চিড়া এই বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের সাহিত্যে চিড়ার বেশ একটা ভূমিকা রয়েছে। বাঙালির সকালের নাস্তায়, যাত্রা পথের হালকা খাদ্যে, আড্ডায় মুখরোচক খাবার হিসাবে চিড়া খাওয়া হয়।
চিড়া আমাদের সাহিত্যেও জায়গা দখল করে আছে। যেমন সৌমিত্র দে লিখেছেন,
“চিড়া মুড়ি খই
বগুড়ার দই
তার সাথে গুড় মেখে
খাব বসে চেটে পুটে।”
এছাড়া আমাদের আঞ্চলিক বিভিন্ন বিয়ের গীতে চিড়ার উল্লেখ আছে। অতিথি আপ্যায়নে চিড়া খুবই চটজলদি জলখাবার। তাই চিড়া আমাদের বাঙ্গালীদের চিরাচরিত খাদ্যে পরিণত হয়েছে।
আজকের এই ‘চিড়া খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা’ আর্টিকেলে চিড়া খাওয়ার উপকারিতা এবং অপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
উপমহাদেশে চিড়ার বিভিন্ন আঞ্চলিক নাম
চিড়া আমাদের এই উপমহাদেশে এতটাই জনপ্রিয় যে— এখানকার প্রতিটা অঞ্চলে চিড়া খাওয়ার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। মূলত উপমহাদেশের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে যেখানে ধান চাষ বেশি হয় সেখানে চিড়া খাওয়া হয় বেশি। একই অঞ্চলে একেক নাম এই চিড়ার। তাই কিছু প্রধান প্রধান অঞ্চলে চিড়াকে কী বলে ডাকে তা নিম্নোল্লিখিত।
পৌয়া বা পোহা – গুজরাটি
পোয়া – রাজস্থানী
চুড়া – ওড়িয়া
আতুকুলু – তেলুগু
আভাল – তামিল ও মালায়ালম
তাবেন – সাঁওতালি
চিউরা – বিহার এবং ঝাড়খণ্ড
চিঁড়া – বাংলা এবং আসামি
সুরা/সুরো – চাটগাঁইয়া
চিউড়া – মৈথিলি, নেপালি, ভোজপুরি, ছত্রিশগঢ়,
পোহা বা পাউয়া – হিন্দি
বাজি – নেওয়ারি
পোহে – মারাঠি
চিড়াতে থাকা পুষ্টিগুণ
আমরা নিয়মিত চিড়া খেয়ে থাকি কিন্তু আমরা অনেকেই চিড়ার পুষ্টিগুণ সম্পর্কে অবগত নই। নিচে চিড়ার পুষ্টিমান উল্লেখ করা হলো।
আরও পড়ুন: ডিমের উপকারিতা ও অপকারিতা
প্রতি ১০০ গ্রাম চিড়ায় আছে—
- ৩৪৬ ক্যালোরি
- ৬.৬ গ্রাম আমিষ
- ৭৭.৩ গ্রাম শর্করা
- ২.০২ মিলিগ্রাম লোহা
- ২৩৮ মিলিগ্রাম ফসফরাস।
চিড়ায় আঁশের পরিমাণ অনেক কম থাকে। ফলে অন্ত্রের প্রদাহ এবং ডাইভারটিকুলাইসিস রোগ প্রতিরোধে উপকারী। এটাতে সোডিয়াম ও পটাশিয়াম খুবই কম। তাই এটা কিডনি রোগীদের জন্য নিরাপদ।
চিড়া খাওয়ার উপকারিতা
দই-চিড়া কিংবা দুধ-কলা দিয়ে চিড়া মেখে খাওয়ার রেওয়াজ বেশ প্রাচীন। কখনো কখনো চিড়া পানিতে ভিজিয়ে গুড় অথবা চিনি মেখেও চিড়া খাওয়া হয়। যদি তাও না হয়— তবে মুখে মুখে শুকনো চিড়া চিবিয়ে খেতে দেরি করে না।
অনেক সময় পেটের সমস্যা দেখা দিলে মুরুব্বিগণ চিড়া খেতে বলেন। কারণ চিড়া খুবই হালকা খাবার। এটা পরিপাক হতে ঝামেলা পোহাতে হয় না। এছাড়া সকালের নাস্তায় হরহামেশা এই খাবারটি খাওয়া হয়।
বর্তমান সময়ে এই লোক দেখানো বিলাসী যুগে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষেরা সকালের নাস্তা হিসেবে ওটস, কর্ণফ্লেক্স, টোস্ট জাতীয় খাবার পছন্দ করে থাকে। কিন্তু পুষ্টিবিদগণ বলছেন, ওটস বা কর্নফ্লেক্সের তুলনায় উপকারের দিক দিয়ে অনেকাংশেই এগিয়ে আছে চিড়া। এছাড়া যাদের দুধ খেলে পেটে সমস্যা হয়, তারা তো চিড়ার সাথে দই মিশিয়েও খেতে পারে। কিন্তু চিড়া খেলে অনেকে নিজেকে ছোট মনে করে। মনে করে এটা গরীবদের খাদ্য। তাই তারা বেশি দাম দিয়ে বিদেশি প্যাকেটজাত ওটস, কর্নফ্লেক্স ক্রয় করে খায়। স্বদেশে উৎপাদিত পণ্যকে হীন মনে করে।
তাই আজ এই আর্টিকেলে চিড়া খাওয়ার কিছু উপকারিতা সম্পর্কে আপনাদেরকে অবহিত করব।
- এই নগর জীবনে মানুষজন খুব দেরি করে ঘুমায়। সেই সাথে রাতের খাবারও দেরি করে খায়। অনেক সময় মানুষজন খাওয়া-দাওয়া সেরেই সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমানোর ফলে খাদ্য সঠিকভাবে হজম হতে পারে না। পেটে গন্ডগোল দেখা দেয়। ক্ষুধামন্দা ভাব শুরু হয়। এমতাবস্থায় সকাল বেলা ভারী নাস্তা না করে দই চিড়া খেতে পারেন। এতে করে পেট ভরবে এবং ঠান্ডাও থাকবে।
- ওটস, কর্নফ্লেক্স, পাউরুটির মতো খাবারগুলো উপকারি হলেও এগুলো সবই প্যাকেটজাত এবং এগুলোকে সংরক্ষণ করে রাখার জন্য বিভিন্ন কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। এছাড়া পাউরুটি কিন্তু স্বাস্থ্যকর নয় কারণ এগুলো খুবই নোংরা পরিবেশে তৈরি হয়। এ সকল খাবারে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে। অনেকের ফাইবার বেশি খেলে সমস্যা হয়। তাই তারা চিড়া খেতে পারেন অনায়াসে। চিড়ার মধ্যে থাকা ফাইবারগুলো খুবই সহজে হজম হয়— যা ছোট বড় সকলের জন্য ভালো।
- আমাদের এই ব্যস্ত নগর জীবনে আমরা প্যাকেটজাত খাদ্যে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে— এটা থেকে মুক্ত হতে পারছি না। আমাদের সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে রাতের খাবার পর্যন্ত এই প্যাকেটজাত খাদ্যের ওপর নির্ভর করে। যা আমাদেরকে খুবই মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে। অপরদিকে চিড়া খুবই সাধারণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উৎপাদন করা হয়। এতে না থাকে কোনো কেমিক্যাল, না আছে কোনো প্রকার সংরক্ষণ করা ঝামেলা। তাই এটা নির্দ্বিধায় আমাদের জলখাবারে রাখা যায়।
- দেহের চর্বি কমাতে আপনার ডায়েটে রাখতে পারেন চিড়া। এটার মধ্যে কার্বোহাইড্রেট থাকে। তবে ফ্ল্যাটি উপাদান খুব কম। এটা যদি দই সহযোগে খান তাহলে আরো ভালো।
- আরও পড়ুন: পেয়ারার উপকারিতা ও অপকারিতা
- রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি অথবা উচ্চ রক্তচাপ থাকলে চিকিৎসক শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণে নিষেধ করেন। কিন্তু চিড়া রোগীদের পথ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কেননা এটা রোগীর তেমন ক্ষতি করে না।
ওজন কমাতে চিড়া খাওয়ার উপকারিতা
দেশের প্রায় সকলেই সকালের চায়ের সঙ্গে বা বিকেলের নাস্তায় চিড়া খেতে পছন্দ করেন। এছাড়াও যাত্রা পথে যাওয়ার সময় হালকা জলখাবার হিসাবে চিড়া খাওয়া হয়।
চিড়াতে দেহে চর্বি জমে না এবং খারাপ কোলেস্টেরল দেহের মধ্যে বাসা বোনে না। ওজন কমাতে চান যারা তারা রোজ খাবারের তালিকায় রাখতে পারেন চিড়া। চিড়াতে সোডিয়াম এর পরিমাণ কম। তাই ওজন থাকে একদম থাকে নিয়ন্ত্রণে। অনেকে মনে করে থাকেন চিড়া খাওয়া যাবে না ডায়েট কররে। এটা সম্পূর্ণ ভুল তথ্য। এটা সকলের জন্য উপকারী।
চিড়াতে যেহেতু সোডিয়াম এর পরিমাণ কম। তাই ওজন থাকে একদম নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া এটা উচ্চ রক্তচাপের রোগীর জন্যও ক্ষতিকর নয়।
চিড়াতে আছে প্রচুর পরিমাণে লৌহ। যা রক্তের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি করে শরীরকে রাখে সুস্থ।
ডায়াবেটিস রোগিদের নাস্তা হিসেবে চিড়া রাখা যেতে পারে। চিড়ার তৈরি নানান ধরণের মুখরোচক খাবার রয়েছে— যা ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েটে যুক্ত করা যেতে পারে।
গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হলে চিড়া খেতে পারেন। কেননা এটা খুব সহজেই হজম হয়ে যায় এবং পেটকে রাখে ঠান্ডা।
চিড়া খাওয়ার অপকারিতা
কোন জিনিস অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া ঠিক নয়। চিড়া একটি কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য। তাই এটাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন বা অন্যান্য নিউট্রিশন পাওয়া যায় না। তাই এটাকে প্রধান খাদ্য না বানিয়ে নাস্তার জন্য রাখা উচিত।
আমাদের দেহে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিনের প্রয়োজন রয়েছে। সকল ভিটামিন তো আর চিড়াতে নেই। তাই চিড়ার পাশাপাশি অন্যান্য পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা উচিত।
চিড়া রেসিপি
গ্রামবাংলায় বহু আগে থেকে চিড়া খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। তবে একই এলাকায় একেক ভাবে খাওয়া হয়। তাই আজ আপনাদেরকে চিড়া খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা আর্টিকেলে কয়েকটা চিড়া দিয়ে তৈরি খাবারের রেসিপি দেওয়া হলো।
পোহা: এই পোহা শব্দটা গুজরাটি। গুজরাটে চিড়া দিয়ে একটি সুস্বাদু খাবার তৈরি করা হয়। প্রথমে আপনি কয়েক প্রকারের সবজি কুচি করে নেবেন। এরপর একটি কড়াই য়ে খাঁটি সরিষার তেল অল্প পরিমাণে ঢেলে এতে জিরা, মেথি, সামান্য কালোজিরা, একটি বা দুটি করে এলাচ, দারচিনি, লঙ ও তেজপাতা দিয়ে তেলে নেবেন। এরপর তাতে পেঁয়াজ কুচি, রসুন কুচি, কাঁচা মরিচ, সামান্য শুকনো মরিচ গুঁড়া ও হলুদ গুঁড়া কুচি করা সবজি ভেজে নেবেন। বেশি অর্ধেক ভাজা হয়ে গেলে ভিজিয়ে রাখা চিড়া পানি ঝরিয়ে তাতে ঢেলে দেবেন এবং কিছুক্ষণ ভেজে নেবেন। সবশেষে ধনিয়া পাতা কুচি করে উপরে ছড়িয়ে দিয়ে নামিয়ে ফেলবেন।
দই চিড়া: এটা খুবই প্রচলিত ও সহজ রেসিপি। মিষ্টি দইয়ের সাথে ভিজিয়ে রাখা নরম ছিলাম মিশিয়ে তৈরি হয়ে যাবে দই চিড়া। তবে ডায়াবেটিস রোগীর জন্য টক দই ব্যবহার করা যেতে পারে।
ফ্রুটি চিড়া: এটা বিভিন্ন প্রকার ফল দিয়ে তৈরি করতে হয়। আপনার হাতের কাছে থাকা রসালো মিষ্টি ফল দিয়ে এটা তৈরি করতে পারেন। যেমন কলা কুচি, আম কুচি, ডালিমের দানা, তরমুজ কুচি ইত্যাদি ফল ও দুধ মিশিয়ে ফ্রুটি চিড়া সহজেই তৈরি করতে পারেন। যাদের দুধ খেলে পেটে গ্যাস হয় তারা মিষ্টি দই ব্যবহার করতে পারেন।
চিড়ার ঘণ্ট: আমাদের দেশে মুড়িঘন্ট তৈরি করা হয় মুগের ডাল দিয়ে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মুগ ডালের পরিবর্তে ভাজা চিড়া দিয়ে মুড়িঘন্ট তৈরি করা হয়। যা খেতে খুবই সুস্বাদু। আপনারা চাইলে চিড়া দিয়ে মুড়িঘন্ট তৈরি করে খেতে পারেন।
চিড়ার পোলাও: সুগন্ধি চাল দিয়ে তৈরি চিড়া দিয়ে সুন্দর পোলাও তৈরি করা সম্ভব। তবে চিড়া দিয়ে তৈরি পোলাও রান্না করার সময় এতে অনেকে গাজর ও মটরশুঁটি ব্যবহার করে থাকে। যা এটার স্বাদ বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। সবার আগে চিড়া ধুয়ে পোলাও এর চালের মতো ভেজে নিতে হবে। এরপর পোলাও রান্নার মতো করে এটা রান্না করতে হবে।