কাঁঠালের বিচি খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা

আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল। কিন্তু অনেকে এমনও আছে যারা এটি খেতে এতটা পছন্দ করে না। অনেকে এই রসালো ফলটি না খেলেও এটার বিচি খেতে অত্যন্ত পছন্দ করে। কাঁঠালের বিচি ভর্তা বা মাছ-মাংসের সঙ্গে রান্না করে কিংবা শুধু ভেজেও খাওয়া যায়।

এখন এই গ্রীষ্মের শেষে চলছে পাকা কাঁঠালের মৌসুম। অনেকে এই ফল না খেলেও ঠিকই এর বিচি নিশ্চয় খাবেন। কাঁঠালের বিচি বাজারে আলাদা কেজি দরেও কিনতে পাওয়া যায়। বর্ষাকালে বৃষ্টির মধ্যে যখন কোথাও বের হওয়া যায় না। বারান্দায় বসে তাওয়ায় সেঁকা কাঁঠালের বিচি আর চা হলে তো আর নাশতায় কিছু না হলেও চলবে। কাঁঠালের বিচি কিছুটা বাদামের মতো। তাই অনেকে এটাকে ভেজে বাদামের মতো খায়। কাঁঠালের বিচি নানা পদের তরকারির সাথেও খাওয়া যায়। তাইতো গৃহিণীদের পছন্দের বস্তু এই কাঁঠালের বিচি।

কাঁঠালের বিচির ঔষধি গুণ

কাঁঠালের বিচিতে রয়েছে অনেক পুষ্টি। এই পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ কাঁঠালের বিচিতে আছে অনেক রোগের চিকিৎসা। আপনাদের জন্য ‘কাঁঠালের বিচি খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে এর কিছু ঔষধি গুণ তুলে ধরা হলো।

১. কাঁঠালের বিচি হজমশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে এবং বদহজম রোধ করে থাকে।

২. যাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা আছে তারা কাঁঠালের বিচি খেলে অনেক উপকার পেতে পারেন। এটা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়তা করে।

৩. কাঁঠালের বিচিতে থাকে প্রোটিন ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস— যা মানসিক চাপ কমাতে অনেক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

৪. কাঁঠালের বিচিতে থাকা পুষ্টিগুণ চেহারার বলিরেখা দূর করে ও ত্বকের বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

৫. কাঁঠালের বিচিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ । ফলে এটি শিশুদের চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি ও শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

৬. যাদের রাতকানা রোগ আছে তাদের জন্য ভিটামিন এ খুবই প্রয়োজন। কাঁঠালের বিচি রাতকানা রোগ সারতে সাহায্য করে।

৭. অনেকে আছে যাদের চুলের আগা ফেটে যায়। কাঁঠালের বিচি খেলে চুলের আগা ফাটা সমস্যা রোধ হয় ও চুল পড়া কমে।

৮. কাঁঠালের বিচিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন। এটি নিয়মিত খেলে তা শরীরে আয়রনের অভাব দূর হয় এবং রক্তশূন্যতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

কাঁঠালের বিচির পুষ্টিগুণ

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের ফল জন্মায় এবং সেগুলো বাঙালিরা খুবই শখ করে খায়। কিন্তু কোনো ফলের বিচি কাঁঠালের বিচির মতো এত জনপ্রিয় নয়। আমার জানামতে বাংলাদেশ অন্য কোনো ফলের বিচি কেউ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে না। অন্যান্য ফলের বিচির তুলনায় কাঁঠালের বিচি অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ। এটাতে আছে প্রচুর পরিমাণে স্টার্চ, প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল এবং অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট।

প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁঠালের বিচিতে থাকা পুষ্টিগুণ নিচে দেওয়া হলো—

  • শক্তি পাওয়া যায় ৯৮ ক্যালরি
  • কার্বোহাইড্রেট ৩৮.৪ গ্রাম
  • প্রোটিন ৬.৬ গ্রাম
  • ফাইবার ১.৫ গ্রাম
  • চর্বি ০.৪ গ্রাম
  • ক্যালসিয়াম ০.৫০ থেকে ০.৫৫ মিলিগ্রাম
  • ফসফরাস ০.১৩ থেকে ০.২৩ মিলিগ্রাম
  • আয়রন ১.২ মিলিগ্রাম
  • সোডিয়াম ২ মিলিগ্রাম
  • পটাশিয়াম ৪.০৭ মিলিগ্রাম।

কাঁঠালের বিচির উপকারিতা

কাঁঠালের বিচির উপকারিতা

অনেকে আছে কাঁঠাল খেতে পারে না কারণ এর মধ্যে আছে প্রচুর পরিমাণে মিষ্টি। যা ডায়বেটিস রোগীদের জন্য কিছুটা ক্ষতিকর। তবে তারা অনায়াসে কাঁঠালের বিচি ভক্ষণ করতে পারে।

কাঁঠালের বিচিতে আছে প্রচুর পরিমাণে থায়ামিন ও রিবোফ্লাভিন। এ দুটোই ভিটামিন বি। এরা শরীরে শক্তি সংরক্ষণের পাশাপাশি নার্ভস সিস্টেম, হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক, অন্ত্র, মাংসপেশি ইত্যাদির দেখভাল করে থাকে।

কাঁঠালের বিচিতে আছে ফাইবার ও রেজিস্ট্যান্ট স্টার্চ। এই পদার্থ পেটে সহজে হজম হয় না। কিন্তু অন্ত্রে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ফাইবার ও রেজিস্ট্যান্ট স্টার্চ সহজে হজম না হওয়ার ফলে ক্ষুধা কম লাগে। মাত্রাতিরিক্ত ক্ষুধায় কয়েকটি কাঁঠালের বিচি খেলে ক্ষুধা নিবারণ হয়। রক্তে শর্করার মাত্রা কমায়।

আরও পড়ুন: ডালিম খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কাঁঠালের বিচিতে আছে বেশ কিছু অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান। ডায়রিয়া, গ্যাসের সমস্যায় আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় কাঁঠালের বিচিরকাঁঠালের বিচির গুঁড়া ব্যবহার করা হয়। কাঁঠালের বিচির পৃষ্ঠতলে ছোট ছোট কণার মতো উপাদান আছে— যেগুলো হলো একপ্রকার অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এজেন্ট। পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে— এই এজেন্টগুলো সাধারণ ব্যাকটেরিয়া যেমন ই–কোলাইয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে থাকে। ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া সাধারণত ডায়রিয়া বা অন্যান্য খাদ্যজনিত পেটের অসুখের মতো সমস্যা তৈরি করে।

কাঁঠালের বিচিতে আছে অ্যান্টিক্যানসার উপাদান
আরো আছে অনেক উদ্ভিদ যৌগ এবং অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট। অ্যান্টি–অক্সিডেন্টের ভেতর রয়েছে ফ্ল্যাভোনয়েডস, স্যাপোনিনস, ফেনোলিকস। গবেষণায় দেখা গেছে যে— এই উদ্ভিদ যৌগ এবং অ্যান্টি–অক্সিডেন্টগুলো শরীরের ইনফ্ল্যামেশনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম। এগুলো রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এমনকি ডিএনএ ড্যামেজ হলে সেটা মেরামত করতেও সাহায্য করে।

কাঁঠালের বিচি হজমক্রিয়ায় সহায়তা করে
অন্যান্য ফলের বিচির মতো বা শস্যের মতো কাঁঠালের বিচিতে দ্রবণীয় এবং অদ্রবণীয় দুই প্রকারের ফাইবার থাকে। অদ্রবণীয় ফাইবারগুলো সহজে হজম হয় না কিন্তু এগুলো পেটে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়া গুলোর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলে পেটের অন্যান্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া কমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়।

কোলেস্টেরল কমাতেও কাঁঠালের বিচির ভূমিকা আছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে— কাঁঠালের বিচি রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল (এলডিএল) কমায় এবং ভালো কোলেস্টেরল (এইচডিএল) বৃদ্ধি করে। এইচডিএল কোলেস্টেরল যেটা হৃদযন্ত্রের জন্য অনেক উপকারী। আর এলডিএল অর্থাৎ খারাপ কোলেস্টেরল হৃদরোগ সৃষ্টির পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।

কাঁঠালের বিচির অপকারিতা

কাঁঠালের বিচি অতিমাত্রায় খাওয়াটা ঠিক নয়। বরঞ্চ কোন কিছুই অতিমাত্রায় খাওয়া উচিত না। কাঁঠালের বিচি বেশি পরিমাণে খেলে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হওয়া লাগতে পারে।

আরও জেনে নিন: লেবুর উপকারিতা ও অপকারিতা

বিশেষ করে যাদের অ্যালার্জি রয়েছে, তাদের অনেক সময় কাঁঠালের বিচি খেলে এলার্জি বৃদ্ধি পায়। তাই তাদের উচিত যথাসম্ভব কাঁঠালের বিচি এড়িয়ে চলা। কেননা কিছু পুষ্টিগুণ পাওয়ার জন্য পুরো শরীরকে এলার্জি দিয়ে ভরিয়ে তোলার কোনো মানে হয় না।

কাঁঠালের বিচিতে বেশ কিছু ফাইবার আছে যেগুলো হজম হয় না। তাই কাঁঠালের বিচি বেশি পরিমাণে খেলে সেগুলো বদ হজমের কারণ হয়। পেটে গ্যাস উৎপন্ন হয়। যা খুবই অস্বস্তিকর ব্যাপার।

এগুলো ছাড়া কাঁঠালের বিচি খেলে কেমন কোনো রোগ অথবা সমস্যার কথা শোনা যায়নি। কাঁঠালের বিচি যদি ভালোভাবে রান্না করা হয় তাহলে এ সকল সমস্যা থেকেও পরিত্রান পাওয়া সম্ভব। তাই আমরা ‘কাঁঠালের বিচি খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা’ আর্টিকেলে কাঁঠালের বিচি রান্না করার কয়েকটা রেসিপি তুলে ধরছি।

কাঁঠালের বিচি রান্নার রেসিপি

কাঁঠালের বিচি রান্নার রেসিপি

কাঁঠালের বিচি এক একজন এক এক ভাবে রান্না করে। এটা রান্না করার জন্য কোনো বাঁধা-ধরা নিয়ম নেই। তবে যারা নতুন রাধুনী তাদের জন্য কয়েকটা রেসিপি এখানে উল্লেখ্য করা হলো। এগুলো খুবই সহজ রেসিপি তাই যে কেউ রান্না করতে পারবে।

কাঁঠালের বিচির ভর্তা: কাঁঠালের বিচিগুলোর খোসা ছাড়িয়ে ভালোভাবে ধুয়ে তাওয়াতে সেঁকতে হবে। ভালোভাবে সেঁকা হলে সেগুলো হামানদিস্তায় অথবা পাতায় বেটে গুঁড়ো করতে হবে। এরপর তাতে পেঁয়াজ কুচি, শুকনো মরিচ, সরিষার তেল, অল্প পরিমাণ কাঁচা মরিচ ও স্বাদমতো লবণ মিশিয়ে ভালোভাবে মাখাতে হবে। হয়ে গেল সুস্বাদু কাঠালের বিচির ভর্তা।

কাঁঠালের বিচি দিয়ে মুরগির মাংস: কাঁঠালের বিচি দিয়ে মুরগির মাংস রান্না করলে সেটা খুব সুস্বাদ হয়। সর্বপ্রথম কাঁঠালের বিচির খোসা ছাড়িয়ে কিছুক্ষণ পানিতে চুবিয়ে রাখতে হবে যাতে করে কাঁঠালের বিচির কষগুলো দূর হয়। এরপর কাঁঠালের বিচি ভালো করে সিদ্ধ করতে হবে। সিদ্ধ কাঁঠালের বিচি হালকা আঁচে তেলে ভাজতে হবে। সেই সাথে পেঁয়াজকুচি, আদা-রসুন বাটা, এলাচ, দারচিনি, গরম মসলা দিয়ে মুরগির মাংস ভালোভাবে কষাতে হবে। মুরগির মাংস কষানো হয়ে গেলে পরিমাণ মতো পানি দিয়ে সিদ্ধ করতে হবে। সিদ্ধ হয়ে গেলে সামান্য পরিমাণ উপরে গরম মসলা ছিটিয়ে দিলে সুন্দর ঘ্রাণ ছড়াবে। এভাবেই কাঁঠালের বিচির মুরগির মাংস রান্না করতে হয়।

কাঁঠালের বিচির ডাল: কাঁঠালের বিচি দিয়ে খুব সুন্দর ডাল রান্না করা যায়। সর্বপ্রথম কাঁঠালের বিচির খোসা ছাড়িয়ে চিকন চিকন করে কেটে সিদ্ধ করতে হবে। এরপর বুটের ডাল অথবা মুগের ডালের সাথে মিশিয়ে স্বাভাবিক ডালের মতো করে রান্না করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে দাল যেন পাতলা না হয়। একটু ঘন থাকলে খেতে সুস্বাদু হবে।

শুঁটকি দিয়ে কাঁঠালের বিচি: শুঁটকি দিয়ে কাঁঠালের বিচি সুস্বাদু লাগে খেতে। পেঁয়াজ কুচি, রসুন কুচি, আদাবাটা, তেজপাতা, এলাচ, দারচিনি তেলে ভালোভাবে কষাতে হবে। এরপর যেকোনো শুঁটকি বিশেষ করে চ্যাপা অথবা লইট্টা শুটকি এবং কাঁঠালের বিচি কুচি কুচি করে কেটে উত্তম রূপে কষাতে হবে। মাঝে মাঝে একটু একটু পানি দিতে হবে যাতে মসলা পুড়ে না যায়। এভাবে এক সময় কাঁঠালের বিচি সিদ্ধ হয়ে যাবে এবং খেতে হবে অসাধারণ।

কাঁঠালের বিচি সংরক্ষণ করার উপায়

কাঁঠালের মৌসুম শেষ হয়ে গেলে কাঁঠালের বিচি কোথায় পাবেন? এটা নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। কাঁঠালের মৌসুম শেষ হওয়ার বেশ কয়েক মাস পর পর্যন্ত কাঁঠালের বিচি সংরক্ষণ করে রাখা যায়।

কাঁঠালের বিচি ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে খোসাসহ রোধে ভালো করে শুকাতে হবে। এরপর একটি বায়ু নিরোধক বয়ামে আটকে রাখতে হবে। প্রতি সপ্তাহে একবার অন্তত বের করে রোদে শুকাতে হবে। নচেৎ ছত্রাকের আক্রমণ হতে পারে।

এছাড়া কাঁঠালের বিচি রোস্ট করে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়।

  • যদি ফ্রি থাকে তাহলে কাঁঠালের বিচি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে পলিথিনে মুড়িয়ে বেশ কয়েক মাস সংরক্ষণ করা যায়।
  • কাঁঠালের বিচির উপকারিতা ও অপকারিতা’ আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পাঠ করার জন্য প্রিয় ভিজিটরকে ধন্যবাদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top