ডিমের উপকারিতা ও অপকারিতা 

ডিম আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যে একটি খুবই পরিচিত খাদ্য উপকরণ। ছেলে বুড়ো সকলের প্রিয় এই ডিম। সস্তায় আমিষের চাহিদা পূরণ করতে ডিমের জুড়ি নেই। তবে আমরা অনেকেই এই ডিমের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে অবগত নই। এছাড়া ডিম নিয়ে রয়েছে নানান ধরনের ধোঁয়াশা পূর্ণ তর্কবিতর্ক। তাই আজ ডিম নিয়ে যত গুজব প্রচলিত সেগুলোর সঠিক উত্তর নিয়ে হাজির হয়েছি।

ডিমের পুষ্টিগুণ 

একটি খাবারযোগ্য ১০০ গ্রাম মুরগির সিদ্ধ ডিমে থাকা পুষ্টিমান

  • শক্তি৬৪৭ কিজু (১৫৫ kcal)
  • শর্করা১.১২ g
  • স্নেহ পদার্থ১০.৬ g
  • প্রোটিন১২.৬ g
  • ভিটামিন এ ১৪০ μg
  • থায়ামিন (বি১) ০.০৬৬ মিগ্রা
  • রিবোফ্লাভিন (বি২)০.৫ মিগ্রা
  • প্যানটোথেনিক অ্যাসিড (বি৫) ১.৪ মিগ্রা
  • ফোলেট (বি৯) ৪৪ μg
  • ক্যালসিয়াম ৫০ মিগ্রা
  • লৌহ ১.২ মিগ্রা
  • ম্যাগনেসিয়াম ১০ মিগ্রা
  • ফসফরাস ১৭২ মিগ্রা
  • পটাশিয়াম ১২৬ মিগ্রা
  • জিংক ১.০ মিগ্রা
  • পানি ৭৫ g
  • Choline 225 mg
  • Cholesterol 424 mg

ডিম খাওয়ার উপকারিতা 

ডিমের উপকারিতা ও অপকারিতা 

শিশু থেকে শুরু করে বুড়ো মানুষ অবদি সবাই ডিম খেতে পছন্দ করে। ডিমে আছে উচ্চমাত্রায় প্রোটিন— যেটা শরীরের মাংসপেশী বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। শুধু যে মাংসপেশী বৃদ্ধি করে তা কিন্তু নয়, হার্ট, কিডনি এগুলোর প্রতিনিয়ত প্রোটিন প্রয়োজন। সেই চাহিদাও পূরণ করে। আসুন জেনে নিই ডিম খাওয়ার উপকারিতা।

  • যদি শরীল দুর্বল থাকে কারো, তবে ডাক্তারগণ রোজ সকালে নাস্তায় সিদ্ধ ডিম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে। 
  • প্রত্যহ একটি করে ডিম খেলে শরীরে ভিটামিন ও খুনি জো উপাদানের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ হয়। ডিমের নিউট্রেশন দেহের কোষের কার্যক্রম ভালো রেখে শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
  • চোখ ভালো রাখার জন্য রোজ একটি করে ডিম খাওয়া উচিত। ডিমে আছে লুটেইন এবং জিয়াক্সএনথিন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট— যেটা চোখের ছানি ও অন্ধত্ব প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
  • ডিমের মধ্যে থাকা ভিটামিন ও মিনারেল মস্তিষ্কের কোষকে সুস্থ রাখে। এটি স্নায়ুকেও ভালো রাখে ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে।
  • ডিমে আছে ক্যালসিয়াম, আয়রন ও উচ্চমাত্রায় প্রোটিন— যা পেশিকে রাখে ভালো। পেশির শক্তি বর্ধন ও কর্মক্ষম করে। 
  • সাধারণত ডিম খেলে তুলনামূলক অনেক সময় অবধি ধরে পেট ভরা থাকে। ফলে অন্য খাবার গ্রহণে আগ্রহ কমে যায়। এতে করে ওজন নিয়ন্ত্রণকারীদের দৈনন্দিন ক্যালোরির চাহিদার পূরণ হয়, তবে ক্ষুধাও কম লাগে। 
  • ডিমের মধ্যে আছে ভিটামিন এ, ভিটামিন বি১২ ও সেলেনিয়াম— এই ভিটামিনসমূহ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। 
  • ডিমে আছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ও ভালো চর্বি। এই ওমেগা-৩ খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানব দেহের জন্য। অনেকে মনে করেন চর্বি মানেই খারাপ। তা কিন্তু নয়। দেহের শক্তি ধরে রাখার জন্য কিছু ভালো চর্বিও প্রয়োজন।

ডিম খাওয়ার অপকারিতা 

ডিম আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় এমন ভাবে আসন গেলে নিয়েছে যে— এটা এখন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ডিম আবালবৃদ্ধ সবার প্রিয় একটি খাবার। এর মাঝে থাকা পুষ্টিগুণ সম্পর্কে মোটামুটি সবারই কমবেশি জানা আছে। সবাই অন্তত এটা জানে যে ডিম একটি আমিষের উৎস। তাছাড়া এটা সহজলভ্য হওয়ার কারণে দৈনন্দিন খাবারে ডিম থাকে। পুষ্টিগুণের কথা ভেবে অনেকে বেশি বেশি করে ডিম খেয়ে ফেলে। আবার অনেকে এমনও আছে শরীর সুস্থ রাখার জন্য বেশি ডিম খায়। আবার কেউ কেউ তো রোগের কথা ভেবে ডিম খাওয়া বাদই দিয়ে দিয়েছে। অনেকের ধারণা ডিম খেলে দ্রুত ওজন বেড়ে যায় তাই ডিম খাওয়া পরিত্যাগ করেছে। 

আরও পড়ুন: লটকনের উপকারিতা ও অপকারিতা

আমরা জানি কোনো কিছু অতিরিক্ত ভালো নয়। তাই ডিম নিয়ে এ সকল তর্ক বিতর্কের অবসান করতে চাই।

ডিমে মূলত যা থাকে: ডিমের দুই–তৃতীয়াংশ শাদা অংশ ও এক–তৃতীয়াংশ থাকে হলুদ অংশ বা কুসুম। সাদা অংশেই মূলত প্রোটিন থাকে এবং হলুদ অংশ বা কুসুমে যা থাকে তা হচ্ছে ফ্যাট বা স্নেহ, প্রোটিন ও কোলেস্টেরল।

আচ্ছা, এবার জেনে নেই ডিম খাওয়ার কিছু অপকারিতা।

  • ডিমের কুসুম বেশি খেলে রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলে হার্টের অসুখ হওয়ার ঝুঁকি বহুগুনে বৃদ্ধি পায়। ডিমে ভালো ফ্যাট আছে, তবে সেই সাথে স্যাচুরেটেড ফ্যাটও থাকে— যা দেহের জন্য ভালো নয়। এই কারণেই হার্টের রোগী বা হাই কোলেস্টেরল আছে, এমন রোগীদের ডিমের কুসুম খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। এমনকি ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগীদের জন্য সতর্ক থাকা দরকার।
  • অনেকে ভেবে থাকেন, ডিমের সাদা অংশে যেহেতু খুব ভালো প্রোটিন। তাই দেহের মাংসপেশি বৃদ্ধি করার জন্য এটা বেশি করে খাওয়া যাবে। তবে ডিমের শাদা অংশে অ্যালবুমিন থাকে‌। রোজ ডিমের শাদা অংশ খাওয়া ভালো, কিন্তু অতিরিক্ত অ্যালবুমিন গ্রহণ করলে পরে শরীরে বায়োটিন নামের এক ভিটামিনের শূন্যতা দেখা যায়।
  • ডিম খেলে অনেকের অ্যালার্জি হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় কেউ বেশি করে ডিম খেলে অ্যালার্জিজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
  • ডিম বেশি খেলে পেটে গ্যাস বা অস্বস্তি হয়। বিশেষ করে সিদ্ধ ডিম।

ডিম অত্যন্ত উপকারী একটি খাদ্যবস্তু। এটা আমিষের একটি সহজ ও সস্তা উৎস। তাই একজন স্বাভাবিক মানুষের উচিত প্রতিদিন একটি করে হলেও ডিম খাওয়া। কিন্তু অনেক মানুষ আছে যাদের ডিম খেলে সমস্যা হতে পারে। তাদের উচিত ডাক্তারের পরামর্শক্রমে ডিম গ্রহণ করা।

ডিম খাওয়ার নিয়ম

স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের জন্য এখানে ডিম খাওয়ার কিছু নিয়মের কথা উল্লেখ করা হলো। 

  • কেউ যদি ক্যালরি, ওজন বা কোলেস্টেরল কমানোর কথা চিন্তা করেন কিংবা ফ্যাটি লিভারের কথা ভাবেন— তাহলে তাদের উচিত হবে ডিম সিদ্ধ করে বা পানিতে পোচ করে খাওয়া। কেননা তখন ডিমে কোনো প্রকার তেল ব্যবহার করা হবে না। ফলে  ডিম থাকবে কোলেস্টেরল মুক্ত। 
  • সর্বাধিক ডিমের পুষ্টি পেতে হলে যতটা সম্ভব হয় কম তাপমাত্রায় অল্প সময়ে রান্না করা।
  • প্রচলিত ফার্মের ডিমের চাইতে অর্গানিক বা দেশি ডিম বেশি পুষ্টিকর। গ্রামে যেভাবে মুরগি পালা হয, সারাদিন ঘুরে ফিরে খায়, সেই মুরগির ডিমে ভিটামিন এ, ই, ওমেগা থ্রি ও ভিটামিন ডি ফার্মের মুরগির ডিমের চাইতে তিন গুন বেশি। তাছাড়া ওমেগা থ্রি যুক্ত ডিমে উপকারি চর্বির পরিমাণ বেশি। 
  • ডিম রান্নার জন্য অবশ্যই ভালো তেল ব্যবহার করা উচিত। তবে সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল। এছাড়া সূর্যমুখীর তেলও ব্যবহার করতে পারেন।
  • ডিমে কিন্তু কোনো ফাইবার বা আঁশ থাকে না। ডিমের সাথে ফাইবার বা আঁশ হিসেবে খেতে পারেন পালংশাক, পাতাকপি, কাঁচকলা, পেঁয়াজ, মরিচ ইত্যাদি।
  • ডিম কখনোই দীর্ঘ সময় ভাজা উচিত নয়। কেননা এতে করে ডিমের মধ্যে থাকা ভিটামিনগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া অধিক তেলে ভাজলে তা দেহের কোলেস্ট্রল বৃদ্ধি করার কারণ হয়ে যায়।

ডিম খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা

  • ডিম কাঁচা বা অতি অল্প পোচ করে খাওয়া উচিত না। বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও শিশুর জন্য এটা ক্ষতিকর। কেননা কাঁচা ডিমে থাকা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যায় তাদের। 
  • ডিম যেহেতু একটি প্রোটিন ও ফ্যাটের উৎস। তাই সারাদিন অন্যান্য কী খাদ্য খাচ্ছেন সেটার উপর নির্ভর করে ডিম খেতে হবে।
  • ডিম ধরার পর হাত অবশ্যই সাবান-পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। কেননা ডিমের খোলসে প্রচুর পরিমাণে জীবাণু থাকে। 

হাঁসের ডিম না মুরগির ডিম

সাধারণত হাঁস ও মুরগির ডিম উভয়কেই সমান পুষ্টিসম্পন্ন বলা যায়।

ডিম নিয়ে আমাদের মাঝে বেশ বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই মনে করে, হাঁসের ডিমের চাইতে মুরগির ডিম ভালো। তবে কথাটি একেবারে সঠিক নয়। পুষ্টিমানের দিক দিয়ে দেখলে হাঁস ও মুরগির ডিম প্রায় একই পুষ্টিমানের বলা চলে‌

আবারো মুরগির ডিমই ভালো, মুরগির ডিম খেলেই বেশি উপকার পাওয়া যায়— এমন ধারণাও ভুল।

হাঁস ও মুরগির ডিমের তুলনামূলক কিছু তথ্য দিয়ে বিষয়টি আরো পরিষ্কারভাবে বোঝানো হচ্ছে। 

  • প্রতি ১০০ গ্রাম হাঁসের ডিমে আছে ১৮১ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি। আর মুরগির ডিমে আছে ১৭৩ কিলোক্যালরি।
  • প্রতি ১০০ গ্রাম হাঁসের ডিমে আমিষ ১৩.৫ গ্রাম এবং একই পরিমাণ মুরগির ডিমে ১৩.৩ গ্রাম।
  • হাঁসের ডিমের চর্বি ১৩.৭ গ্রাম ও মুরগির ডিমে চর্বি ১৩.৩ গ্রাম।
  • ১০০ গ্রাম হাঁসের ডিমে ক্যালসিয়াম আছে ৭০ মিলিগ্রাম, লৌহ ৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন এ ২৬৯ মাইক্রোগ্রাম। অপরদিকে মুরগির ডিমে ক্যালসিয়াম ৬০ মিলিগ্রাম, লৌহ ২.১ মিলিগ্রাম, ভিটামিন এ ২৯৯ মাইক্রোগ্রাম।

এই তুলনায় দেখা যাচ্ছে যে— হাঁসের ডিমে খাদ্যশক্তি, আমিষ, চর্বি, শর্করা, লৌহ ও ক্যালসিয়ামের মুরগির ডিমের চাইতে সামান্য বেশি থাকে।

আবার মুরগির ডিম হাঁসের ডিমের চাইতে ভিটামিন এ এবং ভিটামিন বি২ সামান্য বেশি থাকে। সুতরাং চুলচেরা বিচার করলে হাঁসের ডিমই বেশি পুষ্টিমানের বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু এই দুটো ডিমের মধ্যে পুষ্টিগুণের পার্থক্য তেমন একটা বেশি নয়।

তাই আপনি যেকোনো একটি ডিম খেতে পারেন। যেটা আপনার কাছে সহজলভ্য মনে হবে সেটাই আপনি গ্রহণ করুন।

ডিম পুরো বিশ্বময় এতটাই জনপ্রিয় এবং এর পুষ্টিগণের কথা বিবেচনা করে পুরো বিশ্বে অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবারকে বিশ্ব ডিম দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top