কারবালার ইতিহাস ও রাজনীতি এবং কারবালার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানেত পারবেন আজকের লেখাটি পড়ে।
এক
১০ হিজরির জিলহজ্জ মাসের একটি ঘটনা। যায়েদ ইবনে আরকাম রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ
قَامَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَوْمًا فِينَا خَطِيبًا بِمَاءٍ يُدْعَى خُمًّا بَيْنَ مَكَّةَ وَالْمَدِينَةِ فَحَمِدَ اللَّهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ وَوَعَظَ وَذَكَّرَ ثُمَّ قَالَ : أَمَّا بَعْدُ أَلاَ أَيُّهَا النَّاسُ فَإِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ يُوشِكُ أَنْ يَأْتِيَ رَسُولُ رَبِّي فَأُجِيبَ وَأَنَا تَارِكٌ فِيكُمْ ثَقَلَيْنِ أَوَّلُهُمَا كِتَابُ اللَّهِ فِيهِ الْهُدَى وَالنُّورُ فَخُذُوا بِكِتَابِ اللَّهِ وَاسْتَمْسِكُوا بِهِ. فَحَثَّ عَلَى كِتَابِ اللَّهِ وَرَغَّبَ فِيهِ ثُمَّ قَالَ : وَأَهْلُ بَيْتِي أُذَكِّرُكُمُ اللَّهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي أُذَكِّرُكُمُ اللَّهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي أُذَكِّرُكُمُ اللَّهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي
“রাসূলুল্লাহ ﷺ মক্কা-মদীনার মধ্যবর্তী খুম নামক কুপের পাশে আমাদের সামনে খুৎবা দিতে দাঁড়ালেন। আল্লাহর হামদ, ছানা পাঠ ও নসিহত করার পর তিনি বললেনঃ “পর কথা হলো, হে মানবজাতি, আমি একজন মানুষ। অচিরেই আমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে (মৃত্যুর) বার্তাবাহক আসবেন এবং আমি তাঁর ডাকে সাড়া দেব। আর, আমি তোমাদের জন্য দুটি ভারি (গুরুত্বপূর্ণ) বিষয় রেখে যাচ্ছি। প্রথমটি আল্লাহর কিতাব। এতে রয়েছে হেদায়াত ও নূর। অতোএব তোমরা আল্লাহর কিতাবকে গ্রহণ করো এবং শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো।” এরপর তিনি ﷺ আল্লাহর কিতাবের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করতে লাগলেন। এরপর বললেনঃ “এবং (দ্বিতীয়টি হলো) আমার আহলে বায়েত। আমি আমার আহলে বায়েতের ব্যাপারে তোমাদেরকে আল্লাহর কথা (আল্লাহর ভয়) স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।” তিনি ﷺ এ কথাটি তিনবার পুনরাবৃত্তি করলেন। [সহীহ মুসলিম; কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা]
একই সাহাবি থেকে বর্ণিত আরেকটি রেওয়ায়াত হচ্ছে-
وَعِتْرَتِي أَهْلُ بَيْتِي وَلَنْ يَتَفَرَّقَا حَتَّى يَرِدَا عَلَىَّ الْحَوْضَ فَانْظُرُوا كَيْفَ تَخْلُفُونِي فِيهِمَا
“এবং (দ্বিতীয়টি হলো) আমার স্বজন-আহলে বায়েত। এরা হাউযে কাউছারে পৌঁছানোর পূর্বে একে অপর থেকে আলাদা হবে না। অতোএব খেয়াল রাখবে যে, তোমরা এদের সাথে কীরূপ আচরণ করো।” [সুনান আত-তিরমিযি; কিতাবুল মানাকিব]
দুই
৬১ হিজরির মুহররম মাসের একটি ঘটনা। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ
أُتِيَ عُبَيْدُ اللَّهِ بْنُ زِيَادٍ بِرَأْسِ الْحُسَيْنِ عَلَيْهِ السَّلاَمُ فَجُعِلَ فِي طَسْتٍ فَجَعَلَ يَنْكُتُ وَقَالَ فِي حُسْنِهِ شَيْئًا فَقَالَ أَنَسٌ كَانَ أَشْبَهَهُمْ بِرَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم
“উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের (ইয়াযিদ কর্তৃক নিয়োজিত কুফার গভর্নর) সামনে সায়্যিদুনা হুসাইন আ. -এর কর্তৃক মাথা নিয়ে একটি থালায় উপস্থাপন করা হলো। তখন সে (ইবনে যিয়াদ) একটি ছড়ি দিয়ে হুসাইনের মাথায় খোঁচাখুঁচি করতে লাগল এবং (উপহাসের ভঙ্গিতে) তাঁর সৌন্দর্য নিয়ে কিছু কথা বলল। তখন আনাস বললেনঃ এই চেহারা (তুই যাকে অপমান করছিস) রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর চেহারার সাথে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল।” [সহীহ বুখারী; কিতাবু ফাদ্বায়িলি আসহাবিন নাবী]
১০ হিজরি থেকে ৬১ হিজরি- মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে কী এমন হয়ে গেল যে, এ উম্মত তাঁদের নবীর সন্তানদের সাথে এত বড় বর্বরতা প্রদর্শন করে ফেলল? নবীয়ে আকরাম ﷺ-এর রেখে যাওয়া আমানতের (আহলে বায়েত) প্রতি এ উম্মত এত বড় খেয়ানত কীভাবে করল? কী কী উদ্দেশ্য, কোন কোন ঘটনা ১০ই মুহররম কারবালায় আহলে বায়েতের নির্মম শাহাদাতের পেছনের কারণ হয়েছিল? কারও প্রতি বিদ্বেষবশত নয়; বরং রাসূলে আকরাম ﷺ-এর আহলে বায়েতের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাবশত এ সত্যটি আমরা জানতে চাই। এ সত্য যাচাইয়ের আমরা আহলে সুন্নাতের হাদিসের কিতাবসমূহকে আমাদের মূল উৎস হিসেবে গ্রহণ করব।
আমাদের ইতিহাসের ৫টি যুগ
নুমান ইবনে বাশীর রা. বর্ণনা করেছেন হুযায়ফা রা.-এর সূত্রে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
تَكُونُ النُّبُوَّةُ فِيكُمْ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ تَكُون ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ خِلَافَةٌ عَلَى مِنْهَاجِ النُّبُوَّةِ فَتَكُونُ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ تَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ مُلْكًا عَاضًّا فَيَكُونُ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ الله ُأَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ مُلْكًا جَبْرِيّاً فَتَكُونُ مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ تَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ خِلَافَةٌ عَلَى مِنْهَاجِ النُّبُوَّةِ ُثمَّ سَكَتَ
“তোমাদের মধ্যে নবুয়ত থাকবে যতদিন আল্লাহ চাইবেন, এরপর যখন আল্লাহ চাইবেন তা উঠিয়ে নেবেন। এরপর আসবে নবুয়তের আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত খেলাফত। যতদিন আল্লাহ চাইবেন তা থাকবে, যখন আল্লাহ চাইবেন তা উঠিয়ে নেবেন। এরপর আসবে দাঁত-কামড়ানো রাজতন্ত্র। যতদিন আল্লাহ চাইবেন তা থাকবে, যখন আল্লাহ চাইবেন তা উঠিয়ে নেবেন। এরপর আসবে জোরজবরি রাজতন্ত্র। যতদিন আল্লাহ চাইবেন তা থাকবে, যখন আল্লাহ চাইবেন তা উঠিয়ে নেবেন। এরপর (পুনরায়) আসবে নবুয়তের আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত খেলাফত।” এরপর তিনি ﷺ চুপ থাকলেন। [মুসনাদ ইমাম আহমদ, ৪/২৭৩]
উক্ত হাদিস থেকে আমরা নববী যুগ থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সময়কে ৫ ভাগে ভাগ করতে পারি। যথা-
১. নবুয়ত, তথা নবী করীম ﷺ-এর মোবারক যুগ।
২. নবুয়তের আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত খেলাফত, তথা খোলাফায়ে রাশিদীনের যুগ।
৩. দাঁত-কামড়ানো রাজতন্ত্র, তথা শক্তিবলে আঁকড়ে ধরা ক্ষমতা। উদাহরণস্বরূপ বনু উমাইয়া, বনু আব্বাসের রাজতন্ত্র।
৪. জোরজবরি রাজতন্ত্র, তথা অনিচ্ছাসত্ত্বেও চাপিয়ে দেয়া ক্ষমতা। উদাহরণস্বরূপ মুসলিম উম্মাহ’র ওপর ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, স্পেনিশ, ইটালিয়, ডাচ বা পর্তুগিজ সাম্রাজ্যবাদী শাসন।
৫. পুনরায় নবুয়তের আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত খেলাফত, তথা কিয়ামতের পূর্বে ইমাম মাহদী ও সায়্যিদুনা মাসীহ আলাইহিস সালামের যুগ।
নবুয়তের যুগ শেষ হয়েছিল ১১ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ইন্তেকালের মাধ্যমে। ঠিক তখন থেকেই শুরু হয়েছিল নবুয়তের আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত খোলাফায়ে রাশিদীনের যুগ।
খোলাফায়ে রাশিদীনের সময়কাল
সাফিনা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
الْخِلاَفَةُ فِي أُمَّتِي ثَلاَثُونَ سَنَةً ثُمَّ مُلْكٌ بَعْدَ ذَلِكَ
“আমার উম্মতের মধ্যে খেলাফত থাকবে ত্রিশ (৩০) বছর। এরপর আসবে রাজতন্ত্র।” [সুনান আত-তিরমিযি; কিতাবুল ফিতান]
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর পর প্রথম খলিফা হয়েছিলেন সায়্যিদুনা আবু বকর সিদ্দীক রা.। তাঁর খেলাফতকাল ছিল ১১ হিজরির রবিউল আউয়াল থেকে ১৩ হিজরি পর্যন্ত। এরপর যথাক্রমে সায়্যিদুনা উমর (১৩-২৩ হি.) সায়্যিদুনা উসমান (২৩-৩৫ হি.) ও সায়্যিদুনা আলী (৩৫-৪০ হি.)। ৪০ হিজরির রামাদ্বান মাসে শাহাদাত বরণ করেন ৪র্থ খলিফা আলী রা.। এরপর মুসলিম উম্মাহ হাসান ইবনে আলী রা. -এর হাতে খেলাফতের বাই’আত প্রদান করেছিলেন [শারহ আত-তাহাবিয়্যাহ, শারহ মুসলিম, ফায়যুল কাদীর]। ৬ মাস দায়িত্ব পালন করার পর উম্মতের মধ্যকার কলহ নিরসনার্থে হাসান রা. আমিরে শাম মুআবিয়া রা. -এর হাতে উম্মতের শাসনভার ছেড়ে দিয়েছিলেন [সহীহ বুখারী; কিতাবুস সুলহ]। সময়টি ছিল ৪১ হিজরির রবিউল আউয়াল মাস। ১১ হিজরির রবিউল আউয়াল থেকে ৪১ হিজরির রবিউল আউয়াল- হাসান রা. -এর মাধ্যমে খেলাফতের ৩০ বছর পূর্ণ হয়।
হাদিসের ভাষ্যনুযায়ী, নবুয়তের আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত খেলাফত-এর সমাপ্তির পর শুরু হয় দাঁত-কামড়ানো রাজতন্ত্র। প্রশ্ন জাগে, নববী আদর্শ ও খোলাফায়ে রাশিদীনের পথপরিক্রমা ত্যাগ করে এ উম্মত কীভাবে রাজতন্ত্রের ঘেরাটোপে পতিত হলো?
শাসনব্যবস্থায় পটপরিবর্তনের আভাস
৩য় খলিফা উসমান রা. -এর খেলাফতকালে তাঁর মনোনিত কতিপয় প্রাদেশিক গভর্নরের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছিল। তন্মধ্যে কুফার গভর্নর ওয়ালিদ ইবনে উকবা ও মিশরের গভর্নর আবদুল্লাহ ইবনে সা’দ ইবনে আবিস সারাহ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া খলিফা নিজ গোত্র বনু উমাইয়ার লোকজনকে বিশ্বাস করে যেসব দায়িত্ব দিয়েছিলেন, দু’একজন ছাড়া বাকিরা কেউ সে বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেনি। স্বয়ং খলিফার চাচাতো ভাই মারওয়ান তখনকার কূটকৌশলের মধ্যে শামিল ছিলেন।
দ্বিতীয়ত, কতিপয় সাহাবি খলিফার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিকভাবে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। কয়েকজন খোলাখুলি তাঁদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন। খলিফা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছিলেন বিষয়গুলোকে ন্যায়সঙ্গতভাবে সমাধান করতে। কিন্তু নব্য মুসলমানদের মধ্যে কিছু বিপথগামী এসব অভিযোগ সামনে এনে খলিফার বিরুদ্ধে প্রচারণা করতে শুরু করে। ফলস্বরূপ, ইরাক ও মিশরের কয়েকশ লোক একত্রিত হয়ে মদীনায় আসে এবং খলিফার বাসভবন ঘেরাও করে। তারা তাঁকে মসজিদে যেতে বাধা দেয়, তাঁর ঘরে পান করার পানি বন্ধ করে দেয় [সুনান আত-তিরিমিযি; কিতাবুল মানাকিব]। খলিফা তাদের যাবতীয় অভিযোগের জবাব প্রদান করলে তারা ফিরে যেতে উদ্যত হয়। হঠাৎ পরিস্থিতি এমনভাবে মোড় নেয় যে, তারা ফিরে আসে এবং খলিফার পদত্যাগ দাবী করে। খলিফা তাতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে এমনটি করতে বারণ করেছিলেন। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
يَا عُثْمَانُ إِنَّهُ لَعَلَّ اللَّهَ يُقَمِّصُكَ قَمِيصًا فَإِنْ أَرَادُوكَ عَلَى خَلْعِهِ فَلاَ تَخْلَعْهُ لَهُمْ
“হে উসমান, আল্লাহ তোমাকে একটি জামা পরাবেন। যদি তারা এটি খুলে নিতে চায়, তাহলে তুমি তাদের জন্য সেটি খুলে দেবে না।” [সুনান আত-তিরমিযি; কিতাবুল মানাকিব]
সাহাবিরা এসব বিপথগামীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু খলিফা তাঁদেরকে নিজের প্রতিরক্ষায় কোনোরূপ রক্তপাত ঘটানোর অনুমতি দেননি। এক সময় বিদ্রোহীরা খলিফার ঘরে প্রবেশ করে এবং নির্মমতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশস্বরূপ খলিফাকে হত্যা করে [বিদায়াহ, ৭ম খণ্ড]। উসমান রা. -এর শাহাদাতের মধ্য দিয়ে উম্মতের মুহাম্মাদীর রাজনৈতিক ঐক্য চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে যায়। আবু মুসা আশআরী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, একদা রাসূল ﷺ বাগানের ভেতর বসা ছিলেন। উসমান এসে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলে রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেনঃ
افْتَحْ وَبَشِّرْهُ بِالْجَنَّةِ عَلَى بَلْوَى تُصِيبُهُ
“দরজা খুলো এবং তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দাও। সাথে একটি বিপর্যয়ের, যা তার ওপর পতিত হবে।” [সহীহ বুখারী; কিতাবুল আদাব]
বিপর্যয়ের বহিঃপ্রকাশ
খলিফা উসমান রা. -এর শাহাদাতের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট চরম বিশৃঙ্খল সময়ে প্রবীণ সাহাবিদের মধ্যে কেউই উম্মতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কাঁধে তুলে নিতে রাজি ছিলেন না। অগত্যা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রিয়ভাজন আলী ইবনে আবি তালিব রা.-কে মুসলিম উম্মাহ তাঁদের খলিফা মনোনিত করেন। সবার মনে তখন উসমান হত্যা নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ কাজ করছিল। খলিফা আলী রা. চেয়েছিলেন প্রাথমিক বিশৃঙ্খলা স্তিমিত করে উসমান হত্যার বিচার করবেন। ওদিকে উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা. এ ব্যাপারে খলিফাকে রাজনৈতিকভাবে চাপ দিতে থাকেন। তাঁর সাথে যুক্ত হন প্রসিদ্ধ দুই সাহাবি- তালহা রা. এবং যুবায়ের রা.। তাঁরা মদীনা ছেড়ে বসরায় চলে যান এবং সেখানে উসমান হত্যার বিচার দাবী করেন [সহীহ বুখারী; কিতাবুল ফিতান]।
তবে খলিফার জন্য বড় বিপত্তি নিয়ে আসেন আমিরে শাম (সিরিয়ার গভর্নর)। তিনি একেতো খলিফার হাতে বাই’আত দেননি, তার ওপর উসমান হত্যা নিয়ে চরম উদ্বেগপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। আলী রা. বিষয়টি সমাধা করার জন্য সিরিয়ায় রওয়ানা করেন। পথিমধ্যে আয়েশা রা.-এর নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সাথে আলী রা.-এর বাহিনীর সাক্ষাৎ ঘটে। তাঁরা কথাবার্তা বলে উসমান হত্যার বিচারের ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছালেও উভয় দলের উত্তেজিত জনতার মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই কয়েক হাজার মুসলমান প্রাণ হারান। দুঃখজনকভাবে সায়্যিদুনা তালহা রা. ও সায়্যিদুনা যুবায়ের রা. শাহাদাত বরণ করেন। আলী রা. আয়েশা সিদ্দীকা রা.-কে সসম্মানে বসরায় পাঠিয়ে দেন, যেভাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নির্দেশ ছিল [মুসনাদ ইমাম আহমদ, ৬/৩৯৩]। না চাইতে এমন একটি বিপর্যয় আসবে, কেউ ভাবতেই পারেনি। এমনকি আয়েশা রা. উষ্টীর যুদ্ধে তাঁর পদক্ষেপের জন্য আমৃত্যু আফসোস করে গেছেন [মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা, ৩৭৭৭২]।
খলিফা উসমান, খলিফা আলী, সাহাবি তালহা ও যুবায়েরের রা. -এর মধ্যে কিছু মতপার্থক্য ছিল, থাকাটা স্বাভাবিক। তবে সেটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিরুদ্ধাচরণ বা ব্যক্তিগত ও গোত্রীয় বিদ্বেষ নয়। এজন্য আলী রা. বলতেনঃ আমি আশাবাদী যে, আমি, উসমান, তালহা ও যুবায়ের সেসব মানুষের অন্তর্ভুক্ত, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ [সুরা হিজর : ৪৭] বলেছেনঃ “তাদের অন্তরে যে ক্রোধ ছিল, আমি তা দূর করে দেব। তারা ভাই ভাইয়ের মত সামনা-সামনি আসনে বসবে।” [ফাদ্বায়িলুস সাহাবা : ইমাম আহমদ]
সিরিয়াবাসীর বিদ্রোহ
সিরিয়ার অদূরবর্তী সিফফিনে পৌঁছে আমিরুল মু’মিনীন আলী রা. আমিরে শামকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমিরে শাম কোনো কথাই কানে নেননি। অগত্যা ৭ই সফর, ৩৭ হিজরি সনে আমিরে শামের বাহিনী আমিরুল মু’মিনীন আলী রা.-এর বাহিনীর ওপর হামলা করে [বিদায়াহ, ৭ম খণ্ড]। ৫ দিনের যুদ্ধে অন্তত ৬০-৬৫ হাজার মুসলমান প্রাণ হারিয়েছিলেন।
প্রশ্ন জাগে, আমিরুল মু’মিনীন আলী রা. -এর বিরুদ্ধে সিরিয়াবাসীর এমন বিরুদ্ধাচরণ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ কী? অথচ রাসূলুল্লাহ ﷺ মুসলমানদের (বৈধ) খলিফাকে মান্য করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ فِيمَا أَحَبَّ وَكَرِهَ إِلاَّ أَنْ يُؤْمَرَ بِمَعْصِيَةٍ فَإِنْ أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلاَ سَمْعَ وَلاَ طَاعَةَ
“প্রত্যেক মুসলমানের উচিৎ হচ্ছে, পাপকাজের নির্দেশ ব্যতীত (বৈধ আমিরের) হুকুম শোনা ও মান্য করা, চাই সে পছন্দ করুক বা না করুক। যদি আমির (শাসক) পাপকাজের নির্দেশ দেয়, তাহলে তার কথা শোনা ও মান্য করার প্রয়োজন নেই।” [মুত্তাফাকুন আলাইহি]
আলী রা. ছিলেন মুসলিম উম্মাহ’র ঐক্যমতের ভিত্তিতে খলিফায়ে রাশিদ তথা সুপথপ্রাপ্ত খলিফা। এবং খোলাফায়ে রাশিদীনের অনুসরণ করা সবার জন্যই কর্তব্য। ইরবাদ্ব ইবনু সারিয়্যাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
سَتَرَوْنَ مِنْ بَعْدِي اخْتِلاَفًا شَدِيدًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ عَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ
“আমার পরে তোমরা প্রচুর মতভিন্নতা দেখতে পাবে। অতোএব তোমাদের জন্য রইল আমার সুন্নাত ও আমার সুপথপ্রাপ্ত খলিফাদের সুন্নাত। তোমরা দাঁতের মাড়ি দিয়ে এগুলো আঁকড়ে ধরবে।” [সুনান ইবনে মাজাহ; কিতাবুল মুকাদ্দিমা]
সিফফিনে উপস্থিত দুই বাহিনীর মধ্যকার পার্থক্য
আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
وَيْحَ عَمَّارٍ تَقْتُلُهُ الْفِئَةُ الْبَاغِيَةُ يَدْعُوهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ وَيَدْعُونَهُ إِلَى النَّارِ
“আফসোস আম্মারের জন্য! একটি বিদ্রোহী দল তাকে হত্যা করবে। সে তাদেরকে জান্নাতের দিকে আহ্বান করবে, (অথচ) তারা তাকে জাহান্নামের দিকে আহ্বান করবে।” [সহীহ বুখারী; কিতাবুস সালাত]
সিফফিনের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রিয় সাহাবি আম্মার ইবনে ইয়াসির রা. ছিলেন আমিরুল মু’মিনীন আলী রা. -এর দলে। আমিরে শামের বাহিনী তাঁকে হত্যা করে। যদিও আমিরে শাম এ ব্যাপারে নিজেদের ভুল স্বীকার না করে উল্টো এ হত্যার দায়ভার আমিরুল মু’মিনীন আলী রা. -এর ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। [মুসনাদ ইমাম আহমদ, ৪/১৯৯]
আমিরুল মু‘মিনীন আলী রাদ্বিআল্লাহু আনহু
সায়্যিদুনা আলী রা. السَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ তথা প্রথম সারির মুসলিম মুহাজিরদের অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ ﷺ দশজন সাহাবির নাম ধরে তাঁদের জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। আলী রা. তাঁদের অন্যতম [সুনান আত-তিরমিযি; কিতাবুল মানাকিব]। আলী রা. বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবিদের অন্যতম, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ যাবতীয় ক্ষমা ও সন্তুষ্টি ঘোষণা করেছেন। [সহীহ বুখারী; কিতাবুল মাগাযী]
যায়েদ ইবনে আরকাম রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ খুম নামক জায়গায় খুৎবা দেয়ার সময় বলেছিলেনঃ
مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِيٌّ مَوْلاَهُ اللَّهُمَّ وَالِ مَنْ وَالَاهُ وَعَادِ مَنْ عَادَاهُ
“আমি যার মাওলা (পরম প্রিয়, নৈকট্যভাজন), আলী তার মাওলা। হে আল্লাহ, যে তাকে (আলীকে) বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে, তুমিও তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো। আর যে তাকে (আলীকে) শত্রু হিসেবে গ্রহণ করে, তুমিও তাকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করো। [সুনান আত-তিরমিযি; কিতাবুল মানাকিব, (শেষাংশ) মুসনাদ ইমাম আহমদ]
সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ তাবুক অভিযানের প্রাক্কালে আলী রা.-কে বলেছেনঃ
أَمَا تَرْضَى أَنْ تَكُونَ مِنِّي بِمَنْزِلَةِ هَارُونَ مِنْ مُوسَى غَيْرَ أَنَّهُ لاَ نَبِيَّ بَعْدِي
“তুমি কি সন্তুষ্ট নও যে, তুমি আমার জন্য সেরকম যেরকম হারূণ আ. ছিলেন মুসা আ.-এর জন্য। পার্থক্য এই যে, আমার পরে আর কোনো নবী নেই।” [মুত্তাফাকুন আলাইহি]
আলী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ
وَالَّذِي فَلَقَ الْحَبَّةَ وَبَرَأَ النَّسَمَةَ إِنَّهُ لَعَهْدُ النَّبِيِّ الأُمِّيِّ صلى الله عليه وسلم إِلَىَّ أَنْ لاَ يُحِبَّنِي إِلاَّ مُؤْمِنٌ وَلاَ يُبْغِضَنِي إِلاَّ مُنَافِقٌ
“কসম সেই খোদার, যিনি বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম করেন এবং জীবন সৃষ্টি করেন। নবী আল-উম্মী ﷺ আমাকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, মুমিন ব্যতীত কেউ আমাকে (আলীকে) ভালোবাসবে না এবং মুনাফিক ব্যতীত কেউ আমাকে ঘৃণা করবে না। [সহীহ মুসলিম; কিতাবুল ঈমান]
সুলহে হাসান
৪০ হিজরির রামাদ্বান মাসে সায়্যিদুনা আলী রা. -এর শাহাদাতের পর মুসলমানরা সায়্যিদুনা হাসান ইবনে আলী রা. -এর হাতে খেলাফতের বাই’আত প্রদান করেন। যতদিন আলী রা. জীবিত ছিলেন ততদিন আমিরে শাম নিজেকে খলিফা দাবী করেননি। হাসান রা. খলিফা হওয়ার পরই আমিরে শাম নিজেকে খলিফা দাবী করেন। যুদ্ধের দামামা বাজে। ইমাম হাসান বসরি বলেছেন, মুসলিম বিশ্বের বৃহদাংশ যুক্ত হয় হাসান রা. -এর সাথে। আমিরে শাম দুজন ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন হাসান রা. -এর সাথে মীমাংসা করার জন্য। হাসান রা. উম্মতের মধ্যে পুনরায় ক্ষমতাকেন্দ্রিক রক্তপাত প্রতিরোধ করার জন্য মীমাংসায় রাজি হয়ে যান। চুক্তিতে হাসান রা. আমিরে শামের সামনে কতিপয় শর্ত রাখেন। [সহীহ বুখারী; কিতাবুস সুলহ]
ইমাম আসকালানী (ফাতহুল বারী) ও ইমাম ইবনে আবদিল বার (আল-ইসতি’আব) বলেছেন, হাসান রা. আমিরে শামকে যেসব শর্ত দিয়েছিলেন, তন্মধ্যে ছিল-
১. আমিরে শাম যেন কুরআন-সুন্নাহ ও খোলাফায়ে রাশিদীনের অনুসরণে শাসনকার্য পরিচালনা করেন।
২. আমিরে শাম যেন পরবর্তীতে নিজের পক্ষ থেকে কাউকে খলিফা মনোনিত না করেন। বরং বিষয়টি যেন উম্মতের পরামর্শের ভিত্তিতে নির্ণীত হয়।
৩. সায়্যিদুনা আলী রা. -এর সাথে যারা ছিলেন এবং যারা তাঁকে মুহাব্বাত করেন, তাঁদেরকে যেন কোনোরূপ জোরজুলুম না করা হয়।
৪. আহলে বায়েতের জন্য পবিত্র কুরআনে বর্ণিত খুমুস (গণিমতের এক পঞ্চমাংশ) যেন বহাল থাকে।
সিরিয়াবাসী যাবতীয় শর্ত পূর্ণ করার অঙ্গীকার করেন। এরপর হাসান রা. আমিরে শামের হাতে উম্মতের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে খেলাফতের মসনদ ত্যাগ করেন। সমাপ্ত হয় নববী আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত খেলাফতের ৩০ বছর। আবু বাকরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ হাসানের ব্যাপারে বলেছেনঃ
إِنَّ ابْنِي هَذَا سَيِّدٌ وَلَعَلَّ اللَّهَ أَنْ يُصْلِحَ بِهِ بَيْنَ فِئَتَيْنِ عَظِيمَتَيْنِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ
“নিশ্চয়ই আমার এ বাচ্চা নেতা। সম্ভবত আল্লাহ তার মাধ্যমে মুসলমানদের দুটি বড় দলের মধ্যে বিরোধ মীমাংসা করাবেন।” [সহীহ বুখারী; কিতাবু ফাদ্বায়িলি আসহাবিন নাবী, কিতাবুস সুলহ]
বনু উমাইয়ার শাসনকাল : একটি পর্যালোচনা
বনু উমাইয়ার রাজতন্ত্র শুরু হয় মুআবিয়া রা. ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে। মুআবিয়া রা. সাহাবি ছিলেন। তাঁর ঈমান, আমল, দীনদারী নিয়ে কারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু এটিও বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বনু উমাইয়ার (উমর ইবনে আবদুল আযীয রহ. ব্যতীত) শাসনামলে, এমনকি প্রথমদিকেও বহু অনভিপ্রেত এবং অগ্রহণযোগ্য বিষয় সংঘটিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো-
১. আবদুর রাহমান থেকে বর্ণিত, সায়্যিদুনা আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. কা’বা শরীফের ছায়ায় বসে ফিতনা ও নেতার আনুগত্য বিষয়ে কথা বলছিলেন। আবদুর রাহমান বলেন, আমি তাঁকে বললাম, আপনার চাচাতো ভাই (তৎকালীন শাসক) আমাদেরকে নির্দেশ দেন যেন আমরা পরস্পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করি এবং হানাহানি করি। অথচ আল্লাহ এমনটি করতে নিষেধ করেছেন (তিনি সুরা নিসার ২৯ নং আয়াত পড়লেন)। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেনঃ
أَطِعْهُ فِي طَاعَةِ اللَّهِ وَاعْصِهِ فِي مَعْصِيَةِ اللَّهِ
“তোমার আল্লাহর আনুগত্যের অধীনে তাঁর (ওই শাসকের) আনুগত্য করবে। এবং আল্লাহর অবাধ্যতার ব্যাপারগুলোতে তাঁর (ওই শাসকের) অবাধ্যতা করবে। [সংক্ষেপিত, সহীহ মুসলিম; কিতাবুল ইমারাহ]
২. সাঈদ ইবনে জুবায়ের থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ
كُنْتُ مَعَ ابْنِ عَبَّاسٍ بِعَرَفَاتٍ فَقَالَ مَا لِي لاَ أَسْمَعُ النَّاسَ يُلَبُّونَ قُلْتُ يَخَافُونَ مِنْ مُعَاوِيَةَ فَخَرَجَ ابْنُ عَبَّاسٍ مِنْ فُسْطَاطِهِ فَقَالَ لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ فَإِنَّهُمْ قَدْ تَرَكُوا السُّنَّةَ مِنْ بُغْضِ عَلِيٍّ
“আমি সায়্যিদুনা আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. -এর সাথে আরাফাহ ময়দানে ছিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি কেন মানুষদেরকে তালবিয়া পাঠ করতে শুনছিনা? আমি বললাম, মুআবিয়ার ভয়ে (এরা তালবিয়া পাঠ করছে না)। তখন ইবনে আব্বাস রা. (রাগান্বিত অবস্থায়) তাঁর তাবু থেকে বের হলেন এবং ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ পাঠ করতে শুরু করলেন। বললেন, এরা আলী রা. -এর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে গিয়ে রাসূল ﷺ-এর সুন্নাতকে বাদ দিয়ে দিচ্ছে। [সুনান আন-নাসায়ী; কিতাবু মানাসিকিল হাজ্জ]
৩. আমির ইবনে সা’দ বর্ণনা করেছেন, সায়্যিদুনা সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা.-কে ‘তৎকালীন শাসক’ জিজ্ঞেস করলেনঃ
مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسُبَّ أَبَا التُّرَابِ فَقَالَ أَمَّا مَا ذَكَرْتُ ثَلاَثًا قَالَهُنَّ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَلَنْ أَسُبَّهُ
“কোন বিষয়টি তোমাকে আবু তুরাব (সায়্যিদুনা আলী রা.) এর প্রতি গালাগাল করা থেকে বিরত রাখছে? সা’দ রা. বললেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর ব্যাপারে এমন তিনটি বিষয় বলেছেন, যতদিন আমি এগুলো স্মরণ রাখব ততদিন আমি আলীর ব্যাপারে মন্দ কথা বলব না। [সংক্ষেপিত, সহীহ মুসলিম; কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা]
৪. রাবাহ ইবনুল হারিছ বর্ণনা করেছেন, “আমি জনৈক ব্যক্তির (কুফায় নিযুক্ত উমাইয়া গভর্নর) কাছে বসেছিলাম, যেখানে কুফার লোকজন ছিল। এমতাবস্থায় সায়্যিদুনা সাঈদ ইবনু যায়েদ রা. সেখানে উপস্থিত হলেন। সবাই তাঁকে সম্মান করল। তখন কায়েস ইবনে আলকামা নামক এক ব্যক্তি হাজির হলো এবং (কাউকে উদ্দেশ্য করে) অকথ্য গালাগাল করতে শুরু করল। তখন সাঈদ ইবনু যায়েদ রা. জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যক্তি কাকে গালাগাল করছে? তারা জবাব দিল, আলীকে! সাঈদ ইবনু যায়েদ রা. (চমকে ওঠে) কুফার গভর্নরকে বললেনঃ
أَلاَ أَرَى أَصْحَابَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُسَبُّونَ عِنْدَكَ ثُمَّ لاَ تُنْكِرُ وَلاَ تُغَيِّرُ
“আমি এসব কী দেখছি! তোমার সামনে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সাহাবিদের গালাগাল করা হচ্ছে? অথচ তুমি এসব বন্ধ করছ না, কোনো (শাস্তিমূলক) পদক্ষেপও নিচ্ছ না। [সংক্ষেপিত, সুনান আবি দাউদ; কিতাবুস সুন্নাহ]
৫. তারিক ইবনে শিহাব থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ
أَوَّلُ مَنْ بَدَأَ بِالْخُطْبَةِ يَوْمَ الْعِيدِ قَبْلَ الصَّلاَةِ مَرْوَانُ فَقَامَ إِلَيْهِ رَجُلٌ فَقَالَ الصَّلاَةُ قَبْلَ الْخُطْبَةِ فَقَالَ قَدْ تُرِكَ مَا هُنَالِكَ
“(উমাইয়া গভর্নর) মারওয়ান ঈদের দিন নামাজের পূর্বে খুৎবা দেয়ার (বিদ’আত) প্রচলন করেন। এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললেন, (সুন্নাত হচ্ছে) খুৎবার আগে নামাজ আদায় করা। মারওয়ান বললেন, আগে যা (সুন্নাত) ছিল, তা এখন পরিত্যাগ করা হলো।” [সহীহ মুসলিম; কিতাবুল ঈমান]
৬. হুজার ইবনে আদী রা. একজন সাহাবি ছিলেন। ইমাম হাকিম (মুসতাদরাক, ১ম খণ্ড), ইমাম ইবনে আবি শাইবা (মুসান্নাফ) ও ইমাম যাহবী (সিয়ার) বলেছেন, উমাইয়া শাসনামলে হুজার ইবনে আদীকে দামেস্কের পাশে আযরা নামক গ্রামে নিয়ে গিয়ে শিকলবদ্ধ অবস্থায় নির্মমভাবে শহীদ করা হয়। তাঁর “অপরাধ” ছিল, তিনি আলী রা. -এর প্রতি মুহাব্বাত পোষণ করতেন এবং উমাইয়া গভর্নরদের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ করতেন। [মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা, ১১০৯৫]
উপরিউক্ত প্রত্যেকটি ঘটনা বনু উমাইয়ার শাসনামলের শুরুর দিকে সংঘটিত হয়েছে। আল্লাহর যাতে পাক সাক্ষী, কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতি সমালোচনার তীর ধার্য করা মোটেও আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা কেবল সে সময়ের রাজনৈতিক অবস্থাটি বুঝতে চেষ্টা করছি, যেন জানতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর আহলে বায়েতের প্রতি এত ভয়াবহ অবিচারের পেছনের কারণ কী ছিল।
ইয়াযিদের মনোনয়ন
ইউসুফ ইবনে মাহাক থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ
كَانَ مَرْوَانُ عَلَى الْحِجَازِ اسْتَعْمَلَهُ مُعَاوِيَةُ فَخَطَبَ فَجَعَلَ يَذْكُرُ يَزِيدَ بْنَ مُعَاوِيَةَ لِكَىْ يُبَايِعَ لَهُ بَعْدَ أَبِيهِ فَقَالَ لَهُ عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ أَبِي بَكْرٍ شَيْئًا فَقَالَ خُذُوهُ فَدَخَلَ بَيْتَ عَائِشَةَ فَلَمْ يَقْدِرُوا
“মুআবিয়া রা. মারওয়ান ইবনে হাকামকে হিজাযের গভর্নর নিযুক্ত করেন। তিনি (মারওয়ান) খুৎবায় ইয়াযিদ ইবনে মুআবিয়ার নাম উল্লেখ করেন, যেন মানুষ তার পিতার (মুআবিয়া) পরে তার হাতে খেলাফতের বাই’আত প্রদান করে। তখন আবদুর রাহমান ইবনে আবু বকর রা. মারওয়ানকে উদ্দেশ্য করে কিছু বললেন। মারওয়ান বললেন, ওকে গ্রেফতার করো। তখন আবদুর রাহমান আয়েশা সিদ্দীকা রা. -এর ঘরে প্রবেশ করেন, ফলে তারা তাঁকে ধরতে সক্ষম হয়নি।” [সহীহ বুখারী; কিতাবুত তাফসীর]
ইমাম আসকালানী (ফাতহুল বারী, তাফসীর অধ্যায়) ও ইমাম ইবনে কাসির (তাফসীর ইবনে কাসির, সুরা আহকাফ, আয়াত ১৭) বলেছেন, মুআবিয়া রা. তাঁর পুত্র ইয়াযিদকে পরবর্তী শাসক মনোনিত করতে চাইলেন। এ মর্মে তিনি হিজাযের গভর্নর মারওয়ানের নিকট পত্র প্রেরণ করলেন। মারওয়ান লোকদেরকে ডেকে শুনিয়ে দিলেন যে, আল্লাহ আমিরুল মু’মিনীনকে (মুআবিয়া) ইয়াযিদের মধ্যে কল্যাণ দেখিয়েছেন (অর্থাৎ তিনি ইয়াযিদকে ভালো মনে করছেন)। তাই তিনি ইয়াযিদকে তার স্থলাভিষিক্ত করবেন, যেভাবে আবু বকর রা. ও উমর রা. করেছিলেন। আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর রা. বললেন, এটি আবু বকর ও উমরের সুন্নাত নয়। বরং এটি হিরাকল (রোমান সম্রাট) ও কিসরার (পারস্য সম্রাট) নিয়ম। খোদার কসম, আবু বকর রা. তাঁর সন্তান কিংবা পরিবারের কাউকে খলিফা মনোনিত করেননি। তখন মারওয়ান তাঁকে আটক করতে উদ্যত হলেও আটক করতে সক্ষম হলেন না।
খেলাফত বিষয়ে সায়্যিদুনা উমর রা. –এর ফতোয়া
ইয়াযিদের মনোনয়ন বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহ’র পছন্দে হয়নি, ন্যুনতম একটি কমিটিও গঠন করা হয়নি। কেবল দু’একজনের পছন্দের ভিত্তিতে মুআবিয়া রা. নিজের জীবদ্দশায় পুত্রের নাম ঘোষণা করে প্রাদেশিক গভর্নরদের মাধ্যমে ইয়াযিদের পক্ষে বাই’আত গ্রহণ করিয়েছেন, যদিও তখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাহাবি জীবিত ছিলেন।
এ ধরণের এককেন্দ্রিক মনোনয়ন ও জোরপূর্বক বাই’আত গ্রহণ করা খেলাফতের সুন্নাতের বিপরীত। উম্মতের দুনিয়াবি বিষয়াদি পারস্পারিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পাদন করাই পবিত্র কুরআনের নির্দেশ। আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
وَأَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ
“তারা পারস্পারিক পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করে।” [সুরা শুরা: ৩৮]
এ বিষয়ে আমিরুল মু’মিনীন উমর ইবনে খাত্তাব রা. -এর স্পষ্ট দিক-নির্দেশনা রয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, উমর রা. বলেছেনঃ
فَمَنْ بَايَعَ رَجُلاً عَلَى غَيْرِ مَشُورَةٍ مِنَ الْمُسْلِمِينَ فَلاَ يُتَابَعُ هُوَ وَلاَ الَّذِي بَايَعَهُ تَغِرَّةً أَنْ يُقْتَلاَ
“অতোএব (স্মরণ রেখো), যে ব্যক্তি মুসলমানদের পরামর্শ ব্যতিরেকে কাউকে খেলাফতের বাই’আত প্রদান করবে, তাহলে যে বাই’আত দিল আর যার হাতে দেয়া হলো, কারও অনুসরণ করা যাবে না। বরং দুজনকেই হত্যা করা উচিৎ।” [সহীহ বুখারী; কিতাবুল হুদুদ]
মুআবিয়া রা. -এর শাসনামলে মুসলিম উম্মাহ অনেক কল্যাণের সাক্ষী হয়েছিল। গৃহযুদ্ধের কারণে আটকে পড়া মুসলিম বিশ্বের সম্প্রসারণ পুনরায় শুরু হয়েছিল। ৬০ হিজরির রজব মাসে মুআবিয়া রা. ইন্তেকাল করেন। এরপর পূর্বনির্ধারিত কারণে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয় ইয়াযিদ ইবনে মুআবিয়ার কাছে।
বনু উমাইয়ার শাসনের প্রতি রাসূল ﷺ–এর ইঙ্গিত
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ
سَمِعْتُ الصَّادِقَ الْمَصْدُوقَ يَقُولُ هَلاَكُ أُمَّتِي عَلَى يَدَىْ غِلْمَةٍ مِنْ قُرَيْشٍ فَقَالَ مَرْوَانُ غِلْمَةٌ قَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ إِنْ شِئْتَ أَنْ أُسَمِّيَهُمْ بَنِي فُلاَنٍ وَبَنِي فُلاَن
“আমি আস-সাদিক আল-মাসদুক নবী ﷺ-কে বলতে শুনেছি, কুরাইশ বংশের তরুণদের হাতে আমার উম্মতের ধ্বংস হবে। মারওয়ান জিজ্ঞেস করলেন, তরুণদের হাতে? আবু হুরায়রা বললেন, যদি তুমি চাও তাইলে আমি নাম পর্যন্ত বলতে পারব যে, এরা অমুক অমুকের সন্তান।” [সহীহ বুখারী; কিতাবুল মানাকিব]
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ
حَفِظْتُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وِعَاءَيْنِ فَأَمَّا أَحَدُهُمَا فَبَثَثْتُهُ وَأَمَّا الآخَرُ فَلَوْ بَثَثْتُهُ قُطِعَ هَذَا الْبُلْعُومُ
“আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কাছ থেকে দুই ধরণের জ্ঞান অর্জন করেছি। তন্মধ্যে এক ধরণের জ্ঞান আমি প্রচার করি। অন্য ধরণের জ্ঞান যদি আমি প্রচার করতে যাই, তাহলে আমার গলা কেটে দেয়া হবে।” [সহীহ বুখারী; কিতাবুল ইলম]
ইমাম আসকালানী (ফাতহুল বারী) বলেছেন, উলামায়ে কেরামের মতে, এখানে আবু হুরায়রা রা. অত্যাচারী শাসকদের নাম-পরিচয়, অবস্থা ও সময়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, কিন্তু স্পষ্ট করে বলেননি। আবু হুরায়রা রা. বলতেনঃ أعوذ بالله من رأس الستين وإمارة الصبيان অর্থাৎ, “৬০ হিজরি ও বালকদের শাসন থেকে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই।” তাঁর ইঙ্গিত ছিল ইয়াযিদের প্রতি, যিনি ৬০ হিজরিতে ক্ষমতায় আরোহন করেছেন। আল্লাহ আবু হুরায়রার দুআ কবুল করেছিলেন। ইয়াযিদের ক্ষমতায়নের এক বছর পূর্বেই (৫৯ হিজরি) তিনি পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছিলেন।
বনু উমাইয়ার শাসন : সাহাবির মূল্যায়ন
“খেলাফত ত্রিশ বছর থাকবে” শীর্ষক হাদিস বর্ণনা করার পর বর্ণনাকারী তাবেয়ী সাঈদ বলেছেনঃ
قَالَ لِي سَفِينَةُ أَمْسِكْ خِلاَفَةَ أَبِي بَكْرٍ وَخِلاَفَةَ عُمَرَ وَخِلاَفَةَ عُثْمَانَ ثُمَّ قَالَ لِي أَمْسِكْ خِلاَفَةَ عَلِيٍّ قَالَ فَوَجَدْنَاهَا ثَلاَثِينَ سَنَةً قَالَ سَعِيدٌ فَقُلْتُ لَهُ إِنَّ بَنِي أُمَيَّةَ يَزْعُمُونَ أَنَّ الْخِلاَفَةَ فِيهِمْ قَالَ كَذَبُوا بَنُو الزَّرْقَاءِ بَلْ هُمْ مُلُوكٌ مِنْ شَرِّ الْمُلُوكِ
“সাফিনা রা. আমাকে বললেন, তুমি গণনা করো আবু বকর, উমর, উসমান ও আলীর খেলাফত। তিনি বলেন, তাহলে আমরা ত্রিশ বছর পেয়ে যাই। সাঈদ বলেন, আমি তাঁকে (সাফিনা রা.) বললাম, বনু উমাইয়া লোকেরা বলে খেলাফত নাকি তাদের মধ্যে! তখন সাফিনা রা. বলেন, নীল চক্ষুবিশিষ্ট (বনু উমাইয়া) লোকেরা মিথ্যা কথা বলছে। বরং তারা তো নিকৃষ্ট রাজতন্ত্রের মধ্যে একটি রাজতন্ত্র।” [সুনান আত-তিরমিযি; কিতাবুল ফিতান]
একই হাদিসের অন্য রেওয়ায়াতে রয়েছে, বর্ণনাকারী তাবেয়ী সাঈদ বলেছেনঃ
قُلْتُ لِسَفِينَةَ إِنَّ هَؤُلاَءِ يَزْعُمُونَ أَنَّ عَلِيًّا عَلَيْهِ السَّلاَمُ لَمْ يَكُنْ بِخَلِيفَةٍ قَالَ كَذَبَتْ أَسْتَاهُ بَنِي الزَّرْقَاءِ يَعْنِي بَنِي مَرْوَانَ
“আমি সাফিনা রা.-কে বললাম, এরা (বনু উমাইয়া) দাবী করে যে সায়্যিদুনা আলী আলাইহিস সালাম নাকি খলিফা ছিলেন না! সাফিনা রা. বলেন, এই মিথ্যা নীল চক্ষুবিশিষ্ট তথা বনু মারওয়ান পিঠ থেকে নির্গত হয়েছে।” [সুনান আবি দাউদ; কিতাবুস সুন্নাহ]
ইয়াযিদের শাসনকালে সাহাবিদেরকে অপমান
আবু তালুত বর্ণনা করেছেন, সায়্যিদুনা আবু বারযাহ রা. উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের (কুফায় নিযুক্ত উমাইয়া গভর্নর) কাছে আসলেন। ইবনে যিয়াদ তাঁকে দেখিয়ে বললঃ
إِنَّ مُحَمَّدِيَّكُمْ هَذَا الدَّحْدَاحُ فَفَهِمَهَا الشَّيْخُ فَقَالَ مَا كُنْتُ أَحْسِبُ أَنِّي أَبْقَى فِي قَوْمٍ يُعَيِّرُونِي بِصُحْبَةِ مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ لَهُ عُبَيْدُ اللَّهِ إِنَّ صُحْبَةَ مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم لَكَ زَيْنٌ غَيْرُ شَيْن
“তোমাদের এই মুহাম্মাদী (মুহাম্মদ ﷺ-এর সাহাবি) তো খাটো ও মোটা।” আবু বারযাহ রা. এই তাচ্ছিল্য বুঝতে পারলেন। তিনি বললেন, “আমি কোনোদিন ভাবিনি যে, আমাকে এমন একটি দলের মধ্যে বেঁচে থাকতে হবে, যারা আমাকে মুহাম্মদ ﷺ-এর সাহাবি হওয়ার জন্য অপমান করবে!” তখন ইবনে যিয়াদ (পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য) বলল, (তা নয়) সাহাবি হওয়া তোমার জন্য সম্মানজনক; অপমানজনক নয়।” [সংক্ষেপিত, সুনান আবি দাউদ; কিতাবুস সুন্নাহ]
আইদ ইবনে আমর রা. বর্ণনা করেছেন, তিনি একবার উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের কাছে গেলেন। তিনি তাকে বললেনঃ
إِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ إِنَّ شَرَّ الرِّعَاءِ الْحُطَمَةُ فَإِيَّاكَ أَنْ تَكُونَ مِنْهُمْ فَقَالَ لَهُ اجْلِسْ فَإِنَّمَا أَنْتَ مِنْ نُخَالَةِ أَصْحَابِ مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ وَهَلْ كَانَتْ لَهُمْ نُخَالَةٌ إِنَّمَا كَانَتِ النُّخَالَةُ بَعْدَهُمْ وَفِي غَيْرِهِمْ
“আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, “সবচেয়ে খারাপ শাসক হচ্ছে সে, যে নিষ্ঠুর।” অতোএব তুমি এরকম হওয়া থেকে বেঁচে থাকো। ইবনে যিয়াদ (রাগান্বিত হয়ে) বলল, “বসো! তুমি সাহাবিদের মধ্যকার এক খড়কুটো/আবর্জনা।” তিনি প্রতুত্তরে বললেন, “সাহাবিদের মধ্যে কি কেউ খড়কুটো ছিলেন? বরং খড়কুটো হচ্ছে তাঁদের পরবর্তীরা (তোমরা)।” [সহীহ মুসলিম; কিতাবুল ইমারাহ]
ইয়াযিদের হাতে হুসাইন রা. –এর বাই‘আত না দেয়ার কারণ
ক্ষমতায় আরোহন করে ইয়াযিদ সায়্যিদুনা হুসাইন ইবনে আলী রা. -এর বাই’আত নেয়ার জন্য জোরাজুরি করতে থাকেন। কিন্তু ইমাম হুসাইন রা. ইয়াযিদের হাতে বাই’আত দেননি। এর কারণ হিসেবে আমাদের মনে হয়-
১. মুআবিয়া রা. স্বীয় পুত্রকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেছেন। এটি ‘সুলহে হাসান’ এর শর্তের বিপরীত।
২. যেভাবে এককেন্দ্রিক মনোনয়ন ও জোরপূর্বক বাই’আত নেয়া হচ্ছিল, তা খোলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতের বিপরীত।
৩. خِلَافَةٌ عَلَى مِنْهَاجِ النُّبُوَّةِ তথা নববী আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। এটি না করে مُلْكًا عَاضًّا তথা দাঁত-কামড়ানো রাজতন্ত্রকে স্বীকার করে নেয়া সবল ঈমানের লক্ষণ নয়। সবল ঈমানদার সদা অন্যায়ের প্রতিবাদী। আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ
“তোমাদের মধ্যে কেউ কোনো অন্যায় হতে দেখলে সে যেন হাত (শক্তি) দিয়ে সেটি রুখে দেয়। এতে সক্ষম না হলে জবান দিয়ে, এতেও সক্ষম না হলে অন্তর দিয়ে। আর এটি (অন্তর দিয়ে ঘৃণা করা) দুর্বল ঈমানের লক্ষণ।” [সহীহ মুসলিম; কিতাবুল ঈমান]
বলাই বাহুল্য, হুসাইন রা. দুর্বল ঈমানের অধিকারী ছিলেন না। তাঁর ঈমান ছিল সীসার মতো মজবুত, শিশিরের মতো পরিচ্ছন্ন। বাল্যকাল তিনি পার করেছেন সৃষ্টিজগতের শ্রেষ্ঠজনের কোলে। ঈমান, আখলাক, ত্যাগ ও বীরত্ব হুসাইন মায়ের দুধের সাথেই পান করে এসেছেন। ইয়ালা ইবনে মুররাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
حُسَيْنٌ مِنِّي وَأَنَا مِنْ حُسَيْنٍ أَحَبَّ اللَّهُ مَنْ أَحَبَّ حُسَيْنًا حُسَيْنٌ سِبْطٌ مِنَ الأَسْبَاطِ
“হুসাইন আমার থেকে এবং আমি হুসাইন থেকে। যে হুসাইনকে ভালোবাসে, আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন। হুসাইন আমার বংশধরদের মধ্যে একজন (সম্মানিত) বংশধর।” [সুনান আত-তিরমিযি; কিতাবুল মানাকিব]
হুসাইন রা. এর শাহাদাতের ভবিষ্যদ্বাণী
আবদুল্লাহ ইবনে নুজায়-এর পিতা বর্ণনা করেছেন, একবার সফরকালে তাঁরা নিনওয়া নামক স্থান অতিক্রম করছিলেন। তখন আলী রা. চিৎকার দিয়ে বললেন, “হে আবু আবদিল্লাহ (হুসাইন) ফোরাতের তীরে ধৈর্য ধারণ করো।” বর্ণনাকারী বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? আলী রা. বললেনঃ
دَخَلْتُ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ وَعَيْنَاهُ تَفِيضَانِ قُلْتُ يَا نَبِيَّ اللَّهِ أَغْضَبَكَ أَحَدٌ مَا شَأْنُ عَيْنَيْكَ تَفِيضَانِ قَالَ بَلْ قَامَ مِنْ عِنْدِي جِبْرِيلُ قَبْلُ فَحَدَّثَنِي أَنَّ الْحُسَيْنَ يُقْتَلُ بِشَطِّ الْفُرَاتِ قَالَ فَقَالَ هَلْ لَكَ إِلَى أَنْ أُشِمَّكَ مِنْ تُرْبَتِهِ قَالَ قُلْتُ نَعَمْ فَمَدَّ يَدَهُ فَقَبَضَ قَبْضَةً مِنْ تُرَابٍ فَأَعْطَانِيهَا فَلَمْ أَمْلِكْ عَيْنَيَّ أَنْ فَاضَتَا
“আমি একদিন নবী ﷺ-এর ঘরে প্রবেশ করে দেখি তাঁর চোখ মোবারক পানিতে ভেজা। জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর নবী, কেউ কি আপনাকে নারাজ করেছে? আপনার চোখ ভেজা কেন? তিনি ﷺ বললেন, না বরং জিবরাইল কিছুক্ষণ আগে এসেছিলেন। বলে গেলেন, (আমার নাতি) হুসাইন ফোরাতের তীরে শহীদ হবে। তিনি (জিবরাইল) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি ওই মাটির ঘ্রাণ শুঁকতে চান?” আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি হাত বাড়িয়ে কিছু মাটি নিয়ে আমার হাতে দিলেন। ফলে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।” [মুসনাদ ইমাম আহমদ, ১/৮৫]
হুসাইন রা. –এর শাহাদাতের সংবাদ
কুফাবাসীর আমন্ত্রণে মক্কা মুকাররামাহ থেকে কুফায় যাওয়ার পথে ৬১ হিজরির ১০ই মুহররম ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা প্রান্তরে ইয়াযিদের প্রেরিত বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন সায়্যিদুনা হুসাইন রা.। তাঁর মাথা দেহ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। শহীদ হন আহলে বায়েতের আরও ১৮ জন সদস্যসহ মোট ৭২ জন পুরুষ [বিদায়াহ, ৮ম খণ্ড]। এরপর কুফা ও দামেস্কে আহলে বায়েতের বন্দী নারীদের সাথেও চরম অসদাচরণ করা হয়। যেহেতু ইতিহাস বর্ণনা করা আমাদের উদ্দেশ্য না, তাই এ ব্যাপারে দীর্ঘ কথা পরিহার করছি।
কারবালায় আহলে বায়েতের শাহাদাতের সংবাদ পৌঁছে যায় মক্কা-মদীনায়। আম্মার থেকে বর্ণিত, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেনঃ
رأيتُ النبيَّ صلَّى الله عليه وسلَّم في المنام بنِصْف النهار أشعثَ أغْبَرَ معه قارورةٌ فيها دمٌ يلتقطُه قال قلت يا رسول الله ما هذا قال دمُ الحسين وأصحابه لَم أزَلْ أتتبَّعُه منذُ اليومِ. قال عمَّار فحَفِظْنا ذلك اليوم، فوجَدْناه قُتِلَ ذلك اليوم
“আমি এক দুপুরবেলা নবী ﷺ-কে স্বপ্নে দেখলাম। তাঁর চুল অবিন্যস্ত, চেহারা ছিল ধুলোমাখা। হাতে এক শিশি রক্ত। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনার হাতে কী? তিনি ﷺ জবাব দিলেন, “হুসাইন ও তার সাথীদের রক্ত। আমি আজ (সকাল থেকে) এগুলো সংগ্রহ করছি।” বর্ণনাকারী আম্মার বলেছেন, “আমরা ওই দিনটি মনে রেখেছি এবং জানতে পেরেছি যে, ওই দিনেই হুসাইনকে শহীদ করা হয়েছে।” [মুসনাদ ইমাম আহমদ, ১/২৪২]
সালমা থেকে বর্ণিত, উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালামাহ রা. বলেছেনঃ
رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم تَعْنِي فِي الْمَنَامِ وَعَلَى رَأْسِهِ وَلِحْيَتِهِ التُّرَابُ فَقُلْتُ مَا لَكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ شَهِدْتُ قَتْلَ الْحُسَيْنِ آنِفًا
“আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে স্বপ্নে দেখলাম। তাঁর মাথা ও দাড়ি মোবারকে মাটি লেগে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনার কী হয়েছে? তিনি ﷺ বললেন, “এইমাত্র দেখে আসলাম হুসাইনকে হত্যা করা হয়েছে।” [সুনান আত-তিরমিযি; কিতাবুল মানাকিব]
কারবালার ঘটনায় সাহাবা–তাবেয়ীদের প্রতিক্রিয়া
ইমাম ইবনে কাসির (বিদায়াহ, ৮ম খণ্ড) বলেছেন, স্বপ্ন দেখে ইবনে আব্বাস রা. চিৎকার দিয়ে বললেন, “ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হুসাইন শহীদ হয়েছেন।”
শাহার ইবনে হাউশাব বর্ণনা করেছেনঃ
سمعت أم سلمة تقول حين جاء نعي الحسين بن علي لعنت أهل العراق وقالت قتلوه قتلهم الله غروه وذلوه لعنهم الله
“হুসাইন রা. -এর সংবাদ উম্মে সালামাহ রা. -এর কাছে পৌঁছালে তিনি ইরাকবাসীকে লা’নত করে বললেন, “তারা তাঁকে হত্যা করেছে, আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন। তারা তাঁকে ধোকা দিয়েছে এবং অপদস্থ করেছে, তাদের প্রতি আল্লাহর লা’নত বর্ষিত হোক।” [মুসনাদ ইমাম আহমদ, ৬/২৯৮]
ইবনে আবি নু’ম বর্ণনা করেছেন, কিছু লোক মুহরিম অবস্থায় মাছি মারা যায় কিনা এ ব্যাপারে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-কে প্রশ্ন করেছিল। তিনি জবাব দিলেনঃ
أَهْلُ الْعِرَاقِ يَسْأَلُونَ عَنِ الذُّبَابِ وَقَدْ قَتَلُوا ابْنَ ابْنَةِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم
“ইরাকবাসী মাছি মারা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে এসেছে। অথচ তারা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দৌহিত্রকে হত্যা করেছে।” [সহীহ বুখারী; কিতাবু ফাদ্বায়িলি আসহাবিন নাবী]
ইমাম আসকালানী (আল-ইসাবাহ) ও ইমাম তাবরানী (মু’জামুল কাবীর) বর্ণনা করেছেন, ইমাম ইবরাহিম নাখয়ী তাবেয়ী বলেছেনঃ
لو كنت فيمن قتل الحسين ثم أدخلت الجنة لاستحييت أن أنظر إلى وجه النبي صلى الله عليه وسلم
“যদি আমি হুসাইন রা. -এর হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতাম, এরপর জান্নাতেও প্রবেশ করতাম, তবুও (হুসাইন হত্যার কারণে) জান্নাতে আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে মুখ দেখাতে লজ্জাবোধ করতাম।”
আহলে বায়েতের অবস্থান ও মর্যাদা
হুযায়ফা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
إِنَّ هَذَا مَلَكٌ لَمْ يَنْزِلِ الأَرْضَ قَطُّ قَبْلَ هَذِهِ اللَّيْلَةِ اسْتَأْذَنَ رَبَّهُ أَنْ يُسَلِّمَ عَلَىَّ وَيُبَشِّرَنِي بِأَنَّ فَاطِمَةَ سَيِّدَةُ نِسَاءِ أَهْلِ الْجَنَّةِ وَأَنَّ الْحَسَنَ وَالْحُسَيْنَ سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلِ الْجَنَّةِ
“এই ফিরিশতা, যিনি আজ রাতে পৃথিবীতে এসেছেন, তিনি ইতিপূর্বে আর কখনও যমিনে অবতরণ করেননি। তিনি তাঁর প্রতিপালকের কাছ থেকে এই মর্মে অনুমতি নিয়ে এসেছেন যে, তিনি আমাকে সালাম জানাবেন এবং সুসংবাদ দেবেন যে, (আমার কন্যা) ফাতিমা জান্নাতি রমণীদের সর্দার এবং (আমার নাতিদ্বয়) হাসান ও হুসাইন জান্নাতি পুরুষদের সর্দার।” [সুনান আত-তিরমিযি; কিতাবুল মানাকিব]
আহলে বায়েতের প্রতি সাহাবির মুহাব্বাত
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, সায়্যিদুনা আবু বকর সিদ্দীক রা. বলেছেনঃ
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَقَرَابَةُ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَحَبُّ إِلَىَّ أَنْ أَصِلَ مِنْ قَرَابَتِي
“কসম সেই সত্ত্বার যার হাতে আমার প্রাণ, রাসূলুল্লাহ এর পরিবার-নিকটাত্মীয়দের প্রতি উত্তম আচরণ করা আমার কাছে আমার নিজের পরিবার-নিকটাত্মীয়দের প্রতি উত্তম আচরণ করার চেয়ে অধিক প্রিয়।” [সহীহ বুখারী; কিতাবু ফাদ্বায়িলি আসহাবিন নাবী]
ইয়াযিদ বাহিনীর মক্কা–মদীনা আক্রমণ
কারবালার পর মদীনার বাসিন্দারা ইয়াযিদের বাই’আত ত্যাগ করেন [মুত্তাফাকুন আলাইহি]। ফলশ্রুতিতে ইয়াযিদ প্রায় ১১ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। মদীনার অদূরবর্তী হাররা নামক স্থানে বনু উমাইয়া ও ইয়াযিদ বাহিনীর সাথে মদীনাবাসীর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ ব্যাপারে সংবাদ দিয়েছিলেন খোদ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ। আইয়ুব ইবনে বাশির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ হাররা নামক স্থান অতিক্রম করার সময় বলেছেনঃ
يقتل بهذه الحرة خيار أمتي بعد أصحابي
“এই হাররায় এমন মানুষেরা শহীদ হবেন, যারা সাহাবিদের পরে আমার উম্মতের শ্রেষ্ঠ মানুষ।” [দালায়িলুল নুবুয়্যাহ, ৬/৪৭৩]
যুদ্ধের পর ইয়াযিদের অনুমোদন সাপেক্ষে তার সৈন্যরা মদীনায় সীমাহীন হত্যাকাণ্ড, লুটতরাজ চালায় [বিদায়াহ, ১১শ খণ্ড]। উল্লেখ্য, মদীনা মুনাওয়ারায় যুদ্ধবিগ্রহ করা নিষিদ্ধ। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺবলেছেনঃ
الْمَدِينَةُ حَرَمٌ مِنْ كَذَا إِلَى كَذَا لاَ يُقْطَعُ شَجَرُهَا وَلاَ يُحْدَثُ فِيهَا حَدَثٌ مَنْ أَحْدَثَ حَدَثًا فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلاَئِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ
“মদীনা এখান থেকে ওখান পর্যন্ত হারাম। এর বৃক্ষরাজি কর্তন করা যায় না এবং এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যায় না। যে ব্যক্তি মদীনায় বিশৃঙ্খলা/দুর্ঘটনা সংঘটিত করবে, তার ওপর আল্লাহর লা’নত, আল্লাহর ফেরেশতা ও সমগ্র মানবজাতির লা’নত।” [সহীহ বুখারী; কিতাবু ফাদ্বায়িলুল মাদীনা]
মদীনাবাসীর সাথে সামান্য দুর্ব্যবহার জাহান্নামে স্থান করে নেয়ার জন্য যথেষ্ট। আবু হুরায়রা রা. ও সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
وَلاَ يُرِيدُ أَحَدٌ أَهْلَ الْمَدِينَةِ بِسُوءٍ إِلاَّ أَذَابَهُ اللَّهُ فِي النَّارِ ذَوْبَ الرَّصَاصِ أَوْ ذَوْبَ الْمِلْحِ فِي الْمَاءِ
“যে ব্যক্তি মদীনার মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করার (কেবল) ইচ্ছা পোষণ করবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুনে সীসার মতো গলিয়ে দেবেন। অথবা লবন যেভাবে পানিতে গলে যায়।” [সহীহ মুসলিম; কিতাবুল হাজ্জ]
এরপর ইয়াযিদ বাহিনী بَلَدًا آمِنًا বা নিরাপদ শহর মক্কা শরীফে সায়্যিদুনা আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা. ও তাঁর সাথীদের ওপর মিনজানিক বা পাথরগোলা দিয়ে হামলা করে। এতে উম্মতের কিবলাহ কা’বা শরীফ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। [ফাতহুল বারী, ৮ম খণ্ড]
যারা আহলে ইসলামের ওপর এত যুলুম করেছে, আহলে বায়েতকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, মক্কা-মদীনায় হামলা করেছে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দিয়েছে, তাদের ব্যাপারে আমরা পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত উল্লেখ করতে চাই। আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া-তা’আলা বলেছেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ يُؤْذُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا مُّهِينًا
“যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, তাদের প্রতি দুনিয়া-আখেরাতে আল্লাহর লা’নত। এবং তাদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে লাঞ্চনাদায়ক শাস্তি।” [সুরা আহযাব: ৫৭]
শেষকথা
উল্লেখিত হাদিস ও উলামায়ে কেরামের বিশ্লেষণকে সামনে রাখলে এ কথা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, কারবালার নির্মম হত্যাকাণ্ড হঠাৎ করে সামনে এসে হাজির হয়নি। বরং এটি দীর্ঘদিনের উত্তরোত্তর অবনতির শেষ পরিণাম। উসমান রা. -এর শাহাদাতের পর থেকে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, খেলাফতের পরিবর্তে দাঁত-কামড়ানো রাজতন্ত্রে পদার্পণ, গোত্রকেন্দ্রিক প্রতিযোগ এবং আহলে বায়েতের প্রতি নানাবিধ অবিচার ধীরে ধীরে কারবালাকে তরান্বিত করেছে। ইয়াযিদ বা ইবনে যিয়াদরা আসমান থেকে নাযিল হয়নি। বরং চলমান প্রতিহিংসাপরায়ণ সংস্কৃতির দূষিত উপজাত হিসেবে এদের উত্থান ঘটেছিল। এর ফলেই সংঘটিত হয়েছিল কারবালা-হাররা। পরিশেষে আবারও বলছি, কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতি সমালোচনার তীর ধার্য করা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না। ইতিহাসের এই গভীর গিরিখাতে প্রবেশ করে নিরপেক্ষভাবে সত্য তালাশ করার পেছনে আমাদের একমাত্র অভিপ্রায় হচ্ছে আহলে বায়েতের মুহাব্বাত। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
أَحِبُّوا اللَّهَ لِمَا يَغْذُوكُمْ مِنْ نِعَمِهِ وَأَحِبُّونِي بِحُبِّ اللَّهِ وَأَحِبُّوا أَهْلَ بَيْتِي لِحُبِّي
“তোমরা আল্লাহকে মুহাব্বাত করো। কেননা তিনি তোমাদেরকে তাঁর নিয়ামত দিয়ে প্রতিপালন করছেন। আর তোমরা আল্লাহর মুহাব্বাতের জন্য আমাকে মুহাব্বাত করো এবং আমার মুহাব্বাতের জন্য আমার আহলে বায়েতকে মুহাব্বাত করো।” [সুনান আত-তিরমিযি; কিতাবুল মানাকিব]
اللهم صلي على محمد وعلى آل محمد وعلى أصحاب محمد وسلّم تسليما كثيرا
লেখক: মারজান আহমদ চৌধুরী