ছোটবেলায় মরা গাছের গুঁড়ি বা খড়ের গাদায় অথবা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় ছাতার মতো এক ধরনের বস্তু দেখতে পেতাম। যেগুলোকে আমরা ব্যাঙের ছাতা বলে ডাকতাম। আমরা মনে করতাম বৃষ্টি হলে ব্যাঙ এটা নিচে এসে আশ্রয় নেয়। ওই সব কথা ভাবলে এখন হাসি পায়। ব্যাঙের আবার বৃষ্টির ভয়! আসলে এগুলো হচ্ছে মাশরুম (Mushroom) এটা এক ধরনের ছত্রাক।
অনেকে হয়তো বিজ্ঞান বইতে পড়ে থাকবেন মানবদেহ অথবা গাছপালা ছত্রাকের আক্রমণ হয়। হ্যাঁ, ছত্রাক ক্ষুদ্র আকৃতিরও আছে বৃহৎ আকৃতিরও আছে। তবে ছত্রাক একটি উদ্ভিদ। কিন্তু এটা অন্যান্য উদ্ভিদের মতো নয়। গাছ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্য তৈরী করে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য জন্য সূর্যের আলোর প্রয়োজন হয়। তবে মাশরুম বা ছত্রাক সূর্যের আলো ছাড়াই নিজের খাদ্যের ব্যবস্থা করে। মূলত এটা জৈব পদার্থ থেকে পুষ্টি নিয়ে নিজের দেহ বৃদ্ধি করে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাশরুম বেশ জনপ্রিয়। চীন জাপান কোরিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে মাশরুমের বিভিন্ন ধরনের রান্না হয়ে থাকে। এছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকাতেও মাশরুম প্রচুর খাওয়া হয়। বাংলাদেশে একসময় মাশরুম গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া কেউ খেত না অথবা চিনত না। এখন মাশরুম খাওয়ার প্রচলন ঘটেছে। তবে অন্যান্য সবজি যেমন ব্যাপক হারে খাওয়া হয় মাশরুম তেমনটা নয়। মাশরুম এখনো পয়সাওয়ালাদের বিলাসী খাদ্যের তালিকাতেই রয়ে গেছে।
মাশরুমের পুষ্টিমান
আমরা হয়তো অনেকেই জানি না এই ব্যাঙের ছাতা, যাকে মাশরুম বলা হয় এর মধ্যে কী পরিমানে পুষ্টি রয়েছে। ‘মাশরুম এর উপকারিতা’ আর্টিকেলে এর পুষ্টিমান উল্লেখ্য করা হলো। এটা জেনে হয়তো এখন আর মাসরুমকে অবহেলা করবেন না।
আরও পড়ুন: হলুদ উপকারিতা ও অপকারিতা
প্রতি ১০০ গ্রাম মাশরুম এর মধ্যে থাকা পুষ্টিমান—
- শক্তি ১১৩ কিলো জুল
- শর্করা ৪.১ গ্রাম
- স্নেহ পদার্থ ০.১ গ্রাম
- প্রোটিন ২.৫ গ্রাম
- থায়ামিন (বি১) ০.১ মিগ্রা
- রিবোফ্লাভিন (বি২) ০.৫ মিগ্রা
- নায়াসিন (বি৩) ৩.৮ মিগ্রা
- প্যানটোথেনিক
- অ্যাসিড (বি৫) ১.৫ মিগ্রা
- ভিটামিন সি ০ মিগ্রা
- ক্যালসিয়াম ১৮ মিগ্রা
- কপার ০.৫ মিগ্রা
- ফসফরাস ১২০ মিগ্রা
- পটাশিয়াম ৪৪৮ মিগ্রা
- সোডিয়াম ৬ মিগ্রা
- জিংক ১.১ মিগ্রা
মাশরুম এর উপকারিতা
ব্যাঙের ছাতা বলে আমরা যেটাকে তুচ্ছ বা অবহেলা করি, আপনারা হয়তো জানেন না এটা খাওয়া যায় এবং এটার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদান। এই মাশরুম মানব দেহের জন্য অনেক উপকার বয়ে আনে।
মাশরুম পুরো বিশ্বে খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু বাংলাদেশে এটা এখনো ঐরকম ভাবে জনপ্রিয় হতে পারেনি। এটা এখনো ফাস্টফুড তৈরিতে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু উচিত ছিল এটা দিয়ে স্বাস্থ্যকর খাদ্য তৈরি করা। কেননা এটা প্রোটিনের অন্যতম একটি উৎস। এছাড়া এর পুষ্টিগুণ অনন্য।
আরও পড়ুন: আপেল এর উপকারিতা ও অপকারিতা
তাই আমাদের এই ‘মাশরুমের উপকারিতা’ আর্টিকেলে মাশরুমের উপকারিতা বর্ণনা করা হলো।
- মাশরুমে লো ক্যালোরি সম্পন্ন একটি উদ্ভিদ। এর ফলে যারা ওজন কমাতে চায়, তারা এটাকে খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন। কেননা এটা ক্যালোরি কম পুষ্টি বেশি দেবে।
- অনেকে আছেন ভেজিটেরিয়ান। তারা প্রোটিনের জন্য মাশরুম খেতে পারেন। কেননা মাসরুম প্রোটিনের একটি উৎকৃষ্ট উৎস। এটা খেলে পেশী বৃদ্ধি পায়।
- মাশরুমে থাকে পেনিসিলিন নামক এক ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। যা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এজন্য মাশরুম খেতে ছোট বড় সকলকে উৎসাহিত করা উচিত।
- মাশরুমে শর্করার পরিমাণ খুব কম। এর ফলে এটা রক্তে শর্করা অর্থাৎ সুগার লেভেল কম রাখে। মাশরুম ডায়াবেটিস রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের পছন্দের খাবার মাশরুম।
- মাশরুমের মধ্যে আছে এক ধরনের বিশেষ উপাদান— যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে মাশরুম।
- মাশরুমে কোলেস্টেরলের পরিমাণ খুবই নগণ্য। ফলে এটা রক্তে কোনো প্রকার চর্বি জমতে দেয় না। কিন্তু এর মধ্যে থাকা নিউট্রেশন ও পুষ্টি উপাদান রক্তনালী রাখে পরিষ্কার। ফলে হৃদপিণ্ড থাকে সুস্থ।
- গবেষণায় দেখা গেছে যে— ক্যান্সার ও টিউমার প্রতিরোধে মাশরুম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- মাশরুমে আছে ক্যালসিয়াম। যা মানুষের হাড় গঠনে খুবই সহায়তা করে। বিশেষ করে ছোট শিশুদের হাড় নরম থাকে। তাদের জন্য মাশরুম খুবই উপকারী।
- দেহের মধ্যে দূষিত পদার্থ দূর করতে মাশরুম খুবই কার্যকর। এতে করে দেহ থাকে রোগমুক্ত। তাই সপ্তাহে অন্তত দুইবার করে মাশরুম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞগণ।
মাশরুম রান্নার রেসিপি
মাশরুমকে বাংলাদেশের জনপ্রিয় করার জন্য সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে প্রচারণামূলক বিজ্ঞাপন তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এখনো মাশরুম সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক খাদ্য তালিকায় ঠাঁই নিতে পারেনি। মাশরুম এখনো বন্দি হয়ে আছে ফাস্টফুড দোকানগুলোর রসুইঘর। ফাস্টফুড এমনিতেই ক্ষতিকর। সেখানে মাশরুমের ব্যবহার করলে মানুষের স্বাস্থ্যের তেমন একটা উন্নতি হবে না। তাই উচিত হবে মাশরুম দিয়ে স্বাস্থ্যকর খাদ্য তৈরি করা।
কিন্তু আমরা অনেকেই মাশরুম রান্নার সঠিক রেসিপি জানি না। তাই আপনাদের জন্য সহজ এবং স্বাস্থ্যকর পন্থা মাশরুম দিয়ে রান্নার কয়েকটি রেসিপি এখানে উল্লেখ করা হলো।
মাশরুমের সালাদ: মাশরুম দিয়ে একটি স্বাস্থ্যকর সালাদ তৈরি করা যায়। এটা খুবই পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ।
মাশরুমের সালাদ তৈরি করার জন্য প্রয়োজন গাজর, বরবটি, টমেটো, ক্যাপসিকাম, পেঁয়াজ, রসুন।
প্রথমে অল্প পরিমাণ অলিভ অয়েল ফ্রাই প্যানে দিতে হবে। এরপর এটাতে পেঁয়াজ ও রসুন কুচি দিয়ে হালকা ভেজে নিতে হবে। এরপর দিতে হবে মাশরুম কুচি। এগুলো হালকা ভাজা হয়ে গেলে চিকন করে কাটা গাজর, বরবটি, ক্যাপসিকাম, টমেটোগুলো ঢেলে দিতে হবে। এরপর এতে সামান্য পরিমাণ গোলমরিচের গুঁড়া, ধনিয়া গুঁড়া ও পরিমাণ মতো লবণ দিয়ে হালকা ভেজে নিন। এরপর দেখবেন কত সুন্দর ঘ্রান ছড়াচ্ছে। এটা খেলে আপনার কোলেস্টেরলের মাত্রা এত পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে না। এগুলোতে আছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার যা হজম শক্তি বৃদ্ধি করবে এবং এর পুষ্টি সমূহ আপনার দেহ গঠনে সাহায্য করবে।
মাশরুম সুপ: মাশরুম দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সুপ তৈরি করা হয়। তবে এখানে একটি সহজ এবং কম সময়ের মধ্যে তৈরি করা যায় এমন একটি সুপ তৈরির রেসিপি দেওয়া হচ্ছে।
প্রথমে পাত্রে অল্প পরিমাণ তেল দিয়ে সেটাই পেঁয়াজ কুচি, রসুন কুচি, সামান্য আদা কুচি ভালোভাবে ভেজে নেবেন। এরপর এতে একটি গাজর কুচি, মাশরুম কুচি, ক্যাপসিকাম কুচি দিয়ে হালকা ভেজে নেবেন। ভাজা হয়ে গেলে এতে পরিমাণ মতো পানি দেবেন। মসলা হিসেবে গোলমরিচের গুঁড়া, ধনিয়া গুঁড়া, অরিগানো, দিয়ে জ্বাল দিতে থাকবেন। যদি আপনি এখানে চিকেনের স্বাদ পেতে চান তাহলে কয়েক টুকরো মুরগির মাংস দিয়ে দিতে পারেন। ভালোভাবে সিদ্ধ হলে একটি ছোট পাত্রে আধা কাপ পানি নিয়ে ওর সাথে দুই চামচ কর্নফ্লাওয়ার গুলিয়ে সুপের মধ্যে ঢেলে দিতে হবে। এতে করে খুব হবে ঘন। এরপর আপনার ইচ্ছানুযায়ী জ্বাল দিয়ে ঘন করে নামিয়ে ফেলবেন।
জেনে নিন: তালমাখনা উপকারিতা ও অপকারিতা
পরিবেশনয়ের সময় সামান্য ধনিয়া পাতা কুচি ও কয়েক ফোটা লেবুর রস ব্যবহার করতে পারেন। এতে করে এর স্বাদ আরো বৃদ্ধি পাবে।
মাশরুমের দেশীয় স্টাইলে তরকারি: বিদেশে নানান ভাবে মাশরুমের তরকারি তৈরি করা হয়। তবে দেশীয় পন্থায় আপনি খুব সহজেই মাশরুমের তরকারি তৈরি করতে পারেন।
প্রথমে তেলে আদা বাটা, পেঁয়াজ বাটা, রসুন বাটা, মরিচ ও হলুদের গুঁড়া, ধনিয়া গুঁড়া দিয়ে ভালোভাবে কষিয়ে নেবেন। মাঝে মাঝে কয়েক চামচ পানি দিয়ে নেবেন নচেৎ মশলা পুড়ে যাবে। এরপর এতে আপনার পছন্দের মাশরুম দিয়ে আবারো কষাবেন ভালোভাবে। কষানো হয়ে গেলে পরিমাণ মতো পানি দিয়ে আপনি ঝোল তৈরি করে নেবেন। আপনি যদি চান মাশরুমের সাথে অন্যান্য সবজি খেতে তাহলে সেটাও করতে পারেন। মাশরুমের সাথে টমেটো, গাজর, ফুলকপি এগুলো খেতে খুব স্বাদ লাগে।
মাশরুম এর অপকারিতা ও সতর্কতা
মাশরুম একটি ছত্রাক জাতীয় উদ্ভিদ। যাদের অ্যালার্জিজনিত সমস্যা রয়েছে তাদের মাশরুম খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়া কিডনি রোগীদের জন্য মাশরুম খাওয়া উচিত না।
মাশরুম কোনো অবস্থাতেই কাঁচা অথবা অল্প সেদ্ধ করে খাওয়া ঠিক না। এতে করে বিষক্রিয়া হতে পারে।
কোনো মাশরুম সম্পর্কে সঠিকভাবে না জেনে তা আহার করা কখনোই উচিত না। কেননা মাশরুম অনেক প্রজাতির রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু মাশরুমে খুবই বিষাক্ত। এতটাই বিষাক্ত যে এটাই স্পর্শ করলেও মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই যে সকল মাশরুম চাষ করা হয় এবং বহুল প্রচলিত সেগুলোই খাওয়া উচিত।
সবচাইতে ভালো হয় নিজের ঘরে চাষ করে মাশরুম খাওয়া। স্টোররুমে পোর্টেবল মাশরুম বক্স এনে রেখে দিলে, মাঝেমধ্যে পানি স্প্রে করলে বারো থেকে পনের দিনের মধ্যেই খাদ্যোপযোগী মাশরুম তৈরি হয়ে যায়।
উপসংহার
আমাদের দেশ কোনো মরুভূমির দেশ নয়। এখানকার বাতাসে যথেষ্ট পরিমাণে আর্দ্রতা থাকে। বাংলাদেশ মাশরুম উৎপাদনের জন্য একটি উৎকৃষ্ট জায়গা। কিন্তু আমাদের জনগণের ব্যর্থতা হচ্ছে আমরা এই অত্যন্ত দামী একটি ফসল আমাদের দেশে ফলাতে আগ্রহী হচ্ছি না। যদি এটা বাংলাদেশের চাষ হয় তাহলে বিদেশে রপ্তানি করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
এর জন্য প্রয়োজন অনেক বেশি প্রচারণা করা। এটা নিয়ে পেপার-পত্রিকায় লেখালেখি করা। ডিজিটাল মিডিয়ায় এটার পুষ্টিগুণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। মাশরুমকে শুধুমাত্র ফাস্টফুডের দোকানে আবদ্ধ না রেখে সাধারণ মানুষের রান্নাঘরে প্রবেশ করাতে হবে।
মাশরুম চাষ করার জন্য তেমন একটা জমির প্রয়োজন হয় না। স্যাঁতস্যাঁতে, অন্ধকারাচ্ছন্ন, বদ্ধ পরিত্যক্ত ঘরের মধ্যে দারুন ভাবে মাশরুম চাষ করা যায়। এটা চাষের ফলে বেকার যুবকগণ খুব সহজে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবে। দেশের বেকারত্ব দূর হবে। তাই আমাদের উচিত মাশরুম খাওয়া এবং এটার চাষ করতে উদ্যোগী হওয়া।