আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস বা বিশ্ব বাঘ দিবস সমস্ত বিশ্বে বাঘ সংরক্ষণ করার জন্য ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রত্যেক বছর ২৯ জুলাই এই দিবস পালন করা হয়। এই দিবস পালন করার মূল উদ্দেশ্য হলো— বাঘের প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংরক্ষণ করা এবং বাঘের রক্ষায় সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। বাঘের সম্পর্কে থাকা ভুল ধারণা ও ভয় দূর করা। প্রত্যেক বছর বিভিন্ন কার্যসূচীর মধ্য দিয়ে এই দিবস পালিত হয়। বাঘ ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় পশু হওয়ার কারণে এই দিবসের গুরুত্ব ও মহত্ব এখানে বেশি।
বিশ্ব বাঘ দিবসের উৎপত্তি
বিশ্ব বাঘ দিবস আজ। এই বাঘ প্রজাতির সকল প্রাণীর সংকট তীব্র আকারে দেখা দিয়েছে। এমনকি এদের মধ্যে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই কারণেই ২০১০ সালের ২৯ জুলাই রাশিয়ায় প্রথমবারের মতো বাঘ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
ওই সম্মেলনে আগামী ১২ বছরে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণে পরিণত করার অঙ্গীকার করা হয়।
এরই প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিকভাবে বাঘ আছে এমন দেশে বাঘ সংরক্ষণে বিশেষ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হতে শুরু হয়। বাংলাদেশেও এর একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মসূচি চলছে। এতে বন বিভাগের সাথে ওয়াইল্ড টিম এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সাহায্য করছে।
বাংলাদেশে বাঘের গুরুত্ব
বাঘ বাংলাদেশের জাতীয় পশু। তাই এটাকে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বলে ডাকা হয়। কেননা এটার ডোরাকাটা দেহ দেখতে চমৎকার ও অন্তত সুন্দর।
ঐতিহাসিকভাবে পুরো বাংলাদেশে আগে বাঘের ছিল অবাধ বিচরণ। কিন্তু কালের পরিক্রমায় বন জঙ্গল ধ্বংস হতে হতে আজ বাঘ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে গিয়ে ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু বাঘের ওটা আদি নিবাস নয়। ওই কর্দমাক্ত লবনাক্ত জলাভূমিতে বাঘের বাস করা কষ্টকর হলেও সেখানে বাঘ নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। বাংলার বাঘ মূলত বাঙালির মতোই সমতল ভূমির জঙ্গলের প্রাণী।
আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাস, তাৎপর্য ও উদযাপন
বাঘ জঙ্গলের জীববৈচিত্র্য ও খাদ্যশৃঙ্খল রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খলের সবচাইতে উপরে রয়েছে বাঘ। বলা হয়ে থাকে, সুন্দরবনের প্রহরী এই বাঘ। তবে দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে— রয়েল বেঙ্গল টাইগার সমগ্র দেশের মধ্যে শুধু এই সুন্দরবনেই বিচরণ করে।
মধু, কাঠ, মাছ ইত্যাদি সংগ্রহ করার জন্য মানুষ সুন্দরবনে প্রবেশ করে। কিন্তু প্রতিবছরই ওই সকল মানুষের সাথে দুর্ঘটনা ঘটার খবর শোনা যায়। তবে এখন আর তেমন একটা শোনা যায় না। আগেতো বাঘ লোকালয়ে মানুষের উপর আক্রমণ করতো অথবা গরু-ছাগল শিকার করত। কেননা জঙ্গলে তখন পর্যাপ্ত শিকার থাকত না। তবে এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক।
তাছাড়া এখন বাঘ সম্পর্কে মানুষের ধারণাও পাল্টে গেছে। বাঘের গুরুত্ব ও টিকিয়ে রাখতে ওয়াইল্ড টিম একটি স্বেচ্ছাসেবী দল গড়ে তুলেছে। যারা শুধু বাঘই নয়— বরং যে কোনো বন্যপ্রাণী লোকালয়ে আসলে তা উদ্ধার করে জঙ্গলে ছেড়ে দেয়।
এই সম্মেলনের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ভুটানে বাঘের সংখ্যা ইতিমধ্যে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। নেপাল ও ভারতেও বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশও বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাঘের চোরা শিকারীদের গ্রেফতার করা। নিয়মিত টহল ও পাহারা জোরদার করা। কেননা বাঘের সংখ্যা কমার জন্য এই চোরা শিকারীরা অনেকাংশে দায়ী। ওরা বাঘের চামড়া উচ্চ দামে কালো বাজারে বিক্রি করে।
এছাড়া জঙ্গলে হরিণ, বন্য শুকর বৃদ্ধির কাজ চলছে। যাতে করে খাদ্য সংকট তৈরি না হয় এবং বাঘ লোকালয়ে চলে না আসে।
বাংলাদেশের বাঘ সংরক্ষণের জন্য জনগণকেও সচেতন হতে হবে। এটা নিয়ে আলোচনা ও জনমত গঠন করতে হবে।
এশিয়ায় বাঘ সংরক্ষণ প্রচেষ্টা
প্রতিটা দেশেই মোটামুটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তর দেশ ভারত— ঐতিহাসিকভাবে ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলে বাঘ ছিল। তবে এখন সেটা শুধুই ইতিহাস। ভারতের সুন্দরবনে এখনো বাঘ রয়েছে। তবে একটা সময় ভারতে অনেক চিতা বাঘ ছিল। যেগুলো আজ বিলুপ্ত। মূলত ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ সৌখিন মানুষদের দ্বারা শিকারের ফলে এই ভারতীয় চিতা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
পরবর্তীতে ২০২২ সালের জানুয়ারীতে ভারত সরকার কুনো জাতীয় উদ্যানে চিতাদের পুনঃপ্রবর্তনের বিশাল পরিকল্পনা হাতে নেয়।
কিন্তু এই পার্কে কোনো ভারতীয় চিতার আগমন ঘটেনি। এগুলো সব আফ্রিকা থেকে আমদানি করা।
ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসের দিকে চার থেকে ছয় বছর বয়সী পাঁচটি মহিলা এবং তিনটি পুরুষ চিতা আফ্রিকার নামিবিয়া দেশ থেকে কুনো জাতীয় উদ্যানে আমদানি করে ছাড়া হয়েছিল। পরবর্তী বছর আরো ১২টি চিতা সেখানে ছাড়া হয়। সর্বশেষ তথ্য মতে শোনা গেছে চারটি শাবক জন্ম নিয়েছে।
জেনে নিন: বিশ্ব ভালোবাসা দিবস – ভ্যালেন্টাইন ডে
কিন্তু ফলাফল অতীব দুঃখের! একে তো এ সকল চিতা ভারতীয় চিতা নয়। দ্বিতীয়ত এই চিতাগুলো এই জঙ্গলের জন্য উপযোগী হয়ে উঠতে পারিনি। কেননা একটি চিতা কমপক্ষে একশো বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে থাকতে পছন্দ করে। এই শত কিলোমিটার এর মধ্যে সে অন্য চিতা বাঘকে সহ্য করতে পারে না। ১০০ বর্গ কিলোমিটার তার স্বাচ্ছন্দময় জায়গা হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু ভারতের কুনো ন্যাশনাল পার্ক প্রায় ৭৮৮ বর্গ কিলোমিটার। যেখানে দশটির বেশি চিতা থাকতে পারবে না। চিতার এই বৈশিষ্ট্যের কারণে ভারতে চিতার পুনঃপ্রবর্তন ঝুঁকিপূর্ণ রয়ে গেল।
বন্যরা বনে সুন্দর; শিশুরা মাতৃক্রোড়ে
“বিশ্বের বনাঞ্চলে যতো বাঘ আছে, তার প্রায় দ্বিগুণ আছে আমেরিকায়।”
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। কিন্তু আমেরিকার এসব বঘগুলো রয়েছে সব বন্দি অবস্থায়। সেখানকার বনাঞ্চলে মুক্ত কোনো বাঘ নেই।
বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, বাঘ মূলত এশিয়া মহাদেশের একটি প্রাণী। বিশ্বে যতো প্রজাতির বাঘ আছে সেগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র একটি প্রজাতি সাইবেরিয়ান টাইগার আছে রাশিয়ায়। এছাড়া বাকি সব বাঘ ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, চীনসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের বনাঞ্চলে মুক্তভাবে জীবন ধারণ করে আছে।
তাই দেখা যায় যে— আমেরিকায় যত বাঘ রয়েছে সেগুলোর শিকড় মূলত এই এশিয়া। এখান থেকে তারা বাঘগুলো নিয়ে আমেরিকার প্রজননের মাধ্যমে এত পরিমান সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে।
আমেরিকায় বাঘের উপর নানান ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করা হয়। বাঘ এবং সিংহের মিলনের ফলে উৎপন্ন সংকর প্রজাতির বাঘ সেখানে রয়েছে। এভাবেই তারা বিভিন্ন ধরনের জাতের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ঐ সকল নব্য সংকর জাতের বাঘের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি রয়েই যায়। যেটা নিয়ে বন্যপ্রাণী অধিকার সংস্থার ব্যাপক আপত্তি রয়েছে।
সেখানে বাঘ পালনে বাধা নেই?
সারা বিশ্বে বাঘ আছে প্রায় ৩৮৯০ টির মতো। কিন্তু খোদ আমেরিকাতেই আছে সাত হাজারের চেয়ে বেশি বাঘ। পার্থক্য একটাই— আমেরিকার বাঘগুলো সব মালিকানা এবং বন্দি। আর বিশ্বের অন্যান্য বাঘগুলো বেশিরভাগ মুক্ত স্বাধীন।
আমেরিকার ৩৫টি রাজ্যে বাঘ পালন করা নিয়ে আইন রয়েছে তবে তা অত কঠোর নয়। কিন্তু অন্যান্য রাজ্যসমূহে বাঘ পালন একদম বৈধ এবং পোষা কুকুর বিড়ালের মতোই বাঘ পালন করা হয়— যা জনজীবনে হুমকি স্বরূপ।
তবে প্রাণী অধিকার কর্মী এবং মানবাধিকার কর্মীগণ এটা নিয়ে খুব তীব্র প্রতিবাদ করছে। আশা করা যায় খুব দ্রুত সমগ্র আমেরিকা জুড়ে বাঘ পালন সম্পর্কে কঠোর আইন বাস্তবায়ন হবে।
আমেরিকায় বাঘের সংখ্যা বেশি কেন?
বন্য পরিবেশে একটি বাঘ একসাথে তিন থেকে চারটি বাচ্চা দেয়। কিন্তু জঙ্গলের প্রতিকূল পরিবেশে তিন থেকে চারটি বাচ্চার মধ্যে মাত্র একটি টিকে থাকে। কখনো সেটাও টিকে থাকে না। এইজন্য জঙ্গলে বাঘের জন্মহার অনেক কম। তাছাড়া বনাঞ্চল ধ্বংস ও নগরায়নের ফলে তীব্র খাদ্য ও বাসস্থান সংকট দেখা দিচ্ছে এশিয়ার সকল বন্যপ্রাণীদের। ফলে বাঘের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
অপরদিকে আমেরিকায় নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বাঘ লালন-পালন করা হয়। সেখানে প্রতিটি বাঘ গড়ে বিশ বছর বাঁচে। এর মধ্যে যদি তিন বছর অন্তর অন্তর তিন থেকে চারটি করে বাচ্চা দেয় তাহলে তার আয়ুষ্কালে কতগুলো বাচ্চা হবে চিন্তা করে দেখুন! এছাড়া সেখানে প্রতিটা বাচ্চাকে আলাদা ভাবে যত্ন সহকারে রাখা হয়। খাদ্য সঠিকভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করা হয়। ফলে বাঘের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়ে চলছে আমেরিকায়। কিন্তু শত কিছুর পরেও জঙ্গলের প্রাণীকে এভাবে গৃহস্থলী পোষা প্রাণীতে রূপান্তর করাটা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়।
আরও জানুন: ২১শে ফেব্রুয়ারি | আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
ইতিমধ্যে আমেরিকায় বাঘ সংরক্ষণ নিয়ে বেশ কিছু প্রাণী অধিকার সংরক্ষণ সংস্থা আমেরিকান সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করছে। ফলে বেশ কিছু রাজ্যে বাঘ পালনের জন্য অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে আমেরিকার সহ বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতেও মুক্তভাবে বন জঙ্গলে বাঘে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন জঙ্গল সংরক্ষণ করা। অবাধে জঙ্গল ধ্বংস করে নগরায়ন বন্ধ করতে হবে। তবেই বন্যপ্রাণীর বিস্তার সম্ভব হবে।
উপসংহার: ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, নেপাল, ভুটান এ সকল দেশে বাঘ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে বাঘ সংরক্ষণ নিয়ে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু বন বিভাগের সদিচ্ছার অভাব ও অলসতার জন্য আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। তাই আমাদের জনগণকেই সচেতন হতে হবে।
শুধু বাঘ নয়— অন্যান্য বন্য প্রাণীর সংখ্যাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। যেমন গ্রামাঞ্চলে যদি কোথাও মেছো বাঘ ধরা পড়ে তাহলে সেটাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। যা কখনোই উচিত নয়। এতে করে গ্রামীণ জীববৈচিত্রের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। কিন্তু জনসচেতনতা না থাকার কারণে এমনটা অহরহ করছে। তাই জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের নিয়মিত কাজ করে যেতে হবে। তাই আজকের বিশ্ব বাঘ দিবসে প্রতিজ্ঞা করতে হবে— আমরা কখনোই বাঘের চামড়া বা দাঁত দিয়ে তৈরি পণ্য ক্রয় করব না। বন্যপ্রাণী শিকার করা সর্বদা নিরুৎসাহিত করব।