জাফরান, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় Saffron. জাফরান নামটি শুনলেই একটি রাজকীয় কিছুর কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়বেই না কেন? এটা যে রাজকীয় একটি মশলা-জাত বস্তু। সাধারণ মানুষ খুব কমই এটা ব্যবহার করে থাকতো। এটা ছিল সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। সেই প্রাচীন গ্রিক সময় থেকে এটার ব্যবহার হয়ে আসছে খাদ্যে, রূপচর্চায় বা রোগ নিরাময়ে। এটা অকৃত্রিম অনন্য স্বর্গীয় ঘ্রাণ ও ঐশ্বর্যময়ী রঙ বিমোহিত করে ফেলবে চেয়ে কাউকে। এটা উদ্ভিদ থেকে হয় সত্য— কিন্তু এটার উৎপাদন খরচ এবং সীমিত হওয়ার কারণে এটার দাম অনেক বেশি। এজন্য এটাকে বিশ্বের সবচাইতে দামি মসলা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অনেকে তো এটাকে ‘রেড গোল্ড’ বলে ডাকে।
এই জাফরান শব্দটি এসেছে ইরান থেকে। কেননা ইরানেই এটার সবচাইতে বেশি চাষ করা হয়। তাদের শিল্পকলা এমনকি সাহিত্যেও এটার উল্লেখ আছে। সেই প্রাচীন গ্রীক ও ভারতীয় সভ্যতাতেও জাফরানের ব্যবহার ছিল।
জাফরান অত্যন্ত দামি। কিন্তু বর্তমানে অনেক সৌখিন মানুষ আছে যারা ক্ষুদ্র পরিসরে জাফরানের ব্যবহার করে থাকে। বিশেষ করে কাচ্চি বিরিয়ানি, রোস্ট, খাসির রেজালা তৈরি সময় বিশেষ স্বাদ আনতে এটার ব্যবহার হয়। এ ছাড়া আজকাল রূপচর্চায় এটার প্রচুর ব্যবহার দেখা যায়। যেহেতু এটা খুবই দামি তাই নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এখনো হাতের নাগালে আসতে পারেনি। আজ এই বিলাসী বস্তু নিয়ে আমাদের এই ‘জাফরানের উপকারিতা’ আর্টিকেল। এটা পড়ার পর আশা করি জাফরান সম্পর্কে অনেক তথ্য আপনাদের জানা হয়ে যাবে।
জাফরান চাষ
জাফরান গাছ খুব একটা বড় হয় না। এটা নির্বীজ এক ধরনের উদ্ভিদ। পেঁয়াজের মতো এর কাণ্ড হয়।
এটা চাষ করার জন্য আবহাওয়া, মাটি ও অঞ্চল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যই এটা বিশ্বের সব দেশে চাষ করা সম্ভব হয় না।
জাফরান চাষ করতে হলে প্রচুর জনবল প্রয়োজন। কেননা জাফরান গাছ খুবই যত্ন সহকারে লাগাতে হয়। এটা থেকে বেগুনি রঙের ফুল ফোটে। ওই ফুলের মধ্যে তিনটি করে লাল রঙের রেণু দণ্ড থাকে। ওগুলোই মূলত জাফরান। খুব ধৈর্য ও সময় ব্যয় করে খুব সাবধানে সেগুলো সংগ্রহ করতে হয়। এখানে কোনো মেশিনের সাহায্য নেওয়া যায় না। ফলে এর উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি বেড়ে যায় এবং এটার দামও বাজারে অত্যন্ত বেশি।
আরও পড়ুন: ডাবের পানির উপকারিতা ও অপকারিতা
বিশ্বের সর্বপ্রথম ইরানেই জাফরানের চাষ শুরু হয়েছে। এমনকি বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ জাফরান ইরান থেকে আসে।
ভারতের কাশ্মীর রাজ্য গুলোতে বিশ্বের পাঁচ থেকে সাত শতাংশ কাশ্মীর উৎপাদন করা হয়।
স্পেনে প্রায় দুই থেকে তিন শতাংশ উৎপন্ন হয়ে থাকে।
গ্রিসে এক থেকে দুই শতাংশ। আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিম দেশ মরক্কোতে এক শতাংশ জাফরান চাষ হয়।
সাম্প্রতিক কালে আফগানিস্তানে জাফরার চাষ হচ্ছে।
জাফরানের পুষ্টিমান
জাফরান অত্যন্ত দামি একটি বস্তু। চাইলেও কেউ এটা বেশি পরিমাণে খেতে পারে না। এটা মূলত কেউ পুষ্টির জন্য খায় না। এটা দামি খাবারে স্বাদ এবং রঙের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। জাফরানের অসংখ্য গুণাবলী রয়েছে। তবে আপনাদের কৌতুহল দমনের জন্য জাফরানের পুষ্টিমান নিচে উল্লেখ্য করা হলো।
১০০ গ্রাম জাফরানের পুষ্টিমান—
- ক্যালোরি ৩১০ কিলো জুল
- প্রোটিন ১১.৪ মিলি গ্রাম
- ফ্যাট ৫.৯ মিলি গ্রাম
- কার্বোহাইড্রেট ৬৫.৪ মিলি গ্রাম
- ফাইবার ৩.৫ মিলি গ্রাম
- সুগার ০.৬ মিলি গ্রাম
- ভিটামিন সি ৪০ মিলি গ্রাম
- ভিটামিন এ ৫৩০ IU
- ভিটামিন বি৯ ৯৩ মাইক্রো গ্রাম
- ভিটামিন বি২ ০.২৭ মিলি গ্রাম
- আয়রন ১১.১ মিলি গ্রাম
- ম্যাগনেসিয়াম ২৬৪ মিলি গ্রাম
- পটাশিয়াম ১৭২৪ মিলি গ্রাম
- ক্যালসিয়াম ১১১ মিলি গ্রাম
- জিংক ১.০৯ মিলি গ্রাম
- ম্যাঙ্গানিজ ২৮.৪ মিলি গ্রাম
- কপার ০.৩৩ মিলি গ্রাম
*উল্লেখিত পুষ্টিমান বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিভিন্ন রকম দেখায়। তাই এটা নিয়ে আরো বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন।
জাফরানের উপকারিতা
জাফরানের অনেক উপকারিতা রয়েছে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি — যে সকল খাদ্য তৈরিতে জাফরান ব্যবহার করা হয় সেগুলো মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে অতটা উপকারী নয়। যেমন ধরুন মিষ্টি। এটাতে স্বাদ বৃদ্ধি ও রঙের জন্য জাফরান ব্যবহার করা হয়। কিন্তু মিষ্টি একটু বেশি খেলেই মানুষের নানান ধরনের জটিলতা তৈরি হতে পারে। তবুও জাফরান বিভিন্ন উপকার সাধন করে থাকে। যদিও এটা বেশি পরিমাণে কেউ খায় না এর অধিক মূল্যের জন্য।
পড়ে নিন: শসার উপকারিতা ও অপকারিতা
এখানে জাফরানের কিছু উপকারিতা উল্লেখ করা হলো।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান সমৃদ্ধ জাফরান: জাফরানে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদান যেগুলো মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থেকে মুক্ত করতে জাফরান সাহায্য করে। রক্ত পরিশুদ্ধ করার জন্য জাফরানের ভূমিকা রয়েছে।
স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে: গবেষণায় দেখা গেছে যে— জাফরান স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এর মধ্যে এমন এক বিশেষ ধরনের উপাদান রয়েছে যেগুলো মস্তিষ্কের সুক্ষ্ম শিরা উপশিরা সুস্থ রাখে। নিউরন গুলোকে সতেজ রাখে। ফলে মানুষের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়।
হৃদরোগ থেকে দূরে রাখে: হৃদযন্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়ে মূলত এতে চর্বি জমে গেলে। এছাড়া হৃদযন্ত্রে আসা রক্তনালীতে চর্বি তথা কোলেস্ট্রল জমে গেলে রক্ত চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। জাফরান কোলেস্ট্রল দূর করতে সাহায্য করে। এতে করে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায় এবং হৃদপিণ্ড সঠিকভাবে কাজ করতে পারে।
ওজন কমাতে জাফরান: জাফরান খেলে ক্ষুধা লাগা কমে যায়। ক্ষুধা কমে গেলে মানুষ খাবার কম খায় এবং ওজন বৃদ্ধির প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। যাদের ওজন বেশি তাদের জন্য জাফরান উপকারী প্রমাণিত হতে পারে।
ক্যান্সার রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে: একটি গবেষণায় দেখা গেছে জাফরান ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। তবে এটা নিয়ে আরো ব্যাপক গবেষণা চলছে।
চোখের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় জাফরান: জাফরান চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি করে। চোখের সুস্থতায় জাফরান খেতে পারেন অনেকেই। এর মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান চোখের জীবাণু নাশ করতে সাহায্য করে।
ত্বকের যত্নে জাফরান: ত্বকের যত্নে জাফরানের ব্যবহার হয়ে থাকে। সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিত্তশালীদের রূপচর্চায় জাফরান ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রসাধনী হিসেবে কিভাবে জাফরান ব্যবহার করবেন তা নিচে উল্লেখ করা হবে।
প্রসাধনীতে জাফরান
আগেরকার যুগের রাজা-বাদশাহদের হেরেমে রাণীদের রূপচর্চার জন্য জাফরানের ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানি জাফরান দিয়ে নির্মিত ক্রিম, লোশন ইত্যাদি তৈরি করে। তবে ওই সকল ক্রিম বা লোশনের কতটুকু জাফরান থাকে এবং সেটার কতটুকু উপকার মানুষ পেতে পারে সেটা নিয়ে সন্দেহ থাকে। তাই আপনাদের জন্য একদম প্রাকৃতিক উপায়ে রূপচর্চার কয়েকটি পদ্ধতি নিচে উল্লেখ করা হলো।
কাঁচা দুধে জাফরান: কাঁচা দুধ শরীরের ব্যবহার করলে শরীরের ময়লা দূর হয়। কাঁচা দুধের সাথে যদি আপনি কয়েকটি জাফরান মিশিয়ে নিতে পারেন তাহলে সেটা ময়লা দূর করার পাশাপাশি ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করবে।
জেনে নিন: কাঁচা পেঁপের উপকারিতা ও অপকারিতা
জাফরান ও চন্দনের ফেসমাস্ক: ফেসমাস্ক হিসেবে বাজারে বিভিন্ন ধরনের প্রোডাক্ট পাওয়া যায়। কিন্তু ওগুলোতে অসংখ্য ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। যা ত্বকের জন্য অদূর ভবিষ্যতে অতি ক্ষতিকর হতে পারে। তাই প্রাকৃতিক উপায়ে জাফরান দিয়ে ফেসমাস্ক তৈরি করতে পারেন।
দুই চামচ চন্দনের গুড়া ও এক চিমটি জাফরান অর্গানিক গোলাপজলের সাথে মিশিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিন। এরপর এটা মুখে দিয়ে কমপক্ষে বিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। সপ্তাহে দুইবার ব্যবহার করলে ভালো উপকার পাওয়া যায়।
জাফরান ও গোলাপজলের টোনার: গোসলের পর কৃত্রিম ক্রিম না মেখে এই টোনার ব্যবহার করতে পারেন। এক থেকে দুইটি জাফরান নিয়ে দুই চামচ অর্গানিক গোলাপজলের সাথে মিশিয়ে রাখুন কিছুক্ষণ। এরপর অল্প অল্প করে সেটা মুখে ম্যাসাজ করুন। এতে করে মুখ থাকবে দীর্ঘক্ষণ কোমল ও আর্দ্র। এছাড়া রঙ হবে আরো উজ্জ্বল উদ্দীপ্ত।
জাফরান ও ব্রাউন সুগারের স্ক্রাব: শরীরের ময়লা দূর করতে স্ক্রাব করা হয়। বাজারে অনেক প্রকারের স্ক্রাব পাওয়া যায়। তবে জাফরানের তৈরি স্ক্রাব ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায় বেশি।
ব্রাউন সুগার অর্থাৎ দেশি লাল চিনির সাথে কাঁচা দুধ এবং একটু জাফরান মিশিয়ে এটা শরীরে ভালোভাবে মেখে ডলতে হবে। এতে করে ত্বকের সকল ময়লা উঠে যাবে এবং শরীর হবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও কোমল উজ্জ্বল।
জাফরানের অপকারিতা
জাফরান সাধারণত কেউ বেশি পরিমাণে খায় না এবং খেতেও পারবে না। কেননা এটার উচ্চ মূল্য এটা কি মানুষের হাতের নাগাল থেকে দূরে রেখে দেয়। ১ গ্রাম জাফরানের দাম পাঁচশত টাকা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ওষুধ হিসাবে এটার বেশি প্রয়োগ করলে কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
- যাদের অ্যালার্জি আছে, তাদের অনেক সময় এলার্জি বৃদ্ধি পেতে পারে।
- অতিরিক্ত খেলে মাথা ব্যথা এবং মাথা ঘোরা ও বমি হতে পারে।
- গর্ভবতী মহিলাদের জরায়ু সংকোচনের ফলে বাচ্চা প্রসবের সময় মারাত্মক ঝামেলা হতে পারে।
- অনেক সময় নিদ্রাহীনতা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে অনেকে জাফরানের চা তৈরি করে খান। তাদের এই সমস্যা হতে পারে।
উপসংহার
জাফরানের অত্যাধিক মূল্য হওয়ার কারণে এটার অনেক নকল বাজারে পাওয়া যায়। অনেক অসাধু মানুষ কদম ফুলের পাপড়ি দিয়ে এই জাফরান তৈরি করে। কদম ফুলের পাপড়ি গুলো শুকিয়ে এর সাথে কমলা রঙ মিশিয়ে নকল জাফরান তৈরি করা হয়। তাই জাফরান ক্রয় করার আগে ভালোভাবে পরীক্ষা করে নিতে হবে। কেননা নকল জাফরান মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ হতে পারে।