সরিষার তেলের অপকারিতা

সরিষার তেলের উপকারিতা ও অপকারিতা

আপনাদেরকে ‘সরিষার তেলের উপকারিতা ও অপকারিতা’ প্রবন্ধটি আমাদের ওয়েবসাইটে পাঠ করার জন্য ধন্যবাদ। এই প্রবন্ধের নাম ‘সরিষার তেলের উপকারিতা ও অপকারিতা’ না হয়ে হওয়া উচিত ছিল ‘বাঙালির ঐতিহ্যের সরিষার তেল’। কেননা সরিষার তেল বা সরিষা নিয়ে বাঙালি বরাবরই আবেগপ্রবণ এবং এটার সাথে বাঙালির অনেক রান্নার আয়োজন জড়িত। হোক সেটা সর্ষে ইলিশ অথবা কাঁচা আম খেতে কাসুন্দি। বাঙালির সরিষা ও সরিষার তেল লাগবেই। তাই আজ আপনাদেরকে আমরা সরিষার তেল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানাবো।

বাঙালির ঐতিহ্যে সরিষার তেল ও সরিষা

বাঙালির সাহিত্যে ও ঐতিহ্যে সরিষার উল্লেখ্য বহু প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে। এটাকে কখনো সর্ষপ, কখনো বা রাই বলেও উল্লেখ্য করা হয়। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এর আবেদন এখনো ফুরাবার নয়।
সরিষার তেল আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গেই যেন মিশে আছে। একটা সময় পল্লীগ্রামের একমাত্র ভোজ্যতেল ছিল সরিষার তেল। আমরা যে আজকাল তেলে ভেজে পিঠাপুলি খাই—এটা একসময় সরিষার তেলে ভাজা হতো। এছাড়া সরষে ইলিশের কথা কোনো বাঙালির অজানা নয়। সরির্ষার তেল দিয়ে তৈরি রান্নার সুঘ্রান মোহনীয়। এখনো বিভিন্ন ভর্তাতে সরিষার তেলের বিকল্প অন্য তেল অকল্পনীয়। নাস্তায় মুড়ি মাখাতেও সরিষার তেলের জুড়ি মেলা ভার।

বাংলার উর্বর মাটিতে সরিষার চাষ সেই প্রাচীনকাল থেকে হয়ে আসছে। এর হলুদ ফুলে আচ্ছন্ন ক্ষেত দেখতে চমৎকার সুন্দর। এর ফুল থেকেও সরিষার সুন্দর ঘ্রাণ পাওয়া যায়।

সরিষার তেলের ব্যবহার

সরিষার তেল ওষুধি গুণাগুণ সম্পন্ন। প্রাচীনকাল থেকেই আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় সরিষার তেল ব্যবহৃত হচ্ছে। এই সরিষার তেলের যেমন প্রয়োজনীয়তা আছে তেমনি উপকারীতাও অনেক। ভারতবর্ষে খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার বছর থেকে সরিষার ব্যবহার হচ্ছে। সরিষার তেল অন্ত্রে পাচকরস উৎপাদনে সাহায্য করে ফলে হজমপ্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন হয়। এছাড়া এই প্রক্রিয়ায় ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়। সুস্বাস্থ্য ধরে রাখতে এই তেলের ব্যবহার করা হয়।

ছোট বড় সকলেই এই তেল শরীরে মাখে। বিশেষ করে ছোট বাচ্চাদের ত্বক এবং হাঁড় মজবুত করার জন্য এই তেল মালিশ করা হয়।

তবে ইদানিং বাঙালির রান্নাঘরে সরিষার তেলের ব্যবহার দিন দিন কমছে। কিন্তু যারা এই তেলের গুণাগুণ সম্পর্কে অবগত আছেন, তারা নিয়মিত সরিষার তেলের ব্যবহার করে চলেছেন।

সরিষার তেল কিভাবে উৎপন্ন হয়?

কৃষক হালকা আর্দ্র জমির মাটি কর্ষণ করে তাতে সরিষা বীজ ছিটিয়ে দেয়। এরপর এটা বড় হলে ফুল হয়। সেই ফুল থেকে সরিষার বীজ উৎপন্ন হয়।
সরিষাবীজ থেকে তৈরি হয় সরিষার তেল। আগে কাঠের ঘানিতে পিষে সরিষার তেল উৎপন্ন হতো। তবে এখন যান্ত্রিক উপায়ে তা খুব অল্প সময়ে ও সহজে উৎপন্ন করা হচ্ছে। এই তেল গাঢ় বাদামি এবং তামাটে বর্ণের। এর স্বাদ কিছুটা ঝাল। এটা ঝাঁঝালো সুবাসযুক্ত তেল।

সরিষার তেলের পুষ্টিগুণ

সরিষার তেলে ওমেগা আলফা-৩ ও ওমেগা আলফা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ভিটামিন ই বিদ্যমান। এটা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের সমৃদ্ধ উৎস হওয়াতে এই সরিষার তেলকে স্বাস্থ্যকর তেল বলা চলে। নানান ভোজ্য তেলের ওপর করা এক সমীক্ষায় দেখা যায়, সরিষার তেল ৭০ শতাংশ হৃৎপিণ্ড–সংক্রান্ত রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। সরিষার তেল খাদ্যে ব্যবহারে শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা কিছুটা কমে। যা হৃদরোগের আশঙ্কা কমায়।

১০০ গ্রাম সরিষার তেলে ৮৮৪ ক্যালোরি থাকে। ১১% স্যাচুরেটেড ফ্যাট। ৫৯% মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট। ২১% পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে।

সরিষার তেলের উপকারিতা

সরিষার তেলের উপকারিতা

সরিষার তেল ব্যবহারের নানান উপকারিতা রয়েছে। সরিষার তেলের উপকারিতা ও অপকারিতা প্রবন্ধে আমরা সরিষার তেলের যাবতীয় তথ্য তুলে ধরছি।

মালিশ কাজে সরিষার তেলের ব্যবহার
বাংলায় শিশুদের দেহ মালিশ করতে খাঁটি সরিষার তেলের ব্যবহার হয়ে আসছে বহু আগে থেকে।
এছাড়া সরিষা তেল ঠান্ডা ও কাশি উপশমে সাহায্য করে। যখন বুকে মালিশ করা হয়, তখন তার ঝাঁঝালো সুবাস নিশ্বাসের মাধ্যমে নেওয়া হয়। এটা শ্বাসযন্ত্রের নালির থেকে কফ অপসারণ করতে সাহায়ক হয়।

চুলের বৃদ্ধিতে সহায়ক সরিষার তেল
সরিষার তেল চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। অকালে চুল সাদা হওয়া রোধ করতে ও চুল পড়া কমায় বলে ধারণা বিজ্ঞদের। সরিষার তেলে প্রচুর ভিটামিন ও খনিজ উপাদান থাকে। বিশেষ করে উচ্চমাত্রায় বিটা ক্যারোটিন থাকে এতে। বিটা ক্যারোটিন চুলের বৃদ্ধিতে সাহায়তা করে। তাছাড়া এতে থাকা আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফ্যাটি অ্যাসিড ও ম্যাগনেশিয়াম, যা চুলের বৃদ্ধিতে খুবই সাহায্য করে। এছাড়া রাতে চুলে সরিষার তেল মালিশ করলে চুল কালো হয়।

ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে উপকারী সরিষার তেল
সরিষার তেলে গ্লুকোসিনোলেট নামক উপাদান থাকে, যা অ্যান্টিকারসিনোজেনিক উপাদান হিসেবে পরিচিত। তাই এটি ক্যানসারজনিত টিউমারের গঠন প্রতিরোধে সাহায্য করে। এর ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট কোলোরেক্টাল ও গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল ক্যানসার থেকে সুরক্ষাও প্রদান করে।

চুল পাকা রোধ করতে সরিষার তেল
সরিষা তেলের পুষ্টি উপাদান, ভিটামিন এবং মিনারেল আকালে চুল পাকা রোধ করে থাকে। প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এই তেল চুলে এবং মাথার তালুতে মালিশ করলে এটা চুল পাকা রোধ করবে।

উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে
সরিষার তেল পরিপাকতন্ত্রের পরিপাককার্য, রক্ত সংবহন ও রেচনতন্ত্রের শক্তিশালী উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। এছাড়া এটা খাওয়ার পাশাপাশি বাহ্যিকভাবে শরীরে মালিশ করলে শরীরের রক্ত সঞ্চালন এবং ঘর্মগ্রন্থি উদ্দীপ্ত হয় এবং শরীরের তাপমাত্রা কমে শরীরে প্রশান্তি আনে।

ঠোঁটফাটা রোধ
শীতকালে ঠোঁট ফাটা খুব সাধারণ একটি সমস্যা। অনেকের এই সমস্যা এতই তীব্র হয়ে থাকে যে লিপবামে কাজ হয় না। অল্প একটু সরিষার তেল ঠোঁটে লাগালে এই প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার ঠোঁটফাটা রোধ করে ঠোঁট নরম ও কোমল করে তুলবে। শুষ্ক ঠোঁটের যত্নে সরিষার তেল ভালো ফলাফল দেয়।

ত্বকের তামাটে ভাব দূর করতে সরিষার তেল
সরিষার তেল ত্বকের তামাটে ভাব ও অবাঞ্ছিত দাগগুলো দূর করতে এবং ত্বককে প্রাকৃতিক উপায়ে উজ্জ্বল করতে সহায়তা করে। এর জন্য অল্প বেসন, দই ও সরিষার তেল এবং কয়েক ফোঁটা লেবুর রস একত্রে মিশিয়ে মিশ্রণটি ত্বকে লাগাতে হবে। ১০-১৫ মিনিট রেখে দিয়ে ঠান্ডা পানি দ্বারা ধুয়ে ফেলতে হবে। উত্তম ফলাফল পেতে সপ্তাহে তিনবার ব্যবহার করা উচিত। এই প্রসাধনীর পদ্ধতিটাকে সংক্ষেপে ‘উপটান’ বলে।

কার্ডিওভাসকুলার রোগ রোধে উপকারিতা
সরিষার তেল মনোস্যাচুরেটেড ও পলিস্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ। ফলে কোলেস্টেরলের ভারসাম্য রক্ষা করতে সরিষার তেল সাহায্য করে এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি কমে।

সরিষার তেল একটি প্রাকৃতিক সানস্ক্রিন
সরিষার তেল খুবই ঘন হয় এবং এটায় উচ্চমাত্রার ভিটামিন ই বিদ্যমান। এই তেল ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি প্রতিরোধ করে এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থ থেকে ত্বককে সুরক্ষা প্রদান করে। তাই সরিষার তেল ত্বকের ক্যানসারও প্রতিরোধ করতে সহায়ক পারে। ভিটামিন ই মুখের বলিরেখা ও বয়সের ছাপ দূর করতে সাহায্য করে থাকে। তাই সানস্ক্রিন লোশনের মতো সরিষার তেল ব্যবহার করা যেতে পারে। এই তেল কিছুটা ঘন, তাই ত্বকে প্রয়োগের পর ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে। যাতে অতিরিক্ত তেল ত্বকে লেগে না থাকে। নচেৎ ধুলাবালু জমে ত্বকের ভালোর চাইতে মন্দ করতে পারে বেশি।

সরিষার তেল ব্যবহারে সাবধানতা

সরিষা তেল ক্রয় করার আগে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে যে সরিষার তেলটি খাঁটি। কেননা অসাধু ব্যবসায়ীরা পামওয়েলে কৃত্রিম রঙ এবং ঝাঁঝালো কেমিক্যাল মিশ্রণ করে ভেজাল সরিষার তেল বাজারজাত করে। নকল বা ভেজাল সরিষার তেল ব্যবহারের ফলে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে অনেক।
ভেজাল সরিষার তেল ব্যবহার করলে শরীরে নানা ধরনের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

সরিষার তেলের অপকারিতা

বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছে, সরিষার তেলে ইউরিক এসিড বেশি পরিমাণে থাকে। এটা হৃদপিন্ডের বিভিন্ন রোগ তৈরিতে সাহায্য করে। এই ধারণা থেকে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরিষার তেল ব্যান করা হয়েছে বা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ এর চাইতে বেশি ব্যবহার করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ওইসকল দেশে সরিষা থেকে উৎপন্ন সস ব্যবহারে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।

তাই আমাদের উচিত সরিষার তেল পরিমিত ব্যবহার করা। সরিষার তেলের উপকারিতা ও অপকারিতা প্রবন্ধটি মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top