আয়কর রিটার্ন দাখিলের নিয়ম

আয়কর রিটার্ন কি? কোনো ব্যক্তি বা সত্তার আয় বা লভ্যাংশের উপর সরকারকে প্রদেয় করই হচ্ছে আয়কর বা ইনকাম ট্যাক্স। কোনো করদাতার বার্ষিক আয়, ব্যয় ও সম্পদের অন্যান্য বিবরণী সুনির্দিষ্ট ফর্মে আয়কর কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করার নামই আয়কর রিটার্ন বা ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন। আয়কর রিটার্ন দাখিল করার জন্য নির্দিষ্ট ফরমটি আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ এর আওতায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত।

কোন কোন খাতের আয় করযোগ্য?

আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ অনুসারে, কোনো করদাতা যদি নির্দিষ্ট খাতসমূহের মোট আয় করমুক্ত আয়ের সীমা অতিক্রম করলে তাকে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। এই খাতসমূহ হচ্ছে বেতন, নিরাপত্তা জামানতের উপর সুদ, গৃহ সম্পত্তির আয়, কৃষি থেকে আয়, ব্যবসা বা অন্য কোনো পেশার আয়, মূলধনী মুনাফা ইত্যাদি।

আয়কর রিটার্ন কারা দাখিল করবেন?

আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে এমন ব্যক্তি বা সত্তাকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে।
১. করযোগ্য আয় আছে এমন ব্যক্তি বা সত্তা।
২. আবশ্যিকভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে এমন ব্যক্তি বা সত্তা।

করযোগ্য আয়ের ভিত্তিতে কারা আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন?
১. কোনো পুরুষ ব্যক্তি করদাতার বার্ষিক আয় ৩,০০,০০০ (তিন লাখ) টাকার বেশি হলে।
২. কোনো মহিলা এবং ৬৫ বা এর চেয়ে বেশি বয়স্ক কোনো করদাতার বার্ষিক আয় ৩,৫০,০০০ (তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার) টাকার বেশি হলে।
৩. কোনো প্রতিবন্ধী করদাতার বার্ষিক আয় ৪,৫০,০০০ (চার লাখ পঞ্চাশ হাজার) টাকার বেশি হলে।
৪. কোনো গেজেটভুক্ত এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করদাতার বার্ষিক আয় ৪,৭৫,০০০ (চার লাখ পচাত্তর হাজার) টাকার বেশি হলে।

আবশ্যিক ভাবে কারা আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন?
১. ১২ ডিজিটের ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার বা টিআইএন গ্রহণকারী ব্যক্তি।
২. করমুক্ত আয়ের সীমা অতিক্রমকারী ব্যক্তি।
৩. আয় বছরের পূর্ববর্তী তিন বছরের যেকোনো এক বছর করদাতার কর নির্ধারণ হয়ে থাকলে অথবা তার আয় করমুক্ত আয়ের সীমা অতিক্রম করলে।
৪. করদাতা কোনো কোম্পানির অংশীদার পরিচালক কিংবা অংশীদার কর্মকর্তা হলে।
৫. করদাতা কোনো ফার্মের অংশীদার হলে।
৬. করদাতা সরকার বা সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষের কর্মচারী হয়ে বছরের যেকোনো সময়ে মাসিক মূল বেতন ১৬,০০০ (ষোলো হাজার) বা তার বেশি টাকা আহরণ করে থাকলে।
৭. করদাতা কোনো ব্যবসায় নির্বাহী বা ব্যবস্থাপনা পদে বেতন ভোগ করে থাকলে।
৮. করদাতার আয় হ্রাসকৃত হারে করযোগ্য হয়ে থাকলে।
৯. করদাতা মোটরগাড়ি, জিপ, মাইক্রোবাস ইত্যাদির মালিক হয়ে থাকলে।
১০. করদাতা সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ হতে ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করে ব্যবসা পরিচালনা করে থাকলে।
১১. করদাতা মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইনের অধীনে নিবন্ধিত কোনো ক্লাবের সদস্যপদ গ্রহণ করে থাকলে।
১২. করদাতা চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবি, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, প্রকৌশলী ইত্যাদি পেশার স্বীকৃত পেশাজীবি সংস্থার নিবন্ধিত সদস্য হলে।
১৩. করদাতা আয়কর পেশাজীবি হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিবন্ধিত হলে।
১৪. করদাতা কোনো ব্যবসায়ী সংঘের সদস্য হলে।
১৫. করদাতা কোনো পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের কোনো পদে কিংবা সংসদ সদস্য পদে প্রার্থী হলে।
১৬. করদাতা কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত কিংবা স্থানীয় সরকারের কোনো টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে থাকলে।
১৭. করদাতা কোনো কোম্পানি বা গ্রুপ অফ কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত থাকলে।
১৮. করদাতা মটরযান, স্থান, বাসস্থান ইত্যাদি সরবরাহের মাধ্যমে যৌথ অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে থাকলে।
১৯. করদাতা লাইসেন্সধারী কোনো অস্ত্রের মালিক হলে।
উল্লিখিত তালিকার বাইরে বাংলাদেশে নির্দিষ্ট ভিত্তি নেই এমন নিবাসীকে কর রিটার্ন দাখিল হবে না। এছাড়াও জমি বিক্রয় বা ক্রেডিট কার্ড গ্রহণের জন্য ১২ ডিজিটের টিআইএন গ্রহণকারী ব্যক্তির করযোগ্য আয় না থাকলে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে না।

আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার নিয়ম | আয়কর রিটার্ন দাখিলের নিয়ম

প্রথমে আপনার একটি ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার দরকার হবে। যদি না থাকে সেক্ষেত্রে জাতীইয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইটে (www.nbr.gov.bd) গিয়ে মুঠোফোন নাম্বার, জাতীয় পরিচয়পত্র, সদ্য তোলা এক কপি ছবি দিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে ঘরে বসেই ই-টিআইএন (E-TIN) পাওয়া যাবে।

ই-টিআইএন ধারী সকলেই স্ব স্ব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হতে টিডিএস (Tax Deducted at Source) এর একটি কপি পেয়ে যাবেন। যাদের আয়কর ৩,০০০ টাকা থেকে ৫,০০০ টাকার মধ্যে তাদের আয়কর অফিস থেকেই কেটে রাখা হবে। যদি এই টাকা রিটার্ন দাখিলের জন্য পূরণকৃত ফর্মের থেকে কম হয় তাহলে বাকি টাকা সোনালী ব্যাংক বা অন্য ব্যাংকের নির্ধারিত শাখায় জমা দিয়ে রশিদ নিতে হবে।

এর পরে আয়কর রিটার্ন ফরম পূরণ করতে হবে। ফরমটি সকল আয়কর অফিসেই বিনামূল্যে পাওয়া যাবে। অথবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইট (www.nbr.gov.bd) থেকেও বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যাবে। ফটোকপি হলেও চলবে। নির্ধারিত ফরমটি যথাযথ তথ্য দিয়ে পূরণ করার পরে এনবিআর অফিসে গিয়ে জমা দিতে হবে। ফরমটি নিজেই পূরণ করা সম্ভব। তবে চাইলে একজন ভালো আয়কর আইনজীবির সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। অথবা আয়কর অফিসে গিয়ে আয়কর কর্মকর্তার দিকনির্দেশনা নিয়েও ফরমটি পূরণ করা যেতে পারে।

ব্যক্তি করদাতাকে নির্দিষ্ট কর দিবসের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয়। ২০২১-২২ কর বছরের জন্য নির্ধারিত আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। অর্থাৎ ৩০ নভেম্বর, ২০২১ এর মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে।
একজন করদাতা যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে ব্যর্থ হন তাহলে তিনি রিটার্ন দাখিলের সময়সীমা বৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট ফরমে যথাযথ কারণ দেখিয়ে উপ-কর কমিশনারের নিকট আবেদন করতে পারেন। উপ-কর কমিশনার সময় মঞ্জুর করলে করদাতা আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন। আয়কর রিটার্ন দাখিলের এই ফর্মটিও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইট (www.nbr.gov.bd) থেকে বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যাবে।

অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করার নিয়ম

১ সেপ্টেম্বর ২০২১ থেকে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করার সুবিধা পুনরায় চালু করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইট (www.nbr.gov.bd) থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহার করে আয়কর রিটার্ন দাখিল করা যাবে।

আয়কর রিটার্ন ফরম পূরণের নিয়ম

আয়কর রিটার্ন ফরমে (আইটি-১১গ ফরম) আটটি পৃষ্ঠা থাকবে।
১. প্রথম পৃষ্ঠায় বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য যেমন নাম, ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, টিআইএন, পিতা-মাতার নাম ইত্যাদি দিতে হবে।
২. দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় করদাতার আয়ের বিবরণী দিতে হবে। এসব তথ্য টিডিএস স্টেটমেন্টে পাওয়া যাবে।
৩. তৃতীয় পৃষ্ঠায় আয়ের বিস্তারিত বিবরণী দিতে হবে। এ তথ্যগুলোও টিডিএস স্টেটমেন্টে পাওয়া যাবে।
৪. চতুর্থ পৃষ্ঠায় বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত ও আয়কর রিটার্নের সাথে দাখিলকৃত দলিলপত্রের তালিকা দিতে হবে।
৫. পঞ্চম ও ষষ্ঠ পৃষ্ঠায় বেতন-ভাতা ছাড়া অন্যান্য সম্পত্তি, আয়, ঋণ, ব্যয় ইত্যাদির তথ্য দিতে হবে।
৬. সপ্তম পৃষ্ঠায় ব্যক্তি করদাতার জীবনযাত্রার মান সম্পর্কিত তথ্য দিতে হবে।
৭. অষ্টম পৃষ্ঠায় অনুসরণীয় নির্দেশাবলি দেওয়া আছে।

আয়কর রিটার্ন দাখিল না করার শাস্তি কী?

আয়কর রিটার্ন দাখিল না করলে শাস্তির বিধান আছে। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ এর ৭৫ ধারা অনুযায়ী, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল না করলে করদাতার উপর আয়কর অধ্যাদেশ এর ১২৪ ধারা অনুসারে জরিমানা, ৭৩ ধারা অনুসারে ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত সরল সুদ এবং ৭৩ক অনুসারে বিলম্ব সুদ আরোপিত হবে। তবে করদাতা যদি উপ-কর কমিশনার কর্তৃক রিটার্ন দাখিলের জন্য বর্ধিত সময়ের জন্য আবেদন করেন এবং আবেদন মঞ্জুর হয় তবে সেক্ষেত্রে জরিমানা আরোপিত হবে না কিন্তু সরল সুদ ও বিলম্বিত সুদ আরোপিত হবে।

আরো দেখতে পারেন: অনলাইনে জাতীয় পরিচয় পত্র সংশোধন

আয়কর রিটার্ন দাখিলের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

  • নতুন করদাতাদের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট সাইজের সত্যায়িত ছবি।
  • এনআইডি কার্ডের কপি।
  • ই-টিআইএন এর কপি।
  • টিডিএস স্টেটমেন্টের কপি।
  • অতিরিক্ত কর পরিশোধের সমর্থনে চালান/পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফটের কপি।
  • বেতন বিবরণী।
  • বেতন অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্ট।
  • ডিপোজিট স্কিম থাকলে তার স্টেটমেন্ট।
  • ল্যাপটপ বা ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রাংশ কিনে রেয়াত দাবি করলে।
  • অন্যান্য বিনিয়োগ থাকলে তার সপক্ষে প্রমাণাদি।
  • অন্যান্য সম্পত্তি থাকলে তার সপক্ষে প্রমাণপত্র।
  • গত বছরের আয়কর রিটার্ন এর প্রাপ্তি স্বীকার পত্রের কপি।

About Juyel Ahmed Liton

সুপ্রিয় “প্রোবাংলা” কমিউনিটি, ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি আকর্ষণ ছিলো এবং হয়তো সেই আকর্ষণটা অন্য দশ জনের থেকে একটু বেশি। ওয়েবসাইট, টাইপিং, আর্টিকেল লেখাসহ টেকনোলজি সবই আমার প্রিয়। জীবনে টেকনোলজি আমাকে যতটা ইম্প্রেস করেছে ততোটা অন্যকিছু কখনো করতে পারেনি। আর এই প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ থেকেই লেখালেখির শুরু.....

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *