বর্তমানে বাংলাদেশে উৎপাদনমুখী ব্যবসা শুরু করতে চাইলে অন্যতম লাভজনক একটি ব্যবসা হলো চামড়ার ব্যাগ উৎপাদন ব্যবসা। যদিও এই ব্যবসাতে মূলধন কিছুটা বেশি প্রয়োজন হবে। তবে এই ব্যবসাতে অন্যান্য ব্যবসার তুলনায় আয়ের পরিমাণও অনেকটাই বেশি।
তাই উদ্যোক্তা ভাইদের জন্য এই আর্টিকেলে চামড়ার ব্যাগ উৎপাদন ব্যবসা, কি কি প্রয়োজন, কত টাকা মূলধন লাগবে, কিভাবে কাঁচামালের পণ্য সংগ্রহ করতে হবে, পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া, বাজারজাতকরণ ও আয়-ব্যয়ের একটি আনুমানিক হিসাব তুলে ধরা হলো।
বাংলাদেশে চামড়ার ব্যাগের ব্যবসায়িক চাহিদা
বাংলাদেশে চামড়ার ব্যাগের ক্রমবর্ধমান ব্যবসায়িক চাহিদা রয়েছে। দেশের ফ্যাশন এবং লাইফস্টাইল পরিবর্তনের সাথে সাথে চামড়ার ব্যাগের প্রতিও আগ্রহ বাড়ছে। বিশেষ করে উচ্চমানের এবং স্টাইলিশ ডিজাইনগুলোর প্রতি বর্তমানের তরুণ সমাজের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণির গ্রাহকরা গুণগত মানের চামড়ার ব্যাগের জন্য সবচেয়ে বেশি আগ্রহী।
পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক বাজারেও বাংলাদেশের চামড়ার পণ্যের বিশেষ চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশী চামড়ার পণ্যের জন্য বৈশ্বিক বাজারে চাহিদা থাকায় দেশের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানদের জন্য ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এছাড়াও হাতে তৈরি বা কাস্টমাইজড ব্যাগের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকায়, এই ব্যবসার বিকাশের সম্ভাবনাও রয়েছে।
আরও পড়ুনঃ লাভজনক কয়েকটি উৎপাদনমুখী ব্যবসায় আইডিয়া।
চামড়ার ব্যাগ উৎপাদনের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা
চামড়ার ব্যাগ উৎপাদন ব্যবসা শুরু করার আগে একটি সুসংগঠিত ব্যবসায়িক পরিকল্পনা করে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পূর্বপরিকল্পনা ব্যতীত একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন। তাই যেকোন ব্যবসায় শুরু করতে চান না কেন, প্রথমে সেই ব্যবসা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা অর্জন করে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে নেওয়া উচিত।
ব্যবসায়িক পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে লক্ষ্য নির্ধারণ করা, গুণগত মানসম্পন্ন ব্যাগ উৎপাদন প্রক্রিয়া আয়ত্তকরন এবং ডিজাইন করা বা কাস্টমাইজড পণ্য তৈরি করার পদ্ধতি জানতে হবে। এরপর বাজার গবেষণা করাও জরুরী, যাতে করে আপনি জানতে পারবেন কোন ধরনের কাস্টমারদেরকে টার্গেট করে পণ্য তৈরি করা হবে। স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক বাজার, অথবা কোন শ্রেণির গ্রাহক টার্গেট করা হবে, সে সম্পর্কে লক্ষ্য রেখেই পণ্যের মান ও ডিজাইন বজায় রাখতে হবে।
তারপর পণ্য উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন এবং যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করতে হবে। এক্ষেত্রে আপনার সেলাই মেশিন, কাটিং টুলস এবং চামড়ার প্রক্রিয়াজাতকরণের যন্ত্র ইত্যাদি প্রয়োজন হবে। তারপর আপনার উৎপাদন ব্যবসার জন্য কাঁচামাল কোথা থেকে সংগ্রহ করবেন, তার উৎস সরবরাহকারী আগে থেকেই নির্ধারণ করে নিতে হবে।
তদুপরি, ব্যবসা পরিচালনার জন্য পণ্য বিক্রয়ের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা, অনলাইন ও অফলাইন মার্কেটিং এবং গ্রাহকদের আকর্ষণ করার জন্য আগে থেকেই ব্যবস্থাগত পরিকল্পনা করে নেওয়া ভালো। এই সম্পূর্ণ পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন নির্ধারণ এবং বাজেটিংয়ের দিকে লক্ষ্য দিতে হবে। তাছাড়া ব্যবসা চলমান হলেও খরচ এবং লাভের একটি সুনির্দিষ্ট হিসাব রাখার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই সচেতন থাকতে হবে।
আরও পড়ুনঃ সাপ্লাই ব্যবসা কী? বাংলাদেশে সাপ্লাই ব্যবসা করার নিয়ম।
চামড়ার ব্যাগ উৎপাদন ব্যবসা শুরু করতে কি কি লাগবে?
চামড়ার ব্যাগ উৎপাদন ব্যবসা শুরু করতে আপনার কিছু মৌলিক উপকরণ এবং সরঞ্জামের প্রয়োজন হবে। প্রথমত, উন্নতমানের চামড়া সংগ্রহ করতে হবে, যা হতে হবে টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী। চামড়া সংগ্রহের জন্য নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে নিতে হবে।
এরপর চামড়া কাটার জন্য সঠিক যন্ত্রপাতি, যেমন কাটিং টুলস, স্কেল, মেজারিং টেপ, এবং সেলাই মেশিন সংগ্রহ করতে হবে। সেলাইয়ের জন্য শক্তিশালী মেশিন ও উচ্চমানের সুতাও প্রয়োজন।
তারপর ব্যাগ তৈরির জন্য ডিজাইন প্রক্রিয়া, গুণগত মান নিশ্চিতকরণ, এবং ফিনিশিংয়ের জন্য দক্ষ কর্মী এবং কারিগর নিয়োগ করা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসার জন্য একটি উপযুক্ত স্থান বা উৎপাদন ইউনিটও প্রয়োজন হবে, যেখানে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া পরিচালিত হবে। এগুলো ছাড়াও ব্যবসা শুরুর আগে আপনাকে আইনি অনুমোদন নিয়ে বৈধভাবে ব্যবসায় উদ্বোধন করতে হবে।
আরও পড়ুনঃ ২০২৫ সালে শুরু করার জন্য সেরা কয়েকটি বড় ব্যবসার আইডিয়া।
আইনি অনুমোদন ও লাইসেন্স সংগ্রহ
বাংলাদেশে চামড়ার ব্যাগ উৎপাদনের ব্যবসার জন্য ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, এবং বিএসটিআই থেকে প্রোডাক্ট সার্টিফিকেশন প্রয়োজন হবে। আবার পরিবেশবান্ধব উৎপাদনের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। যদি কারখানা স্থাপন করেন, তাহলে ফায়ার সেফটি সনদ এবং শ্রম আইন মেনে চলার জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন লাগবে। এছাড়া রপ্তানি করতে চাইলে ইপিবি থেকে রেজিস্ট্রেশন এবং আমদানি-রপ্তানি সনদপত্র প্রয়োজন হবে।
উন্নতমানের কাঁচামাল ও সরঞ্জাম সংগ্রহ
এই ধরনের ব্যবসার উন্নয়নের ক্ষেত্রে চামড়ার ব্যাগের জন্য উন্নতমানের কাঁচামাল ও সরঞ্জাম সংগ্রহ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারন মানসম্মত পণ্য তৈরি করতে না পারলে কাস্টমার আকৃষ্ট হবেনা। আবার কেউ যদি সেই পণ্য ক্রয় করেও, পরবর্তীতে সেই পণ্যের মান খারাপ পেলে ব্যবসার উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হবে। তাই চামড়া বাছাই করে, ভালো চামড়া সরবরাহকারীর সাথে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। যেন একযোগভাবে সাশ্রয়ী দামে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পাওয়া যায়।
অন্যদিকে, বিভিন্ন সরঞ্জাম যেমন সেলাই মেশিন, কাটিং টুলস, স্ক্র্যাপিং ব্লেড, এবং পালিশ করার যন্ত্রপাতি গুলোও ভালো মানের সংগ্রহ করতে হবে। যাতে দীর্ঘদিন ধরে কার্যকরী থাকে এবং উৎপাদনের গুণমান বজায় থাকে। খেয়াল রাখবেন, আপনার কাঁচামাল ও সরঞ্জাম যত ভালো হবে, পণ্যের গুণমান ততই নিখুত হবে।
আরও পড়ুনঃ লাভজনক ৭টি ৫০ হাজার টাকায় ব্যবসা আইডিয়া।
ডিজাইন করা ও মানসম্মত উৎপাদন প্রক্রিয়া
এই ধরনের পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ট্রেন্ড অনুসারে বিভিন্ন ডিজাইনের ব্যাগ তৈরি করতে হয়। তাই সর্বপ্রথম বাজারের চাহিদা এবং আশেপাশের মানুষদের দৈনন্দিন জীবনাচরণের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। অর্থাৎ প্রথমেই গ্রাহকের পছন্দ, ফ্যাশন ট্রেন্ড, এবং ব্যবহারের উপযোগিতা মাথায় রেখেই আপনার পণ্য তৈরির কাজ শুরু করতে হবে।
সাধারণত একজন দক্ষ কারিগর ছাড়া এই ধরনের পণ্য ব্যবসায়িকভাবে উৎপাদন করা কঠিন। আর দক্ষ কারিগররা এই পণ্যের সঠিক ও মানসম্মত উৎপাদন সম্পর্কে আগে থেকেই ধারণা রাখেন। তবুও ডিজাইনের মধ্যে ব্যাগের আকৃতি, আর্ম স্ট্র্যাপ, জিপার, পকেটের সংখ্যা, রঙ এবং ফিনিশিংয়ের বিষয়গুলো ঠিক নির্ধারণ করে নিতে হয়। এর জন্য প্রাথমিকভাবে স্কেচ বা ডিজিটাল ফরম্যাটে ডিজাইন তৈরি করে নিতে পারেন।
এরপর নির্ধারিত কাঁচামাল, যেমন গাভির চামড়া ব্যবহার করে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করতে হবে যাতে কোনো ধরনের ত্রুটি না থাকে। প্রথমে ব্যাগের জন্য চামড়াটুকু পরিষ্কার করা হয়, এরপর সেটি শুকানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। শুকানো চামড়াকে পরবর্তী ধাপে প্রয়োজন অনুযায়ী কাটা হয়। চামড়া কাটার সময় নিখুঁত আকার ও ডিজাইনের জন্য মাপ নির্ধারণ করে নিতে হয়।
তারপর চামড়ার টুকরোগুলোকে একসাথে সেলাই করার মাধ্যমে সেলাই প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর ফিনিশিং এবং পালিশ করা হয়, যাতে চামড়া মসৃণ এবং চকচকে দেখায়। ব্যাগের ফিনিশিংয়ের সময় ব্র্যান্ডিং, লোগো এবং ফাস্টেনার বা জিপার বসাতে হয়।
সর্বশেষে ব্যাগগুলোকে প্যাকেজিং করে বাজারজাত করার আগে গুণগত মান পরীক্ষা করে নিতে হবে। এখানে বিভিন্ন বিষয়ের উপর লক্ষ্য রেখে আপনার পণ্যের গুণমান যাচাই করতে পারবেন। উৎপাদন প্রক্রিয়ার এই অংশটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এতে পণ্যের মান বজায় থাকে এবং গ্রাহকের কাছে পৌঁছানোর সময় পণ্যটি আকর্ষণীয় দেখা যায়।
উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ
চামড়ার ব্যাগ উৎপাদন করার পর সে পণ্যগুলো আপনি মার্কেটিং করার মাধ্যমে বা সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন মার্কেটে পাইকারি দামে বিক্রি করতে পারবেন। অথবা, আপনি চাইলে বিভিন্ন ই-কমার্স ওয়েবসাইটে কিংবা নিজস্ব ই-কমার্স সাইট তৈরি করেও পণ্য বিক্রয় করতে পারবেন।
চামড়ার ব্যাগ উৎপাদন ব্যবসায় আনুমানিক আয় ব্যয়ের হিসাব
চামড়ার ব্যাগ উৎপাদন ব্যবসার আয়-ব্যয়ের একটি আনুমানিক হিসাব নিচে দেওয়া হলো:
ব্যয় সমূহ:
- কারখানা ভাড়া: মাসে ৩০,০০০-৭০,০০০ টাকা (লোকেশন ও আকার অনুযায়ী)।
- যন্ত্রপাতি: সেলাই মেশিন, কাটিং মেশিন, এবং প্রেস মেশিনের জন্য এককালীন ৫-১২ লাখ টাকা।
- কাঁচামাল: চামড়া, জিপার, কাপড় ইত্যাদির জন্য মাসে ১-৩ লাখ টাকা।
- শ্রমিক বেতন: ৫-১০ জন শ্রমিকের জন্য মাসিক ৪০,০০০-১ লাখ টাকা।
- মার্কেটিং ও ডিস্ট্রিবিউশন: মাসিক খরচ ২০,০০০-৫০,০০০ টাকা।
আয়:
একটি ব্যাগের বিক্রয়মূল্য ৮০০-১,৫০০ টাকা। মাসে ১,০০০ ব্যাগ বিক্রির মাধ্যমে আয় হতে পারে ৮-১৫ লাখ টাকা।
অর্থাৎ, এখানে সকল খরচ বাদ দিয়ে চলতি ব্যয় হিসেবে বিনিয়োগকৃত অর্থের ২০-৩০% লাভ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ব্যবসার পরিধি ও প্রসার অনুসারে মাসিক ২-৪ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব হবে।