ডাবের পানির উপকারিতা ও অপকারিতা 

ডাব আমাদের অতি পরিচিত। এটাকে একটি ফল এটা অনেকেই জানে না। এটা পাম জাতীয় একটি গাছ। মূলত নারিকেল যখন সবুজ রঙের এবং কচি অবস্থায় থাকে তখন এটাকে ডাব বলা হয়। ডাব শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এমনকি সমুদ্র উপকূলবর্তী আফ্রিকা— বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে প্রচুর পরিমাণে জন্মে। এছাড়া এগুলো দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল ও এর আশেপাশের দেশগুলোতেও ব্যাপক জন্মায়।

নারিকেল কচি থাকা অবস্থায় অর্থাৎ ডাব থাকা অবস্থায় এর পানি এবং শাঁস খাওয়া হয়। ধাপ পরিপক্ক হয়ে গেলে এটাকে নারকেল বলে। তখন এর মধ্যে পানির পরিমাণ কমে গিয়ে শাঁস আরো পুরু ও শক্ত হয়ে যায়। তবে নারিকেলের পানি খাওয়ার জন্য এটার কচি অবস্থা অর্থাৎ ডাবকেই সবাই প্রধান্য দেয়। 

সেই প্রাচীনকাল থেকেই ডাবের ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় ডাবের পানি যেন অমৃত। ডাবের পানি খুবই সুস্বাদু। সেই সাথে এর মধ্যে আছে অসংখ্য ভিটামিন ও মিনারেল। এটার মধ্যে পটাশিয়ামের পরিমাণ অনেক বেশি। যাদের পটাশিয়ামের অভাবে বিভিন্ন রোগ ব্যাধি আছে তাদের জন্য ডাবের পানি খুবই উপকারী। 

আজ আমরা ডাবের পানির উপকারিতা ও অপকারিতা আর্টিকেলে ডাবের পানি উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে জানব।

ডাবের পানির পুষ্টিমান 

আমরা সকলেই জানি ডাবের পানি অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি পানীয়। এটা পানি স্বল্পতা দূর করে। সেই সাথে দেহের ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের ঘাটতি পূরণ করে। রোদে প্রচণ্ড ঘেমে গেলে এটা পান করার পর শরীর দ্রুত চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এছাড়া এটা ডায়রিয়া রোগীদের পানি স্বল্পতাও দূর করে। 

আজ আমরা জানবো ডাবের পানিতে ভিটামিন ও খনিজ উপাদান কোনটা কী পরিমাণে রয়েছে।

১০০ মিলি লিটার ডাবের পানির মধ্যে থাকা পুষ্টিমান—

  • ক্যালোরি ১৯ থেকে ২৫ কিলো জুল 
  • কার্বোহাইড্রেট ৩.৭ থেকে ৬.২ গ্রাম
  • সুগার ২.৫ থেকে ৪ গ্রাম 
  • প্রোটিন ০.৪ থেকে ০.৮ গ্রাম 
  • ফ্যাট সর্বোচ্চ ০.৫ গ্রাম
  • ফাইবার ০.৮ থেকে ১.২ গ্রাম 
  • ভিটামিন সি ০.৮ থেকে ১.৬ মিলি গ্রাম
  • ভিটামিন বি১ ০.০৩ মিলি গ্রাম
  • ভিটামিন বি২ ০.০২ মিলি গ্রাম
  • ভিটামিন বি৩ ০.০৩ মিলি গ্রাম 
  • ফলেট ৩ মাইক্রো গ্রাম 
  • পটাশিয়াম ১৬০ থেকে ২৪০ মিলি গ্রাম 
  • সোডিয়াম ১২ থেকে ২৫ মিলি গ্রাম 
  • ম্যাগনেসিয়াম ৬ থেকে ১০ মিলি গ্রাম 
  • ক্যালসিয়াম ১৬ থেকে ২৪ মিলি গ্রাম 
  • ফসফরাস ১২ থেকে ১৬ মিলি গ্রাম 

*ডাবের পানির পুষ্টিমান মাটির গুনাগুনের উপর নির্ভর করে। তাই স্থানের ভিন্নতার কারণে ডাবের পানির পুষ্টিমানের তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া ডাবের পানিতে লবণের পরিমাণ কম বেশি থাকলে এর স্বাদেও পরিবর্তন ঘটে।

ডাবের পানির উপকারিতা

ডাবের পানির উপকারিতা

প্রচণ্ড গরমে রোদ থেকে এসে একটি ডাবের পানি খেলে শরীরটা জুড়িয়ে যায়। কঠোর পরিশ্রমের পর ডাবের পানি শরীরে আনে শক্তি। মুহূর্তেই করে ফেলে চাঙ্গা ও তাজা। এমনিতে ডাবের পানি পান করলে শরীরে এক ধরনের সতেজ ভাব আনে। কিন্তু আমরা অনেকেই আছি যারা জানি না ডাবের পানির কত উপকারিতা। তাই এই ডাবের পানির উপকারিতা ও অপকারিতা আর্টিকেলে ডাবের পানির উপকারিতা সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

আরও পড়ুন: শসার উপকারিতা ও অপকারিতা 

পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত রোগ:     দেহে পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়ামের অভাবে বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় কৃত্রিম ঔষধ না খেয়ে প্রাকৃতিক ঔষধ ডাবের পানি খাওয়া উচিত। কেননা এতে রয়েছে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়াম। ডাবের পানির সাধারণত কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। তাই এটা নিশ্চিন্তে খাওয়া যায়। 

ডায়রিয়া ও কলেরা রোগীর পথ্য ডাবের পানি:      ডায়রিয়া বা কলেরা হলে মানুষের শরীর থেকে সকল তরল পদার্থ বের হয়ে যায়। একটা সময় পানি শূন্যতা দেখা দেয় এবং মানুষ মারা যায়। এমতাবস্থায় চিকিৎসকগণ তরল খাদ্য গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। ডাবের পানি শুধু যে দেহের পানি স্বল্পতা দূর করে তা কিন্তু নয়। এটা দেহের অন্যান্য উপকার সাধন করে। দেহের খনিজ ও ভিটামিনের স্বল্পতা দূর করে। শরীরকে দ্রুত শক্তি দিতে প্রয়োজন ডাবের পানি।

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে:     যাদের কোষ্ঠকাঠিন্য রয়েছে তাদের উচিত ডাবের পানি পান করা। কেননা ডাবের পানি পান করলে কোষ্ঠকাঠিন্য কমে যায়। এছাড়া পেটের গ্যাস হওয়া অথবা এসিডিটির উপশম করে ডাবের পানি।

রক্তে লৌহ কণিকা বৃদ্ধি করে:     আয়রনের অভাবে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। কেননা রক্তের লৌহ কণিকা আয়রন থেকে তৈরি হয়। ডাবের পানিতে আছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন। যা লৌহ কণিকা বৃদ্ধি করে রক্তের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। 

দাঁতের উজ্জ্বলতায় ডাবের পানি:       ডাবের পানিতে রয়েছে পর্যাপ্ত খনিজ লবণ। মূলত এই লবণের তারতম্যের কারণেই একেক অঞ্চলের ডাবের পানি একেক রকম লাগে। বাংলাদেশের ডাবগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে খনিজ লবণ পাওয়া যায়। ফলে বাংলাদেশের ডাবের পানি খেতে অনেক সুস্বাদু। এই খনিজ লবণ দেহের অনেক উপকার সাধন করে। সেই সাথে দাঁতকে করে তোলে উজ্জ্বল। 

প্রস্রাবের জ্বালা-পোড়া রোধ করে:      দীর্ঘক্ষণ পানি না খাওয়ার ফলে শরীরে পানি স্বল্পতা দেখা দেয়। ফলে প্রস্তাব করার সময় খুবই জ্বালাপোড়া হয়। এই সমস্যা থেকে সমাধান দিতে পারে ডাবের পানি। ডাবের পানি পান করলে পানি শূন্যতা দূর হয় এবং প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। 

আরও জানুন : কাঁচা পেঁপের উপকারিতা ও অপকারিতা

দাঁতের মাড়ি কালো ও মাড়ি থেকে রক্ত পড়া রোধ:       আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাদের মাড়ির রঙ খুবই কালো এবং মাঝেমধ্যে দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত বের হয়।  এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য ডাবের পানি নিয়মিত খেতে হবে। ডাবের পানিতে থাকা ক্যালসিয়াম ও আয়রন মাড়ির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

জলবসন্তের দাগ দূর করতে ডাবের পানি:     অনেকেই আছেন যাদের ছোটবেলায় জলবসন্ত হয়েছে, যেটার দাগ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু যখন জলবসন্ত হয় এবং এটার ঘা শুকাতে আরম্ভ করে তখন যদি ডাবের পানি দিয়ে ধুয়ে দেওয়া হতো নিয়মিত, তাহলে জলবসন্তের দাগ অনেকটা কমে যেত। 

শুধু যে বসন্তের দাগ কম করে তা কিন্তু নয়। এটা মুখের বিভিন্ন ধরনের প্রদাহ, ফুসকুড়ি এমনকি ব্রণ কমাতে সাহায্য করে।

ডাবের পানির অপকারিতা

ডাবের পানি নিঃসন্দেহে খুবই উপকারী। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা অপকারিতাও রয়েছে। ডাবের পানির অপকারিতা সম্পর্কে নিচে বলা হলো।

এলার্জি থাকলে ডাবের পানি না খাওয়া ভালো:      ডাবের পানিতে আছে ‘ট্রোপোমায়োসিন’ নামক এক প্রকার বিশেষ প্রোটিন— যা অতিরিক্ত ডাবের পানি খেলে সেখান থেকে এলার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই যাদের ত্বক খুবই স্পর্শকাতর এবং যাদের আগে থেকেই এলার্জি আছে তারা ডাবের পানি খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নিবেন।

ডায়াবেটিস রোগীর জন্য শঙ্কা:      ডাবের পানিতে সামান্য পরিমাণ সুগার থাকে। এছাড়ায় এতে থাকে প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট। কার্বোহাইড্রেট ভেঙে চিনি তৈরি হয় যা ডায়াবেটিস রোগীর জন্য বিপদজনক। যাদের ডায়াবেটিসের মাত্রা খুবই বেশি তাদের ডাবের পানি খাওয়ার আগে সাবধান হতে হবে। তবে যাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে কিংবা ডায়াবেটিস মাত্রা কম— তাদের জন্য অতটা ক্ষতি কম নয় ডাবের পানি। 

কিডনি রোগীদের জন্য ক্ষতিকর ডাবের পানি:     যাদের কিডনিতে রোগ আছে কিংবা কিডনিতে পাথর তাদের ডাবের পানি খাওয়া উচিত নয়। কেননা ডাবের পানিতে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম রয়েছে। পটাশিয়াম কিডনি রোগ বৃদ্ধি করে এবং কিডনিতে পাথর জমতে সাহায্য করে। তাই ডাবের পানি খাওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এছাড়া যাদের শরীরের আগে থেকে পটাশিয়ামের মাত্রা বেশি তাদের জন্য ডাবের পানি নয়। কেননা দেহে পটাশিয়ামের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়।

উচ্চ রক্তচাপের রোগীর জন্য ডাবের পানি খাওয়া নিষেধ:     যে সকল মানুষের উচ্চ রক্তচাপ আছে, তারা নিশ্চয় উচ্চ রক্তচাপ কমাতে ঔষধ গ্রহণ করে থাকেন। যা উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু একই সময়ে যদি ডাবের পানি পান করেন তবে তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা ডাবের পানি উচ্চ রক্তচাপ হ্রাস করে। ফলে রক্ত চাপ কমে গিয়ে রোগীর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

উপসংহার 

বাংলাদেশ ডাব চাষের জন্য খুবই উত্তম একটি দেশ। এখানকার মাটি ডাব চাষের জন্য অত্যন্ত ভালো। এছাড়া বাংলাদেশের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া ডাবের উৎপাদন আরো বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশের মাটিতে এমন কিছু উপাদান আছে যার জন্য ডাবের পানির স্বাদ অন্যান্য দেশের চাইতে অনেক বেশি। যেমন ব্রাজিলের ডাবের পানি পানসে লাগে। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের ডাবের পানি মিষ্টি লাগে। কিন্তু বাংলাদেশের ডাবের পানি মিষ্টি সেই সাথে হালকা নোনা স্বাদযুক্ত। ফলে এটা হয়ে ওঠে দারুন সুস্বাদু। 

পড়ে নিন: মাশরুম এর উপকারিতা ও অপকারিতা 

বাংলাদেশ অনেকে ডাবের চাষ করে লাভবান হচ্ছে। ডাব চাষ করতে গেলে বেশি একটা ঝামেলা পোহাতে হয় না। খাল বিলের ধারে, সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চলে, পরিত্যক্ত জায়গায় যেখানে পানি জমে না, এমন সব স্থানে বিনা যত্নে ডাব গাছ লাগানো যায়। বাংলাদেশের মানুষ যদি সঠিকভাবে ডাব উৎপাদন করে তাহলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা অসম্ভব নয়। 

তাই আমাদের উচিত আমাদের দেশের মাটিকে কাজে লাগিয়ে দেশের উপকার করা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top