লাভ বার্ড পাখি পালন পদ্ধতি

লাভ বার্ড পাখি পালন পদ্ধতি | Love Bird

পাখি প্রেমিকদের জন্য অন্যতম পছন্দের একটি পাখি হলো লাভ বার্ড পাখি। অনেকেই ব্যক্তিগত শখের বসে আবার কেউ কেউ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে লাভ বার্ড পাখি পালন করে থাকে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই সঠিক পরিচর্যা না জানলে পাখির নানান ক্ষতি হতে পারে। তাই পালন শুরু করার আগে পাখি ক্রয় থেকে শুরু করে বাচ্চা উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয় জেনে নেওয়া উচিত। 

তাই আপনাদের জন্য এই আর্টিকেলে লাভ বার্ড পাখি পালন পদ্ধতি, পাখির বাসস্থান, খাবার-দাবার, প্রজনন ও ডিম উৎপাদন এবং চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

লাভ বার্ড পাখির পরিচয়

লাভ বার্ড হলো পাখি প্রেমিকদের পছন্দের একটি পাখি। মূলত এটি একটি আগাপোরনিস প্রজাতির পাখি। এটিকে আফ্রিকা অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। তবে বর্তমানে সারা বিশ্বেই লাভ বার্ড খাঁচায় অথবা খামারে পালন করছে অনেক পাখি প্রেমিকরা। এই পাখির আয়ুষ্কাল ১০-১৫ বছর।

এই পাখিটি ১৩-১৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। পাখিটি চতুর ও চঞ্চল হওয়ার কারনে অনেকের কাছেই প্রিয়। এরা কয়েক রকমের কন্ঠে ডাক দিতে পারে। এগুলো কিছুটা ভিতু প্রকৃতির হয়ে থাকে, কোন বিকট শব্দ শুনলেই লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে।

লাভ বার্ড তোতা পাখির প্রজাতির হওয়ার কারনে মানুষের কথা নকল করার ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু পাখিগুলো বাচ্চা থাকা অবস্থায় মা পাখিটি তাদের অন্য প্রকার ডাক সিখা থেকে বিরত রাখে।

আরও পড়ুনঃ লাভজনক কয়েকটি উৎপাদনমুখী ব্যবসায় আইডিয়া। 

লাভ বার্ড পাখির প্রজাতি সমূহ

লাভ বার্ড পাখির অনেক প্রকারভেদ রয়েছে, আর এই প্রজাতির উপর ভিত্তি করে মূলত লাভ বার্ড পাখির দাম নির্ভর করে। বর্তমানে সারাবিশ্বে প্রায় ৯ প্রজাতির লাভ বার্ড পাখি রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই অফ্রিকা অঞ্চলের প্রজাতি। এছাড়াও বর্তমানে নয়টি প্রজাতির বিভিন্ন মিউটেশন একত্র করে অনেক ধরনের লাভ বার্ড পাখি উৎপন্ন করছে পাখি প্রেমিকরা।

আমাদের দেশে যেসকল লাভ বার্ড পাখি বেশি পাওয়া যায়, তার মধ্যে অন্যতম হলো- লটিনো, পিচ ফেসড, গ্রিন ফিসার, ব্লাক মাস্ক, ইয়েলো ফিসার, ব্লু মাস্ক সহ বিভিন্ন প্রকারের অপালিন ইত্যাদি। এছাড়া এই পাখিকে ২টি আলাদা ভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন- রিং লাভ বার্ড এবং নন রিং লাভবার্ড।

রিং লাভ বার্ডের চোখের বর্ডারে গোলাকার রিং দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু নন রিং লাভ বার্ডের চোখের বর্ডারে কোনো রিং দেখতে পাওয়া যায় না। 

লাভ বার্ড পাখি পালন পদ্ধতি

লাভ বার্ড পালন পদ্ধতি - লাভ বার্ড পাখির খাবার কি - লাভ বার্ড পাখির বাসস্থান ও প্রজনন

যারা অল্প পরিসরে পাখি পালন করতে চান তাদের জন্য লার্ভ বার্ড খুবই ভালো আইডিয়া। এই পাখির দাম একটু বেশি হওয়ায় অনেকেই পালন করতে চায়না। তবে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে লালন পালন করলে স্বল্প খরচেই লাভবান হওয়া সম্ভব। 

এই পাখির পরিচর্যার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম খেয়াল করতে হবে ভালো পাখি ক্রয় করার বিষয়টি। বাজার থেকে লাভ বার্ড পাখি ক্রয় করার সময় অবশ্যই সুস্থ্য পাখি দেখে ক্রয় করবেন। নতুন অবস্থায় একজোড়া পাখি দিয়ে শুরু করতে পারেন। অনেকে বাজরিগার পাখিকে লাভ বার্ড বলে চালিয়ে দেয় তাই কেনার সময় যাচাই-বাছাই করে ক্রয় করতে হবে।

আরও পড়ুনঃ সেরা ৫টি লাভজনক আধুনিক ব্যবসা আইডিয়া

এছাড়াও পাখি কেনার সময় নর/ মাদি দেখে কিনতে হবে। পাখির খাঁচা বাসার এমন স্থানে সেট করবেন যেখানের পরিবেশ বাসার অন্য জায়গা থেকে নিরিবিলি থাকে এবং বেশি চলাচল হয় না। নিয়মিত রুটিন করে স্বাস্থ্যকর খাবার দিতে হবে। সকাল, দুপুর, বিকালে আলাদাভাবে খাবার দিতে হবে এবং নজরদারিতে রাখতে হবে। তাছাড়া পাখির জন্য খাবার পানি প্রতিদিন পরিবর্তন করে দিতে হবে। কারন পাখির অধিকাংশ রোগ হয়ে থাকে পানি থেকে।

এই পাখির বাড়তি পরিচর্যা হিসেবে প্রতিমাসে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম ও জিংক এর কোর্স খাওয়াতে পারেন। পাখির খাঁচার ট্রে গুলো সাপ্তাহে ৩/ ৪ দিন পরিষ্কার করে দিতে হবে। অন্যদিকে, ডিম পাড়ার সময় হলে পাখির অবস্থান যেন সবসময় নিরাপদ হয় সেদিকে লক্ষ রাখবেন।

খাঁচার ভিতরে ডিম পাড়ার থলি যেন বেশি বড় না হয় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। রাতের বেলায় পাখির খাঁচা থেকে খাবার পাত্র সরিয়ে রাখতে পারেন। এ সকল বিষয়গুলো মেনে চললেই আপনি সফলতার সাথে লাভ বার্ড পাখি পালন করতে পারবেন বলে আশা করা যায়।

লাভ বার্ড পাখির মেল ফিমেল চেনার উপায়

লাভ বার্ড পাখি লালন পালনের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই পাখির মেল ফিমেল চেনা। এই পাখি সাধারনত ৯ থেকে ১২ মাসের মধ্যেই এডাল্ট হয়ে থাকে। এ সময় লাভ বার্ড পাখিটি ছেলে নাকি মেয়ে, তা ভালোভাবে চেনা যায়। এসময় সহজ একটি পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে আমরা লাভ বার্ড পাখির মেল ও ফিমেল আলাদা করতে পারি। 

প্রথমে পাখিকে আপনার হাতের তালুতে নিতে হবে পিঠের উপর শুইয়ে। তারপর পাখিটিকে ধরে হালকা করে ঝাকুনি দিয়ে আপনি পাখির লেজের দিকে লক্ষ করবেন। যদি লেজটি ইংরেজি ভি (V) অক্ষরের মতো থাকে তাহলে পাখিটি মূলত মাদি বা মেয়ে পাখি। আর যদি পাখির লেজ ছড়িয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে পাখিটি ছেলে পাখি।

লাভ বার্ড পাখির খাঁচা

লাভ বার্ড পাখিকে একটু বড় সাইজের খাঁচা দেওয়া ভালো। এতে করে পাখিরা ভালোভাবে খাঁচায় বিচরন করতে পারে। এক্ষেত্রে লাভ বার্ড পাখির খাঁচার আদর্শ সাইজ হলো ১৮-১৮-২৪ ইঞ্চি খাঁচা৷ তবে এর থেকে বড় সাইজ নিলেও ভালো হবে। 

আরও পড়ুনঃ সাপ্লাই ব্যবসা কী? বাংলাদেশে সাপ্লাই ব্যবসা করার নিয়ম

লাভ বার্ড পাখির খাবার কি?

লাভ বার্ড পাখি যে সকল খাবার খায় সেগুলো হলো: কাউন, চিনা, তিসি, বাজরা, কুসুম ফুলের বিচি, সূর্যমুখী ফুলের বিচি, সরিষা, চিকন ধান ও বিভিন্ন রকমের ফল। বাজারে সিড মিক্সড কিনতে পাওয়া যায়। আপনারা সেগুলোও কিনে খাওয়াতে পারেন। 

আবার আপনি চাইলে আলাদাভাবে উপরের খাবারগুলো কিনেও মিশিয়ে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনার পাখি কোন জিনিস বেশি খায়, সেটি বেশি যুক্ত করতে পারেন। এছাড়াও কচি ঘাসের পাতা, সবুজ সবজি ও বিভিন্ন প্রকারের ফল খেতে দিবেন নিয়ম করে। একটি লাভ বার্ড পাখি দিনে ৪০-৬০ গ্রাম খাবার গ্রহন করে থাকে।

এই পাখিরা প্রচুর পরিমাণে পানি পান করে থাকে। তাই পানির পাত্রে পানি আছে কিনা তা সবসময় খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়াও পাখির খাঁচায় ক্যাটল ফিডবোন রাখতে পারেন এটা ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পুরন করে।

লাভ বার্ড পাখির প্রজনন

পাখি পালনের ক্ষেত্রে এর প্রজনন সম্পর্কে ধারণা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারনত Love Bird পাখির এডাল্ট হতে ৯ থেকে ১২ মাস সময় লাগে। তাই এক বছর বয়স হলে আপনি ছেলে ও মেয়ে পাখি মিল করে জোড়া দিতে পারেন। তবে লার্ভ বার্ড পাখিকে বছরে ২ বারের বেশি ব্রিডিং করা উচিত নয়। কারণ এতে পাখির শরীর খারাপ হতে পারে।

যখন পাখি ব্রিডিং শুরু করবে তার পরপরই খাঁচার ভিতরে ডিম পাড়ার বক্স বা থলি দিতে হবে। লাভ বার্ড পাখির প্রজননের সময় একই প্রজাতির পাখি দিয়ে প্রজনন করাবেন তা না হলে মিউটেশন পরিবর্তন হয়ে যাবে। প্রজননকালে এরা ৪-৬টি কিংবা ৮টি পর্যন্ত ডিম দিয়ে থাকে। ডিম পাড়ার ২০ থেকে ২৫ দিনের মাথায় ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।

এই পাখির বাচ্চাগুলোর বৃদ্ধি বাজরিগারের মতো হয় না। বরং কিছুটা বেশি সময় লাগে। সাধারণত ৪০-৪৫ দিন বয়সে লাভ বার্ডের বাচ্চাগুলো নিজেরা খাবার খেতে পারে। প্রজননের সময় অবশ্যই পাখিগুলোকে নিরাপদে থাকতে দিতে হবে।

আরও পড়ুনঃ ২০২৫ সালে শুরু করার জন্য সেরা কয়েকটি বড় ব্যবসার আইডিয়া

লাভ বার্ড পাখির ডিম পাড়ার লক্ষন  

লাভ বার্ড পাখি ডিম পাড়ার অগে আগে বিভিন্ন খড়কুটাগুলো তাদের লেজে গুজতে লক্ষ করা যায়। দ্বিতীয়ত, ডিম দেওয়ার আগে আগে পাখির পেটের নিচের দিকটা ফুলে যায়। তাছাড়া ফিমেল পাখিটি খুব বেশি পরিমাণে খাবার খাবে।

আবার যখন দেখতে পাবেন পাখি ঘন ঘন মিটিং করছে, তখন থেকে প্রায় ১৫ দিন পর পাখিকে ডিম পাড়তে দেখা যায়। ডিম দেওয়ার আগে বেশি সময় ধরে হাড়ির ভিতরে বসে থাকতে দেখা যাবে। মূলত এগুলোই হল এই পাখি ডিম পাড়ার লক্ষন।

লাভ বার্ড পাখির চিকিৎসা

পাখি পালনের ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই পাখির সাধারণ কিছু চিকিৎসা সম্পর্কে ধারনা রাখতে হবে। লাভ বার্ড পাখির কিছু সাধারণ রোগ হলো ঠান্ডা লাগা, আমাশয়, চোখের ইনফেকশন, পায়ে ঘাঁ হওয়া ইত্যাদি। 

মূলত পাখির বেশিরভাগ রোগই হয় পানি ও খাবার জনিত কারনে। তাই পানির পাত্র প্রতিদিন পরিষ্কার করে পানি দিতে পারেন। এবং বিকালে নিয়মিত খাঁচা থেকে পানির পাত্র সরিয়ে নিবেন। খাবারের পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার করবেন এবং রাতে খাবারের পাত্র বের করে দিবে পারেন। এই পাখির খুব বেশি স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিলে স্থানীয় পশু হাসপাতালে যোগাযোগ করতে পারেন। 

About Sajjad Hossain

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *