সাবুদানা বা সাগু এমন এক খাদ্যবস্তু— যা ছোট বড় সকলেই খুব শখ করে খেয়ে থাকে। তবে সাবুদানা আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের খাবারেই বেশি ব্যবহৃত হয়।
সাবুদানা একটি স্টার্চ জাতীয় খাবার। এটা সহজে হজম হয়ে যায়। এবং এটা গুরুপাক কোনো খাবার নয়। খুবই হালকা ধরনের খাবার। তাই আমাদের দেশে রোগীর পথ্য হিসেবে এটা ব্যবহার করা হয়।
এটা গোল গোল দানাদার এবং এটা সিদ্ধ করলে স্বচ্ছ হয়ে যায়। যা দেখতে খুবই সুন্দর দেখায়— অনেকটা মাছের ডিমের মতো। তাই দেশে-বিদেশে এটার কদর অনেক বেশি।
সাবুদানা কী?
সাবুদানা কী জিনিস তা নিয়ে অনেকেরই কৌতুহল রয়েছে। কেউ মনে করে এটা হয়তো কোনো ফল— যা গাছে ধরে। আবার কেউ মনে করে এটা হয়তো আটা বা ময়দা দিয়ে তৈরি। আসলে এটা আটা বা ময়দা দিয়েও তৈরি নয়— আবার এটা কোনো গাছের ফলও নয়। এটা মূলত এক জাতের পাম গাছ (ট্যাপিওকা) থেকে উৎপন্ন হয়। পাম গাছ কর্তনের পর এটাকে মাঝখান থেকে চেড়া হয়। ভেতরে শাদা নরম কাণ্ড থাকে— খেজুর গাছ অথবা নারকেল গাছ কাটলে যেমন ভেতরে নরম কান্ড থাকে তেমন। ওই নরম অংশটুকু ভালোভাবে পিষে সেটার রস বের করা হয়। ওই রসটুকু ছেকে সেটার পানি শুকিয়ে ট্যাপিওকা পাউডার তৈরি হয়। এরপর যান্ত্রিক উপায়ে এটা গোল গোল দানাদার করা হয়।
সাবুদানা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উৎপাদন হয়। বিশ্বের সবচাইতে বেশি মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি দেশ সমূহে সাবুদানা উৎপাদন করে।
সাবুদানার পুষ্টিমান
আমরা অনেকেই সাবুদানা খাই। খুব সুস্বাদু এই খাবারটি। সুন্দর একটি ঘ্রাণ আছে এটার। কিন্তু আমরা জানি না এটার মধ্যে কী পরিমান পুষ্টি থাকে। সাবুদানার উপকারিতা ও অপকারিতা আর্টিকেলে সাবুদানার পুষ্টিগুণ নিচে উল্লেখ্য করা হলো।
১০০ গ্রাম সাবুদানায় থাকা পুষ্টিমান সমূহ—
- ক্যালোরি ৩৫৮ কিলোক্যালরি
- কার্বোহাইড্রেট ৪৪.৪ গ্রাম
- প্রোটিন ০.২ গ্রাম
- ফ্যাট ০.২ গ্রাম
- ফাইবার ০.১ গ্রাম
- ক্যালসিয়াম ৫ মিলিগ্রাম
- আয়রন ০.৬ মিলিগ্রাম
- ম্যাগনেসিয়াম ২০ মিলিগ্রাম
- পটাশিয়াম ২৬ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি১ ০.০১ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি২ ০.০২ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন বি৩ ০.৫ মিলিগ্রাম
সাবুদানার উপকারিতা
সাবুদানা মূলত একটি স্টার্চ জাতীয় খাবার। এটাকে রোগীর পথ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া এটা বিভিন্ন মুখরোচক মিষ্টান্ন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এগুলো ছাড়াও এটার নানাবিধ উপকারিতা রয়েছে। সেই সকল উপকারিতা গুলো ধারাবাহিকভাবে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা হলো।
- সাবুদানা রক্তচাপ হ্রাস করে: সাবুদানার মধ্যে আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে পটাশিয়াম। যেটা উচ্চ রক্তচাপ হ্রাস করে। যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে তাদের জন্য সাবুদানা খুবই উপকারী।
- সাবুদানা হাড় মজবুত রাখে: সাবুদানাতে আছে ক্যালসিয়াম। যা মানব দেহের হাড় গঠনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- আরও পড়ুন: কুমড়া বীজের উপকারিতা ও অপকারিতা
- সাবুদানা শরীরে শক্তি যোগায়: সাবুদানা একটি সরল শর্করা জাতীয় খাদ্য। এই শর্করা বা কার্বোহাইডেট খুব দ্রুত ভেঙে গিয়ে শক্তি উৎপাদন করে। ফলে খাবার পর তাৎক্ষণিকভাবে শক্তি পাওয়া যায়। এছাড়া এটার মধ্যে অন্যান্য কিছু পুষ্টিগুণ রয়েছে যার শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। তাই অনেকে দেখবেন ব্যায়াম করার আগে বা ব্যায়াম করার পর সাবুদানা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাদ্য খেতে।
- সাবুদানা হজমশক্তি বাড়ায়: সাবুদানা খুব সহজে হজম হয়ে যায়। এটা অন্যান্য খাদ্যকে হজম করতে সাহায্য করে। তাই এটা খাওয়ার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা থেকে অনেকাংশে মুক্তি পাওয়া যায়।
- সাবুদানা ওজন বাড়াতে সাহায্য করে: অনেকেই আছেন খুবই রোগা শরীরের। তাদের জন্য সাবুদানা হয়ে উঠতে পারে শরীরের ওজন বাড়ানোর প্রধান হাতিয়ার। কেননা সাবুদানা খুব সহজে হজম হয়ে যায়। দামে অন্যান্য প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের চাইতে সস্তা। এছাড়া সাবুদানা খাওয়ার ফলে তেমন একটা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। বিশেষ করে যে সকল শিশুরা খুবই শীর্ণ দেহের— তাদেরকে সাবুদানা দিয়ে তৈরিকৃত সুস্বাদু খাদ্য পরিবেশন এর মাধ্যমে খুব দ্রুত স্বাস্থ্য বৃদ্ধি করা সম্ভব।
- সাবুদানা গর্ভাবস্থায় উপকারী: গর্ভবতীদের জন্য সাবুদানা খুবই উৎকৃষ্ট খাদ্য। সহজপাক এই খাদ্যটি গর্ভবতীর দেহের নানান ধরনের পুষ্টির যোগান দেয়। এর মধ্যে থাকা ভিটামিন বি নারীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যা সন্তানের ভ্রুণ বিকাশে সহায়তা করে।
- রোগীদের উৎকৃষ্ট খাদ্য: জ্বর, জন্ডিস, টাইফয়েড, কলেরা, আমাশয় রোগসমূহে রোগী খুবই দুর্বল থাকে। এমত অবস্থায় তাকে ভারী খাদ্য দেওয়াটা খুবই ঝামেলার। কেননা তখন রোগীর পাকস্থলী ভারী খাদ্য হজম করার উপযোগী থাকে না। কিন্তু রোগীকে সুষম খাদ্য না খাওয়ালে পুষ্টি অভাবে রোগ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই তখন রোগীকে সাবুদানা খাওয়ানো হয়। এটা খুব দ্রুত হজম হয়ে যায় এবং এর মধ্যে থাকা পুষ্টিগুণ রোগীর দৈনিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে।
সাবুদানার অপকারিতা
সাবুদানা সাধারণত মানব দেহের জন্য কোনো ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে না। এছাড়া এটা তেমন একটা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও দেখা যায় না। কিন্তু যাদের ওজন বেশি তাদের এটা বেশি পরিমাণে না খাওয়াটাই উচিত। কেননা এটার মধ্যে আছে প্রচুর পরিমাণে শর্করা— যা ওজন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
যাদের ডায়াবেটিস খুব বেশি তারা শর্করা গ্রহন থেকে বিরত থাকবেন। সাবুদানা একটু শর্করা সমৃদ্ধ খাবার তাই এটা পরিমিত খাওয়াটাই উচিত।
কীভাবে চিনবেন আসল সাবুদানা?
আজকাল বাজারে নকল সাধুদানা বিক্রি হচ্ছে। নকল সাবুদানাগুলো সাধারণত আটা বা ময়দা দিয়ে তৈরি হয়। তাই আপনি খুব সহজেই ধোঁকা খেতে পারেন। কেননা আসল নকল উভয়ই সাবুদানা সাদা রঙের। কিন্তু আপনি চাইলে একটি ছোট্ট পরীক্ষার মাধ্যমে আসল নকল যাচাই করতে পারবেন।
- সাবুদানা এক গ্লাস পানিতে অল্প কিছু পরিমাণ ঢেলে দিবেন। এরপর চামচ দিয়ে নাড়তে থাকবেন। যদি দেখেন খুব দ্রুত গলে গিয়েছে অথবা পানির রঙ ঘোলা হয়ে গিয়েছে তাহলে বুঝবেন এটা আটা বা ময়দা দিয়ে তৈরি।
- জেনে নিন: চিড়া খাবার উপকারিতা ও অপকারিতা
- যদি দেখেন পানি ঘোলা বেশি একটা হচ্ছে না এবং সাবুদানাগুলো অক্ষত আছে। তাহলে বুঝবেন এটা আসল সাবুদানা। কেননা আসল সাবুদানা সহজে পানিতে গুলে যাবে না। এটা সিদ্ধ করলে স্বচ্ছ হবে। অপরদিকে নকল সাবুদানা আটার দল মতো হয়ে যাবে।
সাবুদানা রেসিপি
সাবুদানা আপনি অনেকভাবেই রান্না করতে পারেন। এখানে আপনাকে সহজ কয়েকটি রেসিপি তুলে ধরা হলো।
সাবুদানার পায়েস: সাবুদানা দিয়ে খুব চমৎকার পায়েস রান্না করা যায়। যা খেতে অসাধারণ। প্রথমে এক লিটার দুধ নেবেন এবং সেখানে দেড়শ গ্রাম সাবুদানা ঢেলে দেবেন। অবশ্যই সাবুদানা ব্যবহার করার পূর্বে ভালোমতো ধুয়ে নেবেন। অল্প আছে জাল দিতে থাকুন। যখন দেখবেন সাবুদানা গুলো স্বচ্ছ হয়ে গেছে তখন বুঝবেন এটা সম্পূর্ণ সিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু সাবধান থাকবেন, কখনোই সাবুদানা সিদ্ধ হওয়ার আগে চিনি দেবেন না। কেননা চিনি দেওয়ার সাথে সাথে সাবুদানা সিদ্ধ হওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর স্বাভাবিক পায়েস রান্নার মতো করে এতে বাদাম কিসমিস একটি তেজপাতা একটি এলাচ একটি দারচিনি ও সর্বশেষে স্বাদমতো লবণ ও এক চিমটি লবণ দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে ঘন করে ফেলুন। ব্যাস হয়ে গেল সাবুদানার পায়েস।
সাবুদানা লাড্ডু: আপনার হয়তো অনেকেই জানেন না সাবুদানা দিয়ে চমৎকার লাড্ডু তৈরি হয়। এর জন্য প্রথমে সাবুদানা পানিতে সিদ্ধ করতে হবে। এক চিমটি লবণ দিয়ে সিদ্ধ করলে ভালো হয়। সাবুদানা সম্পূর্ণরূপে সিদ্ধ হয়ে গেলে ভালোভাবে এর পানি ঝরিয়ে নিন। এরপর এতে তরল জর্দ্দার রঙ দিন যাতে সুন্দর দেখতে লাগে। যদি তরল জর্দ্দার রঙ না থাকে তাহলে গুঁড়ো রঙ ব্যবহার করতে পারেন। তবে গুঁড়ো রঙ ব্যবহার করতে হবে সাবুদানা সিদ্ধ করার সময়।
পানি ঝরানো হয়ে গেলে এতে সমপরিমাণ অথবা একটু কম চিনি, যেকোনো প্রকার বাদাম কুচি মিশিয়ে ঘি অথবা তেল মাখানো কড়াইতে ভাজতে থাকুন। যখন সম্পূর্ণ চিনি গলে গিয়ে সাবুদানার সাথে মিশে যাবে এবং খুব ঘন হয়ে উঠবে তখন নামিয়ে ফেলুন। সহনশীল পর্যায়ের গরম থাকা অবস্থায় হাতে সামান্য ঘি মেখে গোল গোল লাড্ডু বানিয়ে ঠান্ডা করে পরিবেশন করুন। দেখবেন খুব সুস্বাদু লাগছে খেতে।
সাবুদানার ফ্রুট ডিজার্ট: দুধের মধ্যে সাবুদানা দিয়ে ভালোভাবে সাবুদানা সিদ্ধ করুন। সিদ্ধ হয়ে গেলে এর মধ্যে স্বাদমতো চিনি দিন। এরপর জাল দিয়ে ঘন করে ফেলুন। ঘন হয়ে গেলে এতে আপনার পছন্দমত ফল উচিত মিশিয়ে ফ্রিজে ঠান্ডা করে পরিবেশন করুন।
আপনি যদি চান তাহলে এতে সামান্য পরিমাণ ভ্যানিলা এসেন্স ব্যবহার করতে পারেন। এতে করে এটার ঘ্রাণ অনেক সুন্দর আসবে।
আরও পড়ুন: লটকনের উপকারিতা ও অপকারিতা
সাবুদানার অন্য একটি চমৎকার ব্যবহার
আপনার হয়তো অনেকেই ছোটবেলায় ঘুড়ি উড়িয়েছেন। তাই আপনারা অনেকেই জেনে থাকবেন ঘড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেওয়ার ব্যাপারটা। কিন্তু আজকালকার প্রজন্ম এগুলো থেকে বঞ্চিত। তারা জানি না মাঞ্জা দেওয়া কী?
সাবুদানা ভালোভাবে সিদ্ধ করে এটার সাথে কাচের মিহি গুঁড়ো মিশিয়ে খুব ভালোভাবে মাখানো হয়। এরপর সেটা সুতাতে লাগিয়ে শুকাতে দেওয়া হয়। শুকিয়ে গেলে এই সুতা হয় কিছুটা ধারালো। যখন ঘুড়ি ওড়ানো হয় তখন অপর প্রতিযোগীর ঘুড়ির সুতো কাটার জন্য এটা দারুন কাজে লাগে। খুবই আনন্দের সেই স্মৃতিগুলো আজ কালের অন্ধকার গহ্বরে বিলীন হয়ে গেছে। এভাবেই বিলীন হয়ে যাবে আজকের সময়।