বেগুনি রঙের রসে টইটম্বুর মিষ্টি একটি ফল জাম। এটা খেতে কার না পছন্দ হবে। এটাতে হালকা টক স্বাদ রয়েছে। গ্রীষ্মকালের সুস্বাদু এই ফলটিতে আছে ভিটামিন ও খনিজ পুষ্টিগুণ। এছাড়া আছে নানান ধরনের ঔষধি বৈশিষ্ট্য। তাই ঐটা অন্যান্য ফলের তুলনায় অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর।
কেননা এটাতো চিনির মাত্রা খুবই কম। যা ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে ও ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য জাম খুবই উপকারী। কারণ এতে আছে অ্যান্টি-ডায়াবেটিক প্রোপার্টিজ। এর ফলে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। এটা স্টার্চ ও চিনিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং শরীরে শক্তির সঞ্চার করে।
সাহিত্যে জাম
এই জাম আমাদের দেশীয় একটি ফল গাছ। যেহেতু এটা এই বাংলায় সেই প্রাচীনকাল হতে জন্মাচ্ছে, তাই এটাকে নিয়ে কবি সাহিত্যিকদের অন্যরকম এক মোহ কাজ করে। ক্লাসিক্যাল কাব্যে জাম গাছের উল্লেখ্য রয়েছে। জাম ফলের কথা বহু জায়গায় বলা হয়েছে। এই ফল গাঢ় বেগুনি রঙের হয়। এটা খেলে জিব্বা বেগুনি রঙে রঙিন হয়ে যায়। তাই শিশুরা এটা খাওয়ার পর খুবই আনন্দিত হয়।
তাই তো আমাদের পল্লী কবি জসীমউদ্দীন তার কবিতায় জামের উল্লেখ্য করেছেন। এই কবিতা পাঠ করেনি এমন বাঙালি খুব কমই রয়েছে। তাই স্মৃতি জাগ্রত করে দেওয়ার জন্য সম্পূর্ণ কবিতাটা এখানে দেওয়া হলো।
“আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা,
ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে
মামার বাড়ি যাই।
মামার বাড়ি পদ্মপুকুর
গলায় গলায় জল,
এপার হতে ওপার গিয়ে
নাচে ঢেউয়ের দল।
দিনে সেথায় ঘুমিয়ে থাকে
লাল শালুকের ফুল,
রাতের বেলা চাঁদের সনে
হেসে না পায় কূল।
আম-কাঁঠালের বনের ধারে
মামা-বাড়ির ঘর,
আকাশ হতে জোছনা-কুসুম
ঝরে মাথার ‘পর।
রাতের বেলা জোনাক জ্বলে
বাঁশ-বাগানের ছায়,
শিমুল গাছের শাখায় বসে
ভোরের পাখি গায়।
ঝড়ের দিনে মামার দেশে
আম কুড়াতে সুখ
পাকা জামের শাখায় উঠি
রঙিন করি মুখ।
কাঁদি-ভরা খেজুর গাছে
পাকা খেজুর দোলে
ছেলেমেয়ে, আয় ছুটে যাই
মামার দেশে চলে।”
এছাড়া বিভিন্ন গল্প উপন্যাসেও জামের উল্লেখ করেছে। এই ফলটির প্রতি সবচাইতে বেশি আকর্ষণ শিশু-কিশোরদের। কেননা এই ফলটি যখন তাকে তখন ওরাই সবার আগে গাছে ঢিল দেওয়া শুরু করে। বড় হওয়ার পর ওই সকল স্মৃতি মনে করে মানুষজন পুলকিত হয়।
শুধু বাংলাদেশ নয়, হিন্দি সাহিত্যের একজন লেখক কৃষণ চন্দর সাহেব উনার একটি গল্পের শিরোনাম দিয়েছেন “এক জামুন কি পেড়’ অর্থাৎ ‘একটি জাম গাছ।’
জামের আদি নিবাস
জ্যাম সম্পূর্ণ দেশীয় একটি ফল। জাম ফল ১ থেকে ২.৫ সেন্টিমিটার লম্বা। এটা গোল ও লম্বাটে। জাম গাছ ১৪ থেকে ৬০ ফুট বা এর বেশিও লম্বা হয়ে থাকে। জাম গাছের পাতা চকচকে সবুজ, বড়, চামড়া পুরু। গাছি চিরসবুজ তাই ছায়াও অনেক বেশি। জাম গাছের পাতার আরেকটি বিশেষ গুণ হচ্ছে, এর পাতাটা কিছুটা সুগন্ধিযুক্ত। অনেকটা কাঁচা জামের মতো ঘ্রাণ।
আরও পড়ুন: কাঁঠালের বিচি খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
জাম এই ভারত উপমহাদেশ থেকে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়েছে এবং এটা বর্তমানে সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ দেশগুলোতে বেশি দেখা যায়।
আমাদের দেশে প্রধানত দুটি জাতের জাম পাওয়া যায়। একটি হলো ‘ক্ষুদি জাম’— যা খুব ছোট আকৃতির হয়। এই জামের নরম অংশ কম থাকে।
অপরটি হলো ‘মহিষে জাম’— যেটা ছোট দামের চাইতে বেশ একটু বড় ও মিষ্টি স্বাদের হয়। এটি বর্ষাকালে পাওয়া যায়। এই জাম ফলের গা কালো এবং খুব মসৃণ পাতলা আবরণ দিয়ে ঢাকা থাকে। উপরের কালো বা কালচে বেগুনি পাতলা আবরণের নিচেই থাকে টসটসে মিষ্টি রসালো জামের শাস। যা খুবই সুস্বাদু খেতে।
জাম চাষ
বাংলাদেশে প্রাকৃতিকভাবে গ্রামীণ বন জঙ্গল অথবা পাহাড়ি বন জঙ্গলে জাম গাছ হয়ে থাকে। পাখি জাম আহার করে এবং এটার বিচি হজম হয় না। এরপর পাখি যেখানে মলত্যাগ করে সেখানে বিচি থেকে জামের চারা গাছ গজিয়ে ওঠে। এছাড়া গ্রামের লোকজন বাড়ির পাশে অথবা রাস্তার ধারে জাম গাছ লাগায়। এর জন্য বিশেষ পরিচর্যা বা যত্ন দরকার হয় না। বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে কেউ জামের বাগান তৈরি করে না। কম মানুষই এখন তাদের ফল বাগানে জামগাছ লাগায়। কেননা, জামগাছ লাগিয়ে ফল পেতে পেতে কমপক্ষে ১০-১২ বছর লেগে যায়। এছাড়া কলম করা গাছেও আশানুরূপ ফল হয় না। জাম গাছ অনেক উঁচু হয়। সেই উঁচু গাছ থেকে জাম পাড়তেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। তাই পূর্ব থেকে লাগানো গাছ থেকেই ফল আহরণ করে ফল বিক্রেতারা। এবং সেগুলোই বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। যা চাহিদার তুলনায় খুবই কম।
সাম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জের কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক ও উদ্যানতত্ত্ববিদ মো. মাযদার হোসেনের উদ্যোগে হর্টিকালচার সেন্টারের মধ্যে লাগানো ইন্দোনেশিয়ার একটি খাটো ও সুস্বাদু জাতের জামগাছের পরীক্ষামূলক বংশ বিস্তার কাজ শুরু হয়েছে এবং সেটা সম্প্রসারণের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। এই বিশেষ জাতের জাম গাছের চারা কলম তৈরি করা হচ্ছে বিক্রির জন্য। এই জাতের বিশেষত্ব হচ্ছে, দু-তিন বছরের মধ্যেই গাছ থেকে ফল আহরণ করা যাবে। বেশি উঁচু না হওয়াতে হাত দিয়েই ফল পাড়া যাবে। বাড়ির ছাদে বড় টবে লাগিয়েও জাম খাওয়া যাবে।
সাধারণত জাম গাছে মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে ফুল আসে। জামের ফুল ছোট এবং কড়া ঘ্রাণযুক্ত। মে ও জুন মাসে জাম ফল বড় হয়। শুরুতে জাম সবুজ থাকে এবং পরে গোলাপি হয়। যখন এটা পাকে তখন কালো বা কালচে বেগুনি হয়ে যায়। এটি খেলে জিহ্বাও বেগুনি রঙে রঙিন হয়।
কিন্তু এই বিশেষ জাতের জাম গাছে ফল পাওয়া যাবে প্রায় আড়াই মাস পর্যন্ত। ফলে বাংলাদেশের চাহিদা পূরণ করার ক্ষেত্রে ভালো অবদান রাখতে পারে।
জামের মধ্যে থাকা পুষ্টিগুণ
জাম দেখতেও খেতে শুধু সুন্দর ও সুস্বাদু নয়, এর মধ্যে আছে অনেক পুষ্টিগুণ। ‘জাম খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা’ প্রবন্ধে এর পুষ্টিগুণ উল্লেখ করা হলো।
প্রতি ১০০ গ্রাম জামের মধ্যে থাকা পুষ্টিগুণ—
- শক্তি ২৫১ কিলো জুল
- শর্করা ১৫.৫৬ g
- স্নেহ পদার্থ ০.২৩ g
- প্রোটিন ০.৭২ g
- ভিটামিন এ ৩ IU
- থায়ামিন (বি১) ০.০০৬ মিগ্রা
- রিবোফ্লাভিন (বি২) ০.০১২ মিগ্রা
- নায়াসিন (বি৩) ০.২৬০ মিগ্রা
- প্যানটোথেনিক অ্যাসিড (বি৫) ০.১৬০ মিগ্রা
- ভিটামিন বি৬- ০.০৩৮ মিগ্রা
- ভিটামিন সি ১৪.৩ মিগ্রা
- ক্যালসিয়াম ১৯ মিগ্রা
- লৌহ ০.১৯ মিগ্রা
- ম্যাগনেসিয়াম ১৫ মিগ্রা
- ফসফরাস ১৭ মিগ্রা
- পটাশিয়াম ৭৯ মিগ্রা
- সোডিয়াম ১৪ মিগ্রা
- পানি ৮৩.১৩ g
জামের ঔষধি গুণ
প্রচুর পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ জাম গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালের একটি প্রিয় ফল। ছেলে বুড়ো সকলের প্রিয় রসালো এই মিষ্টি স্বাদের ফলটি ত্বক, চুল ও স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। জামের কিছু ঔষধি গুণ জেনে নেওয়া যাক।
জেনে নিন: জামরুল খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: কালো জামে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান আছ। যার মধ্যে পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম অন্যতম। এগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে কাজ করে।
ডায়াবেটিসের ঝুঁকি: জাম ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। জামের গ্লিসামিক ইনডেক্স কম হওয়ায় এটি ডায়াবেটিসের জন্য ভালো বলে বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত। জামের বিচি রক্তের সুগার লেভেল ৩০% অবধি কম করতে সাহায্য করে।
হৃদরোগের ঝুঁকি: জামে আছে এলাজিক এসিড বা এলাজিটেনিন্স, এন্থোসায়ানিন এবং এন্থোসায়ানিডিন্স। এই উপাদানগুলো শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে কোলেস্টেরলের জারণ রোধ করতে। এটা হৃদরোগ সৃষ্টিকারী প্লাক গঠনেও বাধা প্রদান করে।
ইনফেকশন: কবিরাজি চিকিৎসায় জাম গাছের বাকল, পাতা ও বীজ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ম্যালিক এসিড, গ্যালিক এসিড, অক্সালিক এসিড এবং ট্যানিন থাকে জাম গাছে। এই জন্যই জাম গাছের পাতা, বাকল, বিচি ও এর ফল ম্যালেরিয়া রোধী, ব্যাকটেরিয়ারোধী হিসেবে কাজ করে।
পরিপাক: আয়ুর্বেদিক ঔষধে জাম পাতা ব্যবহার করা হয় ডায়রিয়া ও আলসার নিরাময়ে। এছাড়াও মুখের বিভিন্ন সমস্যার ঔষধ তৈরিতেও জামপাতা ব্যবহৃত হয়। জাম খেলে মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়, দাঁত ও মাড়ি শক্ত ও মজবুত করে। এটায় থাকা ভিটামিন সি দাঁতের মাড়ির ক্ষয় রোধে সাহায্য করে।
ক্যান্সার: একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা গেছে, জাম ফলের নির্যাসে রেডিওপ্রোটেক্টিভ থাকে। যেটা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ফ্রি র্যাডিকেলের কাজ ও বিস্তারে বাধা দেয়।
মানসিক স্বাস্থ্য: জাম ফল ত্বককে তারুণ্যদীপ্ত রাখতে সাহায্য করে। জাম স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এই জামে থাকা ভিটামিনগুলো পেশির টিস্যুকে টান টান হতে সাহায্য করে।
জাম খাওয়ার উপকারিতা

জাম যে শুধু সুস্বাদু ও রসালো একটি ফল তা কিন্তু নয়। এর রয়েছে নানান ধরনের উপকারিতা। জাম খেলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের উপকার সাধিত হয়। জাম খেলে ত্বকের সমস্যা থেকে শুরু করে ডায়াবেটিস, রক্তচাপসহ একাধিক রোগভোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। তাই সবার এই ফলের উপকারগুলো জেনে রাখা উচিত। ‘জাম খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা’ শীর্ষক আর্টিকেলে এটা নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
জাম বিপুল পরিমাণ আয়রন সমৃদ্ধ। যা রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ায়। ফলে রক্ত শরীরের অঙ্গগুলোতে আরও বেশি অক্সিজেন বহন করে এবং শরীর সুস্থ রাখে। এছাড়া রক্ত পরিশুদ্ধ করতে জামের বিশেষ অবদান রয়েছে।
আমাদের এই দেশীয় সহজলভ্য ফলটি চোখ ও ত্বকও ভালো রাখে। এই গ্রামে থাকে পটাশিয়াম ভরপুর মাত্রায়— যা হার্ট সুস্থ রাখে। পটাশিয়াম হার্টের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এই ফলটি উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের মতো রোগব্যাধি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
জাম মানব দেহের ধমনীও সুস্থ রাখে। পেতে থাকা ভিটামিন সি ও ক্যালসিয়াম মাড়ি ও দাঁত মজবুত করে। জাম মাড়ি ও দাঁতের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
যাদের মুখে দুর্গন্ধ হয় এবং মারি ফুলে থাকে অথবা মাটি থেকে পুঁজ বের হয় তাদের জন্য জামের পাতা খুবই উপকারী। জামের পাতা দিয়ে মেসওয়াক করলে অথবা জামের পাতা পেস্ট করে মুখে ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়।
জাম খাওয়ার অপকারিতা
জাম নিঃসন্দেহে একটি পুষ্টিকর ফল। কিন্তু কোনো জিনিসই বেশি খাওয়া ঠিক নয়। যাদের বদহজমের সমস্যা আছে তাদের জন্য জাম বেশি খাওয়া উচিত না। কেননা জামের খোসা সহজে হজম হয় না। হলে অনেকের বদহজম হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় জাম বেশি খাওয়ার জন্য পেটে ব্যথা শুরু হয়।
তবে জাম আহামরি কোনো ক্ষতিকর ফল নয়। মৌসুমে মাত্র কিছুদিন এটা বাজারে থাকে। এরপর এটা বেমালুম গায়েব হয়ে যায়। তাই যদি কারো অতীব সমস্যা না থাকে তাহলে বেশি পরিমাণে গ্রাম খেলেও ক্ষতি নেই।
উপসংহার
জাম গাছের সংখ্যা দিলে ধীরে বাংলার জমিনে কমে যাচ্ছে। অধিক হারে বৃক্ষ কর্তনের কারণে দেশীয় এই ফল গাছটি এখন আর তেমন দেখা যায় না। তাই আমাদের উচিত এই গাছ বেশি করে রোপণ করা। এই ফল খেতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। ‘জাম খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা’ আর্টিকেলটি পড়ার জন্য সকলকে ধন্যবাদ।