশিয়ে এটার প্রলেপ দিলে ব্যথা অনেকটা কমে যায়। 

ঘা বা ক্ষত স্থানে অর্জুন:  কোথাও ঘা হলে অথবা ক্ষত হলে সেখানে অর্জুন গাছের রস দিলে দ্রুত ঘা বা ক্ষত শুকিয়ে যায়। কেননা অর্জুন গাছের বাকোলের রসে থাকে এন্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান। যেটা জীবাণুন নাশক। ফলে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

অর্জুন গাছের এসব উপকারিতা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় এর ব্যবহারকে অত্যন্ত জনপ্রিয় করেছে। তবে, সঠিক মাত্রায় এবং উপযুক্ত পরামর্শ অনুযায়ী এটি ব্যবহার করা উচিত।

অর্জুন গাছের অপকারিতা

অর্জুন গাছের অনেক উপকারিতা থাকলেও কিছু অপকারিতাও আছে। বিশেষ করে যদি সঠিকভাবে বা মাত্রাতিরিক্তভাবে ব্যবহৃত হয়। নিচে কিছু সম্ভাব্য অপকারিতা বর্ণনা করা হলো:

রক্তচাপের অতিরিক্ত পতন: অর্জুন গাছের নির্যাস রক্তচাপ কমাতে সহায়ক হলেও, যারা আগে থেকেই নিম্ন রক্তচাপ (হাইপোটেনশন) সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য এটি বিপজ্জনক হতে পারে। এটি রক্তচাপ খুব বেশি কমিয়ে দিতে পারে, যা মাথা ঘোরা, দুর্বলতা, এবং অজ্ঞান হওয়ার কারণ হতে পারে।

ওষুধের সাথে প্রতিক্রিয়া: অর্জুন গাছের নির্যাস কিছু নির্দিষ্ট ওষুধের সাথে প্রতিক্রিয়া করতে পারে। বিশেষ করে, যদি কেউ রক্তচাপের ওষুধ, হৃদরোগের ওষুধ, বা অ্যান্টিকোয়াগুলান্ট ওষুধ গ্রহণ করেন, তবে অর্জুন ব্যবহার করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

 গর্ভাবস্থা ও স্তন্যদান: গর্ভবতী মহিলা এবং যারা সন্তানকে স্তন্যদান করছেন তাদের জন্য অর্জুন গাছের নির্যাস ব্যবহারে সতর্ক থাকা উচিত। যদিও এই বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা নেই, তবে নিরাপত্তার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয় যে গর্ভাবস্থা এবং স্তন্যদানকালে অর্জুন গাছের নির্যাস এড়িয়ে চলা উচিত।

হজম সমস্যা: কিছু ক্ষেত্রে, অর্জুন গাছের নির্যাস পেটের সমস্যা, যেমন পেটে ব্যথা, গ্যাস, বা ডায়রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এটি বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেখা যায়।

অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া: কিছু মানুষ অর্জুন গাছের নির্যাসে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া অনুভব করতে পারেন। এটি ত্বকের ফুসকুড়ি, চুলকানি, বা শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গের কারণ হতে পারে।

লিভারের সমস্যা: যদিও বিরল, দীর্ঘমেয়াদী বা অতিরিক্ত অর্জুন গাছের নির্যাস ব্যবহারের ফলে লিভারের ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে, যা লিভারের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করতে পারে।

এই কারণে, অর্জুন গাছের নির্যাস ব্যবহারের আগে একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যদি কোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগ বা ঔষধ গ্রহণ চলমান হয়ে থাকে।

উপসংহার 

বাংলাদেশে ভেষজ উদ্ভিদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কেননা মানুষজন এখন অধিকারে গাছ কর্তন করে ঘরবাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে। যাও দু একটা গাছ লাগাচ্ছে সেগুলোও কাঠ উৎপাদন করার জন্য। মানুষজন বর্তমানে অসুস্থ হলেই এ্যালোপ্যাথিক ঔষধ গ্রহণের দিকে ঝুকে যাচ্ছে। এর দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার মানুষের শরীরে বিভিন্ন রকমের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। তাই আমাদের উচিত ভেষজ উদ্ভিদ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা এবং এগুলোর ব্যবহার করা। 

পড়ে নিন: কাঁচা পেঁপের উপকারিতা ও অপকারিতা

বলা হয়ে থাকে, উপকারী গাছের ছাল থাকে না। অর্জুন গাছের ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছে। প্রায় সময় দেখা যায় অর্জুন গাছের ছাল মানুষজন উঠিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু এখন এটার ব্যবহার দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। আমাদের উচিত এই সকল ভেষজ উদ্ভিদের প্রচার-প্রচারণা করা। যাতে করে মানুষজন জানতে পারে প্রাকৃতিক উপায়েও রোগ প্রতিরোধ করা যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top