কুমড়া বীজের উপকারিতা ও অপকারিতা 

কুমড়া বীজের উপকারিতা ও অপকারিতা 

মিষ্টি কুমড়া আমাদের দেশে অনেক জনপ্রিয় একটি সবজি। এটা আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটা ঘরে কমবেশি রান্না হয়ে থাকে। কেউ এটার ভাজি তৈরি করে ভক্ষণ করে, কেউ বা তরকারি রেঁধে খায়। কিন্তু কুমড়ার মধ্যে থাকা বিচিগুলো আবর্জনা মনে করে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু এই মিষ্টি কুমড়ার বিচি যে খাওয়ার উপযোগী এবং এটা যে কতটা পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ তা আমরা অনেকেই জানি না। এই না জানার ফলে এত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্যবস্তুটিকে অযত্ন অবহেলা করে ফেলে দেওয়া হয়— যেটা করা উচিত নয়। হয়তো এই লেখাটি পড়ার পর আপনিও মিষ্টি কুমড়ার বীজ এখন থেকে ফেলে দেবেন না। এই বীজে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান আছে। এতে প্রোটিন, আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন বি ও বিটা ক্যারোটিন পাওয়া যায়। নিয়মিত যদি আপনি এই বীজ খান তাহলে অনেক উপকার পাবেন।

আমরা আমাদের আর্টিকেলে ‘মিষ্টি কুমড়া বীজের উপকারিতা ও অপকারিতা’ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করছি। আশা করি আর্টিকেলটা আপনারা সম্পূর্ণ পাঠ করবেন।

কুমড়ার বীজের পুষ্টিমান 

মিষ্টি কুমড়ার বীজে কী পরিমান পুষ্টি রয়েছে তা আমরা অনেকেই জানি না। ফলে এই পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ বীজ ময়লার ভাগাড়ে ঠাঁই পায়। তাই ‘কুমড়া বীজের উপকারিতা ও অপকারিতা’ আর্টিকেলে এটার পুষ্টিগুণ উল্লেখ্য করা হলো।

১০০ গ্রাম খাবারো উপযোগী কুমড়ার বীজে থাকা খনিজ ও পুষ্টিমান—

  • ক্যালারি ৫৫৯ কিলোজুল
  • প্রোটিন ৩০ মিলিগ্রাম 
  • ফ্যাট ৪৯ মিলিগ্রাম 
  • কার্বোহাইড্রেট ১৬ মিলিগ্রাম 
  • ফাইবার ৬ মিলিগ্রাম 
  • ভিটামিন কে ৭.৩ মাইক্রো গ্রাম
  • ভিটামিন ই ০.৬ মিলিগ্রাম 
  • থায়ামিন ভিটামিন বি১ ০.১ মিলিগ্রাম 
  • রিবোফ্লেভিন ভিটামিন বি২ ০.২ মিলিগ্রাম 
  • ভিটামিন বি৩ ১.২ মিলিগ্রাম 
  • ভিটামিন বি৬ ০.১ মিলিগ্রাম 
  • ভিটামিন বি৯ ৫৮ মাইক্রোগ্রাম 
  • ম্যাগনেসিয়াম ৫৯২ মিলিগ্রাম 
  • আইরন ৮.৮ মিলিগ্রাম 
  • জিংক ৭.৮১ মিলিগ্রাম
  • কপার ১.৩৪ মিলিগ্রাম 
  • ম্যাঙ্গানিজ ১.১ মিলিগ্রাম 
  • ফসফরাস ১২৩৩ মিলিগ্রাম 

কুমড়া বীজের উপকারিতা 

আপনারা জানলেন মিষ্টি কুমড়া বীজের মধ্যে থাকা পুষ্টিমান সম্পর্কে। এবার জানবেন কুমড়া বীজের উপকারিতা। এটা নিয়মিত খেলে আপনার শরীরে কী কী উপকার সাধন করবে তা ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ্য করা হলো।

  • কুমড়ার বীজে আছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ম্যাগনেশিয়াম, জিঙ্ক এবং ফ্যাটি অ্যাসিড— এটা হার্ট সুস্থ রাখতে জন্য দারুন উপকার করে। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা যায়, নিয়মিত পরিমিত পরিমাণে কুমড়ার বিচি খেলে রক্তে থাকা খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা অনেকাংশে কমে যায়। এছাড়া এটা উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
  • আরও পড়ুন: চিড়া খাবার উপকারিতা ও অপকারিতা 
  • অনেকের দেহে ম্যাগনেশিয়াম কম থাকে তাদের শরীরে ডায়াবেটিস রোগ পরিলক্ষিত হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক চাহিদার প্রায় ৩৭ ভাগ ম্যাগনেশিয়াম পাওয়া যায় এক আউন্স বা প্রায় ৩০ গ্রাম পরিমাণ কুমড়ার বীজ থেকে। এই কারণেই এটা নিয়মিত খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
  • ফাইবার, ভিটামিন ও খনিজের উৎকৃষ্ট উৎস এই কুমড়ার বীজ। ফলে কুমড়া বীজ খেলে ভালো হজম হয়। পরিপাক ক্রিয়ায় যাদের সমস্যা তাদের জন্য এটা খুবই উপকারী। কুমড়ার বিচিতে ভালো পরিমাণে ফসফরাস পাওয়া যায়। যেটা ওজন কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 
  • কুমড়ার বীজ ওমেগা 3 এর ভালো উৎস। তাই এটি মাংসপেশীর জন্য অনেক উপকারী। এছাড়াও এটাতে আছে জিঙ্ক এবং ফসফরাস— যা হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে। অস্থিসন্ধিতে হওয়া ব্যথা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 
  • কুমড়া বীজে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম থাকে। যা শরীরের ইলেক্টোলাইটের ভারসাম্য ঠিক রাখার কাজ করে। এছাড়া এটা রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণ করে। যদি শরীরের ভারসাম্য ঠিক থাকে তবেই তো মানসিক চাপ কমবে ও মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করবে। 
  • কুমড়া বীজে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান। যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এতে আরো আছে ক্যারোটোনয়েডস। এছাড়া ভিটামিন বি এর উৎকৃষ্ট উৎস হচ্ছে  এই কুমড়ার বীজ। যা দেহের জন্য অনেক উপকারী। ভিটামিন বি শরীরের কোষগুলোকে সতেজ রাখে। অনেক সময় দেখা যায় বাচ্চাদের মুখে ঘা হয়। এটা সাধারণত ভিটামিন বি এর অভাবের ফলে হয়ে থাকে। যদি আপনি আপনার শিশুকে নিয়মিত কুমড়া বীজ খাওয়ান, তাহলে মুখে ঘা হওয়া থেকে অনেকাংশে পরিত্রাণ পেতে পারে।

কুমড়া বীজের অপকারিতা 

কুমড়া বীজ নিঃসন্দেহে ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের একটি ভালো উৎস। এটা আমাদের খাওয়া উচিত। কিন্তু কোনো জিনিস এই অতিরিক্ত ভালো নয়। ঠিক তেমনি কুমড়ার বীজ বেশি পরিমাণে খেলে কিছু ক্ষতির সম্ভাবনা রয়ে যায়। যেগুলো ‘কুমড়া বীজের উপকারিতা ও অপকারিতা’ আর্টিকেলে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

  • উচ্চ ক্যালোরি সমৃদ্ধ কুমড়া বীজ: কুমড়া বীজে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালোরি। ক্যালোরি আমাদের দেহের শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে। কিন্তু অতিরিক্ত ক্যালোরি শরীরে জমলে কোলেস্ট্রল বৃদ্ধি পায়। ফলে মোটা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তবে নিয়মিত যদি পরিশ্রম বা ব্যায়ামের মাধ্যমে ক্যালোরি খরচ করা যায় তাহলে অত বেশি ক্ষতিকর নয়।
  • জেনে নিন: ডিমের উপকারিতা ও অপকারিতা 
  • পাচনতন্ত্রের সমস্যা: তোমরা বীজে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। যেটা অনেক সময় হজম করতে পাকস্থলীর বেশ বেগ পেতে হয়। হলে দেখা যায় পেটে গ্যাস জমে যায়। যা বড় অস্বস্তির কারণ।
  • উচ্চ চর্বি থাকে কুমড়া বীজে: কুমড়া বীজে স্বাস্থ্যকর চর্বি রয়েছে। যা মানব দেহের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। কিন্তু বেশি পরিমাণে কুমড়া বীজ খেলে এই চর্বির পরিমাণ দেহে বৃদ্ধি পেতে পারে। যা রক্তের শিরায় রক্ত প্রবাহে বাধা প্রদান করতে পারে।  ফলে হৃৎপিণ্ডের রোগের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
  • পুষ্টির ভারসাম্যহীনতা: মিষ্টি কুমড়ার বীজে অনেক পরিমাণে পুষ্টি রয়েছে। যা দৈনন্দিন চাহিদার অনেকাংশে পূরণ করতে সক্ষম। কিন্তু মানুষ মিষ্টি কুমড়া বীজের পাশাপাশি আর অন্যান্য খাদ্য গ্রহণ করে। সে সকল খাদ্যেও পুষ্টি থাকে। তাই দেখা যায় কোনো কোনো পুষ্টি মাত্রা অতিরিক্ত দেহে বৃদ্ধি পায়। ফলে নানান ধরনের জটিলতা হতে পারে।
  • এলার্জি হতে পারে: অনেক মানুষ আছেন যাদের মিষ্টি কুমড়া খেলে এলার্জি হয় শরীরে। তাদের জন্য মিষ্টি কুমড়া বীজ অনেক সময় এলার্জির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই যাদের মিষ্টি কুমড়া খেলে এলার্জি হয় তারা সাবধানতা অবলম্বন করে মিষ্টি কুমড়া বীজ খাবেন।

কুমড়া বীজের দাম

বাজারে খোসা ছাড়ানো কুমড়ার বীজ কিনতে পাওয়া যায়। কিছু কিছু কুমড়ার বীজ রোস্ট করে বিক্রি করে। বিশেষ করে বিভিন্ন কোম্পানির ড্রাইফ্রুটের সাথে কুমড়ার বীজ প্যাকেটজাত করে। এছাড়া শুধু কুমড়ার বীজও কিনতে পাওয়া যায়। সাধারণত এগুলো ছোট ছোট প্যাকেটে বিক্রি করে। বাজারে ১০০ গ্রাম কুমড়ার বীজ ৫০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। ওই হিসেবে ১ কেজি কুমড়ার বেঁচে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকার মধ্যে কিনতে পাওয়া যেতে পারে। 

তবে কুমড়ার বীজ কেনার আগে লক্ষ্য রাখতে হবে সেটা ভেজা কি না। যদি ভেজা থাকে তাহলে খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবে। এছাড়া ওটার রঙ কেমন সেটাও দেখতে হবে। স্বাভাবিকভাবে কুমড়ার বীজের রঙ সবুজ বা হালকা ফ্যাকাসে সবুজ থাকে। কিন্তু ওটা যদি পুরোপুরি ফ্যাকাস অথবা একটু শাদার মতো হয়, তাহলে সেটা কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা বীজ বেশি পুরাতন হয়ে গেলে সেটাতে ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হতে পারে যা মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর।

পড়তে পারেন: লটকনের উপকারিতা ও অপকারিতা

ঘরে বীজ সংরক্ষণ 

বাজারেও কুমড়ার বিচি কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু ওগুলোর দাম অনেক বেশি হয়ে থাকে। তাই আপনি চাইলে ঘরেই কুমড়ার বিচি খাদ্য উপযোগী করে সংরক্ষণ করতে পারবেন। 

প্রথমত কুমড়ার বিচিগুলো ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। যেন কোনোকিছু লেগে না থাকে। এরপর সেটা রোদে এক ঘন্টার মতো শুকাতে হবে। বেশি শুকানো যাবে না। এতটুকু শুকাতে হবে যেন কুমড়ার বিচি ভেতর থেকে আর্দ্র থাকে। যদি আপনি খটখটে শুকনো করে ফেলেন— তাহলে কুমড়ার বিচির খোসা থেকে ভেতরের শাঁস বের করা সহজ হবে না। 

এরপর সেই শুকনো বিচি থেকে আঙুল দিয়ে চাপ দিয়ে ভেতরের শাঁস বের করে ফেলুন। ভেতরের শাঁস সবুজ রঙের দেখাবে‌। সেটা ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে নিন। যাতে কোনো প্রকার আর্দ্রতা না থাকে। যদি আর্দ্রতা থাকে তাহলে খুব দ্রুত বীজ নষ্ট হয়ে যাবে— বিভিন্ন ধরনের ছত্রাকের সংক্রমণ হবে। 

কুমড়ার বীজ আপনি চাইলে শুধু শুধু চিবিয়ে খেতে পারেন। তবে সবচেয়ে ভালো হয় হালকা রোস্ট করে খেতে। অনেকে সামান্য পরিমাণ লবণ মিশিয়ে কড়াইয়ে একটু রোস্ট করে তারপর খায়। যদি আপনার উচ্চরক্তচাপ হয়ে থাকে তাহলে লবণ পরিহার করুন।

ছোটদের জন্য সুস্বাদু মিষ্টি কুমড়া বীজ

আমাদের গ্রাম বাংলায় বহু আগে থেকেই খোসাসহ মিষ্টি কুমড়া বীজ তাওয়াই তেলে বা ভেজে খাবার রেওয়াজ আছে। কিন্তু আজকালকার বাচ্চারা এভাবে খেতে পছন্দ করে না। তাই তাদের জন্য একটু ভিন্ন পদ্ধতিতে সুস্বাদু করে মিষ্টি কুমড়া বীজ প্রস্তুত করতে পারেন। 

প্রথমত খোসা ছাড়ানো এক কাপ মিষ্টি কুমড়া বীজ নেবেন। এরপর এতে এক কাপের এক চতুর্থাংশ লাল চিনি বা গুড় নেবেন। সাথে আধা চামচ ভ্যানিলা এসেন্স। এক চিমটি লবণ। চাইলে এতে এক চামচ খাটি ঘি ব্যবহার করতে পারেন। এরপর এটা একত্রে মাখিয়ে এর বার তৈরি করে ওভেনে বেক করবেন। ১৫ মিনিট বেক করার পর ফ্রিজে রেখে দেবেন। ঠান্ডা হয়ে গেলে বাচ্চাদের হাতে দেবেন। দেখবেন কত আনন্দ সহকারে সম্পূর্ণ মিষ্টি কুমড়া বীজ খেয়ে শেষ করে ফেলে।

মূলত আপনি এটাকে চীনা বাদামের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top