লটকনের উপকারিতা ও অপকারিতা 

লটকনের উপকারিতা ও অপকারিতা

লটকন, এটাকে অনেকে বুবি বলে ডাকে। এটা আমাদের অতি পরিচিত একটি ফল। এটা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এবং বিশেষ করে বাংলাদেশে বুনোফল হিসেবেই জন্মাতো। এটাকে আগে মানুষজন ফল হিসেবে গ্রহণ করত না। এটাকে কিছুটা ডুমুর ফলের মতো মনে হয়। এছাড়া এটা জঙ্গলে বেশিরভাগ জন্মে থাকে। তাই সাধারণ মানুষজনের হাতে পৌঁছাতো না। কিন্তু বর্তমানে এর ব্যাপক হারে চাষ হচ্ছে এবং এর চাহিদা অনেক। 

লটকন ফলটি একটি ফাঁপা খোসা দিয়ে আবৃত। এর ভেতরে দুই থেকে চারটি কোয়া থাকে। প্রত্যেকটি কোয়া সাদা রঙ অথবা বেগুনি রঙের হয়ে থাকে। এগুলো খেলে জিব্বা বেগুনি রঙে রঙিন হয়ে যায়। যা শিশুদের কাছে খুবই আমোদের বিষয়। কিন্তু এটা ছেলে বুড়ো সকলেরই প্রিয়।

টক মিষ্টি স্বাদের এই লটকনে আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম,ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, জিঙ্ক, থায়ামিন,ভিটামিন বি, সি ইত্যাদি এবং প্রোটিন ও প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। তাই আজ আমরা জানবো লটকনের উপকারিতা ও অপকারিতা।

লটকনের পুষ্টিগণ

  • শক্তি ৭২ ক্যালরি। 
  • শর্করা ১৮ গ্রাম। 
  • প্রোটিন ০.৬ গ্রাম। 
  • ফ্যাট সর্বোচ্চ ০.৫ গ্রাম। 
  • ভিটামিন সি ৮ মিলিগ্রাম। 
  • এছাড়া ভিটামিন এ সহ অন্যান্য ভিটামিন সামান্য পরিমাণে আছে। 
  • পটাশিয়াম ৭০ মিলিগ্রাম।
  •  ক্যালসিয়াম ১০ মিলিগ্রাম। 
  • লৌহসহ অন্যান্য খনিজ উপাদান সামান্য পরিমাণে আছে।

লটকন সম্পর্কে মজার তথ্য 

একটা সময় পর্যন্ত লটকনকে কেউ ফল হিসাবে স্বীকৃতি দিত না। কেননা এটা বনে জঙ্গলে জন্মে থাকে। লোকেরা ভাবতো এগুলো সব বানরের খাবার। কিন্তু ধীরে ধীরে এটা স্বাদ বাঙ্গালীদের মুখে লেগে যায়। এবং এটা ফলের তালিকায় স্থান পায়। 

আরও পড়ুন: পেয়ারার উপকারিতা ও অপকারিতা

এমনকি পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ দুই বঙ্গেই রথযাত্রার সাথে লটকন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। রথযাত্রার দিন এবং উল্টো রথের দিন বিভিন্ন ফলের সাথে এই লটকন বিতরণ করা হয়। লটকন ছিটিয়ে দেওয়া হয়।

এটা মূলত পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের রীতি। কিন্তু ১৯৪৭ দেশভাগ ও ১৯৭১ সালে বাঙালি স্বাধীনতা যুদ্ধে সময় পূর্ববঙ্গের অনেক হিন্দু পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অংশে চলে যায়। ফলে পূর্ববঙ্গের সেই রীতিও পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ভাবেই ভারতের বাঙালি মূলত পূর্ববঙ্গীয় অধ্যুষিত অঞ্চলে লটকনের প্রভাব আছে। এখনো বাংলাদেশের ধামরাই ও টাঙ্গাইলের রথে লটকনের প্রচলন আছে। 

লটকন চাষ

এ বুনো ফলটি চাষ করার জন্য তেমন একটা ঝামেলা পোহাতে হয় না। এটা ছায়ার মধ্যে আরও ভালো জন্মে। তাই লটকন গাছ আম অথবা কাঁঠাল বাগানের মধ্যে চাষ করলে ভালো হয়। 

এটা স্বাভাবিক গাছ লাগানোর মতো করে রোপন করতে হবে। তবে রোপন করার আগে কিছু জৈব সার প্রয়োগ করলে ভালো হয়। বীজ থেকে গাছ উৎপাদন করতে সময় অনেক বেশি লাগে। তাই এটা কলম চারা ব্যবহার করা উচিত। 

এটা বছর খানেকের মধ্যেই ফল দেওয়া শুরু করে। এটাতে তেমন একটা সার অথবা কীটনাশক প্রয়োগ করার প্রয়োজন পড়ে না। তবে যখন ফল গাছে ধরবে তখন যাতে ফলে কোনো প্রকার রোদ না লাগে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।

জেনে নিন: ঢেঁড়সের উপকারিতা ও অপকারিতা

মাঝেমধ্যে কিছু কীটপতঙ্গের উপদ্রব দেখা দিতে পারে। যেগুলো গাছের পাতা খেয়ে নষ্ট করে ফেলে। এগুলোর জন্য কৃষি অধিদপ্তর থেকে পরামর্শক্রমে কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। 

এছাড়া এই ফল বন্য পাখিদের প্রিয় একটি ফল। তাই এ সকল পাখির দ্বারা কিছু ক্ষতি হতে পারে। এ সকল বিবেচনা করে এটা চাষ করা উচিত। 

যেহেতু এটাতে তেমন একটা খরচ নেই তাই এর যতটুকু বিক্রি করা যায় ততটুকুই লাভ। পরিত্যক্ত জমি অথবা গ্রামীণ জঙ্গলে এটার চাষ করলে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আয় হতে পারে।

লটকনের উপকারিতা

লটকনের উপকারিতা
  • লটকনে জলীয় অংশ বেশি থাকে। তাই এটা খেলে শরীর হাইড্রেটেড থাকে।বর্ষা কালের স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ার কারণে ত্বকে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ দেখা দেয়। নিয়মিত লটকন খেলে চর্মরোগ থেকে দূরে থাকা যায়।
  • লটকন ত্বকের রুক্ষতা ও ত্বক ফেটে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।
  • বর্ষায় ফ্লু, জ্বর, সর্দি, কাশির সংক্রমণ হলে— নিয়মিত লটকন খেলে এসব সংক্রমণজনিত রোগ প্রতিরোধ হয়ে থাক।
  • লটকনে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। এই ভিটামিন সি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শরীরের ঘা দ্রুত শুকাতে সহায়তা করে। এছাড়া ভিটামিন সি ত্বক, দাঁত ও হাড় সুস্থ রাখে। রোজ তিনটি থেকে চারটি লটকন খেলে দেহের দৈনিক ভিটামিন সির চাহিদা পূরণ হয়।
  •  এটা খেলে স্কার্ভি রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
  • লটকনে থাকা ভিটামিন বি বেরিবেরি রোগ থেকে বাঁচতে সাহায্য করে এছাড়া ত্বক ও চুল সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
  • রক্তের জন্য বিশেষ উপকারি উপাদান লৌহ আছে লটকনে। এটি হিমোগ্লোবিন বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
  •  এতে আছে পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের মতো উপকারি খনিজ উপাদান— যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখত সাহায্য করে।
  • লটকনে থাকা অ্যামাইনো এসিড ও এনজাইম দেহ গঠন, কোষের ক্ষয়পূরণ, ও কোষকলার সুস্থতায় সাহায্য করে।
  • লটকন খেলে বমি ভাব দূর হয়ে যায় এবং এটি মানসিক অবসাদ দূর করতে সাহায্য করে।
  • ভিটামিন ও খনিজ উপাদানে ভরপুর এ ফলটি রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ফলে ডায়াবেটিস রোগীগণও এই ফলটি খেতে পারে অনায়াসেই। এতে চিনের পরিমাণ অনেক কম। তবে কম খাওয়াটাই উত্তম।টক-মিষ্টি স্বাদের লটকনটি খেলে মুখের রুচি বৃদ্ধি পায়।

লটকনের অপকারিতা 

  • সাধারণত লটকন মানুষজন বিচি সহকারে খেয়ে ফেলে। ডিসি সহকারে খেলে তেমন ক্ষতি নেই কিন্তু বেশি খেলে ক্ষুধামন্দা দেখা দিতে পারে।
  • এছাড়া যাদের কিডনি রোগ রয়েছে তাদের জন্য এটা খাওয়া ক্ষতিকর হতে পারে। কেননা এটাতে প্রচুর পরিমাণ পটাশিয়াম রয়েছে। তাই কিডনি রোগীদের এটা খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

দেশীয় অর্থনীতিতে লটকন 

দেশীয় ফল লটকন বাংলার বন জঙ্গলেই বেশি জন্মে থাকত। এটা যে একটি ফল তা অনেকে মানতেই চাইতো না। এই ফল কিছুটা ডুমুর ফলের মতো দেখতে। কিন্তু এটা ডুমুর ফল নয়, এমনকি এটার ভেতরের অংশ ডুমুর ফল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। 

ধীরে ধীরে কালের পরিক্রমায় এই ফলটি মানুষের প্রিয় ফলগুলোর তালিকায় স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি উৎসব পার্বণে এই ফলের ব্যবহার দেখা যায়। ধীরে ধীরে চাহিদা বাড়ার কারণে এটার চাষ করার প্রবণতা বেড়েছে। 

আপনি পড়তে পারেন: জামরুল খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা

বাংলাদেশের নরসিংদী জেলায় বিপুল পরিমাণে লটকন চাষ হয়। যা সেখানকার অর্থনৈতিক পরিবর্তন এবং বিপ্লব ঘটিয়েছে। লটকন আজকে দেশের জঙ্গল পেরিয়ে দেশের বাজার দখল করে বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছে এবং বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশে আনছে। 

এটা সম্ভব হয়েছে বাঙালির একান্ত পরিশ্রমের ফলে। অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকা লোক চক্ষুর আড়ালে জন্মানো লটকন ফল আজ অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে। 

নরসিংদীর কৃষকগণ লটকন চাষ করে ব্যাপক লাভের মুখ দেখেছে। কেননা এটা চাষ করতে তেমন খরচ হয় না। এমন কি এটা চাষ করতে তেমন জায়গারও প্রয়োজন হয় না। বরঞ্চ এটা আম বা কাঁঠাল বাগানের মাঝখানে চাষ করলে ভালো হয়। অর্থাৎ একই বাগানে অন্য একটি ফল চাষ করে দ্বিগুণ লাভ। 

লটকন গাছ আধো ছায়া আধো রোদে ভালো ফলন দেয়। তাই এটি আম বা কাঁঠাল বাগানে চাষ করলে ভালো হয়। ফলে চাষিগণ একই বাগানে দুইটি ফলের চাষ করে পূর্বের তুলনায় বেশি করে।

এই গাছের তেমন একটা যত্নও করতে হয় না। এটার কোন ফুল অথবা কুঁড়ি হয় না। তাই ঝরে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। এটায় সরাসরি গাছের কাণ্ড থেকে ফল হয়। তাই ব্যাপক ফলনে লাভ বেশি। 

আরও পড়ুন: ডালিম খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা

প্রতিবছর ইউরোপের দেশগুলোতে লটকন রপ্তানি করে কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে বাংলাদেশের। জনসচেতনতা আরও বৃদ্ধি পেলে আরও বেশি পরিমাণে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। 

বর্তমানে বাংলাদেশে এটা ৭০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি বিক্রি হয়। বিদেশে এটার দাম আরো বেশি। এটা খেতে সুস্বাদু হওয়ায় এর চাহিদাও বেশি। 

পরিত্যক্ত বাগান অথবা গ্রামীণ জঙ্গলে লটকন গাছ লাগিয়ে এর থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব। 

About Juyel Ahmed Liton

সুপ্রিয় “প্রোবাংলা” কমিউনিটি, ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি আকর্ষণ ছিলো এবং হয়তো সেই আকর্ষণটা অন্য দশ জনের থেকে একটু বেশি। ওয়েবসাইট, টাইপিং, আর্টিকেল লেখাসহ টেকনোলজি সবই আমার প্রিয়। জীবনে টেকনোলজি আমাকে যতটা ইম্প্রেস করেছে ততোটা অন্যকিছু কখনো করতে পারেনি। আর এই প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ থেকেই লেখালেখির শুরু.....

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *