লাভজনক পদ্ধতিতে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন করার নিয়ম black bengal goat

লাভজনক পদ্ধতিতে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন করবেন যেভাবে

ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বাংলাদেশের একটি সুপরিচিত এবং জনপ্রিয় স্থানীয় ছাগলের জাত। মাংস ও দুধ উৎপাদনের জন্য এই ছাগল পালন ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

অনেক তরুণ উদ্যোক্তা ছাগলের খামার দিতে আগ্রহী। তাই আপনাদের তথ্য চাহিদা পূরণের জন্য এই আর্টিকেলে, আসল ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল চেনার উপায়, এটি পালনের সুবিধা, খামার তৈরি, সুষম খাদ্য, রোগ প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বৈশিষ্ট্য ও চেনার উপায়

black bengal goat

ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের খামার করতে চাইলে এই ছাগলের জাত চেনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে এই ছাগলের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো:

  • ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের শরীর সাধারণত সম্পূর্ণ কালো বা তামাটে হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে বাদামী এবং সাদা রঙেরও হতে পারে।
  • এদের আকার ছোট এবং গড়ে প্রাপ্তবয়স্ক একটি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের ওজন ২৫-৩০ কেজি হয়। 
  • এদের পা ছোট এবং খাড়া হয়।
  • এই ছাগল প্রজনন ক্ষমতা ও দ্রুত বংশবৃদ্ধির জন্য বেশি জনপ্রিয়। এরা বছরে প্রায় ২বার বাচ্চা দেয় এবং প্রতিবার ১-৩টি করে বাচ্চা দিতে পারে।
  • ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল সহজেই স্থানীয় খাবার যেমন ঘাস, পাতা, ছোট ছোট গাছের পাতা ইত্যাদি খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে।
  • অন্যান্য ছাগলের তুলনায় এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি এবং খুব সহজেই স্থানীয় পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে।
  • এ ধরনের ছাগল সাধারণত চঞ্চল হয়।

আরও পড়ুনঃ দেশি মুরগী পালন পদ্ধতি | মুরগীর জাত নির্বাচন, বাসস্থান, খাবার ও চিকিৎসা

ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনের সুবিধা সমূহ

একজন খামার ব্যবসায়ীর জন্য ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনে অনেক নামজনক একটি উদ্যোগ। এই জাতের ছাগল কম খরচে বেশি মুনাফা দিতে সক্ষম। নিচে এই জাতের ছাগল পালনের বিভিন্ন সুবিধা তুলে ধরা হলো:

  • এই ছাগলের প্রজনন ক্ষমতা অনেক বেশি। একটি মাদি ছাগল বছরে ২-৩ বার এবং প্রতি বার ১-৩টি করে বাচ্চা দিতে পারে।
  • এই ছাগল আকার ছোট হওয়ায় এদের কম জায়গাতেই পালন করা যায়।
  • এদের খাদ্যাভ্যাস সাধারণ এবং স্থানীয় খাবার যেমন ঘাস, গাছের পাতা, ঘরের উচ্ছিষ্ট খাবার ইত্যাদি সহজেই খেতে পারে। ফলে খাদ্য খরচ কম হয় এবং পালনে অতিরিক্ত খরচ কম লাগে।
  • এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। তাই চিকিৎসা ও ওষুধ খরচ তুলনামূলকভাবে কম হয়।
  • খুব বেশি যত্নের প্রয়োজন হয় না, তাই খামারিরা স্বাচ্ছন্দ্যে পালন করতে পারে।
  • এই ছাগলের মাংস খুবই সুস্বাদু এবং প্রোটিনসমৃদ্ধ। ফলে এ মাংসের বাজারচাহিদা বেশি এবং দামও ভালো পাওয়া যায়।
  • এই জাতের ছাগলের দুধ উৎপাদনের পরিমাণ কম হলেও সেগুলো স্বাদে ও পুষ্টিতে পরিপূর্ণ হয়।
  • কম খরচে লাভজনক খামার করা যায় বলে বিনিয়োগের ঝুঁকি কম থাকে।

তাই যারা দেশে ছাগল পালন করতে চায় তাদের জন্য এই ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের খামার করা অত্যন্ত লাভজনক হবে।

ছাগল কেনার সময় লক্ষ্যণীয় বিষয়গুলো

Black Bengal goat farming

খামারের জন্য প্রাথমিকভাবে ছাগল কিনতে গেলে কিছু বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। যেমন- ছাগলের বয়স এবং বর্তমান বাজারে ছাগলের দাম কেমন সে সম্পর্কে।

এক্ষেত্রে আপনার খামারের জন্য মাতৃ ছাগল নিতে চাইলে এবং পরবর্তীতে খামার বড় করতে চাইলে, ১৪-১৬ মাস বয়সী ছাগল বাছাই করতে হবে। আর যদি সাময়িকভাবে কয়েক মাস পালন করে বিক্রি করতে চান, তাহলে ছাগলের বাচ্চা নিলে ভালো হবে।

আরও পড়ুনঃ লাভজনক ৭টি ৫০ হাজার টাকায় ব্যবসা আইডিয়া

ছাগলের বয়স জানার জন্য দাঁত দেখে বয়স নির্ণয় করতে পারবেন। সাধারণত ছাগলের বয়স ১ বছর হলে সামনের দুটি দুধের দাঁত পরিবর্তিত হয়। এরপর প্রতি বছর দুটি করে স্থায়ী দাঁত গজায়, ফলে দাঁতের সংখ্যা দেখে বয়স অনুমান করা যায়।

আবার ছাগলের দাম কেমন হতে পারে, সে সম্পর্কে ধারনা না থাকলে ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। বাংলাদেশে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বাচ্চার দাম নির্ভর করে এর বয়স, স্বাস্থ্য, এবং স্থানীয় বাজারের চাহিদার উপর। সাধারণত, এক মাস বয়সী স্বাস্থ্যকর ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বাচ্চার দাম ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।

আবার, যদি বাচ্চার বয়স বেশি হয় বা এটি উন্নত মানের প্রজননের জন্য উপযুক্ত হয়, তবে এর দাম আরও বেশি হবে। বাজারে দাম আরও ভালোভাবে জানতে স্থানীয় পশুর হাট বা অনলাইনে খামারি গ্রুপগুলোতে যাচাই-বাছাই করে নিতে পারেন। এসব বিষয়গুলো খেয়াল রেখেই আপনার খামারের জন্য ছাগল সংগ্রহ করতে হবে।

আরও পড়ুনঃ লাভজনকভাবে কবুতর পালন পদ্ধতি

১০টি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনের জন্য ঘর তৈরি

আপনার মূলধন অনুযায়ী আপনার খামার ঘর তৈরি করতে পারেন। তবে প্রাথমিকভাবে ১০টি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনের জন্য একটি ঘর তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও খামারের গঠন কেমন হবে, সে সম্পর্কে নিচে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হলো:

আপনার খামারের গঠন হবে:

  • মাটি থেকে ২-৩ ফুট উঁচু করে ঘর নির্মাণ করতে হবে। যাতে করে এটি শুকনো থাকে এবং পোকামাকড় থেকে রক্ষা পায়।
  • পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের জন্য তারের জাল দিয়ে চারপাশের বেড়া দিয়ে ঘর তৈরি করবেন‌।
  • ঘরের চালু ঢালু রাখবেন, যেন বৃষ্টির পানি জানতে না পারে। 
  • ঘরের মেঝেতে বাঁশ বা কাঠের তক্তা হালকা ফাঁকা ফাঁকা করে বসাবেন। এমনভাবে বসাবেন যেন বর্জ্য সহজে পরিষ্কার করা যায়।
  • ছাগলের থাকার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রাখতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি ছাগলের জন্য ১৫-২০ বর্গফুট জায়গা রাখতে পারেন।
  • সম্ভব হলে ছাগলের বিশ্রামের জায়গা, খাবারের জায়গা এবং অসুস্থ ছাগল আলাদা রাখার জায়গা রাখবেন।

আরও পড়ুনঃ বর্তমান সময়ের সেরা ৭টি স্টক মালের ব্যবসা আইডিয়া

১০টি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জন্য সুষম খাদ্য

ছাগলের সুস্বাস্থ্য এবং মাংস ও দুধ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সুষম খাদ্য সরবরাহ করা অপরিহার্য। এক্ষেত্রে ১০টি ছাগলের জন্য আপনি যে সকল খাবার দিতে পারেন, সেগুলো হলো: 

  • প্রতিদিন ছাগলকে নেপিয়ার বা অন্যান্য জাতের সবুজ ঘাস দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি ছাগলের জন্য ৫-৬ কেজি ঘাস প্রয়োজন। 
  • প্রতিটি ছাগলের জন্য ১-২ কেজি খড় বা ভুষি।
  • ১টি ছাগলের জন্য ২০০-৩০০ গ্রাম করে চালের কুঁড়া, গমের ভুসি বা ভাঙা ভুট্টা।
  • ১টি ছাগলের জন্য প্রতিদিন ৫০-১০০ গ্রাম সরিষা বা সয়াবিন খৈল।
  • খাবারের সাথে পরিমাণ মতো লবণ ও খনিজ পদার্থের মিশ্রণ দিতে পারেন। 
  • এছাড়াও দিনে ২-৩ বার পরিষ্কার পানি খাওয়ানো ছাগলের সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আপনি যদি একসাথে বিভিন্ন খাবারের মিশ্রণ তৈরি করে সুষুম খাদ্য হিসেবে খাওয়ান, তাহলে সেটি আরো বেশি কার্যকর হবে। এক্ষেত্রে প্রথমে সবুজ ঘাস এবং খড় ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিবেন। এর সাথে অন্যান্য দানাদার ও ভুষি জাতীয় খাবার এবং খনিজ ও লবণ মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করবেন। তারপর সকালে ও সন্ধ্যায় খাবার দিতে পারেন। এছাড়াও আপনার ছাগলকে নিয়মিত বিভিন্ন ঘাসের খেতে খাবার খাওয়ার সুযোগ দিতে হবে।

আরও পড়ুনঃ সেরা ৬টি ২ লাখ টাকায় লাভজনক ব্যবসা আইডিয়া

ছাগলের রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে করণীয়

খামারে ছাগল পালনের সময় ছাগলের বিভিন্ন রোগ হতে পারে। যেমন:

(১) কোন সংক্রামিত এলাকায় গরু-ছাগলের খাদ্য ও পানি খাওয়ার মাধ্যমে মাটিবাহিত রোগ হয়।

(২) পেটের কৃমি বা ত্বকের পোকামাকড় ছাগলের স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এগুলোকে প্যারাসাইটজনিত রোগ বলা হয়।

(৩) অপুষ্টিকর খাদ্য বা সংক্রমণের কারণে ছাগলের ডায়রিয়া হয়ে থাকে।

(৪) ভাইরাসজনিত কারণে পক্স বা গুটি রোগ হতে।

এছাড়াও ছাগলের পেট ফাঁপা ও অন্যান্য রোগ তো রয়েছেই। ছাগলের এ সকল রোগ হয়ে যাওয়ার পর প্রতিকার করা কঠিন। অনেক সময় চিকিৎসার মাধ্যমে প্রতিকার করতে পারলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায়। তাই রোগ হওয়ার আগে সতর্কতার সাথে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলাই ভালো। এক্ষেত্রে উপরোক্ত ছাগলের বিভিন্ন প্রকার রোগ প্রতিরোধ করতে আপনার করণীয় হলো: 

  • ছাগলকে পরিষ্কার এবং শুকনো স্থানে রাখবেন।
  • সময়মতো টিকা দিবেন, যেমন: এন্ট্রাক্স এবং পক্সের জন্য নির্ধারিত টিকা।
  • ছাগলকে নিয়মিত কৃমির ওষুধ খাওয়াবেন।
  • রোগ দেখা দিলে অভিজ্ঞ ভেটেরিনারি ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।
  • স্বাস্থ্যকর খাবার ও পরিমাণমতো পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

এভাবে সঠিক যত্ন নিলে ছাগল দীর্ঘদিন সুস্থ থাকবে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়বে।

মাতৃ ছাগল পালনে যেসকল বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে

মাতৃ ছাগল বা ছাগী পালনের সময় বেশ কিছু বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন। ছাগলের খাবার, স্বাস্থ্য ও বাসস্থান সম্পর্কিত ব্যবস্থার পাশাপাশি পাল দেওয়া ও বাচ্চা খাসিকরন এবং গর্ভবতী ছাগল ও ছাগলের বাচ্চা হলে সেগুলোর বাড়তি খেয়াল রাখতে হয়। এক্ষেত্রে নিচে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় হলো:

(১) ছাগীকে পাল দেওয়ার নিয়ম ও সময়

সাধারণত ১টি ছাগী প্রজননের জন্য প্রস্তুত হয় ৮-১২ মাস বয়সে। পাল দেওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হলো শীতকাল। কারন এসময় আবহাওয়া অনুকূল থাকে। পাল দেওয়ার আগে এবং পরে ছাগলের সুস্থতার জন্য এর বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিত।

(২) ছাগলের বাচ্চাকে খাসিকরণ

ছাগলের খাসিকরণ করলে ছাগল স্বাস্থ্যকরভাবে বেড়ে ওঠে এবং মাংস উৎপাদন বাড়ে। একটি বাচ্চা পুরুষ ছাগলকে ২-৩ মাস বয়সে খাসিকরণ করা উচিত। এটি করতে একজন অভিজ্ঞ ভেটেরিনারি ডাক্তার বা প্রশিক্ষিত ব্যক্তি দ্বারা করাতে পারেন। 

শেষকথা

উপরোক্তভাবে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল লালন পালন করে লাভজনকভাবে আপনি খামার ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন।

About Sajjad Hossain

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *