আখরোট এর উপকারিতা ও অপকারিতা | আখরোট বা Walnut বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় একটি হালকা খাবার। সাধারণ খাবার তালিকার পাশাপাশি আমাদের দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য আখরোট একটি আদর্শ ফল।
বর্তমানে আমরা অনেকেই আখরোট এর উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করি। তাই আখরোট এর উপকারিতা ও অপকারিতা এবং এর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন এই লেখা থেকে।
আখরোট কি?
আখরোট বা Walnut হলো একটি বাদাম জাতীয় ফল। এই বাদামটি পুষ্টিগুণ এবং স্বাদগত বৈশিষ্ট্যের জন্য বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। এটি এক প্রকার সুপারফুড হিসেবেই বর্তমানে আমাদের মাঝে পরিচিত, কারন এর পুষ্টি উপাদান আমাদের দেহের জন্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
আখরোট সাধারণত গোলাকৃতির বা ডিম্বাকৃতির হয়। এর খোসা কড়া এবং খসখসে হয়। খোসার ভেতরে বাদামি রঙের দুটি বা চারটি ভাঁজযুক্ত বীজ থাকে। আখরোটের স্বাদ মিষ্টি ও মৃদু তেতো হতে পারে। এতে একটি বিশেষ ধরনের গন্ধ থাকে যা অন্য বাদাম থেকে আলাদা। আখরোটের বৈজ্ঞানিক নাম Juglans regia।
আখরোট এর পুষ্টিগুণ
আখরোট বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদানে ভরপুর। ১টি ভালো সাইজের আখরোটে যেসকল পুষ্টি উপাদান থাকে সেগুলোর পরিমাণসহ নিচে তুলে ধরা হলো:
- ক্যালোরি: ৬৫৪ ক্যালোরি
- প্রোটিন: ১৫.২ গ্রাম
- মোট ফ্যাট: ৬৫.২ গ্রাম
- স্যাচুরেটেড ফ্যাট: ৬.১ গ্রাম
- মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট: ৮.৯ গ্রাম
- পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট: ৪৭.২ গ্রাম
- ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড: ৯.১ গ্রাম
- ওমেগা-6 ফ্যাটি অ্যাসিড: ৩৮.১ গ্রাম
- কার্বোহাইড্রেট: ১৩.৭ গ্রাম
- ফাইবার: ৬.৭ গ্রাম
- চিনি: ২.৬ গ্রাম
- ভিটামিন ই: ০.৭ মিগ্রা
- ভিটামিন বি৬: ০.৫৪ মিগ্রা
- ফোলেট: ৯৮ মাইক্রোগ্রাম
- থায়ামিন: ০.৩৪ মিগ্রা
- রিবোফ্লাভিন: ০.১৫ মিগ্রা
- নায়াসিন: ১.১২ মিগ্রা
- প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড: ০.৫৭ মিগ্রা
- ক্যালসিয়াম: ৯৮ মিগ্রা
- আয়রন: ২.৯১ মিগ্রা
- ম্যাগনেসিয়াম: ১৫৮ মিগ্রা
- ফসফরাস: ৩৪৬ মিগ্রা
- পটাসিয়াম: ৪৪১ মিগ্রা
- জিঙ্ক: ৩.০৯ মিগ্রা
- কপার: ১.৫৯ মিগ্রা
- ম্যাঙ্গানিজ: ৩.৪১ মিগ্রা
- সেলেনিয়াম: ৪.৯ মাইক্রোগ্রাম
এছাড়াও আখরোটে বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস এবং পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে। এগুলো স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আখরোট এর উপকারিতা
আখরোটের খাদ্যগুণ এবং স্বাস্থ্যগত উপকারিতার জন্য এটি সারাবিশ্বেই জনপ্রিয়। এটি শুধু খাবারের স্বাদ বাড়ায় না, বরং বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার প্রতিরোধেও কার্যকর ভূমিকা রাখে। নিচে আখরোটের বিভিন্ন উপকারিতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি তুলে ধরা হলো:
(১) হার্টের স্বাস্থ্য রক্ষা করে
আখরোটের অন্যতম প্রধান উপকারিতা হলো এটি হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক। আখরোটে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং বিশেষ করে আলফা-লিনোলেনিক অ্যাসিড (ALA), আমাদের রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এটি খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়াতে সাহায্য করে। ফলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমে।
(২) মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে
আখরোটে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং পলিফেনল মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক। এটি স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে এবং স্নায়ুতন্ত্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। নিয়মিত আখরোট খেলে বয়সজনিত মানসিক দুর্বলতা এবং আলঝাইমার রোগের ঝুঁকি কমে। এছাড়াও এটি মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং হতাশা কমাতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
(৩) হাড়ের গঠন মজবুত করে
আখরোটে থাকা ম্যাগনেসিয়াম এবং ক্যালসিয়াম হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি হাড়কে মজবুত করে এবং অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি হ্রাস করে। এছাড়াও এতে উপস্থিত ফসফরাস হাড়ের গঠন ও ক্ষয়পূরনে সহায়ক।
(৪) ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে
আখরোটে থাকা ফাইটোকেমিক্যাল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। বিশেষ করে, ব্রেস্ট ক্যান্সার এবং প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাসে এটি কার্যকর। এছাড়াও আখরোটের ইলাজিক অ্যাসিড এবং গ্যালোট্যানিন ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে।
(৫) ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে
আখরোটে থাকা প্রোটিন, ফাইবার এবং স্বাস্থ্যকর ফ্যাট দীর্ঘ সময় ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। এটি খেলে পেট ভরা থাকে, ফলে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের প্রবণতা কমে যায়। নিয়মিত আখরোট খেলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়।
(৬) ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষা করে
আখরোটে থাকা ভিটামিন ই এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়তা করে। এটি ত্বকের কোষের সুরক্ষা দেয় এবং ত্বককে উজ্জ্বল ও মসৃণ করে। নিয়মিত আখরোট খেলে ব্রণ, বলিরেখা এবং অন্যান্য ত্বকের সমস্যা কমতে থাকে।
(৭) চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখে
আখরোটে থাকা বায়োটিন, ভিটামিন ই এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড চুলের স্বাস্থ্য রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। এটি চুলের গোড়া মজবুত করে, চুল পড়া কমায় এবং চুলের প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে।
(৮) দেহের অভ্যন্তরীণ জ্বালাভাব প্রতিরোধ করে
আখরোটে থাকা পলিফেনল এবং ফ্ল্যাভোনয়েড প্রদাহবিরোধী গুণাগুণসম্পন্ন। এটি শরীরে বিভিন্ন জ্বালাভাব জনিত সমস্যা কমিয়ে আনে। নিয়মিত আখরোট খেলে আর্থ্রাইটিস এবং অন্যান্য প্রদাহজনিত রোগের ঝুঁকি কমে।
(৯) হজমশক্তি বৃদ্ধি করে
আখরোটে অধিক পরিমানে ফাইবার থাকে, যা হজমশক্তি বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। এটি অন্ত্রের চলাচল সহজ করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে। এছাড়া আখরোটে থাকা প্রোবায়োটিক গুণাগুণ অন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষায়ও সহায়তা করে।
এছাড়াও এই আখরোট এর উপকারিতা রয়েছে আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তাই আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় আখরোট অন্তর্ভুক্ত করে এর অগণিত উপকারিতা গ্রহণ করা উচিত।
আখরোট খাওয়ার নিয়ম | আখরোট কিভাবে খেতে হয়
আখরোট খাওয়ার ক্ষেত্রে কোন ধরাবাধা নিয়ম নেই। যেহেতু এটি একটি ফল, তাই যেকোন ভাবেই আপনি এটি খেতে পারেন। আখরোটের খোসা ছাড়িয়ে, বীজের অংশটি খাওয়া যায়। এটি একটি প্রাকৃতিক হালকা নাশতা হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। আপনি সরাসরি এটি খেতে পারবেন। এছাড়াও আপনি আরও বিভিন্নভাবে আখরোট খেতে পারেন। যেমন:
- রাতে কিছু আখরোট পানিতে ভিজিয়ে রাখুন এবং সকালে খালি পেটে সেগুলো খেয়ে নিন। আখরোট ভিজিয়ে খেলে এটি হজম করা সহজ হয় এবং এর পুষ্টিগুণ আরও বৃদ্ধি পায়।
- সবজি, ফল এবং আখরোট মিশিয়ে তৈরি করা সালাদ খেতে পারেন।
- পেস্ট্রি, কেক, কুকি, ব্রেড ইত্যাদিতে মিশিয়ে কিংবা আখরোট বিভিন্ন রান্নায় ব্যবহার খেতে পারেন।
- দুধ, দই, ফল এবং আখরোট মিশিয়ে তৈরি করা স্মুদি বা শেক অত্যন্ত সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর শরবত হবে। এভাবেও খেতে পারেন।
- আখরোটের তেল স্যালাড ড্রেসিং, রান্না এবং বেকিংয়ে ব্যবহার করে খেতে পারেন। আখরোটের তেল ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডে সমৃদ্ধ এবং হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী।
- আখরোট পেস্ট তৈরি করে ব্রেড বা ক্র্যাকার্সে মাখিয়ে খেতে পারেন।
- দই বা ওটমিলে আখরোট, মধু এবং ফল মিশিয়ে একটি পুষ্টিকর খাবার তৈরি করে খেতে পারেন।
আখরোট খাওয়ার পরিমাণ | প্রতিদিন কয়টি আখরোট খাওয়া উচিত
আখরোট খাওয়ার সময় পরিমাণ নিয়ে সতর্ক থাকা উচিত। সাধারণত প্রতিদিন ৭-৯টি আখরোট খাওয়া স্বাস্থ্যকর বলে বিবেচিত হয়। অতিরিক্ত আখরোট খেলে ওজন বৃদ্ধি, হজমের সমস্যা এবং অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
আখরোট এর অপকারিতা
আখরোট অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পন্ন হলেও, কিছু ক্ষেত্রে এটি ক্ষতিও বয়ে আনতে পারে। নিচে অতিরিক্ত আখরোট খাওয়ার কয়েকটি ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা হলো:
- আখরোট একটি সাধারণ অ্যালার্জেন হিসেবে পরিচিত। যারা বাদামজাতীয় খাবারের প্রতি সংবেদনশীল, তাদের জন্য আখরোট অ্যালার্জি সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে ত্বকের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট, পেটের সমস্যা, এমনকি এনাফাইল্যাক্সিস নামক গুরুতর অবস্থাও হতে পারে।
- অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে ওজন বৃদ্ধি হতে পারে।
- ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ায় এটি অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে গ্যাস, পেট ফাঁপা, এবং ডায়রিয়া হতে পারে।
- আখরোটে উচ্চমাত্রায় অক্সালেট থাকে, যা কিডনিতে পাথর তৈরির ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ গ্রহণ করলে আখরোট খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
আখরোটের এসব অপকারিতা থাকা সত্ত্বেও, সঠিক পরিমাণে এবং সঠিকভাবে খেলে এর স্বাস্থ্য উপকারিতা গ্রহণ করা সম্ভব।
আখরোট এর দাম কত
সাধারণত আখরোট এর দাম বাজারভেদে প্রতি কেজি ৫০০-১,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
শেষকথা
এই ছিল, আখরোট এর উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে আজকের বিস্তারিত আলোচনা।