জাম্বুরা খাওয়ার উপকারিতা

জাম্বুরা খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা

জাম্বুরা বা বাতাবি লেবু বা তুরুনজা— যেটা বলেই ডাকা হোক না কেন, এটা এক প্রকার লেবু জাতীয় টক-মিষ্টি ফল। এর ইংরেজি নাম Pomelo (পমেলো)। বাংলাদেশের কিছু কিছু অঞ্চলে একে ছোলমও বলা হয়ে থাকে। কাঁচা ফলের বাহিরের দিকটা সবুজ রঙের হয়। এটি যখন পাকে তখন হালকা সবুজ বা ফ্যাকাসে হলুদ রঙের দেখা যায়।

জাম্বুরার মধ্যে থাকা কোয়াগুলোর রঙ সাদা বা গোলাপি হয়ে থাকে। এটার খোসা বেশ পুরু। জাম্বুরা খোসার ভিতর দিকটা ফোম এর মতো নরম। কারণ এটার খোসায় অনেক বাতাস থাকে। লেবু জাতীয় ফলের মধ্যে এটাই সবচাইতে বৃহৎ আকৃতির হয়ে থাকে।
জাম্বুরা সাধারণত ১৫-২৫ সেমি ব্যাস বিশিষ্ট হয়। এটার ওজন ১ থেকে ২ কেজি হয়।

এর আদিভূমি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হলেও এটা বাংলায় বহুকাল ধরে জন্মাচ্ছে। বাঙালিরা জাম্বুরার পরম ভক্ত। এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত জাম্বুরা ফল গাছে ধরে। এটার বাণিজ্যিক চাষ এখনো তেমনভাবে হয়নি। তবে এটা অন্যান্য ফলের তুলনায় দামে কম। তাই গ্রামাঞ্চলে এটা খুব সহজেই পাওয়া যায়।

এটা ভিটামিন সি এর দারুন উৎস। সস্তায় বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন পাওয়ার জন্য এই ফলের জুড়ি নেই। এই ফল অত্যন্ত রসালো। তাই প্রচন্ড রোদে অথবা গরমের সময় এই ফল খেলে শরীরের পানি শূন্যতা দূর হয়।

এই ফল বিভিন্নভাবে খাওয়া যায়। পথে-ঘাটে এই ফলের পসরা সাজিয়ে বসে অনেক ব্যবসায়ী— যারা এটার ভর্তা বানিয়ে বিক্রি করে। খুব সুস্বাদু হয়।

তাই আজকে ‘জাম্বুরার খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা’ প্রবন্ধে জাম্বুরার খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা নিয়ে কিছু আলোচনা করব।

জাম্বুরার মধ্যে থাকা পুষ্টিগুণ

জাম্বুরা একটি টক ফল। তবে পাকলে এটা কিছুটা মিষ্টি স্বাদের হয়। এই ফলটা খুবই সুস্বাদু ও মুখরোচক। কিন্তু আমরা অনেকেই জাম্বুরার পুষ্টিগুণ সম্পর্কে অবগত নই। তাই ‘জাম্বুরা খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা’ আর্টিকেলে জাম্বুরার পুষ্টিগুণ উল্লেখ্য করা হলো।

আরও পড়ুন: নিম পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা

প্রতি ১০০ গ্রাম বাতাবি লেবু বা জাম্বুরা ফাটা পুষ্টিগুণসমূহ—

  • খাদ্যশক্তি ৩৮ কিলোক্যালরি
  • প্রোটিন ০.৫ গ্রাম
  • স্নেহ ০.৩ গ্রাম
  • শর্করা ৮.৫ গ্রাম
  • খাদ্যআঁশ ১ গ্রাম
  • থায়ামিন ০.০৩৪ মিলি গ্রাম
  • খনিজ লবণ ০.২০ গ্রাম
  • রিবোফ্লেভিন ০.০২৭ মিলি গ্রাম
  • নিয়াসিন ০.২২ মিলি গ্রাম
  • ভিটামিন বি২ ০.০৪ মিলি গ্রাম
  • ভিটামিন বি৬ ০.০৩৬ মিলি গ্রাম
  • ভিটামিন সি ১০৫ মিলি গ্রাম
  • ক্যারোটিন ১২০ মাইক্রো গ্রাম
  • আয়রন ০.২ মিলি গ্রাম
  • ক্যালসিয়াম ৩৭ মিলি গ্রাম
  • ম্যাগনেসিয়াম ৬ মিলিগ্রাম
  • ম্যাংগানিজ ০.০১৭ মিলিগ্রাম
  • ফসফরাস ১৭ মিলিগ্রাম
  • পটাশিয়াম ২১৬ মিলিগ্রাম
  • সোডিয়াম ১ মিলিগ্রাম

এই ফলের বেশিরভাগ অংশ পানি। তাই এটা গরমে পানি শূন্যতা দূর করতে খুবই কার্যকর।

জাম্বুরা খাওয়ার উপকারিতা

জাম্বুরার ‍উপকারিতা

এতদিন আমরা জিহ্বার স্বাদের জন্য জাম্বুরা খেতাম। কিন্তু আমরা জানতাম না এতে কত পরিমাণ এবং কোন কোন পুষ্টি উপাদান রয়েছে। তাই হয়তো আমরা অনেকে এটাকে অবহেলা করতাম। কিন্তু আজ আমরা জাম্বুরা খাবার উপকারিতা সম্পর্কে জানব। জাম্বুরা খাওয়ার উপকারিতা রয়েছে অনেক। যা একটি একটি করে আলোচনা করা হচ্ছে।

  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে জাম্বুরা

জাম্বুরা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। জাম্বুরায় রয়েছে খুবই এক্টিভ এন্টিঅক্সিডেন্ট; যেমন- ভিটামিন সি— যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। ভিটামিন সি কোষের ক্ষয় কমায়— ফলে ত্বক থাকে সুন্দর। তারুণ্য ধরে রাখে। এছাড়া ভিটামিন সি কোষের প্রদাহ কমিয়ে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমায় অনেকাংশে।

  • শরীরের স্নায়ুবিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে জাম্বুরা

জাম্বুরায় রয়েছে ভিটামিন রাইবোফ্ল্যাভিন ও থায়ামিন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ভিটামিন। এটা শরীরের স্নায়বিক কার্যক্রমকে স্বাভাবিক রাখে। ফলে শরীর অসুস্থ হয় না।

  • দেহের খনিজ চাহিদা পূরণ করে জাম্বুরা

জাম্বুরায় রয়েছে অনেক খনিজ উপাদান। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পটাসিয়াম। পটাশিয়াম সবচেয়ে বেশি পরিমাণে আছে জাম্বুরায়। সেই সঙ্গে আছে কপার— যা দেহের খনিজ চাহিদা পূরণ করে এবং দেহকে রাখে সুস্থ। এতে আছে ক্যালসিয়াম। যা আমাদের হাড় মজবুত রাখে।

  • আঁশ সমৃদ্ধ ফল এই জাম্বুরা

জাম্বুরায় আছে অনেক পরিমাণে ফাইবার বা খাদ্য আঁশ। এই খাদ্য আঁশ খুব সহজে খাবারকে হজম করে ফেলে। অনেক পরিমাণে ফাইবার থাকায় হজম ও কোষ্টকাঠিন্য দূর করতে জাম্বুরা সাহায্য করে। এটা খাদ্যনালীতে উপকারী ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করে। সর্বোপরি এটা কঠিন খাদ্য হজমে সহায়ক হতে পারে।

  • ওজন নিয়ন্ত্রণে জাম্বুরা

জাম্বুরায় খুবই কম পরিমাণে ক্যালরি রয়েছে। তাই এটা শরীরে কোনো প্রকার কোলেস্টেরল জমতে দেয় না। ফলে দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। এছাড়া কোলেস্ট্রল অনেক সময় হার্ট অ্যাটাকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ কোলেস্ট্রল রক্তনালীগুলোতে রক্ত চলাচলে বাধা প্রদান করে। কিন্তু জাম্বুরায় কোন প্রকার কোলেস্টেরল উৎপাদন করার উপাদান নেই।

  • হৃদযন্ত্রের সুরক্ষায় জাম্বুরা

জাম্বুরায় থাকা উপাদান সমূহ রক্তে চর্বি জমতে দেয় না। ফলে রক্ত থাকে চর্বি মুক্ত। কেননা রক্তে চর্বি থাকলে রক্তনালিতে সে চর্বি জমে গিয়ে রক্ত চলাচলে বাধা প্রদান করে। ফলে হৃদ যন্ত্রে রক্ত প্রবাহ কমে গিয়ে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। তাই জাম্বুরা পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।

  • অন্তঃসত্ত্ব নারীর জন্য জাম্বুরা খুব গুরুত্বপূর্ণ

উপরে বর্ণিত পুষ্টি উপাদান, ভিটামিন ও খনিজ উপাদান সমূহ একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর জন্য খুবই প্রয়োজন। কেননা ওই সময় গর্ভে থাকা সন্তানের জন্য এই সকল ভিটামিন ও মিনারেল খুব দরকার। তাই অন্তঃসত্ত্বা নারীর জাম্বুরা খাওয়া উচিত। কেননা এতে রয়েছে বিপুল পরিমাণ পটাশিয়াম। যা গর্ভাবস্থায় খুব প্রয়োজন।

  • চুলের যত্নে জাম্বুরা

জম্বুরায় ক্যারোটিন রয়েছে। যা চুল গঠনে সাহায্য করে। তাই জাম্বুরা খাওয়া উচিত।

জাম্বুরা খাওয়ার অপকারিতা

জাম্বুরার মৌসুমে ছেলে বুড়ো সকলেই জাম্বুরা খেতে মেতে ওঠে। জাম্বুরাতে রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ। কিন্তু কোনো জিনিসই অতিরিক্ত ভালো নয়। জাম্বুরার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।

জেনে নিন: লিচু খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা

অতিরিক্ত জাম্বুরা খেলে পেট ব্যথা হতে পারে। কেননা জাম্বুরা একটি অম্ল জাতীয় ফল। জাম্বুরায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অম্ল জাতীয় উপাদান। যা পেটে গিয়ে এসিডিটি তৈরি করে। হলে পেট ব্যথা হয়। তাই জাম্বুরা পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।

যাদের কিডনিতে সমস্যা তাদের জাম্বুরা খাওয়া উচিত নয়। কারণ জাম্বুরাতে আছে পটাশিয়াম। এই পটাশিয়াম কিডনি রোগের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তাই জাম্বুরা এড়িয়ে চলা উচিত কিডনি রোগীদের জন্য। এছাড়া যাদের রক্তে পটাশিয়াম খুব বেশি পরিবারে রয়েছে— তাদেরও উচিত জাম্বুরা কম খাওয়া।

জাম্বুরার কোয়াগুলো সাদা, হালকা গোলাপি অথবা গাঢ় গোলাপি হতে পারে। রঙ যেমনই হোক না কেন— এদের পুষ্টিগুণ একই থাকে। কিন্তু পাকা জাম্বুরা, যেটা গোলাপি রঙ ধারণ করেছে— ওটাতে পরিমাণ একটু বেশি চিনি থাকে। যাদের ডায়াবেটিস মাত্র অতিরিক্ত বেশি— তাদের জন্য জাম্বুরা খাওয়ার আগে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

জাম্বুরা নিয়ে ভুল ধারণা

ছোটরা জাম্বুরা খেতে খুবই ভালোবাসে। গাছ থেকে পড়ে যাওয়া কাঁচা জাম্বুরা দিয়ে ওরা ফুটবল বানিয়ে খেলে। অনেক সময় জাম্বুরার খোসা ছাড়ানোর পর সেই খোসা বাচ্চারা মাথায় হেলমেটের মতো ব্যবহার করে। অনেকে বলে থাকে এভাবে মাথায় দিলে চুল পেকে যায়। কিন্তু এটার কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।

এছাড়া অনেকে বলে জাম্বুরা খেলে রক্ত পানি হয়ে যায়। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য। বরঞ্চ জাম্বুরা মানুষের শরীরে পানি শূন্যতা দূর করে।

জাম্বুরা কিভাবে খাবেন?

একেক মানুষ একেক ভাবে জাম্বুরা খেতে পছন্দ করে। জাম্বুরা কেউ বেশি পাকা পছন্দ করে, কেউ বা কম পাকা। জাম্বুরা কোন প্রকার বাড়তি উপকরণ মেশানো ছাড়াও খাওয়া যায়। তবে অনেকে এর সাথে লবণ, মরিচ মিশিয়ে খেতে পছন্দ করে। তাই ‘জাম্বুরা খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা’ প্রবন্ধে কয়েকটা জামুরা খাওয়ার রেসিপি বলে দিচ্ছি। আশা করি এভাবে খেতে আপনাদের ভালো লাগবে।

  • জাম্বুরা মাখা

প্রথমত জাম্বুরার কোয়া থেকে জাম্বুরার দানাগুলো আলাদা করতে হবে। এরপর একটি বাটিতে নিয়ে এটাতে খাঁটি সরিষার তেল, দুইটি কাঁচা মরিচ কুচি, একটি শুকনা মরিচ পোড়া, স্বাদ মতো লবণ দিয়ে মাখাতে হবে। তবে লবণ বেশি ব্যবহার করা উচিত নয় উচ্চ রক্তচাপ জনিত রোগীদের জন্য। এভাবে মাখিয়ে খেলে জাম্বুরা খুব মজা লাগে।

  • কাসুন্দি জাম্বুরা

জাম্বুরায় কাসুন্দি মাখিয়ে খেতে দারুন লাগে। কিন্তু বাজারে কাসুন্দিগুলো স্বাস্থ্যকর নয়। ওগুলো খৈলের সাথে সাইট্রিক অ্যাসিড ও অল্প পরিমাণ হলুদ মিশিয়ে অস্বাস্থ্যকর উপায়ে মোড়ক জাত করা হয়।

তবে ঘরেও কাসুন্দি বানানো যায়। এর জন্য খুব সহজ উপায় অবলম্বন করতে হয়। অল্প পরিমাণ সরিষা দানা বেটে এর সাথে এক বা দুই চামচ লেবুর রস মিশিয়ে দিলে খুব দারুণ কাসুন্দি হয়। এরপর পরিমাণ মতো লবণ মাখিয়ে জাম্বুরা খেতে অসাধারণ লাগে।

  • দই জাম্বুরা

আজকাল অনেকে অল্প পরিমাণ টক দই ও কাসুন্দির সাথে জাম্বুরা মাখিয়ে খাচ্ছে। যা খুবই সুস্বাদু। আপনিও চাইলে বাসায় এভাবে তৈরি করে খেতে পারে।

উপসংহার

জাম্বুরা খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে আমরা জানলাম। তবে আজকাল জাম্বুরা গাছ বিপুল পরিমাণে কেটে ফেলা হচ্ছে শুধুমাত্র নগরায়নের জন্য। গ্রাম থেকে দেশীয় সকল ফল গাছগুলো ধীরে ধীরে উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের উচিত দেশীয় ফলগুলো চাষ করা, বাজারজাত করা।

About Juyel Ahmed Liton

সুপ্রিয় “প্রোবাংলা” কমিউনিটি, ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি আকর্ষণ ছিলো এবং হয়তো সেই আকর্ষণটা অন্য দশ জনের থেকে একটু বেশি। ওয়েবসাইট, টাইপিং, আর্টিকেল লেখাসহ টেকনোলজি সবই আমার প্রিয়। জীবনে টেকনোলজি আমাকে যতটা ইম্প্রেস করেছে ততোটা অন্যকিছু কখনো করতে পারেনি। আর এই প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ থেকেই লেখালেখির শুরু.....

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *