মেথির উপকারিতা ও অপকারিতা | মেথি একটি বহুল ব্যবহৃত মসলা এবং ঔষধি উদ্ভিদ। মেথি পাতার পাশাপাশি মেথি বীজও খাদ্যে ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে বিশেষ করে চুলের যত্নে বহুকাল আগে থেকেই মেথির ব্যবহার দেখা গেলেও, বর্তমানে এর ব্যবহারিক বিস্তৃতি বৃদ্ধি পেয়ে শরীরের বিভিন্ন উপকারে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
তাই ব্যবহারের আগেই মেথির উপকারিতা ও অপকারিতা এবং এর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জেনে নিন এই লেখা থেকে।
মেথির পুষ্টি উপাদান
প্রতি ১০০ গ্রাম মেথিতে যে সকল পুষ্টি অবদান থাকে এবং যেই পরিমাণে থাকে, তার তালিকা নিচে তুলে ধরা হলো।
- ক্যালোরি: ৩২৩ ক্যালোরি
- প্রোটিন: ২৩ গ্রাম
- মোট ফ্যাট: ৬.৪১ গ্রাম
- স্যাচুরেটেড ফ্যাট: ১.৫৩ গ্রাম
- মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট: ১.৭৩ গ্রাম
- পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট: ৩.০ গ্রাম
- কার্বোহাইড্রেট: ৫৮.৩৫ গ্রাম
- ফাইবার: ২৪.৬ গ্রাম
- চিনি: ০ গ্রাম
- ক্যালসিয়াম: ১৭৬ মিগ্রা
- আয়রন: ৩৩.৫৩ মিগ্রা
- ম্যাগনেসিয়াম: ১৯১ মিগ্রা
- ফসফরাস: ২৯৬ মিগ্রা
- পটাসিয়াম: ৭৭০ মিগ্রা
- সোডিয়াম: ৬৭ মিগ্রা
- জিঙ্ক: ২.৫ মিগ্রা
- ভিটামিন এ: ৬ ইউ
- ভিটামিন সি: ৩.০ মিগ্রা
- ভিটামিন বি৬: ০.৬ মিগ্রা
- ফোলেট: ৫৭ মাইক্রোগ্রাম
মেথির উপকারিতা

একটি বহুমুখী ভেষজ উপাদান। এটি দীর্ঘদিন যাবত এশিয়া, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মেথির পাতা এবং বীজ উভয়ই রান্নায় এবং চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এটি তার ঔষধি গুণাগুণের জন্য ব্যাপকভাবে পরিচিত। নিচে মেথির উপকারিতা গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি তুলে ধরা হলো:
(১) রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ
মেথি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সহায়তা করে। মেথির বীজে গ্যালাক্টোম্যানান নামক একটি দ্রবণীয় আঁশ থাকে, যা শর্করার শোষণ ধীরগতির করে দেয়। এছাড়া এটি ইনসুলিন নিঃসরণ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে, ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
আরও পড়ুন: কাঠ বাদাম এর উপকারিতা ও অপকারিতা
(২) হজমশক্তির উন্নয়ন
মেথির বীজ পেটের সমস্যার জন্যও উপকারী। এটি পেট ফাঁপা, গ্যাস, বদহজম এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়তা করে। মেথির আঁশ হজম প্রক্রিয়া দ্রুতগতির করে এবং অন্ত্রের অভ্যন্তরীণ অবস্থা উন্নত করে। ফলে হজম সংক্রান্ত সমস্যা কমে যায়।
(৩) রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ
মেথি উচ্চ কোলেস্টেরল কমাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, মেথি কোলেস্টেরলের মাত্রা, বিশেষ করে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমায়। এতে করে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
(৪) স্তনের দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করে
মেথি স্তনের দুধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক একটি ভেষজ উপাদান। অনেক নার্সিং মা মেথি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করেন দুধ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য। মেথিতে থাকা প্রোল্যাক্টিন হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করে, যা স্তনের দুধ উৎপাদন বাড়ায়।
(৫) ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে
মেথি ত্বকের জন্যও উপকারী। এটি ব্রণ, কালো দাগ এবং ত্বকের অন্যান্য সমস্যা সমাধানে সহায়ক। মেথির পেস্ট ত্বকে লাগালে ত্বক মসৃণ ও উজ্জ্বল হয়।
(৬) চুলের যত্নে কার্যকরী
মেথি চুলের যত্নেও ব্যবহৃত হয়। মেথির পেস্ট চুলের গোড়ায় লাগালে চুলের গোঁড়া মজবুত হয় এবং চুল পড়া কমে যায়। এছাড়া এটি খুশকির সমস্যাও সমাধান করে।
(৭) দেহের হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখে
মেথি মহিলাদের হরমোন ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক। এটি মেনোপজের লক্ষণ যেমন: হট ফ্ল্যাশ এবং মুড সুইং কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া এটি পিরিয়ডের ব্যথা কমাতেও কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
জেনে নিন: মধু খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
সমগ্র পৃথিবীতে প্রাচীনকাল থেকেই মেথি তার বহুমুখী ব্যবহার ও উপকারিতার জন্য পরিচিত। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় মেথি অন্তর্ভুক্ত করে এর অগণিত উপকারিতা গ্রহণ করা সম্ভব। তবে মেথি ব্যবহার করার আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
পুরুষের জন্য মেথির উপকারিতা
মেথি পুরুষদের জন্য অনেক বিশেষ বিশেষ উপকারিতা বহন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
- টেস্টোস্টেরন বৃদ্ধি: মেথি বীজে এমন কিছু যৌগ রয়েছে যা পুরুষদের টেস্টোস্টেরন স্তর বৃদ্ধি করতে সহায়ক। গবেষণায় দেখা গেছে যে, মেথি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের ফলে টেস্টোস্টেরন স্তরে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে, যা পুরুষদের যৌন স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়ক হয়।
- সরাসরি যৌন স্বাস্থ্যের উন্নতি: মেথি যৌন স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে একটি কার্যকরী ভেষজ উপাদান। এটি যৌন উদ্দীপনা বৃদ্ধি করতে এবং যৌন কর্মক্ষমতা উন্নত বাড়াতে সহায়ক। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, মেথি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের ফলে যৌন উদ্দীপনা ও যৌনতৃপ্তি বৃদ্ধি পেয়েছে।
- পেশী ও শক্তি বৃদ্ধি: মেথি পেশী বৃদ্ধিতেও বিশেষ উপকারিতা বহন করে। এটি দেহে প্রোটিনের শোষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, যা পেশী গঠনে সহায়ক। নিয়মিত মেথি গ্রহণের ফলে পেশী শক্তি এবং পেশির আকার বৃদ্ধি পায়।
এছাড়াও পুরুষের জন্য মেথির অন্যান্য উপকারিতা গুলো হলো:
- মেথি হজম শক্তি বৃদ্ধি করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। পাশাপাশি এটি পেটের গ্যাস ও ফাঁপাভাব কমাতে সাহায্য করে।
- কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে।
- মেথিতে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণাবলী প্রদাহ কমাতে সহায়ক। এটি পুরুষের দেহে বিভিন্ন প্রদাহজনিত রোগ যেমন আর্থ্রাইটিস এবং হজম প্রক্রিয়ার প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে।
- ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে ইত্যাদি।
নিয়মিত মেথি ব্যবহারের মাধ্যমে পুরুষরা এসকল উপকারিতা পেতে পারে।
মেয়েদের জন্য মেথির উপকারিতা
মেথি নারীদের স্বাস্থ্যের জন্য বিভিন্নভাবে উপকারী। নিচে মেয়েদের জন্য মেথির উপকারিতা গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি তুলে ধরা হলো:
- হরমোন মাত্রা নিয়ন্ত্রণ: মেথি নারীদেহের হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে। এটি মেনোপজ পরবর্তী হরমোনের পরিবর্তন এবং পিরিয়ডের সময় হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
- স্তন্য উৎপাদন বৃদ্ধি: মেথি স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য খুবই উপকারী। এটি স্তন্যের দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়। গ্যালাক্টাগগ হিসেবে মেথি প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত।
- মেনোপজের উপসর্গ কমায়: মেথি মেনোপজের সময় বিভিন্ন উপসর্গ যেমন গরম ভাব, মেজাজের পরিবর্তন, অতিরিক্ত ঘেমে যাওয়া কমাতে সহায়তা করে। এতে থাকা ফাইটোইস্ট্রোজেন উপাদানটি হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে মেনোপজের উপসর্গ কমায়।
এছাড়াও নারীদের ত্বকের স্বাস্থ্য উন্নত করতে, চুলের যত্নে, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে, হজমশক্তি বৃদ্ধিতে এবং দেহের বিভিন্ন জয়েন্টের ব্যথা কমাতে মেথি কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
আরও পড়ুন: সজনে পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা
মেথি খাওয়ার নিয়ম
মেথি বিভিন্ন রান্নায় মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া মেথির চা, মেথি বীজের গুঁড়া, এবং মেথির তেল বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতার জন্য ব্যবহৃত হয়।
খাদ্যতালিকায় পরিমিত পরিমাণে মেথি অন্তর্ভুক্ত করে এর পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা গ্রহণ করা যায়। তবে অতিরিক্ত মেথি খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। যা নাহলে এতে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।
চুল লম্বা করতে মেথির ব্যবহার
চুল লম্বা করার জন্য মেথি খুবই কার্যকরী একটি প্রাকৃতিক উপাদান। খাদ্য হিসেবে মেথির ব্যবহার সম্পর্কে আমরা খুব বেশি না জানলেও, সাধারণত চুলের যত্নে মেথির ব্যবহার সম্পর্কে প্রায় সকলেই জানে।
মেথির পেস্ট তৈরি করে মেহেদির সাথে মিশিয়ে সম্পূর্ণ মাথার চুলে ও স্কাল্পে ব্যবহার করতে পারেন। এভাবে চুলের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়, চুলের গোড়া মজবুত হয়, চুল তুলনামূলকভাবে লম্বা হয় এবং চুলের ঘনত্বও বৃদ্ধি পায়।
মেথির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া | মেথি খাওয়ার অপকারিতা
ছেলে ও মেয়েদের জন্য মেথির অসংখ্য উপকারিতার পাশাপাশি কিছু ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। সাধারণত বিভিন্ন মানুষের দেহ সংবেদনশীল হয়ে থাকে, তাদের জন্য মেথি ক্ষতিকর হতে পারে। এছাড়াও অতিরিক্ত পরিমাণে মেথি গ্রহণ করলে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যা দেখা দেয়। যেমন:
- মেথি গ্যাস, ফুলে যাওয়া, এবং পেটের ব্যথার কারণ হতে পারে। অতিরিক্ত মেথি খাওয়া ডায়রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে।
- রক্তচাপ খুব বেশি কমিয়ে আনতে পারে।
- মেথি রক্তের শর্করার মাত্রা খুব বেশি কমিয়ে ফেলতে পারে।
- কিছু লোকের মেথি থেকে এলার্জি হতে পারে। যার ফলে চামড়ার রেশ, ফুসকুড়ি, অথবা শ্বাসকষ্টও হতে পারে।
- গর্ভবতী মহিলাদের মেথি খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ এটি গর্ভাশয়ের সংকোচন ঘটাতে পারে।
- মেথিতে রক্ত পাতলা করার বৈশিষ্ট্য আছে, যার ফলে এটি অতিরিক্ত মাত্রায় ফেলে রক্তপাতলা হয়ে যাবে।
শেষকথা
উপরোক্ত আর্টিকেল থেকে মেথির উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলেন। যদিও মেথির উপকারিতাই বেশি, তবে মেথি খাওয়ার আগে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত। প্রয়োজনে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।