বিপদ থেকে রক্ষা পেতে বা চাহিদা পূরণের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়ার উদ্দেশ্যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের হাজতের নামাজ আদায় করতে উৎসাহিত করেছেন। হাজতের নামাজ কি, কেন পড়া হয়, কখন করবেন, নিয়ত, সালাতুল হাজত নামাজের নিয়ম, দোয়া সম্পর্কে এখানে বিস্তারিত জেনে নিন।
সালাতুল হাজত কি বা হাজতের নামাজ কি?
কোন বৈধ/ হালাল চাহিদা পূরনের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তষ্টির উদ্দেশ্যে দুই রাকাত নফল সালাত আদায় করাই ‘সালাতুল হাজত’। (ইবনু মাজাহ, হাদিস- ১৩৮৫)।
সালাতুল হাজত কেন পড়া হয়
সালাতুল হাজত হলো প্রয়োজন পূরণের/ সাহায্য প্রার্থনার জন্য সালাত। মহান আল্লাহর কাছে প্রয়োজন পূরণের, বিপদ থেকে রক্ষার জন্য সাহায্য চাইতেই সালাতুল হাজত পড়া হয়।
মানুষ স্বাভাবিকভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল বা মুখাপেক্ষী থাকে। কোন মানুষই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। প্রয়োজনের নানা বিষয়ে আমরা আপনজনদের কাছে সাহায্য চাইতে পারি, বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়ার জন্য। তবে আমাদের সবচেয়ে বড় আপনজন এবং সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী হলেন মহান আল্লাহ তায়ালা। যখন কেউ সাহায্য করতে পারে না, তখন মানুষের সবচেয়ে বড় এবং একমাত্র সাহায্যকারী হলেন মহান আল্লাহ।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- “হে ইমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত – ১৫৩)
আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ ঈমানের সাথে বৈধভাবে কোন কিছু চাইলে, কখনোই কেউ নিরাশ হয় না। মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্যই সালাতুল হাজত নামাজ পড়া হয়। তাই আপনিও কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে কিংবা শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে কোনো দুশ্চিন্তায় পতিত হলে সালাতুল হাজত নামাজের নিয়ম অনুযায়ী মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে পারেন।
হাজতের নামাজ কখন পড়বো
হাজতের নামাজ একটি নফল ইবাদত। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য এই সালাত আদায় করা অন্যতম একটি মাধ্যম। সালাতুল হাজতের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। আপনি যখন কোন বিপদে পড়বেন, অভাবগ্রস্থ হবেন, তখনই আপনার প্রয়োজনীয়তা পূরণের উদ্দেশ্যে এই সালাত আদায় করে দোয়া করতে পারেন।
সালাত আদায় করার নিষিদ্ধ সময় গুলো ছাড়া, দিনের এবং রাতের যেকোন সময় হাজতের নামাজ পড়া যায়।
সালাতুল হাজতের নিষিদ্ধ সময়
সালাতুল হাজত একটি নফল সালাত। নিষিদ্ধ সময় ছাড়া দিনের যেকোন সময়ে সালাতুল হাজত নামাজের নিয়মে সালাত আদায় করতে পারবেন। সাধারণত অন্যান্য সালাতের মতোই তিনটি সময়ে এই সালাত আদায় করা যায় না। যথা:
- সূর্যোদয়ের সময়।
- জওয়াল এর সময় বা দ্বিপ্রহরের সময়। অর্থাৎ সূর্য যখন ঠিক মাথার উপরে অবস্থান করে।
- সূর্যাস্তের সময়।
এই তিনটি সময়কে সালাত আদায়ের জন্য নিষিদ্ধ/হারাম করা হয়েছে। অন্য যেকোনো সময় মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য সালাতুল হাজত আদায় করতে পারেন।
সালাতুল হাজত নামাজের নিয়ত
সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে নিয়ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সালাতুল হাজত সহ যেকোনো সালাতের জন্যই আরবিতে নিয়ত করা বাধ্যতামূলক নয়। তবুও আপনি চাইলে নিম্নোক্ত ভাবে আরবিতে সালাতুল হাজত নামাজের নিয়ত করতে পারেন-
বাংলা উচ্চারণ: নাওয়াইতু আন উছাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা রাক’আতাই ছালাতিল হাজাতি মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার ।
নিয়ত অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত। তাই অন্তর থেকে- আমি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কিবলামুখী হয়ে দুই রাকাত হাজতের নামাজ আদায় করছি, আল্লাহু আকবার। এভাবে নিয়ত করে সালাত আদায় করলেই হবে, ঈন-শা-আল্লাহ।
সালাতুল হাজত নামাজের নিয়ম
নামাজের আলাদা কোনো নিয়মে সালাতুল হাজতের আদায় করতে হয় না। প্রয়োজনের নিয়তে অন্যান্য সালাতের অনুরূপ দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করতে হয়।
অন্যান্য নামাজের মতই উত্তম ভাবে অজু করে, নিজে পবিত্র হয়ে নিন। তারপর আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনার নিয়তে দুই রাকাত নফল সালাত আদায় করুন। সালাত শেষে আল্লাহ তায়ালার হামদ ও ছানা এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) – এর উপর দরুদ শরীফ পাঠ করুন। তারপর নিজের মনের কথা ব্যক্ত করে আল্লাহর কাছে প্রাণ খুলে দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে দোয়া করুন।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর দেখানো পদ্ধতি অনুযায়ী নিম্নোক্ত ভাবে সালাতুল হাজত আদায় করতে হবে-
- উত্তমরূপে অজু করে পবিত্রতা অর্জন করুন।
- নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে হাজতের সালাত আদায়ের জন্য মনকে দৃঢ় করে নিয়ত করুন।
- তাকবীরে তাহরীমা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নামাজে হাত বাঁধুন।
- ছানা পড়ুন। বাংলা উচ্চারণ: “সুবহানাকাল্লা-হুম্মা ওয়াবি-হামদিকা, ওয়া তাবারা কাছমুকা, ওয়াতা’আলা জাদ্দুকা, ওয়ালা ইলাহা গায়রুকা।”
- তারপর সূরা ফাতেহা স্পষ্ট ও শুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করুন।
- এরপর সূরা ফাতেহার সাথে অন্য সূরা বা কেরাত পড়ুন। সম্ভাব্য হলে বড় কোন সূরা তেলাওয়াত করতে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন সূরা পড়তে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা নেই।
- অন্যান্য নামাজের মত রুকু ও সিজদা আদায় করুন। আর রুকু সিজদা দীর্ঘ হলে উত্তম। রুকু ও সিজদাতে আল্লাহকে এবং আল্লাহর রহমতকে বেশি বেশি স্মরণ করুন।
- দ্বিতীয় রাকাত একই ভাবে আদায় করুন।
- শেষ বৈঠকে বসে তাশাহহুদ, দরুদ শরীফ ও দোয়া মাছুরা পড়ুন।
- সালাম ফিরানোর মাধ্যমে হাজতের নামাজ সম্পন্ন করুন।
নামাজ শেষে আল্লাহ তায়ালার হামদ ও ছানা এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) – এর উপর দরুদ শরীফ পাঠ করুন। তারপর প্রাণ খুলে মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করুন।
বিশ্বনবী রাসুলুল্লাহ (সাঃ) – এর সুন্নাহ অনুযায়ী এভাবেই সালাতুল হাজতের নামাজ পড়তে পারেন।
সালাতুল হাজত শেষে যে দোয়া পড়বেন
সালাতুল হাজত নামাজের নিয়মে আপনার নিজের চাহিদা উল্লেখ করে যেকোন বৈধ দোয়া করতে পারবেন। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনু আবি আওফা থেকে বর্ণিত হয়েছে,
আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বলেন- “আল্লাহর কাছে বা কোনো আদম সন্তানের কাছে যদি কারও কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকে, তবে সে যেন উত্তম রূপে অজু করে। তারপর যেন দুই রাক’আত সালাত আদায় করে। তারপর যেন আল্লাহর প্রশংসা করে ও রাসুল (সাঃ) – এর উপর দরূদ সালাম পাঠ করে। তারপর এই দোয়াটি পাঠ করবে-
আরবি: لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ الْحَلِيمُ الْكَرِيمُ سُبْحَانَ اللَّهِ رَبِّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ أَسْأَلُكَ مُوجِبَاتِ رَحْمَتِكَ وَعَزَائِمَ مَغْفِرَتِكَ وَالْغَنِيمَةَ مِنْ كُلِّ بِرٍّ وَالسَّلاَمَةَ مِنْ كُلِّ إِثْمٍ لاَ تَدَعْ لِي ذَنْبًا إِلاَّ غَفَرْتَهُ وَلاَ هَمًّا إِلاَّ فَرَّجْتَهُ وَلاَ حَاجَةً هِيَ لَكَ رِضًا إِلاَّ قَضَيْتَهَا يَا أَرْحَمَ الرَّاحِمِينَ
বাংলা উচ্চারণ: “লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হুল হালিমুল কারিম, সুবহানাল্লাহি রাব্বিল আরশিল আজিম। আল-হামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন, আছআলুকা মুজিবাতি রাহমাতিক; ওয়া আজা-ইমা মাগফিরাতিক, ওয়াল গানিমাতা মিন কুল্লি বির্যিউ ওয়াস্ সালামাতা মিন কুল্লি ইছমিন লা তাদা’অলি- জাম্বান ইল্লা গাফার-তাহু ওয়ালা হাম্মান ইল্লা ফাররাজতাহু ওয়ালা হা-জাতান হিয়া লাকা রিজান- ইল্লা কাজাইতাহা ইয়া আরহামার রা-হিমিন।”
সালাতুল হাজত নামাজের দোয়ার অর্থ
“আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনি অতি সহনশীল ও দয়ালু, তিনি সকল দোষ-ক্রটি থেকে পবিত্র। তিনি মহান আরশের প্রভু। সকল প্রশংসা আল্লাহর, তিনি সারা জাহানের রব। আপনার কাছেই আমি যাঞ্ছা করি- আপনার রহমত আকর্ষণকারী সকল পূণ্যকর্মের ওসিলায়, আপনার ক্ষমা ও মাগফিরাত আকর্ষণকারী সকল কাজের বরকত, সকল নেক আমলে সাফল্য লাভের এবং সব ধরনের গুনাহ থেকে নিরাপত্তা লাভের। আমার কোনো গুনাহ যেন মাফ ছাড়া না থাকে। কোনো সমস্যা যেন সমাধান ছাড়া না রয়ে যায়। আর আমার এমন প্রয়োজন, যাতে রয়েছে আপনার সন্তুষ্টি রয়েছে, তা যেন অপূরণ না থাকে। হে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু। (তিরমিজি, ইবনু মাজাহ)
সালাতুল হাজত নামাজের নিয়মে সালাত শেষে এই দোয়াটি পড়ে মহান আল্লাহর কাছে নিজের প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করুন। তবে হাজতের নামাজের শেষে এই দোয়াটি পড়া বাধ্যতামূলক নয়। আপনি নিজের ভাষায় নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে, প্রয়োজনের বিষয়টি উল্লেখ করেও বিশেষভাবে দোয়া করতে পারেন। তাছাড়া এই দোয়াটি অন্যান্য সকল নামাজের পরেও পড়তে পারেন।
সালাতুল হাজত নামাজের পর অন্যান্য দোয়া
সালাতুল হাজত শেষে অন্যান্য দোয়াও করতে পারেন। এক্ষেত্রে অনেক বেশি ফজিলতপূর্ন পবিত্র কুরআনে বর্নিত বিশেষ দোয়াটি পড়তে পারেন-
আরবি: اَللَّهُمَّ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
বাংলা উচ্চারণ: “আল্লা-হুম্মা রব্বানা আ’তিনা ফিদ্দুন্ইয়া হাসা-নাতাঁও ওয়া ফিল আ-খিরাতি হাসানাতাঁও্ ওয়া ক্বিনা আযা-বান্না-র।”
বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ! হে আমাদের রব! আপনি আমাদের দুনিয়াতে কল্যান দান করুন এবং আখিরাতেও কল্যান দান করুন। এবং জাহান্নামের আজাব থেকে আমাদের রক্ষা করুন।”
হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্নিত- “আল্লাহর রাসুল (সাঃ) অধিকাংশ সময় এ দোয়াটি পড়তেন।” (বুখারি, হাদিস: ৪৫২২, ৬৩৮৯; মিশকাত, হাদিস: ২৪৮৭; মুসলিম, মিশকাত; হাদিস: ৮১৩)
সালাতুল হাজত নামাজের ফজিলত
সালাতুল হাজত নামাজের নিয়ম অনুযায়ী দোয়া করখ কতটা ফজিলতপূর্ণ তা রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহ থেকেই ধারণা করা যায়। তিনি কখনো বিপদে সম্মুখীন হলে বা মুসলিম উম্মাহর প্রয়োজনে মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতেন। প্রার্থনা মাধ্যম হিসেবে তিনি সালাতুল হাজতের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।
রাসুল (সাঃ) এর জীবনের বিভিন্ন সমস্যায় তিনি এই সালাত আদায় করে নিজের জন্য এবং সকলের জন্য দোয়া করতেন। পাশাপাশি সাহাবায়ে কেরামদের এই সালাত আদায় করার নির্দেশ দিতেন।
হযরত হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সামনে যখন গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রয়োজন বা বিষয় চলে আসতো, তখন তিনি সাথে সাথে নামাজে দাড়িয়ে যেতেন।” (আবু দাউদ)
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর আমরা সকলেই এই সালাত আদায় করে মহান আল্লাহর কাছে দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে দোয়া করলে, কাঙ্খিত ফলাফল পাবো। ঈন-শা-আল্লাহ।
শেষকথা
হাজতের নামাজ অনেক বেশি ফজিলতপূর্ণ। আমাদের প্রয়োজন মেটাতে আল্লাহর কাছে দোয়া করার অন্যতম কার্যকর মাধ্যম এই নামাজ। তাই মুসলমানদের জন্য বিপদে ভীত না হয়ে ধৈর্য্যের সাথে সালাতুল হাজত নামাজের নিয়মে সালাত আদায় করে আল্লাহর কাছে দোয়া করা উত্তম।